কেমন আছেন, স্যার?
রেজাউর রহমান: শারীরিকভাবে আমি ৮০ পেরোলাম। বয়সের ধাক্কা তো আছে, সেটা আমাকে ছাড়েনি।
আপনি বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনে গবেষণা করেছেন প্রায় ৩৫ বছর। কীটতত্ত্বে পিএইচডি করেছেন চেক একাডেমি অব সায়েন্সেস থেকে। আপনার পিএইচডি, গবেষণার অভিজ্ঞতা সংক্ষেপে বলুন।
রেজাউর রহমান: আমি প্রথমে রাজশাহী সরকারি কলেজে প্রাণিবিদ্যার শিক্ষক হিসেবে যোগ দিই। ছয় মাস পর আমি পরমাণু শক্তি কমিশন থেকে চাকরির অফার পাই। এটা ছিল আমার বাসার কাছে। আর বাসায় থেকে কাজ করতে তো সুবিধা। তাই আমি চাকরি নিয়ে এখানে চলে আসি। দীর্ঘ ৩৫ বছর আমি এখানে কাজ করেছি।
এর মধ্যে ১৯৭৫ সালে আমি চেক একাডেমি অব সায়েন্সেস, প্রাগের বৃত্তি পাই। তখন সেই দেশে সমাজতন্ত্র চলছিল। ফলে অনেকে এই বৃত্তি নেননি। তাঁদের ধারণা ছিল, চেক প্রজাতন্ত্রে লেখাপড়া হয় না, শুধু যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া হয়। কিন্তু চেক একাডেমি অব সায়েন্সেস অত্যন্ত বিখ্যাত একটি প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে অনেক বড় বিজ্ঞানী বেরিয়েছেন, বিশেষ করে আমি যে বিষয়ে কাজ করতে চাচ্ছিলাম, সেই বিষয়ে। ওখানে গিয়ে আমি রেডিয়েশন বায়োলজি বিভাগে যোগ দিলাম। আমার গবেষণার বিষয় ছিল ‘রেডিয়েশন এফেক্টস অন ইনসেক্টস’। প্রফেসর ডক্টর ফ্রান্টিসেক সেহনাল বলে এক বিজ্ঞানীর তত্ত্বাবধানে আমি গবেষণা প্রোগ্রাম নিই। সেটা খুব ইন্টারেস্টিং একটা প্রোগ্রাম। নাম ইন্টারেকশনস অব হরমোন ইন ইনসেক্টস। একটা জুভেনাইল হরমোন—কীটপতঙ্গকে যৌবনের দিকে নিয়ে যায়, অন্যটা মোল্টিং হরমোন—কীটপতঙ্গের এক দশা থেকে অন্য দশায় রূপান্তরের (Metamorphosis) পেছনে কাজ করে। আমি প্রায় সাড়ে তিন বছর ওখানে কাজ করেছি সেই অধ্যাপকের অধীনে। এ ছাড়া আমি ফ্রান্সে, পোল্যান্ডে যেতাম বিভিন্ন সেমিনারে। সেমিনারে যোগ দিয়ে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমাকে পাঠানো হতো। তখন নতুন বিজ্ঞানী হিসেবে সাহস একটু কম পেতাম। তারপরও ভালোই বলতেন শ্রোতারা। এভাবে চার বছর পর, ১৯৭৯ সালে আমাকে সিএসসি (C.Sc, অর্থাৎ পিএইচডি) ডিগ্রি দেওয়া হয়।
তারপর দেশে ফিরে এলাম। আমার লক্ষ্য ছিল, গতানুগতিক গবেষণা না করে একাডেমিক কাজ করব। তখন গতানুগতিক গবেষণার খুব একটা সুযোগ-সুবিধা ছিল না এখানে। গামা রেডিয়েশন সোর্স ছিল অ্যাটমিক এনার্জি সেন্টার, ঢাকায়। তারপর চলে গেলাম সাভারে। ওখানে একটা নতুন ইনস্টিটিউট হলো—ফুড অ্যান্ড রেডিয়েশন বায়োলজি। শুরুতে এমনিতে একটা বিভাগ ছিল, পরে আমরা বড় করে ইনস্টিটিউটটা করলাম। সেখানে আমার লক্ষ্য ছিল, একাডেমিক পারসুয়েশন অব ফ্রুট ফ্লাই (বৈজ্ঞানিক নাম Ceratitis capitata); অর্থাৎ ফলের এই মাছি নিয়ে মৌলিক গবেষণা করা।
