হকিংয়ের মহাবিশ্ব

মহাবিশ্বের মহাসংগীত শুনেছিলেন হকিং, তাই হয়তো মৃত্যুর নিশিডাক উপেক্ষা করতে পেরেছিলেন। নয়তো ২১ বছর বয়সে যিনি দুরারোগ্য মোটর নিউরন ডিজিজে আক্রান্ত হন, চিকিত্সকেরা বেঁধে দেন মাত্র দুই বছর আয়ু, সেই মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে হকিং কিনা আরও পঞ্চান্ন বছর বেঁচে থাকেন, মহাবিশ্বের কোণে কোণে লুকিয়ে থাকা মণি-মুক্তা কুড়িয়ে আনেন দক্ষ ডুবুরির মতো। মহাবিশ্বকে বাদামের খোসার সঙ্গে তুলনা করা তাঁরই সাজে।

আক্ষরিক অর্থেই মহাবিশ্বকে হকিং দেখেছিলেন বাদামের খোসার মতো করে, লিখেছিলেন ইউনিভার্স ইন আ নাটশেল-এর মতো বই। তাঁর আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম-এর মতো বেস্ট সেলার হয়ে ওঠেনি সেটা, কিন্তু কালজয়ী হয়েছে নিশ্চয়ই। বইয়ে যেমনটি লিখেছেন সেভাবেই মহাবিশ্বকে দেখতে চেয়েছিলেন হকিং। ছোটবেলাতেই সেই আগ্রহের শুরু। কিন্তু মোটেও তিনি অতি মেধাবী ছাত্র ছিলেন না। তবে মধ্যম মানের সাদামাটা ছাত্রটিকেও বন্ধুরা ‘আইনস্টাইন’ বলে ডাকত। বন্ধুদের সেই অভিধা যে ভুল ছিল না, তার প্রমাণ তিনি দিয়েছেন কালের নায়ক হয়ে উঠে। যেমন করে গ্রিক সভ্যতায় নায়ক হয়ে উঠেছিলেন আর্কিমিডিস, রেনেসাঁর কালে গ্যালিলিও, নায়ক হয়েছিলেন নিউটন, তারপরে আইনস্টাইন। নায়ক হয়ে ওঠার পথে হাঁটতে গিয়ে, মহাবিশ্বকে বাদামের খোসায় বা হাতের মুঠোয় আনতে গিয়ে শুরুতেই তাঁকে হোঁচট খেতে হয়, মোটর নিউরনে আক্রান্ত হয়ে আক্ষরিক অর্থেই পঙ্গুত্ব বরণ করতে, ঠাঁই হয় হুইলচেয়ারে, দুটি মাত্র আঙুলই তাঁকে করে তোলে মহাবিশ্বের নিশ্চল নিরলস পরিব্রাজকে।

হুইলচেয়ারে বসেই হকিং বৈজ্ঞানিক জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাংসারিক জীবনও সামলে গেছেন বুক চিতিয়ে। বিয়ে করেছেন, তিন সন্তানের জনক হয়েছেন, সংসার ভেঙেছেন, আবার নিজের নার্সকে বিয়ে করেছেন—এসব যেন আটপৌর সাংসারিক মানুষের জীবনেরই আলেখ্যই। ঘর-সংসার, কর্তৃত্ব, পিতৃত্ব, বিচ্ছেদ সামলেও একমুহূর্তের জন্য বিস্মৃত হননি মহাবিশ্বের কোণে কোণে ছড়িয়ে থাকা মহারহস্যের কথা। তাঁর সেই পথচলায় সঙ্গী হয়েছেন আরেক পদার্থবিজ্ঞানী রজার পেনরোজ। অবশ্য পেনরোজের কাজই আগে। ব্ল্যাকহোলের তত্ত্ব দিতে গিয়ে সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দুর জন্য একটা গাণিতিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন পেনরোজ। সেই পরম বিন্দুর ধারণাটাকেই হকিং ধার করলেন মহাবিশ্বের শুরুর সময় ব্যাখ্যা করতে। বিরাট একটা নক্ষত্র যেমন আয়তন সংকুচিত করে, ভর একত্র করে একটা পরম বিন্দুতে গিয়ে সাঙ্গ করে তাঁর অন্তিমযাত্রা—হকিং বললেন, জর্জ গ্যামো আর জর্জ লেমেত্রি যে বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের তত্ত্ব দিয়েছিলেন, সেটার শুরুটাও হয়েছিল একটা পরম বিন্দু থেকেই, যে বিন্দুতে আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ পদার্থবিদ্যার সব সূত্রই।

