জে জে টমসন যেভাবে ইলেকট্রন আবিষ্কার করলেন

ব্রিটেনের বিখ্যাত রয়্যাল ইনস্টিটিউটের সভাকক্ষ। বক্তব্য দিতে মঞ্চে উঠেছেন ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরির পরিচালক। নাম জোসেফ জন টমসন। প্রিয়জনদের কাছে যিনি জে জে নামেই পরিচিত। আর আমজনতা তাঁকে চেনে জে জে টমসন নামে।

১৮৯৭ সালের ৩০ এপ্রিল। শুক্রবার বিকেল। মঞ্চে উঠেই যেন আস্ত একটা বোমা ফাটালেন টমসন। নাটকীয় সুরে ঘোষণা দিলেন, কদিন আগেই তিনি বহুল চর্চিত ক্যাথোড রশ্মির রহস্য ভেদ করেছেন। সেই সঙ্গে আবিষ্কার করেছেন পরমাণুর চেয়েও ছোট একটি কণা। তার আকার অতি ক্ষুদ্র। সবচেয়ে ছোট পরমাণুর চেয়ে সেই কণা প্রায় দুই হাজার ভাগ ছোট।

উপস্থিত দর্শক-শ্রোতারা স্রেফ হাঁ। ভেতরে মাছি ঢুকে যায় আরকি! কেউই বিশ্বাস করতে পারলেন না টমসনের কথা। ভাবলেন, এ আবার হয় নাকি! পরমাণু তো অবিভাজ্য—তা সবাই জানে। একে তো ভেঙে আরও ছোট টুকরা করা সম্ভব নয়! কাজেই টমসনের কথা স্রেফ গুলবাজি ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না!

এককালে র‍য়্যাল ইনস্টিটিউটের এই মঞ্চ কাঁপিয়েছেন হামফ্রে ডেভি, মাইকেল ফ্যারাডে, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের মতো বিজ্ঞানীরা। দুনিয়াজোড়া তাঁদের নামডাক। সেখানে দাঁড়িয়ে টমসন সবার সঙ্গে তামাশা করছেন নাকি—উপস্থিত বিজ্ঞানীদের অনেকের মনেই সে প্রশ্ন। অনেকেই নিশ্চিত, টমসন তাঁদের সঙ্গে ধাপ্পাবাজি করেছেন।

কিন্তু মানুষ বড় বিচিত্র জীব। মুখে এক কথা আর মনে আরেক। বিজ্ঞানীরাও এর ব্যতিক্রম নন বোধ হয়। কাজেই লেকচার শেষে একে একে অনেকেই এসে অভিনন্দন জানাতে লাগলেন ক্যাভেন্ডিশের পরিচালককে। অথচ টমসন ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারেননি, সেই অভিনন্দনের কারণ ভিন্ন। তিনি যে সফলভাবে একটা ধাপ্পাবাজি সবার সামনে প্রকাশ করেছেন, এ জন্য সেই অভিনন্দনের জোয়ার। কারণটা তো আগেই বলেছি—একটা পরমাণুর চেয়েও ছোট কিছু হতে পারে, তা সে সময় কেউই বিশ্বাস করতে পারেনি।

তবে কথা হলো, টমসন এমন নিখুঁত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ব্যাপারটা অকাট্যভাবে প্রমাণ করেছেন যে তা আসলে অবিশ্বাসের উপায়ও রইল না। পরীক্ষাটা শুরু হয়েছিল ভ্যাকুয়াম টিউব–সংক্রান্ত ছোট্ট একটা রহস্য ভেদ করতে গিয়ে। ছোট্ট সেই কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে বেরিয়ে এসেছিল জলজ্যান্ত সাপ। চলুন, ব্যাপারটা বরং একটু খুলেই বলা যাক।

২.