এই ফলের মাছি আমাদের দেশে মারাত্মক ক্ষতি করে। ইউএসডিএ (ইউনাইটেড স্টেট ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচার, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি মন্ত্রণালয়) ওরলান্ডোতে একবার কমলালেবুর ইন্ডাস্ট্রি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এর জন্য। তারা বাধ্য হয়ে মাছি দমনের জন্য এয়ারফোর্স ব্যবহার করেও ভালো ফল পায়নি। তারা আমাকে জানাল, ‘চেক একাডেমি অব সায়েন্সেসে তুমি যে কাজ করেছ, তেমনই কাজের জন্য আমাদের সাহায্য প্রয়োজন।’ তখন আমি আণবিক শক্তি সংস্থা, ভিয়েনায় স্কলারশিপ নিয়ে জানতে পারি—হাওয়াই থেকে যেসব কমলা আসে, ওগুলোতে ফলের মাছির লার্ভা (শিশু মাছি) পাওয়া যায়। ওগুলো ওরল্যান্ডাতে এসে সেখানকার ফলের, ফল ব্যবসায়ীদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করে।
এই ফ্রুট ফ্লাইয়ের কারণে ওদের এক বছরের পুরো ফসল নষ্ট হয়েছিল। এ জন্য ঢাকায় আসেন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির (IAEA) প্রতিনিধি থাইল্যান্ডের পাইসন রোহালানো নামের একজন। তিনি আমাকে তাঁদের সমস্যার কথা জানিয়ে সাহায্য চাইলেন। তিনি জানালেন, ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি, ভিয়েনায় একটা ল্যাব আছে। সেখানে থেকে দেখুন, আমাদের কিছু সাহায্য করতে পারেন কি না।’
আমি সেখানে যেতে রাজি হলাম। ওদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল হাওয়াই থেকে আসা ফলের শিপমেন্টে। ওরা বলত, রেডিয়েশন দিয়ে প্রিজার্ভ (সংরক্ষণ) করে দিয়েছে, কিন্তু আসলে তা করত না। না করেই পাঠিয়ে দিত। খরচ কমানোর জন্য ওরা এটা করত।
সাইবারডর্ফ ল্যাব—ভিয়েনা শহর থেকে ৩০ মাইল দূরে। সেখানে যেতাম প্রতিদিন। এই কাজ করতে গিয়ে আমার ঘুম উধাও হয়ে গেল ছয় মাসের জন্য। একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে এলাম এখানে। কাজটা হচ্ছে না, সময় লাগছে। তাই প্রথমটায় চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। তারপর আমি প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ইনস্টার লার্ভাকে গামা রশ্মি দিয়ে ভেতরে অ্যানাটমিক্যালি (গঠনগত) পরিবর্তন দেখার চেষ্টা করেছি—রেডিয়েশন ও নন-রেডিয়েশনে কোনো পার্থক্য পাওয়া যায় কি না। হাওয়াইয়ের ওরা তো বলত রেডিয়েশন দিয়ে পাঠায়, আসলে দিত না। আমি এটা ধরে ফেলি। আমি যখন ওদের এটা দেখালাম, তখন ওরা খুব আনন্দিত হলো। বলল, তাহলে তো ওই হাওয়াইয়ের লোকদের ধরতে হয়!
