হিগস ও আমাদের মহাবিশ্ব

মহাবিশ্বের জন্ম নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন একমত। তাঁদের মতে, একটা বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল এই মহাবিশ্বের। বিগ ব্যাংয়ের ১০-১০ সেকেন্ড পর একটি নাটকীয় ঘটনা ঘটে। মহাবিশ্বের স্থান-কাল তার অবস্থা পরিবর্তন করে ফেলে। বিজ্ঞানীরা এই ধরনের পরিবর্তনকে বলেন ফেজ ট্রানজিশন বা দশা পরিবর্তন।

আমরা সবাই পানির দশা পরিবর্তনের সাথে পরিচিত। তাপমাত্রা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পানি কঠিন থেকে তরল, তরল থেকে জলীয় বাষ্পে পরিণত হয়। পানির ক্ষেত্রে তাপমাত্রা পরিবর্তনের হলে পানির অণুগুলোর ভিন্নভাবে সজ্জিত হয়ে তাদের বাহ্যিক দশার পরিবর্তন করে। কিন্তু আমরা যে ফেজ ট্রানজিশনের কথা বলছি এটি কোন বাহ্যিক পরিবর্তন নয়, বরং স্থান-কালের একদম মৌলিক একটি পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের ফলে সমস্ত স্থান-কাল সম্পূর্ণ নতুন একটি জিনিসে পরিপূর্ণ হয়ে যায় । একেই আমরা এখন হিগস ফিল্ড বলি।

এই জিনিসটি আমাদের কাছে সম্পুর্ণ অদৃশ্য। এমনকি তা উপলব্ধি করার মতোও নয়। তবে আমরা এই হিগস ফিল্ডের উপস্থিতি বুঝতে না পারলেও ইলেকট্রনের মতো মৌলিক কণিকারা এর প্রভাব ঠিকই বুঝতে পারে। অর্থাৎ অতিক্ষুদ্র মৌলিক কণিকাদের কাছে এই হিগস ফিল্ড একটি বাস্তব জিনিস।

আমরা যেমন একটি বায়ু-সমুদ্রের মধ্যে ডুবে আছি, ঠিক তেমনি এই হিগস ফিল্ডও সবসময় আমাদের ঘিরে রেখেছে। এখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে চলে গেলে এই বাতাস আর পাওয়া যাবে না। কিন্তু মহাবিশ্বের এমন কোনো স্থান নেই যেখানে এই হিগস ফিল্ডের উপস্থিতি নেই। অর্থাৎ এটি আমাদের মহাবিশ্বের সমস্ত শূন্যস্থান জুড়েও অবস্থান করছে। ইলেকট্রনের মতো কিছু মৌলিক কণিকা এই হিগস ফিল্ডের সাথে কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে। ফলে এসব কণিকারা কিছুটা শক্তি লাভ করে। কোনো একটি কণিকা জন্মের সঙ্গে সঙ্গে এই ফিল্ডের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করতে থাকে। এমনকি যদি সেটা স্থির অবস্থায় থাকে, তবুও চলতেই থাকে এই মিথস্ক্রিয়া। ফলে কণিকা জন্মের পরপরই মিথস্ক্রিয়া থেকে কিছুটা শক্তি পায়। আর এই সহজাত শক্তিকেই আমরা ভর বলি। আইনস্টাইনের সেই বিখ্যাত ভর-শক্তি সমীকরণ E=mc2 থেকে আমরা জানি—ভর আর শক্তি মূলত একই জিনিস। কণিকারা হিগস ফিল্ডের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার ফলে শক্তি পায়, আর আমাদের কাছে মনে হয় যেন এসব কণিকাদের কিছুটা ভর রয়েছে। হিগস ফিল্ডের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে মৌলিক কণিকাদের ভর পাবার এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় হিগস মেকানিজম।

