‘পাগলামির কারণেই আমি বিজ্ঞানে চলে আসি’—দিদিয়ের কুইলোজ, নোবেল জয়ী পদার্থবিদ

২০১৯ সালে মহাবিশ্ব ও বহিঃসৌরগ্রহবিষয়ক যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য তিন বিজ্ঞানীকে যৌথভাবে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। এই তিন নোবেল জয়ী পদার্থবিদ হলেন কানাডিয়ান বিজ্ঞানী জেমস পেবলস এবং সুইডিশ পদার্থবিদ মাইকেল মায়োর ও দিদিয়ের কুইলোজ। মহাজাগতিক ইতিহাস, মহাবিশ্বের বিবর্তন এবং এতে পৃথিবীর স্থান কোথায়—এ সংশ্লিষ্ট গবেষণার জন্য পুরস্কার পান জেমস পেবলস। আর মাইকেল মায়োর ও দিদিয়ের কুইলোজকে প্রথম এক্সোপ্ল্যানেট বা বহিঃসৌরগ্রহ আবিষ্কারের জন্য পুরস্কৃত করা হয়।

২০২১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা ১৬ জন শিক্ষার্থীর মুখোমুখি হন বিজ্ঞানী দিদিয়ের কুইলোজ। সেই আড্ডার সংক্ষিপ্ত ও পরিমার্জিত রূপ প্রকাশিত হলো বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য। সাক্ষাৎকারটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জাহিদ হোসাইন খান

বিজ্ঞানী দিদিয়ের কুইলোজ

প্রশ্ন: বিজ্ঞানের প্রতি আপনার আগ্রহ তৈরি হলো কীভাবে?

দিদিয়ের কুইলোজ: বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ আমার রন্ধ্রেরন্ধ্রে লুকিয়ে আছে। আমি খুব আগ্রহী ছিলাম ছোটকাল থেকেই। সব সময় খুব কৌতূহলী ছিলাম। বেশ খানিকটা সৃজনশীলও ছিলাম। ছোটবেলায় খেলাধুলা করতে পছন্দ করতাম। পাশাপাশি বিভিন্ন জিনিস কীভাবে কাজ করে, তা বুঝতে খুব আগ্রহ হতো। যখন ছোট ছিলাম, তখন আমি বিভিন্ন জিনিসপত্র খুলে ফেলতাম। বোঝার চেষ্টা করতাম কোন জিনিস কীভাবে কাজ করে। ভাঙার পরে অবশ্য সে সব জিনিস আর ঠিক করতে পারতাম না। আমার মায়ের জন্য এটা ভালো কিছু ছিল না।

সে যাহোক, মনে হয় আমি জন্মগতভাবেই বিজ্ঞানী। আমি খুব কৌতূহলী ও গণিত বুঝতাম ভালো করে। এসব কারণে হয়তো স্বাভাবিকভাবেই আমার পদার্থবিজ্ঞানে আগ্রহ তৈরি হয়। বিজ্ঞানে আমি খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। এখানে এসে বুঝতে পারি, আমার এমন কাজই করা উচিত।

প্রশ্ন: আপনি বিজ্ঞানের কোন বিষয়টি পছন্দ করেন?

দিদিয়ের কুইলোজ: আমি সব সময় নিজেকে জিজ্ঞাসা করি, কোন ঘটনাটা কেন হয়? বা কে কীভাবে কাজ করে? আর কেনই-বা আমরা কিছু করছি বা করছি না? আমি এসব নিয়ে কৌতূহলী। এটা শুধু পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে নয়। মনস্তাত্ত্বিক বিষয় কিংবা সমাজের কাজ করার পদ্ধতি বা অর্থনৈতিকব্যবস্থা নিয়ে আমি কৌতুহলী। আমি মনে করি, আমার সব কিছু বড় আঙ্গিকে দেখার আগ্রহ ছিল। কিঞ্চিৎ পাগলামির মাধ্যমে সব সময় উত্তর খোঁজার চেষ্টা করতাম। যদিও খুব কমই উত্তর খুঁজে পেতাম।  তবে সত্যিই অনেক উত্তর খুঁজতাম। এটা আমার জন্য রোমাঞ্চকর এক মানসিক যাত্রা ছিল। পাগলামির কারণেই আমি বিজ্ঞানে চলে আসি।

