হিগস বোসন আবিষ্কারে সত্যেন বোসের ভূমিকা কতটা?

২০১২ সালে সার্নের এলএইচসিতে আবিষ্কার হয় হিগস বোসন কণা। হাজার হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট। তাই হিগস বোসন নিয়ে বিশ্বমিডিয়ায় তোলপাড় হবে, সেটাই স্বাভাবিক। হিগস বোসনের প্রধান প্রবর্তক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী পিটার হিগস তখন সুপারস্টার বনে গেলেন। বিশ্বে যখন আলোচনা তুঙ্গে, বাংলার আকাশে তখন হাহাকার। ‘উপেক্ষিত হিগস বোসন কণার আদি প্রবক্তা’; ‘উপেক্ষিত জিনিয়াস’, কিংবা ‘বাঙালি বলেই আদর পেলেন না বিশ্ব দরবারে’ এ ধরনের শিরোনামে ভরে গেল ভারত-বাংলাদেশের সংবাদপত্রের পাতা, কিংবা অনলাইন পোর্টালগুলোর ওয়াল।

হতাশাবাদীদের হা-হুতাশ বাড়ল পরের বছর অক্টোবরে। ঘোষণা করা হলো, ২০১৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী দুই বিজ্ঞানীর নাম। ফ্রঁসোয়া এংলার্টের সঙ্গে নোবেল ভাগ করে নিলেন পিটার হিগস। নোবেল পাওয়ার কারণ হিগস বোসন। তখন আরেকবার হাহাকার ওঠে উপমহাদেশের মিডিয়াপড়ায়। সত্যেন বোস নাকি উপেক্ষিত; হিগস বোসন আবিষ্কারের কৃতিত্ব তাঁকে দেওয়া হলো না; পেলেন না কোনো স্বীকৃতি!

আসলেই কি তাই? হিগস বোসনের সঙ্গে আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে সত্যেন বোসের, যাঁর জন্য এর কৃতিত্ব তাঁকে দেওয়া যায়?

আজকালকার সব যন্ত্রপাতি, গাড়ি, রকেট মেনে চলে নিউটনের গতিসূত্র। তাই বলে কি রকেট আবিষ্কারের কৃতিত্ব নিউটনকে দিতে হবে?

ধরা যাক, একটা খোয়াড়ে একপাল ছাগল আছে। এদের জন্য আছে দুটো ঘর তৈরি করতে হবে খোয়াড়ে। দুজন কেয়ারটেকার আছেন। একজনের নাম মিস্টার বি, আরেক জনের নাম মিস্টার ডব্লিউ। তাঁদের দুজনের দায়িত্ব দুটো ঘর তৈরি করে ছাগলগুলো রাখা। দুজন দুটি ঘর তৈরি করলেন। মিস্টার বি যে ঘরটা তৈরি করলেন, সেটার নাম দিলেন কালা ঘর। অন্যদিকে মিস্টার ডব্লিউ তাঁর তৈরি ঘরের নাম দিলেন ধলা ঘর।

ধরা যাক, দুই রঙের ছাগল আছে খোয়াড়ে। এক দলের গায়ের রঙ কালো এবং আরেক দলের সাদা। কালো রঙের ছাগলগুলো ভরা হলো কালা ঘরে। আর সাদা রঙের ছাগলগুলো ধলা ঘরে। এভাবে বহুদিন চলে গেল। এক সময় মারা গেলেন মিস্টার বি ও ডব্লিউ দুজনেই।

এরও অনেক দিন পর সেই খোয়াড়ে এক ভদ্রলোক এলেন। তাঁর নাম মিস্টার এক্স। সঙ্গে নিয়ে এলেন একটা কালো ছাগল। এই ছাগলটা তাহলে এখন ঢোকাতে হবে কালা ঘরে। অর্থাৎ কালা ঘর একটা নতুন সদস্য পেল। এখন বলুন, নতুন এই ছাগলটি এই ঘরে ঢোকানোর কৃতিত্বটা কার? বহুদিন আগে মারা যাওয়া মিস্টার বি-এর, নাকি নতুন আসা মিস্টার এক্সের?

