গতিসূত্রের অন্তরালে

আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে নিউটনের গতিসূত্র। পদার্থবিজ্ঞানের চিরায়ত সূত্রের ভেতর লুকিয়ে আছে প্রকৃতির অনেক রহস্য। গতিসূত্রের অন্তরালের সেই রহস্যগুলো কেমন?

বল কি এককে মাপা হয় তা বলার আগে, ধরে নিই একটি বস্তুর ভরের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। তাহলে বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তন হওয়ার মানেই হলো ওর বেগের পরিবর্তন। বেগের পরিবর্তনের হারকে বলে ত্বরণ, যেমন জ্যামে পড়তে শুরু করলে গাড়ির বেগ কমতে থাকে, আর জ্যাম ছাড়তে শুরু করলে গাড়ির বেগ বাড়তে থাকে। ত্বরণ মাপা হয় মিটার পার সেকেন্ড স্কয়ারে। একটি এক কেজি বস্তুর ওপর ক্রিয়া করে যে বল এক মিটার পার সেকেন্ড স্কয়ার ত্বরণ সৃষ্টি করতে পারে, সেই বলকে ১ নিউটন বল বলে।

এখন পুরো জিনিসটা একবার ভাবার চেষ্টা করি। এর জন্য ভালো কল্পনাশক্তি থাকতে হয়। তাই বলে নিউটনের দ্বিতীয় গতিসূত্র কোনো কাল্পনিক বিষয় নয়, এটি প্রকৃতির অলঙ্ঘনীয় একটি নিয়ম। ধরে নিই, একটি বস্তু সোজা উত্তর দিকে যাচ্ছে (বস্তুটি শুধু পৃথিবীর বাইরে নয়, একেবারে মহাবিশ্বের বাইরে, যেখানে কিছুই নেই, তার মানে এটা শুধু কল্পনায় সম্ভব)। বাইরে থেকে কোনো বল প্রয়োগ না করলে, মানে ধাক্কা বা টান না দিলে, বস্তুটি একই ভরবেগে উত্তর দিকেই যেতে থাকবে। আমরা যদি বস্তুটির ওপর উত্তর দিকে ঠেলা দিই, তাহলে দেখা যাবে বস্তুর বেগ উত্তর দিকে বেড়ে যাচ্ছে, মানে বস্তুর ভরবেগ উত্তর দিকে বেড়ে যাচ্ছে। যতক্ষণ ঠেলা দেব, ততক্ষণই ভরবেগ বাড়তে থাকবে, কী হারে বস্তুর ভরবেগ বাড়বে, তা নির্ভর করছে ঠেলার মাত্রার ওপর। যত বেশি ঠেলা দেব তত দ্রুত ভরবেগ (এখানে শুধু বেগ, ধরে নিয়েছি ভর স্থির আছে) বাড়তে থাকবে। ঠিক যে মুহূর্তে ঠেলা দেওয়া বন্ধ করে দেব, তখন আর ভরবেগ বাড়বে না। ঠেলা দেওয়ার শেষ মুহূর্তে যে ভরবেগ ছিল, সে ভরবেগেই উত্তর দিকে চলতে থাকবে। আবার দক্ষিণ দিকে বল প্রয়োগ করলে বা দক্ষিণ বরাবর টেনে ধরলে বস্তুর ভরবেগ উত্তর দিকে কমতে থাকবে। দক্ষিণের টানটা যদি বেশি হয় অথবা বেশি সময় ধরে দক্ষিণ দিকে টানা হয়, তাহলে দেখা যাবে বস্তু উত্তর দিকে বরাবর কিছুদূর গিয়ে, দিক পরিবর্তন করে দক্ষিণ দিকে চলতে শুরু করেছে। তার মানে বস্তুর গতি পরিবর্তন (গতির দিক বা মান) বা ত্বরণের জন্য বাইরে থেকে বল প্রয়োগ করতে হয়। এটাও নিউটনের দ্বিতীয় গতিসূত্র! বল যেদিকে প্রয়োগ করা হবে ভরবেগের পরিবর্তনও সেদিকেই হবে, অর্থাত্ যেদিকে বল সেদিকেই ত্বরণ!