আসলে ৩ মিলির৵াড রেডিয়েশন দিলে লার্ভা যে স্টেজেই থাকুক না কেন, এর ব্রেনের আকার ছোট হয়ে যায়। এটা আমি ওদের করে দেখালাম। তখন ওরা খুব আনন্দিত। আমাকে বলল, ‘তুমি আরও কিছুকাল থেকে যাও।’ কিন্তু আমি তো সংসারী মানুষ। তাই থাকতে রাজি হইনি। আমি চলে আসি। ওদিকে আমার এই কাজ যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় জার্নাল অব ইকোনমিক এন্টোমোলজিতে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া ফ্রুট ফ্লাই পেস্টস (Fruit Fly Pests) নামের বড় আকারের পাঠ্যপুস্তকের শুরুতে আমার পেপারের উল্লেখ রয়েছে।
প্রথমবার যখন গেলাম, ওরা আমাকে ইন্ডাস্ট্রি পুরোটা দেখিয়েছে। কীভাবে কী করে বিস্তারিত আরকি। আমি ওখানে বক্তব্য দেওয়ার পর ব্রাজিলিয়ান এক বিজ্ঞানী বলেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ করলাম, এটা হয় না। নিউরোলজিক্যালি এটা সম্ভব নয়।’ তখন আমি তাঁকে বললাম, ‘তুমি আমাকে সাত দিন সময় দাও, আমি তোমাকে প্রমাণ করে দেখাব।’ ওরা আমাকে সাত দিন রাখল। আমি ওদের পাঁচ মিনিটে এই কাজ করার ও শনাক্ত করার পদ্ধতি দেখিয়ে দিলাম। ফলে ওরা আমাকে আর্থিক উপহারও দিয়েছিল। সে সময় এটা ছিল অনেক টাকা।
এরপর আমাকে যুক্তরাষ্ট্রের টেনপা অ্যাগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্ট নিয়ে গেল। সেখানে আমি হোটেল শেরাটনে ছিলাম। আমাকে সেখান থেকে টাকা দেওয়া হয়েছিল। এরপর ভাবলাম, দেশে এসে এই লাইনে আমি ছাত্র নেব। ফ্রুট ফ্লাইয়ের ওপর আমি তিনটি পিএইচডি করিয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তারা। তারাও এখন বৃদ্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু ওরাও জানত না যে দেশে ফ্রুট ফ্লাই আছে। তত দিনে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। এটার কাজ সম্ভবত এখনো আমাদের ল্যাবে হয়। এ সময় আমি একটা বুদ্ধি করলাম। দেখলাম, রেডিয়েশন দিয়ে আমরা এটা পারব না। ফলে আমরা শুধু থিসিস সমৃদ্ধ করার দিকে মনোযোগ দিলাম ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে।
আমি তখন আমাদের জন্য ক্ষতিকর পাঁচটি প্রজাতি বাছাই করলাম। সেগুলোর ওপরই কাজ শুরু করি।
তোমরা জানো, আমি অন্বেষা নামে একটা বিজ্ঞান পত্রিকা শুরু করেছিলাম ঢাকা সেন্টারে। পরপর এর ছয়টি সংখ্যা বেরিয়েছিল। আমি সাভার গবেষণাকেন্দ্রে চলে গেলে এটা বন্ধ হয়ে যায়।
পরমাণু শক্তি গবেষণা কেন্দ্রে কাজ করলেন, তখন তো দেখলেন ফ্রুট ফ্লাই এখানে করা সম্ভব নয়। এরপর আপনি আর কী নিয়ে কাজ করেছেন?
রেজাউর রহমান: এরপর আমি শিক্ষার্থী নিয়ে থিসিস গাইডে চলে গেলাম। সেটা ছিল মোল্টিং অ্যান্ড নিউরো হরমোনের একত্র কার্যকারণ। দুটি হরমোন—লার্ভাকে ফার্স্ট ইনস্টার, সেকেন্ড ইনস্টার, থার্ড ইনস্টার, ফোর্থ ইনস্টারের দিকে নিয়ে যায়। পরে পরিণত কীটপতঙ্গের রূপ নেয়।
আমাদের রেডিয়েশন সোর্স এবং অন্যান্য ইমপ্রুভ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এ ধরনের কাজ করা যায়। ধানের জেনেটিকস বদলে দেওয়া যায়। বিদেশে এ ধরনের কিছু কিছু কাজ হয়। ভারত এ ক্ষেত্রে অনেক গোছানো।
যাহোক, পোকামাকড় আমাদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তবে অন্য দেশে এগুলো সামাল দিতে পারলেও আমরা তা পারিনি। তবে আশা করি সম্মিলিত চেষ্টায় এতে আমরা সফল হতে পারব।
১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকাকালে আপনি লেখালেখি শুরু করেছেন। সে সময়ের লেখালেখির অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? সেই উত্তাল সময়ে কেন আপনি লিখতে শুরু করলেন?
