বড় গাড়িতে ডিজেল, আর ছোট গাড়িতে পেট্রোল ব্যবহৃত হয় কেন

ছবি: লিংডিন

সাধারণত মোটরবাইক, কার, পিকআপ বা মাইক্রোবাসের মতো হালকা যানবাহন চলে গ্যাসোলিন, অর্থাৎ পেট্রোল বা অকটেনজাতীয় জ্বালানিতে। অন্যদিকে বাস, মালবাহী ট্রাক বা কৃষি কাজে ব্যবহৃত ট্রাক্টরের মতো ভারীযান চলে ডিজেলে। আকারভেদে যানবাহনে কেন দুই রকম জ্বালানি ব্যবহৃত হয়?

আসলে দুই ধরনের জ্বালানি ব্যবহারের মূল কারণ ইঞ্জিনের পার্থক্য। গ্যাসোলিন এবং ডিজেল ইঞ্জিনে শক্তির তারতম্য রয়েছে। দুই ইঞ্জিনের কাজ দুই রকম, তাই এ ভিন্নতা। অনেকে হয়তো গ্যাসোলিন শব্দটির সঙ্গে একটু কম পরিচিত। তাই বোঝার সুবিধার্থে এ লেখার বাকি অংশে গ্যাসোলিন ইঞ্জিনকে ‘পেট্রোল ইঞ্জিন’ বলব।

ডিজেল ও পেট্রোল ইঞ্জিন—দুটিই ‘ইন্টারনাল কম্বাশন’ বা অন্তর্দহন পদ্ধতিতে কাজ করে। ইন্টারনাল কম্বাশন (মূল ইংরেজি উচ্চারণ কম্বাশচন’) মূলত জ্বালানি পুড়িয়ে শক্তি তৈরির প্রক্রিয়া। এ পদ্ধতিতে প্রথমে ইঞ্জিনের ভেতরের একটি সিলিন্ডারে জ্বালানি তেল ও বাতাসের মিশ্রণ তৈরি হয়, যাতে জ্বালানি অক্সিজেনের সংস্পর্শে ভালোভাবে পুড়তে পারে। এরপর ওই মিশ্রণ অতিরিক্ত চাপে সংকুচিত করা হয়। ফলে তেল-বাতাসের মিশ্রণটি জ্বলে ওঠার মতো যথেষ্ট উত্তপ্ত হয়। মিশ্রণ পোড়া শুরু করলে উৎপন্ন হয় প্রচণ্ড তাপ। এ তাপের কারণে উচ্চ চাপের পরিবেশ তৈরি হয়, যা সিলিন্ডারের ভেতরের পিস্টনকে সজোরে ধাক্কা দেয়। পিস্টনের ক্রমান্বয়ে এই ওঠানামা কাজে লাগিয়ে গাড়ির চাকা ঘোরানো হয়।

জ্বালানি পুড়িয়ে তৈরি হওয়া অতিরিক্ত গ্যাস গাড়ির এক্সজস্ট পাইপ দিয়ে বেরিয়ে পরিবেশে মিশে যায়। এ গ্যাসের মধ্যে থাকে কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ও না পোড়া তেলের কণা। আমরা সবাই জানি, এসব গ্যাস ও আণবিক কণা পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

পেট্রোল ও ডিজেল—দুই ধরনের জ্বালানিই তৈরি হয় খনি থেকে তোলা অপরিশোধিত তেল থেকে। বলা বাহুল্য, এই অপরিশোধিত তেল তৈরি হয় জীবাশ্ম থেকে। এ কারণে এদের জীবাশ্ম জ্বালানিও বলা হয়। পেট্রোল এবং ডিজেলের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যও আলাদা। ফলে এদেরকে ভিন্ন ধরনের ইঞ্জিনে ব্যবহার করা হয়।

