পদার্থবিজ্ঞানে গণিতের বসতি ও একজন নিউটন

১৯৮৮ সালের ঘটনা। গণিতের অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার ফিল্ডস মেডাল দেওয়া হলো পদার্থবিদ এডওয়ার্ড উইটেনকে। কিন্তু উইটেনকে এই সম্মাননা দেওয়ার সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেন গণিত সাম্রাজ্যের কিছু বোদ্ধা। তাঁদের এ রকম রক্ষণশীল চিন্তাধারার পেছনে যুক্তি ছিল, উইটেন গণিতবিদ নন। তাঁর যেমন গণিতে কোনো প্রথাসিদ্ধ স্বীকৃত ডিগ্রি নেই, তেমনি তাঁর কোনো অবদান নেই বিশুদ্ধ গণিতেও। সে সময় সর্বজন শ্রদ্ধেয় গণিতবিদ স্যার মাইকেল আটিয়াহ্ উইটেনকে সম্মাননা দেওয়া জোরালোভাবে সমর্থন করেছিলেন। কারণ, উইটেনের গবেষণার কারণে গণিতের কয়েকটি শাখায় বেশ কয়েকটি ধাঁধার সমাধান মিলেছিল। এই ঘটনার জেরে ‍‍‍‍‘গণিত কী? গণিতবিদই বা কে?’—এসব প্রশ্ন নিয়ে একাডেমিক জগতে বেশ ভালো একটা আলোচনা জমে ওঠে, যার সুরাহা বোধ হয় এখনো হয়নি।

পাঠকের কাছে এই ঘটনা বর্ণনা করার কারণ হলো, বিজ্ঞান ও গণিতের বিভিন্ন শাখার মধ্যে এই বিভাজন মানবসভ্যতার ইতিহাসে অত্যন্ত নতুন। এই তো ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় অর্ধে প্রাকৃতিক দর্শন ভেঙে তৈরি হয় রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান ইত্যাদি জ্ঞানের শাখা। তাই মহাসমুদ্রে এসে যেমন দেশের ভৌগোলিক সীমারেখার কোনো অর্থ হয় না, ঠিক তেমনি জ্ঞানরাজ্যের পরিসীমায় কে গণিতবিদ, আর কে পদার্থবিদ—এই অহেতুক বিতর্ক করা নেহাত অর্বাচীনের কাজ ছাড়া আর কিছু নয়।

আরও মূর্খের কাজ হবে, যদি আমরা এই বিতর্ক স্যার আইজ্যাক নিউটনকে নিয়ে করতে শুরু করি। বিজ্ঞানের ইতিহাসে তাঁর মতো দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছে কি না, সেটা সন্দেহের ব্যাপার। আমরা স্কুল-কলেজে পড়ার সময় আইনস্টাইনকে নিয়ে অনেক হইচই করেছি। কিন্তু সেটা করেছি তাঁর কাজ সম্পর্কে সম্যক ধারণা না রেখে। এর পেছনে দায়ী ছিল আইনস্টাইনের সেলিব্রিটি বা আইকনিক স্ট্যাটাস, যার পেছনে কাজ করেছিল টিভি, রেডিও আর পত্রিকার কাভারেজ । নিউটনের কপাল খারাপ, তাঁর সময় রেডিও, টিভি, ফটোগ্রাফের আবিষ্কার হয়নি। সেটা হলে রাস্তাঘাটে তরুণদের টি-শার্টে চে গুয়েভারার মতো নিউটনের চেহারারও দেখা পেতাম।

নিউটনের কাজ বিজ্ঞানে এক বিপ্লব ঘটিয়েছিল। তাঁর কাজের ওপর ভিত্তি করে গাণিতিকভাবে মহাবিশ্ব উপলদ্ধি করা সহজ হয়ে উঠেছে