সব কণিকাই কিন্তু হিগস ফিল্ডের সঙ্গে এই কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল কার্যকলাপে জড়ায় না। যেসব কণিকা হিগস ফিল্ডের সঙ্গে এই মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নেয়, তাদের ভর থাকে। অন্যদিকে যারা কোনো মিথস্ক্রিয়ায় জড়ায় না তারা ভরহীন থেকে যায়। কিছু কিছু কণিকা হিগস ফিল্ডের সঙ্গে খুব শক্তিশালী মিথস্ক্রিয়া করে। ফলে এদের ভরও হয় অনেক বেশি। যেমন, টপ কোয়ার্ক। এর ভর এতই বেশি, তা পুরো একটি টাংস্টেন পরমাণুর সমান। আর যেসব কণিকা হিগস ফিল্ডের সঙ্গে খুব সামান্য মিথস্ক্রিয়া করে, তাদের ভর হয় খুবই কম। যেমন ইলেকট্রন। ইলেকট্রনের ভর এতই কম, কোনো পরমাণুর মোট ভর গণনা করার সময় এর ভর হিসেবে না ধরলেও চলে। আবার ফোটন হিগস ফিল্ডের সঙ্গে কোন মিথস্ক্রিয়াই করে না। ফলে ফোটন ভরহীন থেকে যায়।

কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি অনুসারে, কোনো কোয়ান্টাম ফিল্ডকে প্রচণ্ড শক্তিতে আঘাত করা হলে সেই ফিল্ডে এক ধরনের কম্পন তৈরি হবে। এই কম্পনে সেই ফিল্ডের কোয়ান্টা তৈরি হয়। এই কোয়ান্টাগুলোকেই আমরা কণিকা হিসেবে পর্যবেক্ষণ করি। অর্থাৎ আমরা যেসব মৌলিক কণিকার কথা বলি, এগুলো মূলত বিভিন্ন কোয়ান্টাম ফিল্ডের কম্পন। ইলেকট্রনের ফিল্ডকে আঘাত করা হলে ইলেকট্রন তৈরি হবে। কোয়ার্ক ফিল্ডে আঘাত করলে কোয়ার্ক তৈরি হবে ।ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডে আঘাত করলে আলোর কণিকা ফোটন তৈরি হবে। হিগস ফিল্ড যেহেতু একটি কোয়ান্টাম ফিল্ড, তাই হিগস ফিল্ডকে আঘাত করলেও একটি কণিকা তৈরি হবে। হিগস ফিল্ডের কোয়ান্টাকে আমরা বলি হিগস বোসন।

এখানে একটি কথা স্পষ্ট করে বলা দরাকার—হিগস বোসন কিন্তু মৌলিক কণিকাদের ভর প্রদান করে না, বরং এই কাজটি করে হিগস ফিল্ড। হিগস বোসনের নিজেরও ভর রয়েছে। সেটাও আসে এই হিগস ফিল্ড থেকে। লক্ষ্য করলে দেখবেন—ওপরে উল্লেখিত সব জায়গায় বলা হয়েছে, হিগস ফিল্ড মৌলিক কণিকাদের ভরের জোগান দেয়। কোথাও বলা হয়নি, পদার্থের সকল ভর হিগস ফিল্ড থেকে আসে।

সাধারণ পদার্থ গঠিত হয় ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন দিয়ে। ইলেকট্রন একটি মৌলিক কণিকা, তাই একটি ইলেকট্রনের সকল ভরই হিগস ফিল্ড থেকে আসে। প্রোটন কিন্তু মৌলিক কণিকা নয়। দুইটি আপ কোয়ার্ক আর একটি ডাউন কোয়ার্ক মিলে একটি প্রোটন তৈরি করে। আপ কোয়ার্কের ভর ২.৩ MeV (মেগা ইলেকট্রন ভোল্ট) আর ডাউন কোয়ার্কের ভর ৪.৮ MeV। হিসেব অনুয়ায়ী, একটি প্রোটনের ভর হওয়ার কথা—(২.৩+২.৩+৪.৮) = ৯.৪ MeV। কিন্তু একটি প্রোটনের ভর আসলে ৯৩৮.২৮ MeV। তাহলে প্রোটনের বাকি ভর আসে কোথা থেকে? প্রোটনের বাকি ভর আসে সবল নিউক্লীয় বলক্ষেত্র থেকে। বিদ্যুৎচুম্বক বলক্ষেত্র যেমন, পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রন ও প্রোটনকে ধরে রাখে, তেমনি সবল নিউক্লীয় বল দুইটি আপ কোয়ার্ক ও একটি ডাউন কোয়ার্ককে একত্রে বেঁধে রেখে প্রোটন তৈরি করে। এই বেঁধে রাখার কাজটি করে সবল নিউক্লীয় বলের কণিকা গ্লুয়ন। প্রোটনের বাকি ভরটুকু আসে এই ভরহীন গ্লুয়নের গতিশক্তি থেকে। দেখা যাচ্ছে, একটি প্রোটনের মোট ভরের ১ শতাংশেরও কম ভর আসে হিগস ফিল্ড থেকে।

