পৃথিবী চক্কর দেওয়া শব্দ

মনে করুন, আপনি রংপুরে আছেন। কেউ আপনাকে বললেন, তিনি কক্সবাজার থেকে আসা শব্দ শুনেছেন। আপনি তাঁর কথা শুনে মজা করছেন ভেবে হাসবেন। কক্সবাজার থেকে রংপুরের দূরত্ব প্রায় ৪২৮ মাইল। কিন্তু যদি তিনি বলেন, ৩ হাজার মাইল দূরের কুয়েতে ঘটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন, তাহলে পাগল হয়ে গেছে ভেবে ডাক্তারের কাছেই নিয়ে যাবেন। তবে এ রকম একটি ঘটনা ঘটেছিল ১৮৮৩ সালে। সেদিন মানুষের লিখিত ইতিহাসে সবচেয়ে জোরালো শব্দ হয়েছিল। সেই শব্দ ৩ হাজার মাইল দূর থেকেও শোনা গিয়েছিল। আর এই শব্দের ধাক্কা পৃথিবীজুড়ে ঘুরপাক খেয়েছিল চারবার।

ভারত মহাসাগরে জাভা ও সুমাত্রার মাঝামাঝি ছোট্ট একটা দ্বীপ ক্রাকাটোয়া। ওই অঞ্চলটা তখন বেশ জনবহুল হলেও ক্রাকাটোয়া দ্বীপে মানুষ বাস করতো না। উনিশ শতকের শেষ ভাগে জাভা সাগর ছিল বেশ সরগরম। ভারত মহাসাগর, দক্ষিণ চীন সাগর আর উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের মিলনস্থল জাভা সাগরে জাহাজের ভিড় লেগেই থাকত। ক্রাকাটোয়া দ্বীপে সতেরো শতকে কিছু ছোটখাটো অগ্ন্যুত্পাত ঘটে। তবে মানুষ ক্রাকাটোয়াকে নিরীহ আগ্নেয়গিরি হিসেবে ধরে নিয়েছিল। আসলে ক্রাকাটোয়ায় আগ্নেয়গিরি ছিল মোট তিনটি। ১৮৮৩ সালের মে মাসে আগ্নেয়গিরি আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে। অগ্ন্যুত্পাত তখনো আহামরি কিছু ছিল না। তবে ২৫ আগস্টের অগ্ন্যুত্পাত প্রকট আকার ধারণ করে ২৭ আগস্ট সকালবেলা।

ক্রাকাটোয়ার আগ্নেয়গিরি বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতে থাকে। এই শব্দ শোনা গিয়েছিল ১ হাজার ৩০০ মাইল দূরের আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে, ২ হাজার মাইল দূরের নিউগিনি ও পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া, এমনকি ৩ হাজার মাইল দূরের ভারত মহাসাগরের মাঝে মরিশাসের কাছাকাছি রডরিগাস দ্বীপে। সব মিলিয়ে ভূগোলকের ৫০টি ভিন্ন স্থানে শব্দটি শোনা যায়।

আগ্নেয়গিরি এতটা তীব্রতার সঙ্গে বিস্ফোরিত হয়েছিল যে তা দ্বীপটিকে প্রায় ছিঁড়েই ফেলেছিল। অগ্ন্যুত্পাতের ধোঁয়া বায়ুমণ্ডলের ১৭ মাইল ওপরে চলে যায়। বিস্ফোরণের গতি ছিল ঘণ্টায় ১ হাজার ৬০০ মাইল। অর্থাৎ, শব্দের গতির চেয়ে দ্বিগুণ গতি ছিল সেই বিস্ফোরণের। বিস্ফোরণের কারণে প্রায় ১০০ ফুট উঁচু (৩০ মিটার) সুনামি তৈরি হয়। সুনামির কারণে উপকূলবর্তী ১৬৫ গ্রাম বিলীন হয়ে যায়। ইন্দোনেশিয়ায় তখন ডাচদের উপনিবেশ। তাদের হিসাবেই ৩৬ হাজার ৪১৭ জন মারা যায়। তবে অন্যান্য হিসাবে তা লাখ ছাড়িয়ে যায়।

