শ্রদ্ধাঞ্জলি
সত্যেন বসুর অজানা ১০
আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে যৌথভাবে বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান গড়ে তোলেন তিনি। পাশাপাশি গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তিনি সত্যেন্দ্রনাথ বসু। আজ ৪ ফেব্রুয়ারি তাঁর মৃত্যুদিবসে জেনে নিন তাঁকে নিয়ে অজানা কিছু তথ্য।
বিজ্ঞানের জগতে উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের নাম সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ভারতীয়-বাঙালি এই পদার্থবিদ পরিসংখ্যানগত বলবিজ্ঞান ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় অসামান্য অবদানের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান ও বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট আবিষ্কারে আইনস্টাইন ও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর যৌথ অবদানের মাধ্যমে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে উন্মোচিত হয় নতুন দিগন্ত। সত্যেন বসুর স্মরণে মহাবিশ্বের অর্ধেক কণা—সব বলের কণার নাম রাখা হয়েছে বোসন। এ সব তথ্য আমাদের জানা। কিন্তু এসবের বাইরেও সত্যেন্দ্রনাথ বসু অনন্য। এই লেখায় সত্যেন বসুকে নিয়ে অজানা কিছু তথ্য জানা যাবে।
১) সত্যেন্দ্রনাথ বসু বাংলা ও ইংরেজি ছাড়াও হিন্দি, ফরাসি, জার্মান এবং সংস্কৃতসহ একাধিক ভাষায় অভিজ্ঞ ছিলেন। সহকর্মীদের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন বহুভাষী হিসেবে।
২) ডক্টরেট ডিগ্রি না থাকায় সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অধ্যাপক হওয়ার পথে কিছুটা বাধা ছিল। আইনস্টাইনের সুপারিশে তিনি সে বাধা উৎরে যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন। পরে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।
৩) সত্যেন্দ্রনাথ বসুর বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান ও কনডেনসেট তত্ত্বের ধারণাগুলোর ওপর ভিত্তি করে অনেক গবেষণা হয়েছে। এরকম মোট সাতটি গবেষণা পেয়েছে নোবেল পুরস্কার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্যেন্দ্রনাথ বসু নোবেল পুরস্কার পাননি।
৪) সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন উদারমনের মানুষ। সহজে মানুষের সঙ্গে মিশতে পারতেন। অনেক নামকরা বিজ্ঞানীদের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা ছিল। তাঁদের মধ্যে অন্যতম আরেক বাঙালি পদার্থবিদ মেঘনাদ সাহা, ইংরেজ পদার্থবিদ পল ডিরাক এবং সুইস গণিতবিদ মার্সেল গ্রসম্যান। শিক্ষাজীবনে ভারতের প্রেসিডেন্সী কলেজে (বর্তমান নাম, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর সান্নিধ্য পান তিনি। নিজেও ছিলেন প্রফুল্লচন্দ্রের মতো খ্যাতনামা অধ্যাপক।
৫) বিখ্যাত পদার্থবিদ নীলস বোর তাঁর পরমাণু মডেলের ওপর বক্তৃতা দিতে ১৯৬০ সালে ভারতের কলকাতায় এসেছিলেন। কথিত আছে, বক্তৃতা দিতে দিতে বোর একটি জটিল গাণিতিক সমস্যায় আটকে যান। তখন উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্য থেকে সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাৎক্ষণিকভাবে সমস্যাটি সমাধান করে দেন। এতে বোর এত বিস্মিত হয়েছিলেন যে তিনি বসুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনি কীভাবে এত দ্রুত এই সমস্যা সমাধান করলেন?’ বসু উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি শুধু সমস্যাটিকে অন্যভাবে দেখেছি।’
৬) সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও মেঘনাদ সাহা যৌথভাবে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব নিয়ে জার্মান ভাষায় লেখা মূল গবেষণাপত্র ও মূল গবেষণাপত্র অবলম্বনে একটি বই ইংরেজিতে অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলেন ১৯১৯ সালে। বইটির নাম ছিল প্রিন্সিপালস অব রিলেটিভিটি। এটি ১৯১৫ সালে প্রকাশিত আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভির প্রথম প্রকাশিত ইংরেজি অনুবাদ ছিল।
৭) সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং আইনস্টাইনের ‘বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান’-কে সম্মান জানাতে পদার্থবিদ পল ডিরাক পূর্ণসংখ্যক স্পিনবিশিষ্ট মৌলিক কণাদের নাম প্রস্তাব করেন বোসন (Boson)। এই কণা বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যানের নীতি মেনে চলে।
৮) কোয়ান্টাম তত্ত্বের সমসাময়িক একটি গাণিতিক সমস্যা সমাধান করে সত্যেন্দ্রনাথ বসু তা চিঠিতে পাঠিয়েছিলেন আইনস্টাইনের কাছে। সে সমাধানের জন্য তিনি পরিসংখ্যানগত বলবিদ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন।আইনস্টাইন সত্যেন্দ্রনাথ বসুর চিঠি পড়ে বিস্মিত হন। পরে তা জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন সে কালে জার্মানির বিখ্যাত এক বৈজ্ঞানিক জার্নালে। সঙ্গে আইনস্টাইনের একটি নোটও ছাপা হয়েছিল। সে জন্য এই পরিসংখ্যানটির নাম হয় বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান।
এর সূত্র ধরেই জন্ম হয় বোস-আইনস্টাইন ঘনীভূত অবস্থা বা কনডেনসেটের (Bose-Einstein condensate)। এটাকে অনেক সময় ‘পদার্থের পঞ্চম অবস্থা’ও বলা হয়।
৯) ১৯২৫ সালে গবেষণার জন্য ইউরোপ যাত্রা করেন। সেখানে লুই ডি ব্রগলি, মেরি কুরি এবং ইয়ানস্টাইনের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পান। এ ছাড়া নীলস বোর , পল ডিরাক, লিজ মাইটনার ও ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের মতো বিজ্ঞানীদের সংস্পর্শে আসেন।
১০) বিজ্ঞানের পাশাপাশি সঙ্গীতেও আগ্রহী ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তিনি খুব ভালো এস্রাজ (ভারতীয় তারযন্ত্র) বাজাতে পারতেন।