হকিংয়ের সবচেয়ে বড় কাজ মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় বস্তুটাকে নিয়েই। মহাবিস্ফোরণের মতো কৃষ্ণগহ্বরের ধারণাও বেরিয়ে এসেছিল আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা থেকেই। জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল সোয়ার্জশিল্ড আইনস্টাইনের সেই বিখ্যাত সমীকরণের সমাধান করে দিয়েছিলেন কৃষ্ণগহ্বরের প্রাথমিক ধারণা। পরে রবার্ট ওপেনহাইমার, হার্টল্যান্ড স্নাইডাররা বেশ কিছুটা এগিয়ে নিয়েছিলেন কৃষ্ণহ্বর তত্ত্বকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে সেই গবেষণা চাপা পড়ে যায় নিউক্লিয়ার বোমা গবেষণার নিচে। যুদ্ধ শেষে আবার সেটা বাঁচিয়ে তোলেন রয় কার, জেলদোভিচ, ডেনিস শিয়ামা, জন হুইলারের মতো বিজ্ঞানীরা।

কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনাদিগন্ত নিয়ে কাজ করতে গিয়েই হকিং জন্ম দেন হকিং বিকিরণের। নিউজিল্যান্ডের গণিতবিদ রয় কার সাধারণ আপেক্ষিকতার সমাধান করতে গিয়ে দেখেন, কৃষ্ণগহ্বর স্থির নয়। এটা ঘোরে পৃথিবীর আহ্নিক ঘূর্ণনের মতো নিজ অক্ষকে কেন্দ্র করে। তখন অনেকেই কারের এই সমাধানের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু স্টিফেন হকিং আর তাঁর সহকর্মী ব্রেন্ডন কার্টার দেখালেন, আসলেই কৃষ্ণগহ্বর নিজ অক্ষের চারপাশে ঘুরতে পারে। এটা দেখাতে গিয়েই হকিং পেলেন তাঁর বিখ্যাত হকিং বিকিরণের সন্ধান।

কৃষ্ণগহ্বরের ভেতর কোনো বস্তুর আর বেরোনোর উপায় থাকে না। তাই কৃষ্ণগহ্বরের ভর বেড়েই চলে। সঙ্গে কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রফলও বাড়ে সমানতালে। সেই সঙ্গে বাড়ে কৃষ্ণগহ্বরের তাপমাত্রাও। এই ব্যাপারটার সঙ্গে কোথায় যেন এনট্রপির সম্পর্ক আছে। হকিং দেখলেন ‘ঘটনা দিগন্তের ক্ষেত্রফল উপপাদ্য’-তে ক্ষেত্রফলের জায়গায় এনট্রপি বসিয়ে দিলে সেটা তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রে পরিণত হয়। কিন্তু হকিং বিষয়টাকে গুরুত্ব দিতে চাননি। গুরুত্ব দিলেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ গবেষক জেকব বেকেনস্টাইন। কৃষ্ণগহ্বর শুধু ভর, চার্জ, আর কৌণিক বেগের তথ্য নিজের ভেতরে ধরে রাখে। আর কোনো তথ্যই তার থাকে না। আবার কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে ঢুকলে ফিরে আসতে পারে না আলোও। কোনো এনট্রপিওয়ালা বস্তু যদি কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে ফেলে দেওয়া হয়, সেই এনট্রপির কী হবে? কৃষ্ণগহ্বর তাহলে কি মহাবিশ্বের এনট্রপি কমিয়ে দেয়?