আধুনিক সভ্যতার মেরুদণ্ড বলা চলে বিদ্যুৎ বা ইলেকট্রিসিটিকে। কিন্তু এককালে বিদ্যুৎ ছিল রহস্যময় ব্যাপার। এর রহস্য ভেদ করতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গবেষণা চালাচ্ছিলেন বিজ্ঞানীরা। বিদ্যুৎ এমন এক জিনিস, যা নানা ধরনের কঠিন বা তরলের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তারের ভেতর দিয়ে চলাচল করে। উজ্জ্বল শিখাও তৈরি করতে পারে সেগুলোয়। বিদ্যুৎ মোটর ঘোরানোসহ করতে পারে আরও অনেক কিছু। কিন্তু বিদ্যুৎ আসলে কী, তা কেউ জানে না তখন।

নানা পরীক্ষায় দেখা গেল, বৈদ্যুতিক প্রবাহ মাঝেমধ্যে বাতাসে হুট করে উজ্জ্বল স্ফুলিঙ্গ তৈরি করে। তবে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। তাই তা নিয়ে গবেষণা করাও কঠিন। আবার ওই বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ বাতাসের বিভিন্ন পরমাণুর সঙ্গে মিশে যায়। তাতে সবকিছু গুলিয়ে যায়। তাই একে কোনো শূন্যস্থান বা ভ্যাকুয়ামে পরীক্ষা করে দেখার কথা ভাবলেন বিজ্ঞানীরা। এভাবে একদিন উদ্ভাবিত হলো ভ্যাকুয়াম টিউব।

উনিশ শতকের বিজ্ঞানীদের কাছে সেটা বেশ জনপ্রিয় এক যন্ত্র। বলা চলে স্ট্যাটাস সিম্বল। অবশ্য আরও কিছু ডাকনামও ছিল এর। কেউ বলত গেইসলার টিউব, কেউবা ক্রুকস টিউব, আবার কেউ বলত ক্যাথোড রে টিউব। নাম যা–ই হোক, টিউবের মূলনীতিটা ছিল মোটামুটি একই। একটা পেটমোটা কাচনলের দুই প্রান্তের খোলা অংশ মোমজাতীয় বস্তু দিয়ে সিলগালা করা হতো। তারপর ভেতর থেকে বাতাস বের করে দেওয়া হতো পাম্প করে। আর নলটার দুই প্রান্তে লাগানো থাকত দুটি ধাতব দণ্ড—ইলেকট্রোড। ইলেকট্রোড দুটিতে তারের মাধ্যমে ব্যাটারি থেকে বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়া হতো। ব্যাটারির ধনাত্মক প্রান্তের সঙ্গে লাগানো ইলেকট্রোডকে বলে অ্যানোড এবং ঋণাত্মক অংশের সঙ্গে লাগানো ইলেকট্রোডকে বলে ক্যাথোড।

গ্রিক শব্দ অ্যানা (ana) অর্থ ওঠা, ক্যাটা (kata) অর্থ নামা। এর সঙ্গে গ্রিক শব্দ হোডস (Hodos) যুক্ত হয়ে উদ্ভূত হয়েছে অ্যানোড (Anode) ও ক্যাথোড (Cathode) শব্দ দুটি। এদের অর্থ যথাক্রমে ‘ওপরে ওঠা’ বা ‘আরোহণ’ এবং ‘নিচে নামা’ বা ‘অবরোহণ’। ১৮৩৪ সালের দিকে সদ্য আবিষ্কৃত ইলেকট্রোলাইসিস প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণার পর তা নিয়ে একটা গবেষণাপত্র লিখতে যাচ্ছিলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে। কিন্তু নতুন কিছু বৈজ্ঞানিক পরিঘটনা বোঝাতে দরকার নতুন কিছু পরিভাষা। সে জন্য তিনি সাহায্য চাইলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম ওহেওয়েলের কাছে। তিনিই ফ্যারাডেকে এই শব্দ দুটি ব্যবহারের পরামর্শ দেন।

নিজের গবেষণাপত্রে ফ্যারাডে পরিভাষা দুটির আরও ব্যাখ্যা দিলেন। আসলে অ্যানা বা ওঠা ব্যবহারের কারণ, সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে। আর পশ্চিমে অস্ত যায় বা নেমে যায়। তিনি বললেন, ইলেকট্রোলাইটিক কোষে বিদ্যুৎ এমনভাবে প্রবাহিত হয়, যেন তা পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে যাচ্ছে। অ্যানোডের ভেতর দিয়েই বিদ্যুৎপ্রবাহ ইলেকট্রোলাইটিক কোষে প্রবেশ করে। অর্থাৎ, পূর্ব পাশে।