গত কয়েক শ বছরের মধ্যে অবশ্য ক্রাকাটোয়াই সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্ন্যুত্পাত নয়, ক্রাকাটোয়ার অগ্ন্যুত্পাত কুখ্যাত মূলত গগনবিদারি শব্দের কারণে। ইউরোপে মধ্যযুগে বিজ্ঞানের প্রসার হচ্ছিল। এই অগ্ন্যুত্পাত ঘিরে বিজ্ঞানী ও অভিযাত্রীদের তাই আগ্রহও ছিল বেশ। অনেক বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান হয়েছিল। সে সময় ব্রিটিশ জাহাজ নরহাম ক্যাসল ছিল ক্রাকাটোয়া থেকে মাত্র ৪০ মাইল দূরে। ক্যাপ্টেনের লেখা লগ থেকে জানা যায়, বিস্ফোরণের শব্দে জাহাজের অর্ধেকের বেশি নাবিকের কানের পর্দা ফেটে যায়। সে সময় ক্যাপ্টেনের কেবল তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর কথা মনে পড়ছিল। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন যে দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

ক্রাকাটোয়া থেকে ১০০ মাইল দূরে বাটাভিয়ায় একটি ব্যারোমিটার ছিল। সেই ব্যারোমিটারে পারদ-স্তম্ভের উচ্চতা লাফ দিয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে আড়াই ইঞ্চি ওপরে চলে যায়। এর মানে হলো, বিস্ফোরণে ১৭২ ডেসিবেলের চেয়ে বেশি শব্দ তৈরি হয়েছিল। ১৭২ ডেসিবেল মানে অকল্পনীয় জোরে শব্দ। ডেসিবেল মূলত লগারিদমিক স্কেল। মূল পরিমাপ গুণের নিয়মে বাড়লেও লগারিদমিক স্কেলে তা বাড়ে ধাপে ধাপে। একটি সাধারণ টেলিভিশনে কিংবা রুমের মধ্যে গান শুনলে তা ৭০ ডেসিবেলের মতো হবে। ৮০ ডেসিবেল মানে হলো, তা ৭০ ডেসিবেলের তুলনায় দ্বিগুণ জোরে, আর ৯০ ডেসিবেল চার গুণ জোরে। ১০০ ডেসিবেলের শব্দ ৭০ ডেসিবেলের তুলনায় আট গুণ জোরের।

মাথার ১০০ ফুট ওপর দিয়ে যদি কোনো হেলিকপ্টার উড়ে যায়, তাহলে তা থেকে ১০০ ডেসিবেলের শব্দ হবে। অন্যদিকে সংগীত কনসার্টে স্টেজের একদম কাছে যে শব্দ শোনা যায়, তা ১১০ ডেসিবেল, যা ৭০ ডেসিবেলের তুলনায় ষোলো গুণ জোরে! বিদ্যুচ্চমকের শব্দ হলো ১২০ ডেসিবেল। এই মাত্রা থেকে পীড়াদায়ক শব্দের শুরু। মাথার মাত্র ২৫ মিটার ওপর দিয়ে একটি জেট প্লেন উড়ে গেলে তা ১৫০ ডেসিবেল শব্দ তৈরি করবে। এর ফলে কানের পর্দা ফেটে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক, যদি বিশেষ শব্দনিরোধী ব্যবস্থা নেওয়া না হয়। ক্রাকাটোয়া আগ্নেয়গিরির ১০০ মাইল দূর থেকে যদি ১৭২ ডেসিবেল মাপা হয়, তাহলে বিস্ফোরণস্থলে যে শব্দ তৈরি হয়েছিল, তা চিন্তা করাও কঠিন। আমরা শব্দ বলতে যা বুঝি, সেটার ধারণাই পরিবর্তন করে দেয় এই আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ।