যদি এনট্রপি বিলীনই হয়, তাহলে তো তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রের লঙ্ঘন! হকিং দেখালেন, কৃষ্ণগহ্বরের যদি এনট্রপি থাকে তাহলে এর তাপমাত্রা থাকাও উচিত। আর তাপমাত্রা থাকা মানেই সেটা কিছু না কিছু বিকিরণ করবে। কারণ সাধারণ যেকোনো বস্তুর যদি খুব সামান্য তাপমাত্রাও থাকে তাহলে সে বস্তুটি বিকিরণ করে। একে কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ বলে। সাধারণ অবস্থায় সেসব বিকিরণ চোখে পড়ে না, পরিমাণ খুব কম বলে। কৃষ্ণগহ্বরের হাত থেকে যদি তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রকে বাঁচাতে হয়, তাহলে এর তাপমাত্রা থাকতে হবে। আর তাপমাত্রা থাকা মানেই তার বিকিরণ থাকা। কিন্তু কৃষ্ণগহ্বরের আদর্শ সংজ্ঞামতে কিছুতেই এ তাপমাত্রা থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তকে তাপমাত্রার সঙ্গে তুলনা করতে চেয়েছিলেন যে হকিং, তিনিও পিছু হটে এলেন। তিনি ভেবেছিলেন বেকেনস্টাইন তাঁর আবিষ্কারের অপব্যবহার করছেন। পরে হকিং তাঁর মনোভাব পাল্টান। একসময় স্বীকার করে নেন, বেকেনস্টাইনই ঠিক বলছেন।

হকিং বললেন, কৃষ্ণগহ্বরে বিকিরণ ঘটনা দিগন্তের ভেতর থেকে আসে না। বিকিরিত কণাগুলোর জন্ম ঘটনা দিগন্তের ঠিক বাইরে। বিকিরণ ঘটা মানে শক্তি কমে যাওয়া। ভর-শক্তি সংরক্ষণ সূত্র অনুসারে শক্তি কমে গেলে কৃষ্ণগহ্বরের ভরও কমতে থাকবে। তার মানে ক্রমাগত বিকিরণের কারণে ধীরে ধীরে কৃষ্ণগহ্বরের ভর কমে যাবে। ছোট হতে থাকবে কৃষ্ণগহ্বর। ভর যত কমবে, তত বাড়তে থাকবে তাপমাত্রা।

এখানেই আদর্শ কৃষ্ণবস্তু থেকে কৃষ্ণগহ্বরের পার্থক্য। আমাদের চিরচেনা সব বস্তু এমনকি কৃষ্ণবস্তুও যত বিকিরণ নির্গত করে তত তাদের তাপমাত্রা কমতে থাকে। কৃষ্ণগহ্বর এর ঠিক উল্টো চরিত্রের। আবার আদর্শ কৃষ্ণবস্তুর ক্ষেত্রে বিকিরণের সঙ্গে সঙ্গে তার বিকিরণ হারও কমে। কিন্তু কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রেই এ ব্যাপারটিও উল্টো ঘটে। সময়ের সঙ্গে কৃষ্ণগহ্বরের ভর কমে, ফলে তাপমাত্রা যায় বেড়ে। আর তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর বিকিরণের হার বাড়ে। হকিং বললেন, শেষমেশ একটি কৃষ্ণগহ্বর ভর কমাতে কমাতে এবং বিকিরণের হার বাড়াতে বাড়াতে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন কৃষ্ণগহ্বরটি আর স্থিতিশীল থাকতে পারে না। একটা বিস্ফোরণে মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যায়।

তাহলে কি কৃষ্ণবস্তুর মতো কৃষ্ণগহ্বরের ভেতর থেকে কি বিকিরণগুলো আসে? তাই যদি আসে তাহলে এই বিকিরণ থেকেই কৃষ্ণগহ্বরে ভেতরের খবর জানা যেতে পারে। হকিং বললেন, কৃষ্ণগহ্বরের বিকিরণ এর ভেতর থেকে আসে না। আসে ঘটনা দিগন্তের বাইরে থেকে। সেটা কীভাবে?