আসলে সেকালে মনে করা হতো, বিদ্যুৎপ্রবাহ ব্যাটারির ধনাত্মক মেরু থেকে ঋণাত্মক মেরুর দিকে যায়। অনেকটা উঁচু পাহাড় থেকে নিচের দিকে পানি গড়িয়ে নামার মতো বৈদ্যুতিক প্রবাহও যেন ধনাত্মক মেরু (উঁচু) থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে ঋণাত্মক মেরুর (নিচু) দিকে নেমে যায়। তাই ব্যাটারির ধনাত্মক মেরুর সঙ্গে যুক্ত ইলেকট্রোডের নাম দেওয়া হয়েছিল অ্যানোড। তবে পরে দেখা গেল, বৈদ্যুতিক প্রবাহের দিকের ধারণাটি আসলে ভুল।

ইংল্যান্ডের নামকরা ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরিতে ওই ভ্যাকুয়াম টিউব নিয়ে তখন কাজ শুরু করেছেন স্যার জে জে টমসন। উনিশ শতকের শেষ প্রান্তে এসে কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রসববেদনা যখন ঘোষিত হতে যাচ্ছে, তখন কণা পদার্থবিজ্ঞানের অবিসংবাদিত পণ্ডিত তিনি।

১৮৫৫ সালে হেনরিক গেইসলার নামে এক জার্মান উদ্ভাবক প্রথম এ ধরনের একটা ভ্যাকুয়াম টিউব বানান। এরপর বিজ্ঞানীরা একটা বায়শূন্য জায়গার ভেতরের বৈদ্যুতিক প্রবাহ নিয়ে গবেষণা করতে সক্ষম হন। পরীক্ষা করতে গিয়ে তাঁরা দেখতে পান, এতে কিছু একটা তৈরি হচ্ছে, যা সোজা রেখায় চলাচল করে। সেখানে যে বিকিরণ আছে, তা তাঁরা বলতে পারতেন, কারণ এটা ক্ষীণভাবে জ্বলজ্বল করত। সেটা টিউবের কাচে আঘাত করলে কাচটি আরও জোরালোভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠত। বিজ্ঞানীদের কাছে তা ছিল রহস্যময়। নির্দিষ্ট কিছু কাচের টিউবে খুব ক্ষীণ আভা দেখা যায়, কিন্তু টিউবের ভেতর ফসফর প্রলেপ লাগিয়ে দিলে ধনাত্মক প্রান্তে আভাটা সুস্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। পুরো রহস্য ভেদ করতে না পারলেও বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন, ক্যাথোড ও অ্যানোডের মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় ক্যাথোড থেকে অ্যানোডের দিকে এক অদৃশ্য রশ্মি ছুটে যায়। পরে সেটা টিউবের শেষ প্রান্তে আঘাত করে ওই রহস্যময় আভা বা দীপ্তি সৃষ্টি করে।

১৮৭৬ সালে জার্মান বিজ্ঞানী ইউজেন গোল্ডস্টেইন প্রমাণ করলেন, ওই বিকিরণ হয় শুধু ক্যাথোড নামের ধাতব পাতে। তাই তিনি এই বিকিরণের নাম দেন ক্যাথোড রে বা ক্যাথোড রশ্মি (ঋণাত্মক রশ্মি)। অনেকে ভাবল, ক্যাথোড রশ্মি একধরনের আলো, যা নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ দিয়ে গঠিত। হয়তো ক্যাথোড রশ্মিও একই ধরনের ছোট ছোট তরঙ্গ দিয়ে গঠিত, তবে সে তরঙ্গগুলোর দৈর্ঘ্য হয়তো আলাদা। কিন্তু আরেক পরীক্ষায় দেখা গেল, ভ্যাকুয়াম টিউবের কাছে একটা চুম্বক আনা হলে ক্যাথোড রশ্মির গতিপথ বেঁকে যায়। কিন্তু আলোর আচরণ তো এ রকম নয়। কোথাও চুম্বক থাকুক বা না থাকুক, আলো সব সময় সোজা পথে চলাচল করে। শেষ পর্যন্ত হাইপোথিসিস ধোপে টিকল না। তাহলে ক্যাথোড রশ্মির চরিত্র কী?

১৮৯৫ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী জাঁ ব্যাপটিস্ট পেহরান প্রমাণ করেন, ক্যাথোড রশ্মি একধরনের বৈদ্যুতিক চার্জ বহন করে। তাই এর গতিপথ বেঁকে যায়। অর্থাৎ চুম্বক একটা বৈদ্যুতিক চার্জকে আকর্ষণ করতে পারে। বস্তুর কিছু অংশ বৈদ্যুতিক চার্জ বহন করতে পারে, কিন্তু আলো পারে না। তাই পেহরান অনুমান করলেন, ক্যাথোড রশ্মি বৈদ্যুতিকভাবে চার্জিত ছোট ছোট কণা দিয়ে তৈরি। কিন্তু এর প্রমাণ কী?

সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বলে নিই, ভ্যাকুয়াম টিউব ব্যবহার করে বিজ্ঞানজগৎ তোলপাড় করা নতুন কিছু আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানীরা। এর মধ্যে জার্মান বিজ্ঞানী রন্টজেনের এক্স-রে রশ্মি অন্যতম। কিন্তু এক্স-রে যে আসলে কী, তা–ও কারও জানা নেই তখন। এতে প্রভাবিত হয়ে ইউরেনিয়াম মৌল নিয়ে গবেষণা করেন ফরাসি বিজ্ঞানী হেনরি বেকেরেল। তিনি দেখেন, মৌলটি থেকে রহস্যময় একটা আলো বেরিয়ে আসে, যা ফটোগ্রাফিক প্লেটে ভুতুড়ে চিহ্ন রেখে যায়। ইউরেনিয়াম পরমাণুর মধ্যেই সেই ভূতের বাস। বেকেরেলের নতুন আবিষ্কৃত সেই আলোর ব্যাখ্যাও তখন অজানা।

এদিকে ইংল্যান্ডের নামকরা ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরিতে ওই ভ্যাকুয়াম টিউব নিয়ে তখন কাজ শুরু করেছেন স্যার জে জে টমসন। উনিশ শতকের শেষ প্রান্তে এসে কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রসববেদনা যখন ঘোষিত হতে যাচ্ছে, তখন কণা পদার্থবিজ্ঞানের অবিসংবাদিত পণ্ডিত তিনি।

টিউবের দুই প্রান্ত সিলগালা করে ইলেকট্রোডে বিদ্যুৎ চালনা করে ক্যাথোড রশ্মির প্রকৃতি আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন। একেই বিজ্ঞানের শেষ সীমানা বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কারণ, অনেক বিজ্ঞানীর তখন জোরালো ধারণা, বিজ্ঞানের নতুন কিছু আর আবিষ্কারের বাকি নেই। যা–ই হোক, ভ্যাকুয়াম টিউবের দুই প্রান্তের ধাতব ইলেকট্রোডে কয়েক হাজার ভোল্টেজের বিদ্যুৎ ছুড়ে দিচ্ছেন টমসন। তাতে ক্যাথোড থেকে অ্যানোডের দিকে রশ্মি ছুটে যায়। কিন্তু এই ক্যাথোড রশ্মি আসলে কী? এর এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ কী? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করে বসেন তোলপাড় করা আরেকটা ব্যাপার।

পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাগারে তখনো মোমের সিলিং আর শক্ত দড়ি-সুতাই ছিল ভরসা। কোনো যন্ত্রপাতি বায়ুশূন্য বা ভ্যাকুয়াম করতে মোমের সিলিং লাগানো হতো।

৩.

টমসনের জন্ম ১৮৫৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর। ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারের ছোট্ট এক উপশহর চিথাম হিলের এক স্কটিশ পরিবারে। তাঁর বাবা ছিলেন বই বিক্রেতা। শোনা যায়, ছেলেবেলা থেকেই বিজ্ঞানে ঝোঁক ছিল টমসনের। স্কুল শেষে ১৪ বছর বয়সে ভর্তি হন ম্যানচেস্টারের ওয়েন্স কলেজে (বর্তমানে ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়)। ১৮৭৬ সালে এক অধ্যাপকের সুপারিশে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে বদলি হন। চার বছর পর গ্র্যাজুয়েট হন গণিতে। পরে গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানে এমএ শেষ করে ১৮৮০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে ক্যাভেন্ডিশ প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। বাকি জীবন কাটান এই ল্যাবেই। ১৮৯০ সালে কেমব্রিজের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক স্যার জর্জ এডওয়ার্ড প্যাগেটের মেয়েকে বিয়ে করেন। কিছুদিন পর রহস্যময় ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে গবেষণায় মেতে ওঠেন। কারণ, গবেষণার জন্য সেটা তখন হট টপিক।

পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাগারে তখনো মোমের সিলিং আর শক্ত দড়ি-সুতাই ছিল ভরসা। কোনো যন্ত্রপাতি বায়ুশূন্য বা ভ্যাকুয়াম করতে মোমের সিলিং লাগানো হতো। কিছু যন্ত্রপাতি খাড়া করা হতো দড়ি-সুতা বেঁধে। আর গবেষণাগারে যন্ত্রপাতি দিয়ে সূক্ষ্ম কাজকারবারের জন্য টমসন ছিলেন অপটু। আনাড়ি। তাই তিনি যাতে যন্ত্রপাতিতে হাত না দেন, সেই চেষ্টা চালাতেন তাঁর সহকারীরা। তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ডিজাইন ও ফলাফল ব্যাখ্যায় টমসন ছিলেন অসাধারণ। ক্যাথোড রে নিয়ে পরপর তিনটি ধারাবাহিক পরীক্ষার মাধ্যমে এ–সংক্রান্ত সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করেন তিনি।

ক্যাথোড রেতে যে ঋণাত্মক চার্জ থাকে, তা আগের বিজ্ঞানীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল। কারণ, সেগুলো উৎপন্ন হয় টিউবের ঋণাত্মক ইলেকট্রোড বা ক্যাথোডে। এরপর রশ্মিটা ধনাত্মক ইলেকট্রোড বা অ্যানোডে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। পরীক্ষার মাধ্যমে টমসন জানতে চাচ্ছিলেন, রশ্মিটা থেকে এই ঋণাত্মক চার্জকে আদৌ আলাদা করা যায় কি না। এ রশ্মিটাই ভ্যাকুয়াম টিউবের কাচের ওপর প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করে। প্রথম পরীক্ষার জন্য এক বিশেষ ধরনের টিউব বানান টমসন। শুরুটা ছিল একটা আদর্শ ভ্যাকুয়াম টিউবের মতো, যার একদিকে একটা ধাতব ক্যাথোড রয়েছে। তারপর কয়েক ইঞ্চি ফাঁকা জায়গার পর একটা অ্যানোড। অ্যানোডটিতে একটা আনুভূমিকভাবে ছিদ্র কাটা হয়েছিল, যাতে ক্যাথোড রশ্মি পাতলা ও প্রশস্ত বিমের মতো অ্যানোডের ভেতর দিয়ে ছুটে যেতে পারে। ধনাত্মক প্রান্তের কাচের নলটি সাধারণ টিউবের চেয়ে বেশ খানিকটা প্রসারিত করা হয়েছিল। তাতে বিমটা ভ্যাকুয়াম টিউবের ভেতর দিয়ে লম্বা একটা পথ পাড়ি দিয়ে আঘাত করত শেষ প্রান্তে বসানো তৃতীয় একটা ইলেকট্রোডে।

টিউব থেকে পাম্প করে যথাসম্ভব বাতাস বের করলেন টমসন। এরপর রুহমকর্ফ কয়েল (একধরনের বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, যা দিয়ে নিম্ন ভোল্টেজের ডিরেক্ট কারেন্ট বা ডিসি থেকে উচ্চ ভোল্টেজ তৈরি করা যায়) থেকে প্রথম দুটি ইলেকট্রোডে ছুড়ে দিলেন উচ্চ ভোল্টেজ। অন্যদিকে প্রথম ও তৃতীয় ইলেকট্রোডের সঙ্গে সংযুক্ত করলেন একটা ইলেকট্রোমিটার। টমসন যেমন সন্দেহ করেছিলেন, ঘটলও তেমনটাই। একটা বৈদ্যুতিক প্রবাহ চলতে শুরু করল। তৃতীয় ইলেকট্রোডের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া ইলেকট্রোমিটারের কাঁটায় তার স্বাক্ষর পাওয়া গেল। এতে প্রমাণিত হলো, রশ্মিগুলোয় বিশুদ্ধ বিদ্যুতের উপাদান রয়েছে। এরপর তিনি বিমের লম্বা পথজুড়ে একটা হর্স–শু চুম্বক ব্যবহার করলেন। তাতে দেখা গেল, রশ্মিটা ওই চুম্বকীয় ক্ষেত্রে বেঁকে যাচ্ছে। ফলে সেটা আর তৃতীয় ইলেকট্রোডে গিয়ে আঘাত করতে পারল না। বরং টিউবের কাচে আঘাত করে সেখানে প্রতিপ্রভার সৃষ্টি করল। এবার বৈদ্যুতিক প্রভাবটি আর ইলেকট্রোমিটারে ধরা পড়ল না। এভাবে টমসন প্রমাণ করলেন, বৈদ্যুতিক চার্জ এবং ওই রশ্মি এক ও অভিন্ন। এদের মধ্যে কোনো তফাত নেই।