নোবেল পুরস্কার গ্রহণের সময় দিদিয়ের কুইলোজ
নোবেল প্রাইজ ডটঅর্গ

প্রশ্ন: এমন কেউ ছিলেন, যিনি আপনার বেড়ে ওঠায় প্রভাবিত করেছেন?

দিদিয়ের কুইলোজ: নির্দিষ্টভাবে এমন কাউকে চিহ্নিত করা যাবে না। অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা ভূমিকা রেখেছেন। আমার পরিবার ভীষণ সহায়তা করেছে। পরিবারকে অপরিহার্য বলে মনে করি আমি। আপনি যদি পরিবারের চাপ আর হুমকির মধ্যে থাকেন, তবে কিছু করতে পারবেন না। চাপহীন মন প্রয়োজন কাজের জন্য। আমি সত্যিই যা চাইতাম, তা করতে পারতাম। এটা পেয়েছিলাম বলেই শুরুটা ভালো ছিল আমার। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের কিছু শিক্ষক ছিলেন। তখন ছিল সত্তরের দশক। এ সময়ে নতুন শিক্ষাপদ্ধতি চালু হয়। নতুন পিএইচডি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে মজার শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়। এসব আমার মধ্যে সৃজনশীলতা বিকাশে সাহায্য করেছে। আমার দারুণ কোনো পদার্থবিদ্যার শিক্ষকের কথা আলাদাভাবে মনে পড়ে না। যদিও আমার গণিতের শিক্ষকদের কথা খুব মনে আছে। আমি তাঁদের বেশ পছন্দ করতাম। তাঁদের কারণেই আমার গণিতে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। যে কারণে আমি পরে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়েছি।

আমি তখন বুঝতে পেরেছিলাম, এমন অনেক দুর্দান্ত বিষয় আছে, যেগুলোর কথা আমি জানি না। প্রচুর বই পড়তাম সে জন্য। কার্ল সাগানের মতো জনপ্রিয় লেখকদের বই পড়েছি। বই পড়ে আরও আগ্রহী হয়ে উঠি। এসব পড়ে আমার ভালো লাগত। খুব খুশি হতাম। এই সব মিলেই আমি পদার্থবিদ হয়েছি। এরপরে আমি জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে কাজ করতে আসি।

প্রশ্ন: শিক্ষার্থীদের আপনি কী পরামর্শ দেবেন?

দিদিয়ের কুইলোজ: শিক্ষার্থীদের উপদেশ দেওয়া সব সময় কঠিন।

আমি বিশেষভাবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমি এর নাম দিয়েছি ‘লাইট টাচ সুপারভিশন’, মানে একটু করে ছুঁয়ে দেওয়া। এর মানে হলো, শিক্ষার্থীরা যখন মানসিক চাপ অনুভব করে, তখন আপনাকে সব সময় পাশে থাকতে হবে। যুক্ত হতে হবে তাদের জীবনের সঙ্গে। যদিও উপায় খুঁজে বের করা শিক্ষার্থীদেরই কাজ। আমি পথ দেখাতে পারি, অন্য কোনো উপায় প্রস্তাব করতে পারি।