স্কুলে পড়ার সময় বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই জেনে যায়, গাছ থেকে আপেল পড়তে দেখে নিউটনের মাথায় মাধ্যাকর্ষণের চিন্তাটি এসেছিল। পাশাপাশি অনেকেই ঠাট্টা করে বলেন, আপেলের পরিবর্তে এ দেশের মানুষের মাথায় তাল-নারকেল পড়ে, তাই মহাকর্ষ নিয়ে চিন্তা করার চেয়ে তারা প্রাণ বাঁচানোকেই জরুরি মনে করেন। সে কারণে এ দেশে মৌলিক বিজ্ঞানচর্চা আর সামনে এগোতে পারে না। তবে নিউটনের মহাকর্ষ আবিষ্কারের ব্যাপারটা কিন্তু ঠিক নয়।

আপেলপতন খেয়াল করার আগে থেকেই পৃথিবীর চারপাশে চাঁদের গতিপথ নিয়ে চিন্তাভাবনা করছিলেন নিউটন। আপেলের পতনের যে ব্যাপারটা তাঁর আগের চিন্তাধারায় পরিবর্তন ঘটাল তা হলো, আপেলটি ডানে বা বাঁয়ে না গিয়ে খাড়া নিচের দিকে পড়ছে। নিউটন নিজের কাছে এই ঘটনার ব্যাখ্যা দাঁড় করালেন যে আপেলটি পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে একটি আকর্ষণ বল অনুভব করেছে। আর সেই একই আকর্ষণ বলের প্রভাবেই চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে বৃত্তাকারে ঘুরছে। আমাদের মনে এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, চাঁদ তাহলে আপেলের মতো ধপ করে পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে না কেন? এর উত্তর হলো—চাঁদ চলমান থাকায় তার একটি আদি বেগ আছে, যার ফলে চাঁদের একটি কৌণিক ভরবেগও আছে। কিন্তু সেটা আপেলের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। নিউটন মহাকর্ষ বলের ধারণাটিকে ভিত্তি করে এবং গ্যালিলিওর দেওয়া সমত্বরণে গতিশীল বস্তুর সরণের সূত্র ব্যবহার করে দেখতে পান, পৃথিবীর আকর্ষণের কারণে উদ্ভূত আপেল ও চাঁদের ত্বরণের অনুপাত পৃথিবী থেকে তাদের দূরত্বের বিপরীত বর্গের সমানুপাতিক। অবশ্য নিউটনের প্রাথমিক হিসাবে এই সংখ্যা একেবারে নির্ভুল ছিল না। কারণ, ১৬৬৬ সালে (যখন নিউটন প্রথম হিসাবটি করেন) পৃথিবীর আকার ও চাঁদের কক্ষপথের পরিমাপে কিছু ত্রুটি ছিল। নিউটনের জীবদ্দশায়ই এই পরিমাপে উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে।

নিউটনের এই আবিষ্কার থেকে আমরা প্রথম যে শিক্ষা পাই তা হলো, (পদার্থ) বিজ্ঞানের হাত বেশ লম্বা। এর আগে সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল, পৃথিবীর বুকে যেসব ‘পার্থিব’ (Terrestrial) ঘটনা ঘটে, তার মৌলিক আইন (আমি ‘সূত্র’ শব্দটি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকছি) মহাকাশে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ ও তারকামণ্ডলের জন্য প্রযোজ্য ‘স্বর্গীয়’ (Celestial) আইন থেকে ভিন্ন। নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের আবিষ্কার এই দুই জগৎকে একই ছাদের নিচে নিয়ে এল। এই চিন্তাধারার সূত্র ধরেই আমরা আজ পৃথিবীর বুকে গণিতের হিসাব করে দূরের গ্যালাক্সির বিভিন্ন রাশি নির্ধারণের সাহস দেখাই।

নিউটনের সমাকলন আবিষ্কারের পর অর্ধবৃত্তের সমীকরণ ব্যবহার করে পাইয়ের মান নির্ণয় সহজ হয়ে ওঠে

নিউটন এখানেই থেমে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তাঁর সূত্রের গাণিতিক বিশ্লেষণ নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। ফলে তিনি তৈরি করেন গণিতের নতুন একটি শাখা, যাকে আজ আমরা ক্যালকুলাস বলে অভিহিত করে থাকি।