আশা করি সবাই একমত হবেন, নতুন ছাগলটা কালা ঘরে ঢোকানোর সমস্ত কৃতিত্ব মিস্টার এক্সের। এই আবিষ্কারে মিস্টার বি-এর ভূমিকা নেই বললেই। তবু একটা অবদান মিস্টার এক্সের আছে, কালো ছাগলের জন্য যেহেতু তিনি কালা ঘরটা তৈরি করেছিলেন, তাই নতুন ছাগলটার নামের সঙ্গে মিস্টার বি এর নাম জুড়ে দিতে হবে।

হিগস বোসনের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এরকম। সত্যেন বোস একটা তত্ত্ব দিয়েছিলেন, বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান। এই তত্ত্ব যে কণা মেনে চলে তাদের ঠাঁই হলো বোসন শ্রেণিতে। সে সময় আরেকটি পরিসংখ্যানের জন্ম হয় ইতালিয়ান বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি আর ব্রিটিশ বিজ্ঞানী পল ডিরাকের হাতে- ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান। বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান যে সব কণাদের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে পারে না, সেগুলো ব্যাখ্যা করা যায় এই নতুন পরিসংখ্যানের সাহায্যে। তাই এসব কণাদের ফেলা হয় ফার্মিয়ন শ্রেণির কণার কাতারে। ইলেকট্রন, কোয়ার্কের মতো বস্তু কণারা হলো এই শ্রেণির কণা।

প্রায় চল্লিশ বছর পর তিনটি দল পর পর তিনটি পেপার প্রকাশ করেন পর পর তিন মাসে। প্রথমটির লেখক দুই বেলজিয়ান বিজ্ঞানী ফ্রঁসোয়া এংলার্ট ও রবার্ট ব্রাউট। অন্যটির লেখক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী বিজ্ঞানী পিটার হিগস আর তৃতীয়টির লেখক দুই মার্কিন বিজ্ঞানী জেরার্ল্ড গুরালনিক, কার্ল গেহেন এবং ব্রিটিশ বিজ্ঞানী টম কিম্বলে। তিনটি পেপারের মূল ভাব এক। সেই পেপাগুলিতেই ছিল তিন ধরনের কণার ভবিষ্যদ্বাণী। এই কণাগুলোই বস্তুর ভরের জন্য দায়ী। কণাগুলো আসলে বলবাহী কণা। এদের কম্পন বা পরস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার ফলে তৈরি হয় হিগস ফিল্ড। আর সেই ফিল্ডের সঙ্গে যেসব কণা মিথস্ক্রিয়ায় জড়ায়, সেগুলো ভর লাভ করে। যেমন, ইলেকট্রন, কোয়ার্কের মতো কণারা হিগস বোসনের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় জড়ায়। তাই এই কণাদের ভর আছে। অন্যদিকে ফোটন বা গ্লুয়ন কণারা হিগস ফিল্ডের সঙ্গে কোনোরকম মিথস্ক্রিয়ায় জড়ায় না। তাই এরা ভরহীন কণা।

যাইহোক, পিটার হিগসের ভবিষ্যদ্বাণী করা কণাদের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য কেমন হবে, তারও হিসাব কষেছিলেন পিটার হিগস এবং তাঁর দল। সেটা থেকেই স্পষ্ট বোঝা গেল, অনুমিত এই কণাগুলো আসলে বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান মেনে চলে। তাই এই কণার নামকরণ করা হলো হিগস বোসন। সত্যেন বোসের সঙ্গে হিগস বোসনের সম্পর্ক আসলে এতটুকুই। এটা নিয়ে অতি আবেগী না হওয়াই ভালো।

সূত্র: নিউ সায়েন্টিস্ট ও ব্রিটানিকা ডট কম