আমি শৈল্পিক ভাবনা প্রচারের চেষ্টা করি। শিক্ষার্থীরা যা করতে চাচ্ছে, তা তাদের নিজস্ব উপায়ে চেষ্টা করে দেখতে বলি। কিছুটা উত্তেজনা নিয়ে কাজের কথা বলি। বলি, সুপারভাইজারের কথা শুনবেন না। আপনি যা মনে করেন, তা-ই করুন। সেটা কঠোরভাবে অনুসরণ করুন। এ আচরণ কাজেরই অংশ। এতে নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। আপনি নিজে থেকেই অনেক কিছু করতে পারবেন। এতে আপনি নিজের কথা শুনতে পাবেন। আপনার জন্য কোন জিনিসটা সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত, তা বুঝতে পারবেন।

আমার কথা হলো, শিক্ষার্থী ও সুপারভাইজারের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক থাকতে হবে। শিক্ষার্থীদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি বিকশিত হওয়া উচিত। আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে ভয় পাওয়া যাবে না। প্রায়ই আমি আত্মবিশ্বাসের অভাব বোধ করি। আত্মবিশ্বাস আত্মসম্মান বাড়ায়। আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে কাজ করতে হবে। সুপারভাইজারের কথা খুব বেশি শোনার দরকার নেই, নিজের কথা শুনুন।

আমার কথা হলো, শিক্ষার্থী ও সুপারভাইজারের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক থাকতে হবে। শিক্ষার্থীদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি বিকশিত হওয়া উচিত। আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে ভয় পাওয়া যাবে না
—দিদিয়ের কুইলোজ, নোবেল জয়ী পদার্থবিদ

প্রশ্ন: শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কি আপনি কিছু শিখেছেন? তারা কি আপনাকে কিছু শেখায়?

দিদিয়ের কুইলোজ: হ্যাঁ, শেখায়। এ কারণেই আমি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাজ করতে ভালোবাসি। প্রতিদিনই তারা আমাকে কিছু না কিছু শেখায়। তাদের মস্তিষ্ক আমার চেয়ে অনেক বেশি সতেজ। তারা নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে কাজ করে। কখনো কখনো একেবারে নতুন আইডিয়া বা ধারণা নিয়ে আসে। আমি বেশ পুরোনো মানুষ। অনেক কিছু আমি ওদের চেয়ে বেশি জানি—সৃজনশীল হতে চাইলে এমন মনোভাব অবশ্যই খারাপ। বরং ওদের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে হবে। শিক্ষার্থীরা অনেক জোরেশোরে কাজ করে। প্রচণ্ড শক্তি তাদের। এটা খুব বিস্ময়কর। আমি শিক্ষার্থী—পিএইচডি গবেষকদের সঙ্গে কাজ করতে পছন্দ করি। দল বেঁধে কাজ করতে পছন্দ করি। আমি মনে করি, এটা আমার জন্য সত্যিই আনন্দের।

প্রশ্ন: আপনি তো আপনার পিএইচডি গবেষণার জন্যই নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। অন্যরা কীভাবে আপনাকে অনুসরণ করতে পারেন?

দিদিয়ের কুইলোজ: আমি পিএইচডি শিক্ষার্থী ছিলাম, এটা সত্যি। কিন্তু যেকোনো আবিষ্কারই আসলে ভাগ্যের ব্যাপার। জুয়া খেলার মতো। আমরা ভাগ্যবান ছিলাম। পিছিয়েও যেতে পারতাম। অন্যরা আমাদের আগে এ আবিষ্কার করে ফেলতে পারত। আমরা ভাগ্যবান ছিলাম বলে কাজ ঠিকঠাক করেছিলাম। পিএইচডি গবেষণার সময় আমি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জেনেছি। গবেষণা একধরনের টিমওয়ার্ক—দলীয় কাজ। আর কাজ করার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। আপনি যা করতে চান, তা-ই করুন।