রেজাউর রহমান: আমাদের সময় সব বই ছিল ইংরেজিতে, বিদেশি েলখকদের লেখা। সেগুলো পড়তে কষ্ট হতো। খটমট লাগত। তখন আমি আর আমাদের প্রফেসর মোশাররফ নামের এক ভদ্রলোক চিন্তা করলাম, এই কঠিন জিনিস কীভাবে সহজ করা যায়। তারপর আমরা কীটতত্ত্বের ওপর বাংলায় বই লিখতে থাকি। আমরা তখন জনপ্রিয় বিজ্ঞান নিয়েও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করতাম। পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে বিজ্ঞান ও গল্প লিখতাম। আমি ভালো পাঠক ছিলাম। অনেকের লেখা পড়ে মুগ্ধ হতাম। যেমন আমাদের ঢাকা কলেজের শিক্ষক ছিলেন শওকত ওসমান। তিনি বাংলার অধ্যাপক ছিলেন। আমি স্যারের পেছন পেছন ঘুরতাম। এরপর এল মুক্তিযুদ্ধ। তখন আমি কিছু লেখালেখি করেছি। স্যার (শওকত ওসমান) আমাকে ভালোবাসতেন। সে সময় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমিও একটা বই লিখেছিলাম—অন্ধকারে নয় মাস। প্রথম আলোর ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এরপর ধীরে ধীরে আবার বিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকে গেলাম।
আপনি যে বাংলায় বিজ্ঞানের বই লিখলেন, সেটায় কেমন সাড়া পেলেন?
রেজাউর রহমান: খুব অ্যাডভান্সড ছেলেমেয়েরা বাংলার দিকে গেল। অনেকে বাংলায় পড়ত ও পরীক্ষা দিত। কিন্তু এদের খাতা দেখবে কে? শিক্ষকেরা তো ইংরেজি ছাড়া খাতা দেখতে পারেন না। তাঁরা বাংলা বোঝেন না। কারণ, তাঁরা ইংরেজিতে পড়াশোনা করে অভ্যস্ত। বাংলা একাডেমি থেকে বন্য প্রাণী ছাড়া আর কোনো বিষয়ে তখনো বাংলায় বই লেখা হয়নি। পরে অবশ্য কিছু কিছু কাজ হয়েছে। পদার্থবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানের বই হয়েছে। তবে আমি মনে করি, এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। আমরা নিজেদের ভাষার চর্চা করতে পারিনি। এখনো একটা থিসিস বাংলায় হয় কি না, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। আমার জানামতে, আজ পর্যন্ত একটাও থিসিস বাংলায় হয়নি।
আপনি তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স করেছেন। সেই সময়ের কথা বলুন।
রেজাউর রহমান: তখন তো দেশে উত্তাল অবস্থা। ১৯৬৫ সালে আমি এন্টোমোলজিতে (কীটতত্ত্ব) অনার্স করি। আমরা আটজন ছিলাম, তার মধ্যে দুজন আবার ছিল পাকিস্তানি। আইয়ুব খান আমাদের মাসে ১৩ টাকা স্কলারশিপ দিত। আমিও তা পেতাম। কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে আমি এই স্কলারশিপ পেতাম। তখন একটা জুতার দাম ছিল ৩ টাকা। পরে ১৯৫৯ সালে আমি বিজ্ঞান বিষয়ে লেটারসহ ম্যাট্রিক পাস করি। এরপর দুই বছর কলেজ, চার বছর অনার্স। এমএসসিতে থাকাকালে আমার একটা বড় সুযোগ আসে। এশিয়াটিক সোসাইটি অব পাকিস্তানের অর্থায়নে পার্বত্য চট্টগ্রামে (বান্দরবান সাবডিভিশন) এক বিজ্ঞান অভিযাত্রা হয়। এর মূল নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক কাজী জাকির হোসেন (জীববিজ্ঞানী), প্রয়াত অধ্যাপক সালার খান (উদ্ভিদবিদ)। সেই দলে একমাত্র ছাত্র হিসেবে ছিলাম আমি। কারণ, আমি ভালো ছবি আঁকতে পারতাম। পাখির ছবি আঁকতাম।
ওই সময় রাজনৈতিক অবস্থা কেমন ছিল?