সেই পথ বাতলাতে গিয়েই হকিং নিলেন কোয়ান্টাম বলবিদ্যার আশ্রয়। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বলে শূন্যস্থান শূন্য নয়। সেখানে প্রতিমুহূর্তে তৈরি হচ্ছে কণা আর প্রতি কণার জোড়া। কিন্তু তারা খুব ক্ষণস্থায়ী। জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। পড়ে থাকে শক্তি। সেই শক্তিই পরক্ষণে আবার একজোড়া কণা-প্রতিকণা তৈরি করে। এভাবেই প্রকৃতিতে চলছে ভার্চ্যুয়াল কণাদের ভাঙা-গড়ার খেলা। ব্ল্যাকহোলের ঘটনা দিগন্তের খুব কাছেই তৈরি হয় যেসব ভার্চ্যুয়াল কণার জোড়া, সেগুলো পরস্পরকে ধ্বংস করার আগেই একটা পড়ে যায় ঘটনা দিগন্তের ভেতরে। অন্য কণাটা ঘটনা দিগন্তে না-ও পড়তে পারে। ছুটে পালিয়ে আসতে পারে ঘটনা দিগন্ত থেকে অনেক দূরে। আসার সময় এ কণাটি কৃষ্ণগহ্বর থেকে শক্তির জোগান পায়। সেই শক্তিই বিকিরণ (হকিং বিকিরণ) করে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে কণাটি। ঘটনা দিগন্তের বাইরে তখন তৈরি হয় বিকিরণ-বলয়। সেই বিকরণ-বলয় দেখেই হদিস মেলে কৃষ্ণগহ্বরের। এটাই ছিল কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে হকিংয়ের সেরা কাজ। হকিং বিকিরণের পরীক্ষামূলক প্রমাণ এখনো মেলেনি। তাই নোবেলও দেওয়া হয়নি হকিংকে।

নোবেল তিনি পাননি, তবে খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলেন স্টিফেন হকিং। জীবদ্দশায় এমন খ্যাতি পেয়েছিলেন কেবল আলবার্ট আইনস্টাইন। সেই খ্যাতির পেছনে কেউ কেউ তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধকার জন্য মানুষের সহানুভূতিকে প্রধান কারণ মনে করেন। কথাটার সত্যতার বিষয়ে কেউ জোর দিয়ে কিছু বলতে পারে না। কিন্তু বিশ্বমিডিয়ায় হকিংকে নিয়ে এত তোলপাড়ের প্রধান কারণ তাঁর আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম বইটি। সেই সঙ্গে টক শো, কৌতুকনির্ভর রিয়েলিটি শো, টেলিফিল্ম, সিনেমায় তাঁর সদর্প উপস্থিতি তাঁর জনপ্রিয়তার পারদকে সব সময় শীর্ষে ধরে রেখেছে। ১৯৯২ সালে তাঁকে নিয়ে বানানো হয় হলিউডের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার স্টিভেন স্পিলবার্গ নির্মাণ করেন আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম নামের একটি সিনেমা। কিন্তু সেটা বড় পরিসরে আলোর মুখ দেখেনি। এর বছর দুয়েক পর বানানো হয় ‘স্টিফেন হকিংস ইউনিভার্স’ নামের ছয় পর্বের একটি টিভি সিরিজ। ২০১৪ সালে নির্মাণ করা হয় দ্য থিওরি অব এভরিথিং নামের আরেকটি সিনেমা। ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় সিনেমাটি। দ্য থিওরি অব এভরিথিং সিনেমায় হকিংয়ের চরিত্রে অভিনয় করে এডি রেডমাইন জিতে নেন অস্কার। হকিং ডজনখানেক টিভি সিরিজে ও সিনেমায় অভিনয় করেছেন। অনেকে মনে করেন, তাঁর কাজের চেয়ে তাঁকে নিয়ে বানানো সিনেমা, তাঁর অভিনীত টিভি সিরিজ, তাঁর লেখা বই, তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাঁকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে। আসলেই কি তাই? নাকি উল্টো ব্যাপার—তাঁর কারণেই বিখ্যাত হয়েছে তাঁকে নিয়ে বানানো, তাঁর অভিনয় করা সিনেমা-সিরিজগুলো?