তবে নিউটন তাঁর এই গণিতকে ক্যালকুলাস বলতেন না। তিনি একে বলতেন ফ্লাক্সন প্রণালি (The method of fluxions)। আমরা পরে দেখতে পাই, নিউটন ছাড়া স্বাধীনভাবে লিবনিজও একই গাণিতিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন। অবশ্য তাঁর সংকেত ও যুক্তিতে ভিন্নতা ছিল। বর্তমানে ঐতিহাসিক হদিস পাওয়া যাচ্ছে যে চতুর্দশ শতাব্দীতে দক্ষিণ ভারতের গণিতবেত্তাদের মধ্যে ক্যালকুলাসের মতো গণিতের প্রচলন ছিল। তবে এসব দাবি সত্য প্রমাণিত হলেও নিউটনের কৃতিত্ব কোনোক্রমেই ছোট হবে না। এটা বুঝতে গেলে আমাদের পদার্থবিজ্ঞানের হাত ধরে কীভাবে ক্যালকুলাসের জন্ম, তার দিকে পেছনে ফিরে তাকাতে হবে।

গ্যালিলিওর দেওয়া গাণিতিক প্রকাশ x= ½ a t2 আমাদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত হলেও এই সমীকরণের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে, এর মধ্যে কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক দেওয়া নেই। অর্থাৎ ত্বরণ ঘটার পেছনে কারণ কী, তার ব্যাখ্যা এই সহজ সমীকরণের মধ্যে দেওয়া নেই। তবে পার্থিব বস্তুর স্বাভাবিক চলমান অবস্থা কী হবে, তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করে গিয়েছিলেন গ্যালিলিও। সেটা অ্যারিস্টটলীয় সংকীর্ণ ধারণার চেয়ে ঠিক ছিল। অ্যারিস্টটলের ধারণা ছিল, বাইর থেকে কোনো ‘কিছু’ বস্তুর ওপর কাজ না করলে তা স্বভাবতই স্থির অবস্থায় থাকবে। কিন্তু তার পরিবর্তে গ্যালিলিও বলেন, বস্তুটি সমবেগে চলমান থাকবে। এই উপসংহারে আসার জন্য গ্যালিলিওকে অবশ্য বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়েছিল। অ্যারিস্টটল তাঁর সিদ্ধান্তের সমর্থনে আসলেই কিছু নাড়াচাড়া করেছিলেন কি না, তার কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ সম্পর্কে আমার জানা নেই।

তবে মহাকর্ষ আবিষ্কারের ফলে নিউটন বেশ কয়েকটি নতুন ধারণা অবতারণার সুযোগ পেলেন। প্রথমত, বস্তুর ওপর দূর থেকে ‘বল’ (Force) প্রয়োগের সুযোগ হলো, যেটাকে আমরা ইংরেজিতে Action at a distance বলি। এর আগে আমরা বল প্রয়োগ করতে হলে বস্তুর সংস্পর্শে আসার ধারণার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। দ্বিতীয়ত, বাইরে থেকে একই বল প্রয়োগ করে ভিন্ন ভিন্ন বস্তুর ত্বরণের মান দেখে আমরা বুঝতে পারি যে ‘ভর’ বলে কিছু আছে। তৃতীয়ত, নিউটনের সবচেয়ে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ হলো, এই ত্বরণ ও বলের কার্যকারণ সম্পর্কটি তাৎক্ষণিক। একটা উদাহরণ দিয়ে বলি। ধরা যাক, আমি একটি ক্রিকেট বলকে ব্যাট দিয়ে আঘাত করলাম। এর ফলে বলটির ত্বরণ ঘটবে, মানে বেগের পরিবর্তন ঘটবে। প্রশ্ন হলো, পরিবর্তনটি কখন ঘটবে আর কোন বেগটির কথা আমরা চিন্তা করব, গড় বেগের না কোনো নির্দিষ্ট সময়ের বেগের? আবার, আনুভূমিকভাবে আঘাত করলে বেগের উল্লম্ব অংশের কী পরিবর্তন হবে—এ রকম বহু প্রশ্ন করা যায়। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে নিউটনকে অন্তরকলনের (Differentiation) ধারণা নিয়ে আসতে হয়।

