প্রচণ্ড গরমে চারপাশ যখন উত্তপ্ত, তখন এক পশলা বৃষ্টি স্বস্তি এনে দেয়। আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালে তীব্র গরম থাকে। এ সময়ে মাঝে মাঝে দেখা মেলে কালবৈশাখী ঝড়ের। ঝড় বা বৃষ্টি ছাড়াও বজ্রপাত খুব সাধারণ এক ঘটনা। গ্রীষ্ম-বর্ষায় আকাশে মেঘ জমলেই শুরু হয় গুরু ডাক। মেঘ আরেকটু ঘনিয়ে এলে শুরু হয় বজ্রপাত। কিন্তু ঠিক কীভাবে বজ্রপাতের ঘটনাটি ঘটে?
বজ্রঝড় বা বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের শুরুটা হয় বাতাসের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে। পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে উপবৃত্তাকার পথে। নিজ অক্ষের ওপরও ঘুরছে প্রতিমুহূর্তে। এসব ঘূর্ণনের ফলে দেখা যায়, বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময় পৃথিবীর কিছু এলাকায় সূর্যের আলো তুলনামূলক বেশি সময় ধরে পড়ে। অর্থাৎ দিনের দৈর্ঘ্য বড় হয়।
বেশি মাত্রায় সূর্যের তাপ ভূ-পৃষ্ঠে পড়ায় পৃথিবীপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হয়। উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে বায়ুতে। উষ্ণ, আর্দ্র বায়ুর ঘনত্ব ঠান্ডা বাতাসের চেয়ে বেশি হওয়ায় দ্রুত ওপরে উঠে যায়। ঠান্ডা, শুষ্ক বাতাস পড়ে থাকে নীচে।
ওপরে ওঠার সময় বাতাসের জলীয়বাষ্প ধীরে ধীরে আরও ঠান্ডা হয়ে পরিণত হয় পানির ফোঁটায়। তৈরি হয় মেঘ। এই পানির কণাসমৃদ্ধ বাতাস দ্রুত তাপ ছাড়তে থাকে চারপাশে। ফলে, মেঘ ওপরে উঠতে থাকে। মেঘের আশপাশের অংশে শক্তিশালী ও উর্ধ্বমুখী বায়ুপ্রবাহ তৈরি হয়।
এর প্রায় ৩০ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয় বিশাল বজ্রমেঘ। খাতা-কলমে এ মেঘের নাম ‘কিউমুলাস নিমবাস’। এই মেঘ ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উঁচুতে গিয়ে ঠেকতে পারে। এ উচ্চতা পর্যন্ত বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ক্রমে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে কমতে থাকে। কিন্তু এর বাইরে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা আর কমে না। বাড়তে থাকে। ফলে এখানে এসে অদৃশ্য এক তাপীয় দেয়ালে ঠান্ডা বাতাস ধাক্কা খায়। প্রচুর পরিমাণ মেঘ এখানে এসে ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। ঝড়ের মেঘের সাধারণ আকৃতি—নৌকা বা এনভিল আকৃতি গঠন করে এ সময়।
মেঘের মধ্যে যত বেশি জলীয়বাষ্প ঘনীভূত হয়, ততই পানির ফোঁটাগুলো একটা আরেকটার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বড় হতে থাকে। ওপরের অংশে তাপমাত্রা কম হওয়ায় সেখানে পানি আরও শীতল হয়। ফলে জমতে থাকে বরফকণা। পানি ও বরফের এসব কণা যথেষ্ট ভারী হলে বৃষ্টি বা শিলাবৃষ্টি হিসেবে ঝরতে শুরু করে। তৈরি হয় শীতল বাতাসের এক নিম্নগামী স্রোত। এই বাতাস প্রচণ্ড গতিতে ছড়িয়ে পড়ে ভূ-পৃষ্ঠের কাছাকাছি অংশে। হঠাৎ করেই পরিবেশের তাপমাত্রা কমে যায়। তীব্র গরম থেকে মেলে স্বস্তি।
ওদিকে মেঘের মধ্যে চলে ইলেকট্রনের খেলা। বায়ুপ্রবাহের কারণে মেঘের অজস্র পানির কণা বরফের কণাগুলোর সঙ্গে ক্রমাগত ঘষা খেতে থাকে। ফলে, পানি ও বরফের কণা থেকে ইলেকট্রন মুক্ত বরফের বড় বড় কণায় চলে যায়।
ওপরের দিকে ভারী ও ঋণাত্মক চার্জের কণা, ইলেকট্রন জড়ো হয়। আর এর বিপরীত, অর্থাৎ নিচের অংশে তৈরি হয় ধনাত্মক চার্জের রাজত্ব। মানে, মেঘের ওপর ও নিচের অংশ জমে বিপরীতধর্মী চার্জ। তৈরি হয় বিভব পার্থক্য। এ পার্থক্য যথেষ্ট পরিমাণ হলে হঠাৎ প্রচণ্ড তড়িৎ প্রবাহিত হয় উচ্চ বিভব থেকে নিম্ন বিভবের দিকে। ফলে প্রচণ্ড তাপ তৈরি হয়। এই তাপ ও তাপের কারণে সৃষ্ট কম্পন থেকেই তৈরি হয় শব্দ ও আলো। নিচ থেকে আমরা এ ঘটনাকে বজ্রপাত বলি। তবে, এটা ইন্ট্রা-ক্লাউড ধরনের বজ্রপাত। অর্থাৎ মেঘেই জন্ম, মেঘের মাঝেই এর ইতি।
মেঘের ঋণাত্মক চার্জ ভূ-পৃষ্ঠের ইলেকট্রনকেও আন্দোলিত করে। ফলে ভূ-পৃষ্ঠে তৈরি হয় ধনাত্মক চার্জ। এখানেও একই ঘটনা। বিপরীত ধর্মী চার্জের কারণে তৈরি হয় বিভব পার্থক্য। পর্যাপ্ত বিভব পার্থক্যের কারণে ঘটে তীব্র তড়িৎ প্রবাহ। এবারে বিভব পার্থক্যের একটা প্রান্ত যেহেতু মাটিতে, তাই বজ্রপাতের মাটি পর্যন্ত আসতে অসুবিধা নেই। মূলত এ ধরনের বজ্রপাতের কারণেই ঘটে প্রাণহানি।
আমাদের দেশে প্রতিবছর অনেক মানুষ বজ্রপাতের কারণে মারা যান। তবে সতর্ক থাকলে বজ্রপাতের মতো দুর্ঘটনার হাত থেকেও বাঁচা সম্ভব। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পড়ুন ‘বজ্রপাত: বাঁচতে হলে জানতে হবে’।
লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা
সূত্র: সায়েন্স ফোকাস