আমি যখন কাজ করছিলাম, তখন আসলে নোবেল পুরস্কারের কথা ভাবিনি। শুধু ভেবেছিলাম, কাজটা দুর্দান্ত! নতুন কিছু করছি। মানুষের জানার পরিধিকে সামনে এগিয়ে নিচ্ছি। এ আবিষ্কার নিয়ে আমরা ভীষণ উত্তেজিত ছিলাম। এ ধরনের কাজ আমি ভালোবাসি। মানে, যা করছিলাম, তা ভালোবেসেই করেছি। কখনো ভাবিনি, এর ওপর ভিত্তি করে ক্যারিয়ার গড়ব, নোবেল পুরস্কার পাব। আমি মনে করি, আপনি যদি পিএইচডি গবেষক হন বা নবীন বিজ্ঞানী, তাহলে কোনো বাধাই আসলে সমস্যা না। কী নিয়ে কাজ করছেন, সেটাও বিশেষ কোনো ব্যাপার না। নিজের ওপর বিশ্বাস রেখে কাজ করুন। কাজের সময় উপভোগ করার চেষ্টা করুন। এই তো।

দিদিয়ের কুইলোজ (বাঁয়ে) ও মাইকেল মায়োর (ডানে)

কেন নোবেল পেয়েছিলেন দিদিয়ের কুইলোজ? বিস্তারিত পড়ুন:

প্রশ্ন: তরুণদের কেন বিজ্ঞানে আসা উচিত?

দিদিয়ের কুইলোজ: আমি মনে করি, মানুষের প্রশ্ন নিয়ে আগ্রহ আছে, তারা যুক্তি পছন্দ করে। আপনি যদি যৌক্তিক চিন্তাভাবনা ও গণিত নিয়ে আগ্রহী হন, তাহলে বিজ্ঞানের দুনিয়ায় আসতে পারেন। তবে সবার এমন আগ্রহ থাকে না।

বিজ্ঞান সমাজের জন্য অপরিহার্য। সবখানেই বিজ্ঞান বিরাজমান। এমন এক সমাজে আমরা বাস করছি, যার পেছনে বিজ্ঞানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। নিত্যদিনের সব প্রযুক্তিই বিজ্ঞানের ফলাফল, বিজ্ঞানের হাত ধরে এসেছে। আপনার মোবাইল ফোনটাও বিজ্ঞানে পরিপূর্ণ। আমি মনে করি, আমাদের বিজ্ঞানীদের প্রয়োজন আছে। আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সরকারের পলিসি বা নীতি তৈরির জন্য বিজ্ঞানী। আপনি সংসদ দেখেন, সরকারের দিকে তাকান, সেখানে বিজ্ঞানীর অভাব রয়েছে। আমি সত্যিই সবাইকে বিজ্ঞানে আসতে উৎসাহ দিই। যদি কোনো বিজ্ঞানী প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি বা সংসদ সদস্য হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, আমি ভীষণ উৎসাহ দিই। সমাজের ভারসাম্য বজায় রাখতে আমাদের বিজ্ঞানীদের সেখানে যাওয়া প্রয়োজন। সত্যিই এটা আমাদের দরকার।

আপনি যদি নারী হন, কারো কথা শুনে বা কোনো কিছু দেখে ভুলেও ভাববেন না, বিজ্ঞান আপনার জন্য নয়। এটা ভুল ধারণা। বিজ্ঞান সবার জন্য। আমাদের যেমন পুরুষ বিজ্ঞানী প্রয়োজন, তেমনি নারী বিজ্ঞানীও প্রয়োজন। আপনাদের প্রয়োজন। আমরা এই মুহূর্তে বিজ্ঞান জগতে নারীদের উপস্থিতি কম দেখছি। বিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহী নারীরা এখানে অনুপস্থিত। সামাজিক ও পারিবারিক চাপের জন্যই হয়তো, তাঁরা বিজ্ঞানে আসছেন না। এটা বড় ধরনের বিপর্যয় বটে। আমি মনে করি, নারীদের বিজ্ঞানে আসা উচিত। কারণ, বিজ্ঞানে বৈচিত্র্য গুরুত্বপূর্ণ।