বস্তুর ওপর বাইরে থেকে বল প্রয়োগ না করলে বস্তুর ভরবেগের কোনো পরিবর্তন হবে না। অর্থাত্ একটি বস্তু সমবেগে (বেগের মান এবং দিক একই রেখে) চলতে থাকবে। অথবা বস্তুটি স্থির অবস্থায় থাকলে স্থিরই থাকবে। এটাই নিউটনের প্রথম গতিসূত্র। এটা কি নিউটনের গতির দ্বিতীয় সূত্রের বিশেষ অবস্থা নয়! হ্যাঁ! তারপরও এর বিশেষ গুরুত্বের জন্য এটি আলাদা করে বলা হয়েছে। নিউটনের প্রথম গতিসূত্রের বিশেষ ভূমিকা হলো ইনারশিয়াল রেফারেন্স ফ্রেম নির্ণয়ে। এই ফ্রেম থেকেই গতির মাপজোখ করতে হয়। ইনারশিয়াল রেফারেন্স ফ্রেম হলো এমন একটি রেফারেন্স ফ্রেম, যে ফ্রেমের সাপেক্ষে একটি বস্তুর ওপর বল শূন্য হলে ওর ভরবেগের পরিবর্তনের হারও শূন্য হবে।

শুধু নিউটনের গতির দ্বিতীয় সূত্র দিয়েই মহাবিশ্বের সব গতিশীল অবস্থা ব্যাখ্যা করা যায়। শুরু করা যাক গাছ থেকে আম পড়া থেকে। একটি কাঁচা আম সহজে গাছ থেকে পড়ে না। আম পেকে গেলে গাছ থেকে পড়ে। এখানে আমটি হলো আমাদের বস্তু। বাইরের দুটো জিনিস হলো আমের বোঁটা ও পৃথিবী। কাঁচা আমের ওপর বোঁটার কারণে ওপরের দিকের টান এবং পৃথিবীর জন্য নিচের দিকের টান সমান। ফলে কাঁচা আম বোঁটাতেই থাকে। আম পেকে গেলে বোঁটা নরম হয়ে যায়। তখন বোঁটার কারণে আমের ওপরের দিকের বল কমে গেছে (ধরে নিই কাঁচা ও পাকা আমের ভর একই)। ফলে পৃথিবীর টানে আমটা নিচের দিকে পড়ে এবং মাটিতে পড়ার আগ পর্যন্ত এর ভরবেগ বাড়তে থাকে। আমটা যত বেশি ওপরে থাকবে, তত বেশি সময় ধরে পতনশীল আমের ওপর পৃথিবীর টান কাজ করবে এবং মাটিতে পড়ার আগে আমের ভরবেগ তত বেশি হবে। কিন্তু পড়ার সময় প্রতি সেকেন্ডে আমের ভরবেগ প্রায় একই হারে বাড়বে, কারণ পড়ন্ত অবস্থায় আমের ওপর পৃথিবীর টানের পরিমাণ প্রায় সমান।

এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়ার চেষ্টা করব। আমরা যে চেয়ারে চুপ করে বসে থাকি, এটা ব্যাখ্যা করা যায় নিউটনের দ্বিতীয় গতিসূত্র দিয়ে। চেয়ার আমাদের ওপরের দিকে ঠেলে আর পৃথিবী আমাদের নিচের দিকে টানে। দুটো সমান এবং বিপরীতমুখী বলের কারণে আমাদের ওপর মোট বল শূন্য। তাই আমরা শূন্য ভরবেগেই (বেগ শূন্য বলে ভরবেগ শূন্য) বসে থাকতে পারি। বৃষ্টি পড়া থেকে আমাদের শ্বাস নেওয়া, পাখির উড়ে যাওয়া, আমাদের হাঁটাচলা, পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের ঘোরা—মহাবিশ্বের সব গতিশীল অবস্থা নিউটনের দ্বিতীয় গতিসূত্রের বিশেষ বিশেষ আঙ্গিকে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।

