শূন্যস্থান থেকে ব্যারোমিটার

প্রকৃতি শূন্যতা পছন্দ করে না। তাই কোথাও শূন্যতা সৃষ্টির উপক্রম হলেই সে জায়গাটিকে বায়ু, পানি অথবা অন্য কোনো প্রাকৃতিক উপাদান দ্বারা ভরাট হয়ে যায়। প্রকৃতির নামে কী ভয়ংকর অপবাদ! অপবাদটা দিয়েছিলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি! আর এই ধারণার প্রবক্তা ছিলেন বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল। এটার মতো আরেকটি ভুল ধারণা ছিল, বায়ুর কোনো ভর নেই। কিন্তু একটি ভিত্তিহীন ধারণা নিয়ে আর কত দূর কী করা যায়? প্রকৃতিও আঙুল দিয়ে ভুল ধরিয়ে দেয়।

সে সময় ইতালির রাজপ্রাসাদে ৫০ ফুট গভীর একটি হস্তচালিত কুয়া স্থাপন করা। কিন্তু পানি তুলতে গিয়ে একটা সমস্যা দেখা দেয়। ৩৩ ফুটের বেশি কিছুতেই উঠছে না পানি। কী ঝামেলা! খবর পৌঁছাল গ্যালিলিওর কাছে। তিনি ব্যাখ্যা দিলেন, পানি ওপরে উঠছিল শূন্যস্থানের শক্তির জন্য। অর্থাৎ শূন্যস্থান পূরণের জন্য নিচ থেকে ছুটে আসছিল পানি। কিন্তু একসময় পানির পরিমাণ এত বেশি হয়ে যায়, শূন্যস্থানের শক্তি আর পানির সঙ্গে পেরে ওঠে না!

গ্যালিলিওর ব্যাখ্যা কানে যায় আরেক ইতালিয়ান বিজ্ঞানী গ্যাসপারো বের্তির। এটা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন তিনি। লম্বা (১০.৩ মিটারের বেশি) একটি কাচনল নেন বের্তি। নলটির এক মুখ বন্ধ। তিনি নলটির ভেতর পানি ঢাললেন। তারপর সেটিকে রাখলেন একটি পানিভর্তি পাত্রের মধ্যে। এমনভাবে রাখলেন যেন নলটি পাত্রের সঙ্গে লম্ব অবস্থায় থাকে। অর্থাৎ নলটির খোলা মুখ পানিভর্তি পাত্রের ওপর খাড়া ডুবিয়ে রাখা হয়। কিন্তু বন্ধ মুখটি ওপরের দিকে থাকে। এই পরীক্ষায় অত্যন্ত বিস্ময়কর একটি ফলাফল পান বের্তি। তিনি দেখলেন, পানি অভিকর্ষের টানে নিচের দিকে নেমে আসছে। এতটুকু পর্যন্ত সব স্বাভাবিক। কিন্তু হঠাৎ করেই ১০.৩ মিটার উচ্চতায় এসে পানির লেভেল স্থির হয়ে গেল। আর কাচনলের যে জায়গা থেকে পানি নেমে এসেছে, সেখানে শূন্যস্থানের মতো কিছু একটা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সেটা শূন্যস্থান কি না, সেটার নিশ্চয়তা ছিল না। পানির হঠাৎ এই অদ্ভুত আচরণের কারণ কী? বের্তি এ ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।

এরপর রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব ঘটল গ্যালিলিওর শিষ্য এবং সেকালের প্রখ্যাত গণিতজ্ঞ ও পদার্থবিদ ইভানজেলিস্তা টরিসেলির। তিনি বের্তির পরীক্ষাটি আবার করলেন। এ জন্য একই মাপের এক মুখবন্ধ একটা টিউব নিলেন। তবে তিনি পানির পরিবর্তে ব্যবহার করলেন পারদ। এরপর টিউবটিকে পারদভর্তি একটি পাত্রের মধ্যে উল্টো করে রাখলেন, যাতে টিউবের বন্ধ মুখটা ওপরের দিকে থাকে। আর সেই পরীক্ষায় ফল পেলেন একই রকম। পারদকেও পানির মতো পাগলামিতে ধরেছে! পারদভর্তি টিউবকে যখন উল্টো করে পারদভর্তি পাত্রে রাখা হলো তখন অভিকর্ষ বলের প্রভাবে পারদ নিচের দিকে নামতে থাকে। কিন্তু ৭৬ সেন্টিমিটারে এসে স্থির হয় যায়। পারদের ঘনত্ব পানির চেয়ে ১৩.৬ গুণ বেশি। আর পারদ ঠিক যে উচ্চতায় স্থির হয়েছে, সেটা পানির ১৩.৬ গুণ কম উচ্চতায়!

টরিসেলি এটাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলেন। পানি, পারদ ইত্যাদির এই যে নিচের দিকে নেমে আসার প্রবণতা, এটাকে নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করলেন। এরপর অ্যারিস্টটলের ভুল ধারণার বিরুদ্ধে একের পর এক বোমা ফাটালেন টরিসেলি। তিনি বললেন, বায়ুর ওজন আছে। আর তাই ভূপৃষ্ঠের ওপর বায়ুর চাপও আছে। বললেন বায়ু পারদভর্তি পাত্রের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। সেটা ভেতরে ওপর দিকে কাজ করে। অর্থাৎ বায়ুমণ্ডলীয় চাপ টিউবের পারদের ওপর ঊর্ধ্বমুখী বল প্রয়োগ করছে। আবার অভিকর্ষ বল একই পারদের ওপর নিম্নমুখী বল প্রয়োগ করছে। যখন এই বিপরীতমুখী বল দুটির মান সমান হয়ে যায়, তখন পারদ এক জায়গায় স্থির হয়ে যায়। না যেতে পারে ওপরে, না পারে নিচে। টরিসেলি বললেন, তাঁর পরীক্ষায় ৭৬ সেন্টিমিটার উচ্চতায় এই দুটি বল সমান হয়েছিল। ফলে পারদের লেভেল স্থির হয়ে গিয়েছিল।

তিনি আরও একটি কথা বলেছিলেন। ভূপৃষ্ঠ থেকে যত ওপরে যাওয়া হবে ততই বায়ুর পরিমাণ কমবে এবং বায়ুচাপও তত কমতে থাকবে। তখন বায়ু পারদের ওপর যে ঊর্ধ্বমুখী বল প্রয়োগ করবে তার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম হবে। তাই পারদের উচ্চতা তখন ৭৬ সেন্টিমিটারের চেয়ে কমে যাবে।

আর তার এই পরীক্ষা ও ব্যাখ্যার ফলে বায়ু ও শূন্যস্থান নিয়ে অনেক ভুল ধারণার অবসান হয়। তিনি দেখান, পারদভর্তি টিউবের শীর্ষবিন্দু আর পারদের উচ্চতার মধ্যবর্তী স্থানে শূন্যস্থানের সৃষ্টি হয়। পরে এই শূন্যস্থানের নাম দেওয়া হয় টরিসেলির শূন্যস্থান। যদিও পরে জানা যায় যে এই স্থানে পারদ বাষ্প জমা হয়। টরিসেলির এই এক্সপেরিমেন্টের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয় ব্যারোমিটার।

লেখক: নবম শ্রেণি, ফটিকছড়ি করোনেশন সরকারি মডেল উচ্চবিদ্যালয়, চট্টগ্রাম