বৃত্তাকার পথের গতি ব্যাখ্যা করতে পদার্থবিজ্ঞানে কেন্দ্রমুখী ও কেন্দ্রবহিঃমুখী বল নিয়ে আলোচনা করা হয়। এ দুটি বলের একটি বাস্তব, অন্যটা বাস্তব নয়!
‘কেন্দ্রমুখী বল’—নাম শুনেই বোঝা যায়, এটা কেন্দ্রের দিকে টানে। কাকে টানে? বৃত্তাকার পথে চলা বস্তুকে টানে। কেতাবি ভাষায় বললে, বৃত্তাকার পথে চলা বস্তু কেন্দ্রের দিকে যে আকর্ষণ বল অনুভব করে, তা-ই কেন্দ্রমুখী বল। যে মহাকর্ষ বলের কারণে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে, তাও একধরনের কেন্দ্রমুখী বল।
অন্যদিকে বস্তু বৃত্তাকার পথে ঘোরার সময় কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে যে বল অনুভব করে, তা কেন্দ্রবহিঃমুখী বা কেন্দ্রবিমুখী বল। এ বলকে নিয়েই যত ঝামেলা। কারণ, মজার বিষয় হলো, একে বাস্তব বলা যায় না। মেলায় বা পার্কে যাঁরা নাগরদোলায় চড়েছেন, যেটা ওপরে-নিচে না ঘুরে চারপাশে ঘোরে; তাঁরা অবশ্য প্রতিবাদ জানাতে পারেন। নাগরদোলার আসনগুলো যখন চক্রাকারে ঘুরতে থাকে, তখন মনে হয়, এই বুঝি কেন্দ্র থেকে ছিটকে যাব। তখন কেন্দ্রমুখী বল তো অনুভব করিই না, বরং এর বিপরীত, মানে কেন্দ্রবিমুখী বল অনুভব করি। তাহলে একে বাস্তব বলা যায় না কেন?
কেন্দ্রবিমুখী বল আমাদের অনুভূতি বা দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। আমরা যখন ঘূর্ণমান কোনো সিস্টেমের মধ্যে থাকি, তখন মনে হয় কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে কিছু একটা টানছে। যেন কেন্দ্র থেকে ঠেলে বাইরের দিকে সরিয়ে দিচ্ছে। বাস্তবে এ সবের কিছু ঘটে না। বাস্তবে এ দুটি বল একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। একটার কারণে অন্যটা ‘আছে বলে মনে হয়’। এই যে বারবার ‘আছে বলে মনে হয়’ বলছি, এ কথার মানে হলো, বলটা বাস্তবে থাকুক না থাকুক, এর প্রভাব আমরা টের পাই। মানে অনুভব করি।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন গবেষক এবং পদার্থবিজ্ঞানী ও ডাটা সায়েন্টিস্ট অ্যাড্রু এ গ্যান্স। তাঁর মতে, কেন্দ্রমুখী ও কেন্দ্রবিমুখী বলের মূল পার্থক্য হলো প্রসঙ্গ কাঠামো। অর্থাৎ কীসের সাপেক্ষে বলটিকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে, তা-ই মূল ব্যাপার। মূলত কেন্দ্রমুখী বল আর কেন্দ্রবিমুখী বল অভিন্ন। শুধু দিক আলাদা। ভিন্ন প্রসঙ্গ কাঠামোর কারণে একই বল দুভাবে অনুভব করা যায়, ব্যাখ্যাও করা যায়।
আপনি যদি ঘূর্ণমান সিস্টেমের বাইরে থাকেন, তাহলে কেন্দ্রমুখী বল পর্যবেক্ষণ করবেন। আর ভেতরে থাকলে মনে হবে শুধু কেন্দ্রবিমুখী বল কাজ করছে। তখন আর কেন্দ্রমুখী বল বোঝা যায় না।
এবার হয়তো প্রশ্ন করবেন, প্রসঙ্গ কাঠামোর কারণে যদি একই বলকে ভিন্নভাবে অনুভব করি, তাহলে শুরুতে কেন কেন্দ্রমুখী বলকে বাস্তব বলা হলো? কারণ, বৃত্তাকার পথে ঘোরার জন্য বস্তুকে অবশ্যই কেন্দ্রের দিকে টান অনুভব করতে হবে। এ ছাড়া বৃত্তাকার পথে ঘোরা সম্ভব নয়। কেন্দ্রের দিকে টান না থাকলে কাকে কেন্দ্র করবে ঘুরবে? যে মুহূর্তে কেন্দ্রমুখী বল অকার্যকর বা ছিন্ন হয়ে যায়, সে মুহূর্তে বস্তুটি আর বৃত্তাকার পথে ঘোরে না। চলতে থাকে সোজা একদিকে। ‘হ্যামার থ্রো’, মানে দড়ির মাথায় ভর (বল হতে পারে) বেঁধে ঘুরিয়ে ছুড়ে মারলে বিষয়টা ভালোভাবে বোঝা যায়। অলিম্পিকে হয়তো দেখে থাকবেন এমন খেলা। যতক্ষণ দড়ি খেলোয়াড়ের হাতে থাকে, অর্থাৎ কেন্দ্রমুখী বল সক্রিয় থাকে, ততক্ষণ ভারী বস্তুটি বৃত্তাকার পথে ঘোরে। খেলোয়ার দড়ি ছেড়ে দিলে কেন্দ্রমুখী বল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে ভারী বস্তুটি সরল পথে চলতে শুরু করে। কেন্দ্রবিমুখী বলের সাহায্যে বস্তুর বৃত্তাকার পথে ঘোরা সম্ভব নয়। তাই কেন্দ্রবিমুখী বলকে বাস্তব বলে বিবেচনা করা হয় না।