রেজাউর রহমান: এলোমেলো অবস্থা ছিল তখন। আমরা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কী করব। পাকিস্তানিরাও একটু ভয়ে ছিল। ভাষা আন্দোলনের পর ওরা একটু ভয় পেতে শুরু করে। ইউনিভার্সিটি তখন ছিল এখনকার মেডিকেল কলেজে। সেখানে রাজনৈতিক বক্তৃতা হতো, আমরা শুনতাম। মাঝেমধ্যে পুলিশ বাহিনী আবার আমাদের ঘেরাও করত। একদিন তো আর্মি আমাকে ধরে ফেলেছিল। ভয় দেখানোর জন্য কয়েকজনকে ধরে নিয়ে আবার পরদিন ছেড়ে দিত। আর তখন পরিস্থিতি এ রকম ছিল না। আমরা তখন সারা রাত জেগে পোস্টার লাগাতাম।
এগুলো করতে গিয়ে পড়ালেখায় প্রভাব পড়েনি?
রেজাউর রহমান: আমরা সক্রিয়ভাবে তেমন রাজনীতি করিনি। সারা দিন এ নিয়ে থাকতাম না। রাতে পোস্টার লাগাতাম, মিটিং করতাম। তখন কমিউনিস্ট পার্টি ছিল নিষিদ্ধ। মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন তখন আন্ডারগ্রাউন্ডের প্রধান নেতা। তাঁর সঙ্গে আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ হতো, যোগাযোগ ছিল। আমরা যে স্বাধীনতা পেয়ে যাব, এ নিয়ে তখনো আমরা কেউ নিশ্চিত নই। তখন পাকিস্তানি আর্মির প্রতি আমাদের বিদ্বেষ ছিল। জিন্নাহ, ভুট্টো এদের আমরা দেখতে পারতাম না। তারা এসে এখানে বক্তব্য দিত। আমাদের তো তেমন নেতা ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন জনতার নেতা হয়ে উঠলেন।
তখনকার শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা তুলনা করলে কী দেখতে পান?
রেজাউর রহমান: আমি দু-তিন বছর আগেও কিছু খাতা দেখেছি। কেউ কেউ বাংলায় উত্তর দেয়। কিন্তু আমরা কি উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তুলনা করে বলতে পারি যে আমরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছি? উন্নত বিশ্বে যে সুযোগ-সুবিধা, নিজস্ব আইডিয়া নিয়ে বড় হয়ে ওঠা, সেগুলো কি আমাদের শিক্ষার্থীরা পেত? স্বাধীন হয়েছি আমরা, এটা ছিল অনেক বড় জিনিস। কিন্তু আমরা তখনো এর জন্য অর্গানাইজড ছিলাম না।
আপনি দেশের নামকরা একজন বিজ্ঞানী। শৈশবে কখনো ভেবেছিলেন, বিজ্ঞানী হবেন বা বিজ্ঞানী হওয়ার পেছনে কোনো বিশেষ ঘটনা ছিল?
রেজাউর রহমান: আমাদের সময়ের বাবা-মায়ের সময় ছিল না এসব নিয়ে চিন্তা করার। ৯ সন্তানের বাবা-মা তাঁরা, কখন এসব চিন্তা করবেন?
