ফারেনহাইট স্কেলের ইতিকথা

তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য প্রয়োজন স্কেল। এই স্কেল তৈরির ইতিহাস প্রাচীন। প্রথম ব্যবহারিক ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য স্কেল আবিষ্কার করেন পোলিশ-ডাচ বিজ্ঞানী ড্যানিয়েল গ্যাব্রিয়েল ফারেনহাইট। পারিবারিকভাবে ব্যবসায় শিক্ষা লাভ করলেও বিজ্ঞানের প্রতি তিনি ছোটবেলা থেকেই আগ্রহী ছিলেন। বিশেষ করে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিগুলো তাঁকে খুব ভাবাত।

১৭০১ সালের দিকে বিষাক্ত মাশরুম খেয়ে তাঁর বাবা-মা মারা যান। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৫। এরপর মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যান ডাচ রিপাবলিকে। সেখানে ১৭০৮ সালে তাঁর সাথে দেখা হয় বিখ্যাত ডাচ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ওলে ক্রিস্টেনসন রোমারের সঙ্গে।

তার আগে, ১৭০২ সালে পা ভেঙে বেশ কিছু দিন বাসায় বিশ্রামে ছিলেন রোমার। সময় কাটানোর জন্য তিনি তাপমাত্রা নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন। এ সময় আবিষ্কার করেন তাপমাত্রা মাপার নতুন এক স্কেল। নাম দেন রোমার স্কেল।

এই স্কেলটিকে বলা হয়, তাপমাত্রা পরিমাপের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। রোমার অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড, পানি ও বরফের সমপরিমাণ মিশ্রণের তাপমাত্রাকে ০ ডিগ্রি ধরে হিসেব করেছিলেন। তখন এটাই ছিল পরিমাপযোগ্য সবচেয়ে কম তাপমাত্রা (প্রায় মাইনাস ১৭.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস)। তাঁর স্কেল অনুসারে, বিশুদ্ধ পানির গলনাঙ্ক ৭.৫ ডিগ্রি রোমার, মানুষের শরীরের তাপমাত্রা ২২.৫ ডিগ্রি রোমার এবং বিশুদ্ধ পানির স্ফুটনাংক ৬০ ডিগ্রি রোমার।

গ্যাব্রিয়েল ফারেনহাইট রোমারের সান্নিধ্যে এসে এই স্কেলের সঙ্গে পরিচিত হন। তবে তাপমাত্রা পরিমাপের যন্ত্র নিয়ে আগ্রহী হয়েছিলেন তারও আগে। সুতরাং রোমারের সান্নিধ্য তাঁকে এ ব্যাপারে আরও আগ্রহী করে তোলে। শুরু করেন গবেষণা।

ফারেনহাইট লক্ষ্য করেন, রোমারের স্কেলে দশমিক সংখ্যা রয়েছে। এই দশমিক তুলে দেওয়ার জন্য তিনি প্রতিটি পয়েন্টকে চার দিয়ে গুণ করে নতুন একটা স্কেল আবিষ্কার করেন। এ স্কেলে পানি, বরফ ও অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইডের সমপরিমাণ মিশ্রণের তাপমাত্রা ধরা হয় ০ ডিগ্রি, বিশুদ্ধ পানির গলনাঙ্ক ৩০ ডিগ্রি, সুস্থ মানবদেহের তাপমাত্রা ৯০ ডিগ্রি ও বিশুদ্ধ পানির স্ফুটনাংক ২৪০ ডিগ্রি ধরে নেন। তখনকার দিনে কাঁচের নলের ভেতর ইথানল ব্যবহার করে থার্মোমিটার তৈরি করা হত। কিন্তু ফারেনহাইট লক্ষ্য করেন, অ্যালকোহলের চেয়ে পারদ ব্যবহার করা বেশি সুবিধাজনক। তাই পারদ ব্যবহার করে ১৯১৪ সালে পারদ থার্মোমিটার তৈরি করেন। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ এক মাইলফলক। পরে পারদ থার্মোমিটার ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই ডিজিটাল যুগেও পারদ থার্মোমিটার ব্যবহার বন্ধ হয়নি।

পারদ থার্মোমিটার তৈরির পর নিজের উদ্ভাবিত স্কেল কিছুটা সংশোধন করেন ফারেনহাইট। তিনি চেয়েছিলেন, বিশুদ্ধ পানির গলনাঙ্ক ৩২ ডিগ্রি এবং সুস্থ মানবদেহের তাপমাত্রা ৯৬ ডিগ্রি হয়। এ দুটি বিন্দুকে স্থির বিন্দু ধরে তিনি মধ্যবর্তী অংশকে ৬৪টি ভাগ করেন। থার্মোমিটারে দাগাঙ্কনে সুবিধার জন্য এটা করেন তিনি। প্রথমে ৬৪ ভাগের অর্ধেক অংশে ৩২টা দাগাঙ্কিত করেন। তারপর ৩২-কে অর্ধেক করে ১৬, ১৬ কে অর্ধেক করে ৮, ৮কে অর্ধেক করে ৪—এভাবে পুরো স্কেল দাগাঙ্কিত করেন। পরে সংশোধিত স্কেলে পানির স্ফুটনাংক পরিমাপ করে প্রায় ২১২ ডিগ্রি ফারেনহাইট পান। ১৯২৪ সালে ফিলোসফিক্যাল জার্নাল- তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। বৈজ্ঞানিক সমাজে ব্যপক সাড়া পড়ে যায়। তাঁকে ফেলোশিপ দেয় রয়েল সোসাইটি। ফারেনহাইট স্কেলকে প্রথম স্ট্যান্ডার্ড, ব্যবহারিক ও বাণিজ্যিভাবে ব্যবহৃত স্কেল হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু এই স্কেল অনুযায়ী ০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় সহজে পৌঁছানো যায় না, এটা একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

তাই রয়েল সোসাইটি ফারেনহাইট স্কেলে সামান্য পরিবর্তন করে। নতুন স্কেলে বিশুদ্ধ পানির গলনাঙ্ককে ঠিক ৩২ ডিগ্রি ফারেনহাইটকে নিম্ন স্থির বিন্দু এবং বিশুদ্ধ পানির স্ফুটনাংককে ২১২ ডিগ্রি ফারেনহাইটকে ধরে উর্ধ স্থির বিন্দু ধরা হয়। আজও ফারেনহাইট স্কেলের এই মানটিই ব্যবহার করা হয়। এতে ১৮০টি ভাগ রয়েছে। সংশোধিত এই স্কেলে সুস্থ্ মানবদেহের তাপমাত্রা পরিমাপ করে ৯৮.৪ ফারেনহাইট পাওয়া যায়—আগের তুলনায় ২.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বেশি।

লেখক: শিক্ষার্থী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ

সূত্র: লাইভসায়েন্স ডট কম