কণাপদার্থবিজ্ঞানীরা ২০১২ সালের ৪ জুলাই লার্জ হ্যাড্রন কোলায়ডারে বা এলএইচসিতে ১২৫.৩ GeV ভর ও ০ স্পিনের একটি কণিকা আবিষ্কার করেন। পদার্থবিজ্ঞানীরা মনে করছেন—স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে যে হিগস বোসন কণিকার অস্তিত্ব থাকার কথা, এটিই সেই হিগস বোসন৪,৫,৬। হিগস ফিল্ডের এক ধরনের (কোয়ান্টাম) উত্তেজনার কারণে হিগস বোসন তৈরি হয়। ফলে হিগস বোসন আবিস্কারের মধ্য দিয়ে হিগস ফিল্ডের অস্তিত্ব নিয়ে আমরা নিশ্চিত হতে পেরেছি। তবে এখনো কিন্তু অনেক প্রশ্নের উত্তর বাকি। কোনো কণিকা কেন হিগস ফিল্ডের সাথে শক্তিশালী মিথস্ক্রিয়া করবে, আবার কিছু কণিকা কেন খুব সামান্য মিথস্ক্রিয়া করবে, সে সম্পর্কে আমরা তেমন কিছুই জানি না। এমনকি ডার্ক ম্যাটার ও নিউট্রিনোর ভর হিগস ফিল্ড থেকে আসে কিনা, তা নিয়েও বিজ্ঞানীরা শতভাগ নিশ্চিত নন।

এছাড়া আরও বড় সমস্যা রয়েছে। ইলেকট্রন, কোয়ার্ক, ফোটন, গ্লুয়ন ইত্যাদি যেসব কণিকার সঙ্গে আমরা পরিচিত—এ ধরনের প্রতিটি মৌলিক কণিকাকে স্ট্যান্ডার্ড মডেল একদম নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। স্ট্যান্ডার্ড মডেলের এই কাঠামো গড়ে উঠেছে প্রকৃতির কিছু প্রতিসাম্যতার উপর ভিত্তি করে। এসব প্রতিসাম্যতার উপর ভিত্তি করে পদার্থবিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম বলক্ষেত্রের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য গাণিতিকভাবে প্রতিপাদন করতে পারেন! কিন্তু আমরা যে হিগস ফিল্ডের কথা জানলাম, তা কোন প্রতিসাম্যতার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেনি। অর্থাৎ হিগস ফিল্ড বলে একটি ফিল্ড আসলে কেন আছে তা সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। বিষয়টি কিছুটা এমন যে—এটি আছে তাই আছে, কিন্তু কেন আছে তা আমরা জানি না। এটি পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে অনেক বড় একটি সমস্যা। স্ট্যান্ডার্ড মডেল আমাদের চেনাজানা দুনিয়াকে খুব নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করতে পারলেও অনেকগুলো, ‘কেন?’ এর উত্তর দিতে পারে না। এই কেনগুলোর মধ্যে একটি বড় সমস্যা হলো হিগস ফিল্ডের মতো একটি ফিল্ডের উপস্থিতি। ফলে হিগস ফিল্ডের মাধ্যমে মৌলিক কণিকাদের ভর প্রাপ্তির বর্তমান ব্যাখ্যা আসলে একটি অসম্পুর্ণ ও অসন্তোষজনক সমাধান। বেশিরভাগ পদার্থবিজ্ঞানীই মনে করেন যে—শুধু হিগস বোসনেই গল্পের শেষ হতে পারে না।

চলবে…

লেখক:….

1. Gian Giudice, Ted Talk, Why our universe might exist on a knife-edge

2. https://en.wikipedia.org/wiki/Top_quark

3. Sean carrol, The particle at the end of the universe, Chapter two, Fields pervade the universe

4. http://cds.cern.ch/record/1494477?ln=en

5. https://www.newscientist.com/article/dn22029-its-a-boson-but-we-need-to-know-if-its-the-higgs/

6. https://www.sciencenews.org/blog/deleted-scenes/higgs-hysteria

7. https://en.wikipedia.org/wiki/Physics_beyond_the_Standard_Model#Phenomena_not_explained

8. Gian Giudice, Ted Talk, Why our universe might exist on a knife-edge