বাবা ভাবতেন, আমি ডাক্তার হব আর আমার বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ার হবে। আমাদের টাকার অভাব হবে না। বড় হয়ে সে টাকা দান করে দেব। পড়াশোনা নিয়ে খুব চাপে ছিলাম তখন আমরা। নানা বাবাকে বলে আমাদের নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। আমি তখন ফোর থেকে ফাইভে, আর বড় ভাই সিক্স থেকে সেভেনে ফার্স্ট হয়ে উঠল। এভাবে আমাদের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। লেখাপড়ায় ভালো করতে থাকি। তবে যে ভবিষ্যতে বিজ্ঞানী হব, তা তেমন করে ভাবিনি।
আমি গণিত অলিম্পিয়াডে একটা পুরস্কার দিই ১০ হাজার টাকার। আমার মৃত বড় ভাইয়ের নামে। প্রয়াত লুৎফুর রহমান পদক। এ পর্যন্ত ৮ জনকে আমি এই পদক দিয়েছি। এর মধ্যে একটা মেয়ে সান ফ্রান্সিসকো ইউনিভার্সিটির মডার্ন সায়েন্স অব কম্পিউটারে শিক্ষক হয়েছে।
যা–ই হোক, এরপর আমরা লেটারসহ ম্যাট্রিক পাস করলাম। কপাল ভালো, তখন ডাক্তারিতে চান্স পাইনি। তখন একটাই কলেজ ছিল—ঢাকা মেডিকেল। তারপর এই রিলেটেড সাবজেক্টে পড়ার জন্য গেলাম জুওলজি ডিপার্টমেন্টে (প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগে)। সেই শুরু হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা। এর বাইরেও গুলিস্তানে ইন্ডিয়ান ইনফরমেশন নামে একটি লাইব্রেরি ছিল। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে বন্ধের দিন সেখানে যেতাম। সাহিত্য পড়তাম। তখন অনেক বই পড়েছি।
কখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে বিজ্ঞানী হবেন?
রেজাউর রহমান: চাকরি পাওয়ার পর। ঢাকার বাড়ি ফেলে রাজশাহী গেলাম। সেখানে সরকারি ডিগ্রি কলেজে চাকরি নিলাম। সেখানে থাকা-খাওয়ার খুব ঝামেলা। ভালো বন্দোবস্ত করতে পারিনি। সেখান থেকে আমার মন উঠে গেল। আমি খবর পেলাম, ঢাকার আণবিক শক্তি কমিশনে কিছু বিজ্ঞানী নেবে। সেই সুযোগে আমি ঢাকায় আণবিক শক্তি কমিশনে চাকরি পেয়ে যাই। সেখানে কাজ করতে গিয়ে বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন ভর করে। নতুন ইনস্টিটিউট, তবু আমি সীমিত আকারে গবেষণা করার সুযোগ করে নিয়েছিলাম।
কীটপতঙ্গ নিয়ে আপনার আগ্রহ কখন হলো?