বিজ্ঞান বিশেষ একধরনের ভ্রমণ। বিজ্ঞান ভ্রমণের স্বাধীনতা দেয়, মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেয়। বিশ্বসেরা মানুষ তৈরি করে। বিজ্ঞানের দুনিয়ায় বৈচিত্র্য না থাকলে আমরা নিজেদের সক্ষমতা হারাব। এর মানে, আমরা মানুষ হারাচ্ছি, বুদ্ধি হারাচ্ছি।

বায়ুমণ্ডল আসলে কী? আমরা ঠিক কোন ধরনের গ্রহের কথা বলছি? সেখানে কি প্লেট টেকটোনিকস বা মহাদেশীয় পাত আছে? চৌম্বকক্ষেত্র আছে কি না—এসব জানার চেষ্টা করছি। প্রাণের রসায়নের সূচনা করতে এসব প্রয়োজন

প্রশ্ন: মহাবিশ্বের অন্য কোথাও কি জীবন আছে? আপনার কী মনে হয়? থাকলে, সেই জীবন খুঁজে পেতে কত সময় লাগবে বলে মনে করেন?

দিদিয়ের কুইলোজ: অনেক গ্রহ আছে, যেখানে জীবনের প্রশ্ন অনেকটাই স্পষ্ট। এটাই আসলে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ। আমি নিশ্চিত, অন্য কোথাও না কোথাও জীবন অবশ্যই আছে। আমি বিশ্বাস করতে চাই না যে জীবন মহাবিশ্বে অনন্য কোনো বিষয়। অনেক তারা আছে, অনেক গ্রহ আছে—এটুকু তো পরিষ্কার। এখনো ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না, জীবনের উপাদান হিসাবে কী কী প্রয়োজন। আর, জীবন তো আসলে একধরনের রসায়ন। জীবন জটিলভাবে বদলে যায় কালের আবর্তে। এখন প্রশ্ন হলো, এ জন্য কী দরকার আমাদের?

আমরা পৃথিবীতে বসে ল্যাবে এসব দেখতে পারি। মঙ্গল গ্রহ, শুক্র ও এনসেলাডাস চাঁদেও পরীক্ষা করে দেখতে পারি, জীবন আছে কি না। সৌরজগতের আরও কয়েকটি উপগ্রহ আছে, যেগুলো এভাবে দেখা যায়। তারপরে অন্য গ্রহ দেখার চেষ্টা করা যায়। আমরা আসলে কী দেখব, সেই প্রশ্নটি খুব স্পষ্ট নয়। এটা একটা সমস্যা। তবে ধারণা করা যায়, কোনো এক সময়ে অন্য গ্রহের ভূ-পদার্থবিদ্যা আমাদের জীবন আছে কি না, সে সম্পর্কে ধারণা দেবে। সেটা যেরকম জীবনই হোক। তবে এটা একটা দীর্ঘ পথ। দীর্ঘ পথ, কারণ আমরা সৌরজগতে জীবনের উৎস সম্পর্কে জানি না। এ বিষয়ে আমি অনেক সময় ব্যয় করেছি। আমি একটি কাজ শুরু করেছি কয়েক বছর আগে। তখন এটাই ছিল আমার প্রধান ফোকাস। আমি যখন কেমব্রিজে চলে আসি, তখন নতুন ভাবনা নিয়ে কাজ শুরু করি। বেশ অগ্রগতি এসেছে বলা যায়। আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে, শুধু জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যা থেকে এ ধারণা আসছে না। নক্ষত্র বা মহাকাশ নিয়ে কাজ করেন না, এমন অনেকেও যুক্ত আছেন আমাদের সঙ্গে। এই গবেষকেরা ল্যাবে বিভিন্ন অণু নিয়ে কাজ করছেন, যাকে আণবিক জীববিজ্ঞান বলে।

আণবিক জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনের বিকাশ নিয়ে অনেক কিছু জানা গেছে। জীবনের উপাদান, মৌলিক একক, কোনটা সহজতম একক আর আপনি কীভাবে তা তৈরি করবেন, জানা গেছে সেসব। জীবনের শর্ত কী? সেই শর্ত বুঝে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ধারণা প্রদান করতে পারেন। আমরা সেরকম একটা ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করছি। যেমন বায়ুমণ্ডল আসলে কী? আমরা ঠিক কোন ধরনের গ্রহের কথা বলছি? সেখানে কি প্লেট টেকটোনিকস বা মহাদেশীয় পাত আছে? চৌম্বকক্ষেত্র আছে কি না—এসব জানার চেষ্টা করছি। প্রাণের রসায়নের সূচনা করতে এসব প্রয়োজন। কিন্তু রসায়ন ঠিক রাখতে এসব প্রভাবকের ভূমিকা কী? বুঝতেই পারছেন, আমি একটা নতুন ক্ষেত্র নিয়ে কথা বলছি। বিভিন্ন গবেষণাক্ষেত্রের মধ্যে সীমানা রয়েছে। সেই সীমা ভেঙে একসঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রকে। এটাই আমার পরবর্তী বড় লক্ষ্য। আমি দাবি করছি না যে আমরা উত্তর খুঁজে পাব। এসব তো অনেক বড় প্রশ্ন। আমি অবশ্যই চেষ্টা করব। এসব নিয়েই তো কাজ করছি।

আমরা এই মুহূর্তে আরেকটি পৃথিবী খুঁজে পাচ্ছি না। এ ক্ষেত্রে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমরা আসলে সঠিক সরঞ্জাম স্থাপন করতে পারিনি। আমরা জানি, কাজগুলো কীভাবে করতে হয়। এখন আমাদের শুধু বাস্তবায়ন করতে হবে। আমি টেরা হান্টিং নামে একটি আন্তর্জাতিক প্রোগ্রাম তৈরি করেছি। বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন যন্ত্রপাতি তৈরি করা হচ্ছে। আমরা এ ধরনের গ্রহ অনুসন্ধান করছি। একটা টেলিস্কোপ বর্তমানে এ কাজ করে। ভবিষ্যতে আরও কাজ হবে। বিভিন্ন গ্রহের বায়ুমণ্ডল বিশ্লেষণ করার জন্য আমাদের সরঞ্জাম তৈরি করতে হবে। নতুন ধরনের মহাকাশ-সরঞ্জাম তৈরি করতে হবে। অনেকেই এ বিষয়ে কথা বলছেন। আমারও এসব নিয়েই কাজ। এই বিষয়ে তরুণদের একত্রিত করার চেষ্টা করছি। আশা করি, আমার নোবেল পুরস্কার জয় নতুন এসব ধারণাকে উদ্দীপিত করার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।

আগামীতে এসব যন্ত্র তৈরি হবে বলে সবাই বিশ্বাস করেন। তবে বাস্তবায়ন করা কিছুটা কঠিন। আমরা বিজ্ঞানের একটি নতুন ক্ষেত্র তৈরি করছি। এটা ঠিক সাধারণ ভাবনা না। সাধারণ কাজ করতে যান, দেখবেন সব বেশ সহজ। কিন্তু আপনি যখন সত্যিকার অর্থে নতুন কিছু করতে যাবেন, তখন সেটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। যেমন জীবন নিয়ে প্রশ্ন করা—কোথাও না কোথাও হয়তো জীবন থাকতে পারে। কিন্তু এটা খুঁজে বের করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। পৃথিবীর জীবন নিয়ে আমরা ইতিমধ্যেই অনেক দূর অগ্রসর হয়েছি। তাই আমার ধারণা, আগামী ৫০ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে পৃথিবীতে থাকা জীবন বা ভিন্ন ধরনের জীবন, অর্থাৎ অন্য ধরনের রসায়নের কোনো জীবনের হয়তো সন্ধান পাব আমরা।

অনুবাদক: সাংবাদিক

সূত্র: নোবেল প্রাইজ ডটঅর্গ