হকিংয়ের এই জনপ্রিয়তার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ, বিজ্ঞানকে গণমুখী করার তাঁর চেষ্টা। তিনি নিজে হুইলচেয়ারে বসে মহাবিশ্বের মন বোঝার চেষ্টা করে ক্ষান্ত হননি। তিনি নিজে যেভাবে মহাবিশ্ব দেখেছেন, মহাবিশ্বকে যেভাবে বুঝেছেন বা বুঝতে চেয়েছেন, সাধারণের উপযোগী করে বই লিখে সাধারণ মানুষকেও সেভাবে মহাবিশ্বকে দেখতে ও বুঝতে শিখিয়েছেন। ঠিক এ কারণেই তাঁর বই লন্ডন সানডে টাইমসে টানা ২৩৭ সপ্তাহ বেস্ট সেলার হয়েছে, বিক্রি হয়েছে লাখ লাখ কপি।

স্টিফেন হকিংয়ের জন্ম ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি, গ্যালিলিও তিন শ তম মৃতুদিনে। বাবা ফ্রাঙ্ক হকিংও গবেষক ছিলেন। তবে জীববিজ্ঞানের। মা ইসোবেল হকিং ছিলেন সমাজকর্মী। ১৯৫০ সালে সেন্ট অ্যালবান্সে মেয়েদের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত সেখানে পড়াশোনা করেন। হকিং যখন বড় হলেন, তাঁর বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে ডাক্তারি পড়ুক। কিন্তু হকিংয়ের ইচ্ছা গণিতে পড়ার। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন গণিতের জন্য আলাদা কোনো বিভাগ ছিল না। তাই হকিং পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তি হন। ভাগ্যিস হয়েছিলেন, নইলে আজ মহাবিশ্বের ইতিহাস যেমনটা লেখা হচ্ছে সেটা হয়তো অন্যরকম হত।

অক্সফোর্ডে যখন পিএইচডি করছেন, তখনই হকিং অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাত-পা অসাড় হয়ে আসে। চিকিত্সকেরা জানান, তিনি মোটর নিউরন নামে দূরারোগ্য এক রোগে আক্রান্ত। বাঁচার সম্ভবনা একেবারেই নেই, মেরেকেটে আর দুবছর পৃথিবীর আলো-বাতাস নিতে পারবেন। কিন্তু হকিং দমে যাওয়ার পাত্র নয়। জীবনটাকে তিনি একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলেন। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে যায়। হুইলচেয়ারে বসে শুরু তাঁর মহাজাগতিক পথচলা। ইতিমধ্যে জেন ওয়াইল্ডের সঙ্গে তাঁর প্রেম তুঙ্গে উঠেছে। তাঁকে বিয়েও করেন ১৯৬৫ সালে। জেনের ঘরে তিন সন্তান তাঁর-রবার্ট, লুসি আর টিমোথি। ১৯৯৫ সালে জেনের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয়। সেবছরই তিনি তাঁর নার্স এলেন মেসন বিয়ে করেন। আশির দশকে হকিং বাকশক্তি হারান। গোটা শরীর অবশ হয়ে যায়। মাত্র দুটি আঙুল নাড়াতে পারতেন। দুই আঙুল আর কম্পিউটার ব্যবহার করেই তিনি মহাবিশ্বের স্বরূপ উন্মোচন করে গেছেন।

গত ১৪ মার্চ হকিং মারা গেলেন আইনস্টাইনের জন্মদিনে। তিনি আমাদের বিশ্বাস করতে শিখিয়ে গেলেন পদার্থবিদ্যার মহাবিশ্বে বাস করার অধিকার, সেটাকে জানার অধিকার বৈজ্ঞানিকদের যেমন আছে, স্কুলের গণ্ডি পেরুনো এক তরুণেরও সেটাতে সমান অধিকার। ঠিক এই কারণেই আজ আমাদের কাছে মহাবিশ্ব এত স্পষ্টরূপে ধরা দিয়েছে।

সূত্র: বিবিসি