রেজাউর রহমান: অনার্স পড়ার সময় এ বিষয়ে আমি আগ্রহী হয়ে উঠি। তখন কীটপতঙ্গ নিয়ে পড়াশোনা করলাম। জগৎটা বিশাল। কিন্তু এ বিষয়ে ওই রকম গবেষণা করার মতো বিজ্ঞানী এ দেশে তেমন নেই।
একটু আগে যে বিজ্ঞান অভিযাত্রার কথা বললেন, ১৯৬৫ সালের সেই অভিযান নিয়ে আপনি বিজ্ঞানচিন্তায় লিখেছেন। তবু আপনার মুখে শুনতে চাই। সেখানকার কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলুন, যেটা এখনো মনে আছে।
রেজাউর রহমান: আমরা আটটা পাড়া বা ট্রাইবে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে গিয়েছিলাম বান্দরবানে। একেকটা পাড়ায় গিয়ে রাত কাটাতাম। পরদিন আবার দুটি রুটি ও সেদ্ধ ডিম পকেটে নিয়ে হাঁটা দিতাম। সেই জীবন ছিল খুব কষ্টের, আনন্দেরও।
স্থানীয় অধিবাসীরা ভাত ও শুঁটকি খেত। ওরা ছিল রামু থানার কাছে। যাহোক, জাকির স্যার (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক কাজী জাকির হোসেন) ছিলেন পক্ষিবিশারদ। পাখি সংগ্রহ ও মারার জন্য একজন আমাদের সঙ্গে ছিল, একজন স্থানীয় সাবেক হাবিলদার। যে পাখি মারা হতো, আমি তার ছবি আঁকতাম। তারপর সেগুলো আমরা শুকিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসি। আমরা বার্মা (মিয়ানমার) বর্ডার পর্যন্ত গিয়েছি। সেখানে একটা লেক আছে। নাম রিংখিয়ার লেক। পানি থাকলেও সেই লেকে মাছ ছিল না। এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। অবশ্য আমাদের এ হিসাবে ভুলও হতে পারে। মাছ না থাকলেও হয়তো কাঁকড়া বা অন্য কোনো জলজ প্রাণী থাকতে পারে। এটা আমার মনে আছে। তবে একলা, অল্প সময়ে আমরা আর কতটাই-বা অনুসন্ধান করতে পেরেছি?
আপনার ঘটনাবহুল জীবন নিয়ে ভবিষ্যতে আত্মজীবনী লেখার ইচ্ছা আছে?
রেজাউর রহমান: আমার পক্ষে এখন তা লেখা কঠিন। স্মৃতিশক্তি বয়সের ভারে দুর্বল হয়ে গেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আমার ছোট মেয়ে আমাকে একটা ডায়েরি দিয়ে গেছে। সেটায় আমি একটা ভ্রমণকাহিনি লেখার চেষ্টা করছি। তবে কত দূর কী লিখতে পারব, তা জানি না। এটা ভবিষ্যৎ চিন্তায় রইল।
আপনি জীবনে অনেক কিছু করেছেন। গবেষণা, শিক্ষকতা, এক্সপিডিশন, লেখালেখি। এর মধ্যে কোন কাজটিকে সেরা মনে করেন?
রেজাউর রহমান: ফ্রুট ফ্লাই (ফলের মাছি) নিয়ে ওই গবেষণাকেই আমি নিজের সেরা কাজ হিসেবে দেখি। কারণ, পোকামাকড় দমন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো আমাদের খাদ্য নষ্ট করে, নানাভাবে ক্ষতি করে। তাই সংশ্লিষ্ট গবেষণা খুব দরকার। আমাদের মতো অনুন্নত দেশে এর যথেষ্ট প্রয়োজন ও সম্ভাবনা রয়েছে।
এমন কোনো বইয়ের কথা বলবেন, যেটা পড়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে বা আপনার জীবনে অনেক প্রভাব ফেলেছে?
রেজাউর রহমান: রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গীতবিতান।
বিজ্ঞানের শেষ কোথায়?
রেজাউর রহমান: আসলে বিজ্ঞানের তো কোনো গন্তব্য থাকার কথা নয়। এর কোনো শেষ নেই। একটার পর একটা সমস্যা আসবেই; বরং মানুষ কীভাবে শান্তিতে বাঁচতে পারে, এটা সমাধান করাই এখন বিজ্ঞানের কাজ। এটাই হওয়া উচিত বিজ্ঞানীদের প্রধান উদ্যোগ।
বিজ্ঞানচিন্তার বেশির ভাগ পাঠক কিশোর ও তরুণ। তাঁদের উদ্দেশে কিছু বলুন।
রেজাউর রহমান: তোমরা সত্যের সন্ধানে ঘুরে বেড়াও। সব জায়গায় সত্য আছে, তেমনি মিথ্যাও আছে। শুধু আমরা দেখতে পাই না। সত্য দেখার চোখ তৈরি করতে হবে। তাহলে দেখবে, যতটা চোখে দেখা যায়, জীবনটা তার চেয়েও বড়। দেখবে, অনেক মহৎ কাজের সুযোগ রয়েছে। আর তা আমাদেরই করার চেষ্টা করতে হবে।