আপনি যখন গুনগুন করে মিহি সুর তোলেন, অথবা কোনো শব্দ উচ্চারণ করেন, তখন আসলে আপনি বাতাসের অণুগুলোকে সেকেন্ডে অজস্রবার সামনে-পেছনে আন্দোলিত করেন। কখনো শব্দের চাপ কমিয়ে, কখনো বাড়িয়ে দিচ্ছেন। শব্দ যত জোরে, এসব আন্দোলন ততই অস্থির, বায়ুচাপও ততটা তীব্র। কিন্তু শব্দ কতটা জোরালো হতে পারে তার একটা সীমা রয়েছে। একটা পর্যায়ে আন্দোলনের চাঞ্চল্য এতটাই বেশি হয় যে বাতাসের নিম্নচাপ অঞ্চলের চাপ শূন্য হয়ে পড়ে। তৈরি হয় শূন্যস্থান। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রায় ১৯৪ ডেসিবেল শব্দ তৈরি হলে এমনটা হয়। শব্দ তখন বাতাসকে নিজের সঙ্গে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে যায়। তৈরি হয় গতিশীল বাতাসে অতিচাপের বিস্ফোরণ। একে আমরা শক ওয়েভ বলে চিনি।

ক্রাকাটোয়ার চারপাশে বিস্ফোরণ এই শব্দসীমার বহু ওপরে ছিল। একটি বিস্ফোরণে তৈরি বায়ুচাপ কতটা শক্তিশালী হলে ৪০ মাইল দূরে থাকা নাবিকদের কানের পর্দা ফাটিয়ে দেয়, ভাবা যায়? এই শব্দ হাজার হাজার মাইল ভ্রমণ করে যখন অস্ট্রেলিয়া আর ভারত সাগরে চলে আসে, তখন বায়ুচাপ কমতে থাকে। তখন শব্দটা বহু দূরে বন্দুকের ভোঁতা শব্দের মতো শোনায়।

৩ হাজার মাইল ভ্রমণের পর তৈরি হওয়া বায়ুচাপ-তরঙ্গ মানুষের শ্রবণসীমানার নিচে চলে যায়। তবু তরঙ্গটি পৃথিবী ঘিরে ঘুরতে থাকে। বারবার। মানুষের কান সেটা বুঝতে না পারলেও মানুষের তৈরি অন্যান্য যন্ত্রে তা ধরা পড়ে। ১৮৮৩ সালের দিকে বিশ্বের বিভিন্ন নগরের আবহাওয়া দপ্তর ব্যারোমিটার দিয়ে বায়ুচাপের পরিবর্তনের হিসাব রাখত। ক্রাকাটোয়া বিস্ফোরণের ৬ ঘণ্টা ৪৭ মিনিট পর কলকাতায় বায়ুচাপ হঠাৎ ওপরে উঠে আবার স্বাভাবিক হয়। ১২ ঘণ্টা পর সেন্ট পিটার্সবার্গে বায়ুচাপের এই স্পন্দন ধরা পড়ে। ১৮ ঘণ্টা পর নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি ও টরন্টোতে তা ধরা পড়ে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, বিস্ফোরণের প্রায় পাঁচ দিন ধরে পৃথিবীর ৫০টির মতো শহরে বায়ুচাপের এই অদ্ভুতুড়ে স্পন্দন ধরা পড়ে। ঘড়ির কাঁটা ধরে প্রায় ৩৪ ঘণ্টা ব্যবধানে। মজার বিষয় হলো, শব্দ নিজস্ব গতিতে সারা পৃথিবীতে একবার চক্কর দিতে প্রায় ৩৪ ঘণ্টা সময় লাগে। বিভিন্ন উপকূলের জোয়ার-ভাটা পর্যবেক্ষণকেন্দ্রে বায়ুচাপের এই আচমকা স্পন্দনের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র-তরঙ্গের উচ্চতা বেড়ে গিয়েছিল। সব মিলিয়ে ক্রাকাটোয়া থেকে তৈরি বায়ুচাপ-তরঙ্গ পৃথিবীর চারপাশে চক্কর দিয়েছিল তিন থেকে চারবার। ক্রাকাটোয়ার বিস্ফোরণের শব্দ তাই প্রকৃতির অপরিসীম শক্তির বিস্ময়-জাগানিয়া বহিঃপ্রকাশ।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, রিভারসাইড, যুক্তরাষ্ট্র

সূত্র: নটিলাস ডট কম