সে সময় বিজ্ঞানীরা জানতেন, কোনো চার্জিত কণা চুম্বকীয় ক্ষেত্রে যেমন বেঁকে যায়, তেমনি তা বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের কারণেও বেঁকে যাবে। কারণ, বিদ্যুৎ আর চুম্বক তো একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ

এ পরীক্ষার মাধ্যমে রশ্মিটা যে আসলে কী, তা কিছুটা অনুমান করতে পারলেন টমসন। কিন্তু তাঁর ধারণা আসলেই সঠিক কি না, তা নিশ্চিত হতে আরেকটি পরীক্ষা চালালেন। প্রয়োজনমতো বানানো হলো আরেকটা ভ্যাকুয়াম টিউব। আগের মতোই ধনাত্মক ইলেকট্রোডে একটা বৃত্তাকার ছিদ্র করা হলো। তার ভেতর দিয়ে ক্যাথোড রশ্মির বিমটা অনায়াসে চলে যেতে পারে। সরিয়ে ফেলা হলো তৃতীয় ইলেকট্রোডটা। বদলে টিউবের শেষ প্রান্তে ফসফোরেসেন্টের প্রলেপ লাগানো হলো। এ ছাড়া ক্যাথোড রশ্মির চলার পথে টিউবের ভেতরে দুপাশে জুড়ে দেওয়া হলো দুটি সমান্তরাল ধাতব পাত। এ পাতগুলোর সঙ্গে তার টেনে দেওয়া হলো বিদ্যুৎ–সংযোগ। এখন পাতের বিদ্যুৎপ্রবাহ যদি রশ্মিটা বাঁকিয়ে ফেলতে পারে, তাহলে নিশ্চিত হওয়া যাবে যে রশ্মিটা বৈদ্যুতিক চার্জের স্রোত। কিন্তু তা করতে গিয়ে দেখা গেল, রশ্মিটার গতিপথ বেঁকে যাচ্ছে না। একই পরীক্ষা এর আগেও বেশ কজন বিজ্ঞানী করেছিলেন, কিন্তু কেউ সফল হতে পারেননি।

সে সময় বিজ্ঞানীরা জানতেন, কোনো চার্জিত কণা চুম্বকীয় ক্ষেত্রে যেমন বেঁকে যায়, তেমনি তা বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের কারণেও বেঁকে যাবে। কারণ, বিদ্যুৎ আর চুম্বক তো একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। কিন্তু এখানে একটা ছোট্ট ঘাপলা আছে। চার্জিত কণার চারপাশে যদি পরিবাহী পদার্থ থাকে, তাহলে আর সেটি ঘটবে না। মানে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র চার্জিত কণার গতিপথ বাঁকাতে পারবে না।

ভ্যাকুয়াম টিউব থেকে যথেষ্ট বাতাস পাম্প করে বের করেছিলেন টমসন। তবু ভাবলেন, টিউবে হয়তো তখনো বাতাস বা গ্যাস রয়ে গেছে, যা বিদ্যুৎ পরিবাহী। তাই হয়তো বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের প্রভাবে চার্জিত কণাগুলোর গতিপথ বেঁকে যাচ্ছে না। এই ভাবনা মাথায় রেখে ভ্যাকুয়াম টিউব থেকে আবারও পাম্প করে বাতাস বের করার চেষ্টা করলেন। সে যুগে ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবের ভ্যাকুয়াম পাম্পগুলো ছিল সেরা। সে সুযোগ কাজে লাগালেন টমসন। সেই সঙ্গে মোম দিয়েও সব কটি ছিদ্র ভালোমতো সিলগালা করে দিলেন। তাই টিউবটাকে প্রায় নিখুঁতভাবে বায়ুশূন্য করা সম্ভব হলো।