কিন্তু একটু ভাবলেই দেখা যায়, আমরা যখন হাঁটি, বাইরে থেকে কেউ কি আমাদের ধাক্কা দেয়, না নিজেরাই কিছু করি? আপাতভাবে মনে হচ্ছে সামনে চলার জন্য কেউ আমাদের বাইরে থেকে ধাক্কা দেয় না। একইভাবে গাড়ি-ঘোড়া সবই যখন চলে, প্রথমে নিজেরাই ধাক্কা দেয়। তাহলে কি নিউটনের দ্বিতীয় গতিসূত্র ভুল? বাইরে থেকে বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ না করলে তো আমাদের ভরবেগের পরিবর্তন হওয়ার কথা নয়।

বাইরে থেকে কে ধাক্কা বা টান দিচ্ছে! সে জন্যই নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্রের দরকার! নিউটন এই সূত্রে বলেছেন—প্রতিটি ক্রিয়ারই একটি সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া দুটোই বল। এই বল দুটো একই ধরনের বল, দুটোরই মান সমান, কিন্তু বিপরীতমুখী এবং দুটো বল দুটো ভিন্ন বস্তুর ওপর কাজ করে (এখানে প্রতিটি কথাই গুরুত্বপূর্ণ, পুরো বাক্যটি ভালো করে ভাবতে হবে)। এখন দেখা যাক, আমরা কীভাবে হাঁটি। আমরা প্রথমে রাস্তায় ওপর পা দিয়ে পেছনের দিকে বল প্রয়োগ করি (এতে আমরা এতটাই অভ্যস্ত যে পেছনের দিকে যে ধাক্কা দিচ্ছি, তা আমরা ঠিকভাবে ধরতে পারি না)। রাস্তাও আমাদের ওপর একটি সমান এবং বিপরীতমুখী, মানে সামনের দিকে একটি বল প্রয়োগ করে। নিজের বলের জন্য ভরবেগের পরিবর্তন হয় না, ভরবেগের পরিবর্তন হয় বাইরের বলের কারণে। আমরা রাস্তাকে ব্যবহার করি নিজের বলকে (ক্রিয়াকে) বাইরের বলে (প্রতিক্রিয়া বলে) রূপান্তর করতে। ক্রিয়া কাজ করে রাস্তার ওপর, প্রতিক্রিয়া কাজ করে আমাদের ওপর। গাড়ি, প্লেন, পাখি...সবাই ক্রিয়াকে প্রতিক্রিয়ায় রূপান্তরের মাধ্যমেই চলে।

এরপর নিজে নিজে ভাবলেই দেখা যাবে কী অদ্ভুত সুন্দর এই তিনটি নিয়ম। এই তিনটি নিয়ম ভাঙার সাধ্য কারও নেই। এত পরিষ্কার করে তিনটি বাক্যে প্রকৃতিজগতের তিনটি নিয়ম তুলে ধরা...নিউটনের পক্ষেই সম্ভব ছিল। এ জন্যই তিনি আমার চোখে বিজ্ঞানের জগতে সবচেয়ে বড় ধ্যানী ব্যক্তি! নিয়ম তিনটি দিয়ে মহাবিশ্বের সব গতিশীল অবস্থা বর্ণনা করা যায়। নিয়ম তিনটি বুঝতে পারলে খুব সহজেই আমরা গতিশীল বস্তুর ওপর প্রয়োগ করে অনেক কিছুই জানতে পারব। কিন্তু এর জন্য আমাদের সাধ্যমতো ভাবতে হবে।