বর্তমানে উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষাক্রমে ক্যালকুলাসের অর্ধাংশ হিসেবে শিক্ষার্থীরা অন্তরকলন শেখে। তবে অন্তরকলনের কাছাকাছি ধারণা নিউটন ছাড়া তাঁর সমসাময়িক অন্য গণিতবিদ ও বিজ্ঞানীদের কাজের মধ্যেও পাওয়া যায়। সে জন্য নিউটনকে এই গণিত আবিষ্কারের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব না দিলেও চলে।

অন্যদিকে নিউটনকে তাঁর জীবনের অনেকটা সময় নিয়ে কাজ করতে হয়েছে সমাকলনের (Integration) উদ্ভাবন নিয়ে। এর কারণ বুঝতে হলে আমাদের পুনরায় নিউটনের মহাকর্ষ আবিষ্কারে ফিরে যেতে হবে। মহাকর্ষকে সর্বজনীন হতে হলে এই সূত্র প্রণয়ন করতে হবে ভরবিশিষ্ট যেকোনো দুটি কণার জন্য। কিন্তু সেটা আপেল ও পৃথিবীর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হলে প্রথমেই আমাদের যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তা হলো, আপেলের মতো পৃথিবী যে তার বাইরের সব বস্তুকে কেন্দ্রের দিকে টানে, সেটা প্রমাণ করা। এটা আবার করতে গিয়ে নিউটনকে দুটো আলাদা উপপাদ্যের অবতারণা করতে হয়, যাদের মধ্যে প্রথমটিকে জ্যামিতি ব্যবহার করে নিউটন খুব সহজেই প্রমাণ করতে পারেন। কিন্তু দ্বিতীয়টি প্রমাণ করা নিউটনের পক্ষে প্রথমে সম্ভব হয়নি। বলা হয়ে থাকে, এই বাহ্যিক শেল (External shell) উপপাদ্য প্রমাণ করার জন্যই সমাকলনের উদ্ভাবন করেন নিউটন। সে জন্য তাঁকে প্রায় চল্লিশ বছরের মতো কাজ করতে হয়েছে।

শেষ করি নিউটনের কাজ কীভাবে গণিতে এক বিপ্লব ঘটিয়েছিল, তার একটি উদাহরণ দিয়ে। পিথাগোরাসের সময় থেকে বিজ্ঞানী আর গণিতবিদেরা পাইয়ের (π) মান নির্ণয় করছিলেন বৃত্তের পরিধি আর ব্যাসার্ধের অনুপাত নেওয়ার চেষ্টা করে। এ জন্য তাঁরা বৃত্তকে একটি সুষম বহুভুজ (Polygon) ধরে নিয়ে তার বাহুর সংখ্যা বাড়িয়ে কে কার চেয়ে দশমিকের পর কত বেশি সংখ্যা নির্ণয় করতে পারেন, তার এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। স্বয়ং আর্কিমিডিস এ জন্য ব্যবহার করেছিলেন ৯৬ বাহুর বহুভুজ। ১৬৩০ সালে অস্ট্রীয় জ্যোতির্বিদ ক্রিস্টোফ গ্রিনবার্গার ব্যবহার করেছিলেন ১০৪০ বাহুর বহুভুজ। এর মাধ্যমে দশমিকের পর ৩৮ ঘর পর্যন্ত পাইয়ের মান নির্ধারণ করেছিলেন তিনি! আমরা নিশ্চিত, তিনি এই কাজের পেছনে তাঁর প্রায় পুরো জীবনকালই ব্যয় করেছিলেন।

কিন্তু সমাকলন আবিষ্কারের পর ঘটনাটা দাঁড়াল এ রকম—একক ব্যাসার্ধের একটি অর্ধবৃত্তের সমীকরণ হলো y =√(1-x2)। এ কারণে তার ক্ষেত্রফলের মানকে সহজেই লেখা যায়—

এখন ইচ্ছা করলে দ্বিপদ উপপাদ্য ব্যবহার করে যে কেউই বাঁ দিকের বর্গমূলকে প্রসারণ করে যত খুশি ঘর পর্যন্ত পাইয়ের মান নির্ণয় করতে পারে। তাতে কাগজ ও সময় দুটোই কম লাগবে। নিউটনকে ধন্যবাদ না দিয়ে উপায় আছে?