সব কাজ শেষে আবারও ক্যাথোড ও অ্যানোড প্রান্তে বিদ্যুৎপ্রবাহ চালু করলেন। আগের মতোই ক্যাথোড থেকে একটা রশ্মি ছুটে যেতে লাগল। অ্যানোডের ভেতর দিয়ে সেটা ছুটে গিয়ে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে আঘাত হানল শেষ প্রান্তে। টিউবের শেষ প্রান্তটিতে একটা আভা ফুটে উঠল। এবার টমসন শুরু করলেন দ্বিতীয় পর্বের কাজ। টিউবের লম্বা অংশের বাইরে জুড়ে দেওয়া ধাতব পাত দুটিতে ব্যাটারি থেকে বিদ্যুৎপ্রবাহ চালু করলেন তিনি। তাতে সঙ্গে সঙ্গেই রশ্মিটি সরে গেল ধনাত্মক পাতের দিকে। এবার আর কোনো সন্দেহ নেই। উত্তরটি এখন নিশ্চিত জানেন টমসন। তবু আরেকটি পরীক্ষা করে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে চাইলেন তিনি।

এই পরীক্ষায়ও প্রায় দ্বিতীয় পরীক্ষার মতো ভ্যাকুয়াম টিউব ব্যবহার করলেন টমসন। এ বেলায় তফাত শুধু ধাতব পাত দুটি বাদ দেওয়া হলো। তার বদলে বাইরে চুম্বকীয় কয়েল রাখা হলো। এর মাধ্যমে একটা নিয়ন্ত্রিত চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করা যায়। এই চুম্বকীয় ক্ষেত্র ব্যবহার করে ক্যাথোড রশ্মির ওপর কী প্রভাব পড়ে, তা পরীক্ষা করা হলো। এবারও দ্বিতীয় পরীক্ষার মতো বেঁকে গেল ক্যাথোড রশ্মি।

এমনটাই আশা করেছিলেন টমসন। বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র ও চুম্বকীয় ক্ষেত্র—উভয়ের কারণে ক্যাথোড রশ্মির বেঁকে যাওয়া দেখে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছান তিনি। সে যুগের তুলনায় একে দুঃসাহসীই বলা চলে। তিনি বললেন, ক্যাথোড রশ্মি আসলে অতি ক্ষুদ্র, বৈদ্যুতিকভাবে চার্জিত একটা কণা দিয়ে গঠিত। তিনি এই কণার নাম দেন করপাসল।

এসব কণা আসলে বিভিন্ন পরমাণু থেকে ছিটকে বেরিয়ে ক্যাথোডে এসে জড়ো হয়। তারপর সেগুলো ভ্যাকুয়াম টিউবের লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে ধনাত্মক ইলেকট্রোড বা অ্যানোডের আকর্ষণে ছুটে যায়।

কিন্তু কণাটা কত ছোট? একটা জানা ভোল্টেজ ব্যবহার করার ফলে ক্যাথোড রশ্মি কতটুকু কোণে বেঁকে যায়, সেটা নিখুঁত পর্যবেক্ষণ করে টমসন চার্জ ও ভরের অনুপাত হিসাব করলেন। এভাবে একটা কণার ভর কতুটুকু হতে পারে, তা অনুমান করেন তিনি। টমসন বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার করেন, ক্যাথোড রশ্মির কণা পরমাণুর চেয়েও অনেক অনেক ছোট। এমনকি একটা ক্যাথোড রশ্মির কণার আকার সবচেয়ে ক্ষুদ্র পরমাণু, অর্থাৎ হাইড্রোজেন পরমাণুর আকারের চেয়েও মাত্র ১/১৮০০ গুণ! অর্থাৎ একটা হাইড্রোজেন পরমাণুর প্রায় দুই হাজার ভাগের এক ভাগের সমান। আর কণাটির চার্জ ঋণাত্মক।

এরপর ১৮৯৭ সালের ৩০ এপ্রিল রয়্যাল ইনস্টিটিউটে এক লেকচারে ইলেকট্রন আবিষ্কারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন টমসন। এ কথা শুরুতেই বলেছি। সেকালের বিজ্ঞানীরা তাঁর কথা শুনলেন, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারলেন না। তবে থামিয়ে রাখা গেল না ক্যাভেন্ডিশের একরোখা পরিচালককে।