পেট্রোল ইঞ্জিনের ভেতর স্পার্ক প্লাগ নামে ছোট্ট একটা ডিভাইস থাকে। এর কাজ হলো সংকুচিত জ্বালানি-বাতাসের মিশ্রণে আগুন জ্বালানো। লাখের বেশি ভোল্টেজের বিভব পার্থক্যের সাহায্যে একটি বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ তৈরি করে স্পার্ক প্লাগ। অনেকটা পাথরে পাথর ঘষে তৈরি আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো। এটাই জ্বালানি তেল ও বাতাসের মিশ্রণকে পোড়াতে শুরু করে।

বড় গাড়ি ডিজেলে চলে
ছবি: লিংডিন

ওদিকে জ্বালানি হিসেবে ডিজেলে আগুন ধরানো তুলনামূলক কঠিন। পোড়েও পেট্রোলের চেয়ে ধীরে। মজার বিষয় হলো, উচ্চমাত্রায় সংকুচিত করা হলে স্ফুলিঙ্গ ছাড়াই নিজে থেকে জ্বলে উঠতে পারে ডিজেল। সংকোচনের হার বেশি হওয়ায় এর কার্যক্ষমতাও বেড়ে যায়। ফলে যে গাড়িগুলো ডিজেলে চলে, সেগুলো প্রতি লিটার জ্বালানিতে তুলনামূলক বেশি পথ যেতে পারে অথবা বেশি ভর বহন করতে পারে। মালামাল ও যাত্রী পরিবহন অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক করার ক্ষেত্রে এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাস, ট্রেন বা বড় ট্রাকের ইঞ্জিনে ডিজেল ব্যবহারের এটি অন্যতম কারণ।

পেট্রোল ইঞ্জিনের চেয়ে ডিজেল ইঞ্জিন অনেকটা ব্যয়বহুল। কারণ, এখানে উচ্চচাপ ও তাপ সামলানোর জন্য শক্তপোক্ত যন্ত্রাংশ ব্যবহার করতে হয়। দাম একটু বেশি হলে জিনিস ভালো হবে—এ সূত্র মেনে চলে ডিজেল ইঞ্জিন। পেট্রোল ইঞ্জিনের চেয়ে বেশি দিন কার্যক্ষম থাকে এগুলো। বড় যানবাহনের জন্য এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। দূরপাল্লার যাত্রায় ইঞ্জিন যাতে সহজে নষ্ট না হয়, সে জন্য। ফলে দীর্ঘসময় এসব যানবাহন চলে ঝামেলা ছাড়াই।

এখন প্রশ্ন হলো, ছোট যানবাহনে কেন পেট্রোল ব্যবহার করা হয়? এর একটা কারণ হলো, উচ্চ সংকোচন মাত্রা এবং উচ্চ তাপমাত্রার কারণে ডিজেল ইঞ্জিনগুলোর শব্দ অনেক বেশি হয়। বিশেষ করে উচ্চ কম্পাঙ্কের শব্দ তৈরি হয়, যা মানুষের জন্য বিরক্তিকর। তা ছাড়া ডিজেল ইঞ্জিন বেশি মাত্রার দূষিত গ্যাস উৎপাদন করে। এসব গ্যাসে থাকে অতি খুদে রাসায়নিক কণা, যেগুলোকে পিএম ২.৫ বলা হয়। মানবস্বাস্থ্যে নানা ধরনের ঝুঁকি তৈরি করে এসব কণা।

ছোট গাড়ি চলে পেট্রোলে

এসবের বিপরীতে পেট্রোল ইঞ্জিনের দিকে তাকালে দেখা যায়, এটা দামে সস্তা। আওয়াজ হয় কম। ফলে ব্যক্তিগত বা ছোট যানবাহনে মানুষের বিরক্তি আসে না। দৈনন্দিন কাজে অল্প দূরত্বে এবং মাঝেমধ্যে ভ্রমণের জন্য এ ধরনের ইঞ্জিন আদর্শ। এ জন্য ছোট বা ব্যক্তিগত যানবাহনে পেট্রোল ইঞ্জিন ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ, পুরো বিষয়টিই নির্ভর করছে ব্যবহারের ক্ষেত্র এবং উপযোগিতার ওপর।


লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: দ্য কনভারসেশন ও উইকিপিডিয়া