টমসন বললেন, এসব কণা আসলে বিভিন্ন পরমাণু থেকে ছিটকে বেরিয়ে ক্যাথোডে এসে জড়ো হয়। তারপর সেগুলো ভ্যাকুয়াম টিউবের লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে ধনাত্মক ইলেকট্রোড বা অ্যানোডের আকর্ষণে ছুটে যায়। কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায়। পরমাণুর মোট চার্জ তো শূন্য বা চার্জ–নিরপেক্ষ। তাহলে পরমাণু থেকে ঋণাত্মক চার্জ বেরিয়ে গেলে তা তো আর চার্জ–নিরপেক্ষ থাকার কথা নয়, বরং পরমাণুতে ধনাত্মক চার্জ রয়ে যাওয়ার কথা। এই চিন্তা থেকে পরবর্তী সময়ে আরেকটি সিদ্ধান্তে পৌঁছান টমসন। তার মানে হলো, পরমাণুতে তুলনামূলকভাবে আরেকটি ধনাত্মকভাবে চার্জিত অংশ আছে। সেটা বেশ ভারী হওয়ার কথা। ওই ধনাত্মক অংশের পৃষ্ঠে ইলেকট্রন কণাগুলো আবদ্ধ থাকে। এভাবে পরমাণুর জন্য একটা মডেল খাড়া করেন টমসন। তিনি বললেন, পরমাণুতে ইলেকট্রনগুলো ছড়িয়ে থাকে পুডিংয়ের মধ্যে কিশমিশের মতো। তাই তাঁর এই মডেলকে বলা হয় প্লাম-পুডিং মডেল। তবে পরবর্তী পরীক্ষায় এ মডেলকে ভুল বলে প্রমাণ করেন নিউজিল্যান্ড থেকে কেমব্রিজে পড়তে আসা টমসনেরই এক ছাত্র। সেই ছাত্রের নাম আর্নেস্ট রাদারফোর্ড।

পরমাণু নিয়ে টমসনের ধারণা ভুল হলেও ইলেকট্রনের অস্তিত্ব নিয়ে কোনো সংশয় বা সন্দেহ নেই। এই কণা সত্যি সত্যিই বর্তমান। এর মাধ্যমে তিনিই প্রথম প্রমাণ করেন, পরমাণুকে ভাঙা সম্ভব। তার আগপর্যন্ত পরমাণুকে অবিভাজ্য ভাবা হতো। আর প্রথম সাব–অ্যাটমিক পার্টিকেল বা অতিপারমাণবিক কণা আবিষ্কার করেন তিনি। আগেই বলেছি, শুরুতে টমসন এ কণার নাম দেন করপাসল। অন্যদিকে মার্কিন পদার্থবিদেরা এর নাম রেখেছিলেন নেগাট্রন। নেগেটিভ বা ঋণাত্মক চার্জ বলেই এমন নাম। অবশ্য এ কণা আবিষ্কারের আগে আইরিশ পদার্থবিদ জর্জ জনস্টোন স্টোনি কণাটির নাম দেন ইলেকট্রলিয়ন। ১০ বছর পর তিনি নামটি বদলে ইলেকট্রন রাখেন। ডাচ পদার্থবিদ হেনড্রিক লরেঞ্জসহ সেকালের প্রভাবশালী আরও কজন বিজ্ঞানী এই ‘ইলেকট্রন’ নামটিই বেছে নেন। ইলেকট্রন শব্দটি ইংরেজি ‘ইলেকট্রিক’–এর (Electric) সঙ্গে আয়ন (ion) প্রত্যয় যোগ করে তৈরি। কণাটি বিদ্যুৎপ্রবাহের মধ্যে পাওয়া যায় বলে এমন নাম। শেষ পর্যন্ত ইলেকট্রন নামটিই টিকে যায়। তবে ১৯১৪ সাল পর্যন্তও নিজের দেওয়া করপাসল নামটাই ব্যবহার করতে থাকেন টমসন।

নটেগাছটি মুড়োল, আমার কথা ফুরোল। তার আগে শেষ কথা বলে যাই। যে ইলেকট্রন আবিষ্কারের ঘোষণা শুনে সেদিন ভ্রু কুঁচকে উঠেছিল বিজ্ঞানীদের, তার জন্যই ৯ বছর পর, মানে ১৯০৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান জে জে টমসন।

সূত্র: অ্যাটমিক অ্যাওকেনিং/ জেমস মাহাফি

অ্যাটম/ পিয়ার্স বিজোনি; অ্যাটম/ আইজাক আসিমভ; দ্য সায়েন্টিস্ট/ জন গ্রিবিন, স্ট্রেঞ্জ গ্লো/ টিমোথি জে. জরজেনসেন, উইকিপিডিয়া

*লেখাটি ২০২৪ সালে বিজ্ঞানচিন্তার নভেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত