সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে অনেক বৈজ্ঞানিক ধারণা। পদার্থবিজ্ঞানে সবচেয়ে বেশি বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে যাঁর হাত দিয়ে, তাঁর নাম আইজ্যাক নিউটন। আলবার্ট আইনস্টাইন নিউটন সম্পর্কে বলেছিলেন, প্রকৃতি তাঁর হাতে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছে। প্রকৃতির রহস্য নিউটনের মতো করে আর কেউ এতটা উন্মোচন করতে পারেননি। নিউটনের হাত দিয়েই আমরা পেয়েছি আলো এবং বর্ণের সম্পর্ক, মহাকর্ষ বলের গাণিতিক সূত্র ও গতির সূত্র। জ্যোতির্বিজ্ঞানে নিউটনের গতিবিদ্যা প্রয়োগ করার পর বিগত কয়েক হাজার বছরের চেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই। গণিতের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শাখা ক্যালকুলাসের উৎপত্তি ও বিকাশের অন্যতম নায়ক ছিলেন আইজ্যাক নিউটন। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সর্বকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনাগুলোর একটি নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা, যেখান থেকে আমরা পেয়েছি চিরায়ত বলবিজ্ঞান (যাকে আমরা নিউটনীয় বলবিজ্ঞান বলি), গ্রহ-নক্ষত্রগুলোর মধ্যে মহাকর্ষ বলের সূত্র এবং মহাবিশ্বের গতির গাণিতিক অবকাঠামো।
আইজ্যাক নিউটনের জন্ম ১৬৪২ সালের ক্রিসমাসের দিন, অর্থাৎ ২৫ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের লিংকনশায়ার থেকে সাত মাইল দক্ষিণে কোলসটারওয়ার্থ গ্রামের ‘উলসথর্প’ নামের এক বিশাল ফার্ম হাউসে। সেই সময় ইউরোপের সব জায়গায় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু হয়ে গেলেও ইংল্যান্ডে ১৭০০ সাল পর্যন্ত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু হয়নি। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের তারিখ থেকে ১০ দিন পিছিয়ে ছিল ইংল্যান্ডের জুলিয়ান ক্যালেন্ডার। সে হিসাবে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নিউটনের জন্মতারিখ হয় ৪ জানুয়ারি ১৬৪৩। তারিখের হিসাবে এই গন্ডগোল অবশ্য নিউটনের জীবনে কোনো প্রভাব ফেলেনি।
কেমব্রিজ থেকে প্রায় ৬০ মাইল উত্তর-পশ্চিমের গ্রামটি তুলনামূলকভাবে নতুন। নিউটনের পূর্বপুরুষেরা এখানে এসেছিলেন ১৫০০ সালের দিকে। ‘নিউটন’ তখন কোনো নির্দিষ্ট পরিবারের পদবি ছিল না। ইংল্যান্ডের বিভিন্ন জায়গায় নতুন শহরের গোড়াপত্তন হচ্ছিল সেই সময়। নতুন শহরে এসে অনেকেই তখন ‘নিউটন’ পদবি গ্রহণ করেছিলেন। নিউটাউন থেকে নিউটন শব্দটির উৎপত্তি।
নিউটনের দাদা রবার্ট নিউটন জন্মেছিলেন আনুমানিক ১৫৭০ সালে। উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি কিছু কৃষিজমির মালিক হয়েছিলেন। ১৬০৬ সালে রবার্ট নিউটনের ছেলে আইজ্যাক নিউটনের জন্ম হয়। পরিবারে তখনো লেখাপড়ার কোনো চল ছিল না। পিতা-পুত্র দুজনই নিরক্ষর। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে রবার্ট ক্রমে আরও অনেক জমির মালিক হন এবং ১৬২৩ সালে উলসথর্পের ‘লর্ড অব দ্য ম্যানর’ হয়ে গেলেন। জমিজমাসহ বিশাল বাড়ির মালিক এবং লর্ড হয়ে নিউটন পরিবারের অর্থনৈতিক সম্মান অনেক বেড়ে গেল। এবার রবার্ট নিউটন ঠিক করলেন, শিক্ষিত ভদ্রলোকের পরিবারে ছেলের বিয়ে দিয়ে পরিবারের সামাজিক সম্মান বাড়াবেন। ১৬৩৯ সালে জেমস আয়াসকফের কন্যা হ্যানা আয়াসকফের সঙ্গে আইজ্যাক নিউটনের বাগদান সম্পন্ন হয়। কিন্তু রবার্ট নিউটনের শরীর ভালো যাচ্ছিল না বলে বিয়ে পিছিয়ে দিতে হয়। ১৬৪১ সালে রবার্ট মারা যান। তার মাস ছয়েক পর ১৬৪২ সালের শুরুর দিকে হ্যানা ও আইজ্যাকের বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের ছয়-সাত মাস পরেই হঠাৎ মৃত্যু হয় আইজ্যাক নিউটনের। হ্যানা তখন সন্তানসম্ভবা। ১৬৪২ সালের ২৫ ডিসেম্বর হ্যানা খুব রোগা এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। এই সন্তান তাঁর বাবাকে কোনো দিন দেখেননি। বাবার নাম অনুসারেই তাঁর নাম রাখা হয় আইজ্যাক নিউটন।
সময় হওয়ার আগেই জন্ম নেওয়া রুগ্ণ শিশুটিকে অনেক যত্নে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনেন হ্যানা। কিন্তু তিনি খুবই বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন। তিনি জানেন, এত বড় ফার্ম তিনি একা সামলাতে পারবেন না। সব দেখাশোনা করার জন্য শক্ত অভিভাবক দরকার। ১৬৪৫ সালে হ্যানা ৬৩ বছর বয়সী প্রভাবশালী রেভারেন্ড বারনাবাস স্মিথকে বিয়ে করে নর্থ উইথামে চলে যান।
হ্যানা তাঁর তিন বছর বয়সী শিশু আইজ্যাক নিউটনকে রেখে যান তাঁর বাবা–মায়ের কাছে। নানা-নানির কাছে আদরযত্নের অভাব না থাকলেও মাতৃস্নেহের অভাবে এবং সৎবাবার প্রতি আক্রোশে খুবই বদরাগী শিশু হিসেবে বড় হতে থাকেন আইজ্যাক। তাঁর কোনো বন্ধু ছিল না। একা একা বড় হতে থাকেন তিনি।
হ্যানার ভাই উইলিয়াম কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছিলেন। তাঁদের পরিবার শিক্ষিত। আইজ্যাক নিউটনকে লেখাপড়া শেখানোর ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু তা–ও বেশ দেরিতে। ১২ বছর বয়সে নিউটনকে বাড়ি থেকে সাত মাইল দূরে গ্রান্থাম গ্রামের কিং স্কুলে ভর্তি করানো হয়। ক্লার্ক নামের একজন ফার্মাসিস্টের বাড়িতে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করা হলো। অনেকটা যন্ত্রের মতো সেখানে বাস করেন নিউটন। স্কুলেও তাঁর কোনো বন্ধু হয়নি। তিনি কারও সঙ্গেই মেশেন না। লেখাপড়া নিজে নিজেই করেন। হাতের কাজে বেশ দক্ষতা অর্জন করে ফেলেছেন ইতিমধ্যে।
এদিকে ১৬৫৬ সালে নিউটনের মায়ের দ্বিতীয় স্বামীর মৃত্যু হয়। দুটি কন্যা ও একটি পুত্রসন্তান নিয়ে নিউটনের বাবার ফার্মেই ফিরে আসেন হ্যানা। দ্বিতীয় স্বামীর বিষয়সম্পত্তির মালিকও হন তিনি। ফার্ম আরও বড় হয়। তাঁর মনে হলো, বড় ছেলে নিউটনকে নিজের কাছে এনে ফার্মের কাজে লাগিয়ে দেবেন। ১৬৫৮ সালে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিউটনকে ফার্মে নিয়ে আসেন তিনি। নিউটন ফার্মের কোনো কাজই ঠিকমতো করতে পারেন না। মায়ের কাছে এলেও মায়ের প্রতি কোনো টান অনুভব করা তো দূরের কথা, বরং আক্রোশে জ্বলতে থাকেন তিনি। মামার পরামর্শে নিউটনকে আবার স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে থেকে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য তৈরি হতে থাকেন।
১৬৬১ সালে ১৯ বছর বয়সে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন নিউটন। তাঁর সহপাঠীরা সবাই বয়সে তাঁর চেয়ে তিন–চার বছরের ছোট। ট্রিনিটি কলেজের বেতন আর হোস্টেলের ফি মেটানোর জন্য নিউটনকে একটা অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ দেওয়া হয়। তার বদলে তাঁকে সিনিয়র ছাত্রদের ফাইফরমাশ খাটতে হতো। স্কলারশিপ পেলে এ ধরনের কোনো কাজ করতে হয় না। নিউটন চেষ্টা করলেন ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষায় ভালো করে সেকেন্ড ইয়ারে একটা স্কলারশিপ জোগাড় করার। কিন্তু তিনি সিলেবাসের পড়াশোনা বাদ দিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো পড়াশোনা করছিলেন। সে সময় ইউরোপের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও আর কেপলারের নতুন তত্ত্বগুলো পড়ানো শুরু হয়ে গেলেও কেমব্রিজের পড়াশোনা তখনো অ্যারিস্টটলের পৃথিবীকেন্দ্রিক পদার্থবিজ্ঞানেই সীমাবদ্ধ রয়ে গিয়েছিল। নিউটন নিজে নিজে নতুন তত্ত্বগুলো পড়তে শুরু করেছিলেন। ফলে ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষায় জ্যামিতিতে ফেল করলেন। তখন কেমব্রিজের শিক্ষকেরা ভাবতেও পারেননি, জ্যামিতিতে ফেল করা এই ছেলেটাই কয়েক বছরের মধ্যে মহাবিশ্বের নতুন জ্যামিতি সৃষ্টি করবেন।
২
১৬৬৫ সালে ইংল্যান্ডে বুবোনিক প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। প্রায় ৭৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় প্লেগে। স্কুল-কলেজ সব বন্ধ হয়ে যায় দুই বছরের জন্য। ১৬৬৫-৬৬—এই দুই বছর নিউটন তাঁদের উলসথর্পের ফার্মে কাটান। এই দুই বছরের নিভৃতবাসের সময় তিনি আবিষ্কার করেন তাঁর যুগান্তকারী সূত্রগুলো। তিনি আবিষ্কার করেন ক্যালকুলাস, আলোর প্রকৃতি, মহাকর্ষ সূত্র। গ্যালিলিও এবং কেপলারের প্রকাশিত গবেষণার ওপর বিস্তারিত কাজ করেন তিনি। এই দুই বছরে তিনি যত কিছু আবিষ্কার করেছেন, সেগুলোই পরবর্তী ২০০ বছর ধরে নির্ভুলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের পাঠে এবং গবেষণায়। কিন্তু এসব আবিষ্কারের কথা অপ্রকাশিতই ছিল পরবর্তী ২২ বছর। ১৬৮৭ সালে প্রিন্সিপিয়া প্রকাশিত হওয়ার পরে সবাই জানতে পারে নিউটনের আবিষ্কার সম্পর্কে।
১৬৬৭ সালে আবার কেমব্রিজে ফিরলেন নিউটন, অনেক আত্মবিশ্বাসী হয়ে। এবার একটা স্কলারশিপ পেলেন তিনি। ১৬৬৩ সালে কেমব্রিজে লুকাসিয়ান প্রফেসর পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। পার্লামেন্ট মেম্বার হেনরি লুকাস এই পদের জন্য তদবির করেছেন এবং ১৬৬৪ সালে রাজা দ্বিতীয় চার্লস আনুষ্ঠানিকভাবে এই পদের সূচনা করেন। প্রথম লুকাসিয়ান প্রফেসর হিসেবে নিয়োগ পেলেন আইজ্যাক ব্যারো। ব্যারো নিউটনকে খুবই পছন্দ করতেন। আইজ্যাক ব্যারোর সংস্পর্শে এবং সহায়তায় আইজ্যাক নিউটন কেমব্রিজে স্থায়ী পদ লাভ করেন। ইতিমধ্যে তিনি ডিগ্রি অর্জন করে ফেলেছেন। সে সময় কেমব্রিজে ভর্তি হলেই একটা নির্দিষ্ট সময় পর ডিগ্রি দিয়ে দেওয়া হতো। আইজ্যাক ব্যারো ট্রিনিটি কলেজের মাস্টার এবং রাজকীয় পদে অভিষিক্ত হওয়ার পর লুকাসিয়ান প্রফেসরের পদটা নিউটনকে দিয়ে দেন। আইজ্যাক নিউটন ১৬৬৯ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির লুকাসিয়ান প্রফেসর পদে যোগ দেন। পরবর্তী ৩৩ বছর তিনি সেই পদে কাজ করেছেন।
লুকাসিয়ান প্রফেসর হিসেবে নিউটন প্রথম লেকচার দেন ট্রিনিটি কলেজে ১৬৭০ সালের জানুয়ারিতে। মাত্র কয়েকজন ছাত্র আগ্রহী ছিলেন তাঁর লেকচার শোনার ব্যাপারে। নিউটন তখন আলোকবিদ্যা সম্পর্কে গবেষণা করছেন। লুকাসিয়ান লেকচারে তিনি সেসব তত্ত্বই আলোচনা করছিলেন। কিন্তু কোনো ছাত্রই আগ্রহী হননি তাঁর লেকচারে। প্রথম লেকচারে কয়েকজন উপস্থিত থাকলেও দ্বিতীয় লেকচারে কেউ উপস্থিত হননি। নিউটন খালি থিয়েটারেই লেকচার দিলেন। পরবর্তী ১৭ বছর ধরে নিউটন লুকাসিয়ান লেকচার দিয়েছেন খালি থিয়েটারে। প্রফেসর হিসেবে খুবই অবহেলিত ছিলেন আইজ্যাক নিউটন। তাঁর অধ্যাপনা জীবনে মাত্র তিনজন ছাত্র তাঁর কাছে পড়তে এসেছিলেন। ছাত্র হিসেবে তাঁরা কেউই তেমন কোনো কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে পারেননি। নিউটনের আলোক-সংক্রান্ত গবেষণাগুলো তিনি প্রকাশ করেন অপটিকস বইয়ে, ৩০ বছর পর ১৭০৪ সালে।
নিউটন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি তৈরিতে দক্ষ ছিলেন। আলোক পরীক্ষার জন্য দরকারি যন্ত্রপাতি তিনি নিজেই তৈরি করতেন। আলোক যন্ত্রপাতি তৈরি করতে করতে একটি শক্তিশালী রিফ্লেক্টিং টেলিস্কোপ তৈরি করেন তিনি। এই টেলিস্কোপের কথা রয়্যাল সোসাইটিতে জানাজানি হয়ে যায়। বিজ্ঞানী রবার্ট বয়্যালের নেতৃত্বে রয়্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬৬০ সালে। রয়্যাল সোসাইটির আগ্রহে নিউটন তাঁর টেলিস্কোপের একটি মডেল রয়্যাল সোসাইটিতে পাঠান। পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানে নিউটনের কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা চলতে থাকে সর্বত্র। ১৬৭২ সালে রয়্যাল সোসাইটির ফেলোশিপ লাভ করেন নিউটন। রয়্যাল সোসাইটির নিয়ম অনুযায়ী নিউটনকে একটি বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা দিতে হয়। সেখানে তিনি অপটিকস–সংক্রান্ত তাঁর গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন।
১৬৬৫–৬৬ সালে প্লেগের সময় ফার্মে বসে নিউটন আবিষ্কার করেছিলেন আলোর কণাতত্ত্ব। প্রিজমের ভেতর দিয়ে সূর্যের আলো প্রবেশ করিয়ে তিনি দেখেছেন প্রিজম থেকে বের হওয়ার সময় আলো বিভিন্ন বর্ণে আলাদা আলাদাভাবে বেগুনি, নীল, আকাশি, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল—এভাবে রংধনুর রঙে প্রতিসৃত হয়ে বের হয়। আরেকটি প্রিজমের ভেতর দিয়ে এই বর্ণালি প্রবেশ করিয়ে দেখা গেল, প্রিজমের অন্যদিকে সব কটি রং একসঙ্গে মিলে সাদা রঙের আলো বের হচ্ছে। আমরা কীভাবে রং দেখি, তার পদার্থবৈজ্ঞানিক উত্তর পাওয়া গেল। আমরা যখন লাল দেখি, তখন লাল ছাড়া বাকি সব রং শোষিত হয়। যখন সাদা দেখি, তখন সব রঙের মিশ্রণ দেখি। আর কালো মানে সব রঙের শোষণ।
কিন্তু নিউটনের গবেষণায় সন্তুষ্ট হতে পারলেন না রবার্ট হুক। তিনি দাবি করেন, নিউটন তাঁর মডেল অনুসরণ করে এই যন্ত্র বানিয়েছেন, সুতরাং মূল কৃতিত্ব নিউটনের নয়। ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস দাবি করলেন, নিউটন তাঁর তত্ত্ব নিয়েই কাজ করছেন। নিউটন ক্রমে বিরোধে জড়িয়ে পড়তে শুরু করলেন। এই বিরোধ চলতেই থাকল পরবর্তী এক দশক ধরে।
১৬৭৯ সালে নিউটনের মা মারা যান। নিউটন একেবারেই একা হয়ে গেলেন। ছোটবেলায় মায়ের প্রতি বিতৃষ্ণা থেকে সমগ্র নারী জাতির প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে গিয়েছিল তাঁর। সারা জীবন তিনি নারীর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলেছেন।
১৬৮৪ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যাডমন্ড হ্যালি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে নিউটনের সঙ্গে দেখা করেন। হ্যালি নিউটনকে উদ্বুদ্ধ করেন তাঁর গবেষণাকর্ম প্রকাশের জন্য। ১৬৮৪ থেকে ১৬৮৬ সাল পর্যন্ত দিনরাত পরিশ্রম করে নিউটন তাঁর যুগান্তকারী বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন। ১৬৮৬ সালের জুন মাসে তিনি রয়্যাল সোসাইটিতে উপস্থাপন করেন ফিলোসপিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা। পরের বছর তিন খণ্ডে এই বই প্রকাশিত হয়। তিনি ইচ্ছা করেই বইটিতে অনেক বেশি গাণিতিক সূত্র দিয়ে ভর্তি করে ফেলেন, যেন খুব বেশি মানুষ এই বই পড়ে বুঝতে না পারে। তাঁর ধারণা ছিল, কেউ কিছু বুঝতে না পারলে সমালোচনাও করতে পারবে না। তিনি মানুষের সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না।
১৬৮০ সাল থেকে ট্রিনিটি কলেজে ভীষণ অর্থাভাব দেখা দেয়। এই অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য ভাইস চ্যান্সেলরের নেতৃত্বে ১৬৮৭ সালে আটজনের একটি কমিটি গঠন করা হয়। নিউটন ছিলেন সেই কমিটির অন্যতম সদস্য।
১৬৮৯ সালে নিউটন পার্লামেন্টের সদস্য মনোনীত হন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে। এক বছর তিনি পার্লামেন্টের মেম্বার ছিলেন। কিন্তু কথিত আছে, এই এক বছরে তিনি একটিমাত্র বাক্য বলেছিলেন পার্লামেন্টে। একজন সহকারীকে ডেকে বলেছিলেন, ‘জানালাটা খুলে দাও।’
১৬৯৩ সালে নিউটনের প্রচণ্ড মানসিক সমস্যা দেয়। প্রায় চার মাস তিনি মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভোগেন। এরপর তিনি সুস্থ হলেও আর কোনো দিন কোনো মৌলিক গবেষণা করেননি। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়ান প্রফেসর পদে ছিলেন ১৭০২ সাল পর্যন্ত।
১৬৯৬ সালে নিউটন ইংল্যান্ডের জাতীয় টাঁকশাল ‘রয়্যাল মিন্ট’-এ গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগ দেন। এরপর ১৭২৭ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু তিনি এখানেই ছিলেন। পদোন্নতি হতে হতে তিনি ‘মাস্টার অব দ্য মিন্ট’ হয়েছিলেন। টাকা জাল করা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল নিউটনের দক্ষ ব্যবস্থাপনায়।
রবার্ট হুকের সঙ্গে বিরোধ চললেও ১৭০৩ সালে রবার্ট হুকের মৃত্যুর পর নিউটন রয়্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি রাজনৈতিক এবং অন্যান্যভাবে প্রভাব খাটানোতে খুব দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। ১৭০৩ সাল থেকে আমৃত্যু তিনি রয়্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট পদ ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি কখনো কোনো প্রেস কনফারেন্স বা ঘোষণাপত্র পাঠ করেননি। জনসমাবেশে কিছু বলতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না।
১৭০৫ সালে নিউটন নাইটহুড লাভ করেন। তাঁর আগে আর কোনো বিজ্ঞানী এই সম্মান পাননি।
৩
নিউটনকে কখনো হাসতে দেখা যায়নি। নিজের সমালোচনা একটুও সহ্য করতে পারতেন না। তাঁর বন্ধু বলতে তেমন কেউ ছিলেন না। যাঁদের বন্ধু মনে করতেন, তাঁরাও যদি তাঁর পক্ষে কথা না বলতেন, তাহলে তাঁদের সঙ্গে ঝগড়া লাগিয়ে দিতেন।
নিউটনের প্রিন্সিপিয়া পদার্থবিজ্ঞানে সর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী রচনাগুলোর একটি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই রচনা প্রকাশ করে বিখ্যাত হওয়ার পরেই তিনি প্রধান রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী বা ‘অ্যাস্ট্রোনোমার রয়্যাল’ জন ফ্ল্যামস্টিডের সঙ্গে ঝগড়া লাগালেন। ফ্ল্যামস্টিডের সঙ্গে নিউটনের খুবই ভালো বন্ধুত্ব ছিল। প্রিন্সিপিয়া প্রকাশের সময় জ্যোতির্বিজ্ঞানের যেসব তথ্য–উপাত্ত দরকার হয়েছিল, তার সব কটিই তিনি পেয়েছিলেন ফ্ল্যামস্টিডের কাছ থেকে। কিন্তু নিউটন অপ্রকাশিত ডেটা চাইলে ফ্ল্যামস্টিড তা দিতে অস্বীকৃতি জানান, ফলে নিউটনের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। তিনি কোনো কিছুতেই না শুনতে পছন্দ করতেন না।
নিউটন নিজের প্রভাব খাটিয়ে রয়্যাল অবজারভেটরির পরিচালনা পরিষদের কর্তা হয়ে গেলেন এবং ডেটা দিতে বাধ্য করলেন। শুধু ডেটা পেয়েই সন্তুষ্ট হলেন না নিউটন। তিনি ফ্ল্যামস্টিডের নাম-নিশানা মুছে দিতে চাইলেন। ফ্ল্যামস্টিড যে ডেটা সংগ্রহ করেছিলেন, তার সব কটি বাজেয়াপ্ত করা হলো। ফ্ল্যামস্টিড যেসব গবেষণাপত্র প্রকাশ করার জন্য রেডি হচ্ছিলেন, সেগুলোকে ফ্ল্যামস্টিডের শত্রু অ্যাডমন্ড হ্যালির নামে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু ফ্ল্যামস্টিডও ছেড়ে দেওয়ার মানুষ নন। তিনি কোর্টে মামলা করলেন এবং দ্রুত কোর্ট অর্ডার পেলেন নিজের কাজের পক্ষে। ফ্ল্যামস্টিডের রচনা হ্যালির নামে প্রকাশে বাধাপ্রাপ্ত হয়েও নিউটন দমে গেলেন না। তিনি তাঁর প্রিন্সিপিয়া গ্রন্থের পরবর্তী সংস্করণ থেকে ফ্ল্যামস্টিডের সব কটি রেফারেন্স মুছে দিলেন।
নিউটন অত্যন্ত প্রতিশোধপরায়ণ মানুষ ছিলেন। জার্মান দার্শনিক গটফ্রিড লিবনিজের সঙ্গে ক্যালকুলাস আবিষ্কারের কৃতিত্ব নিয়ে বিরোধে সাংঘাতিকভাবে রেগে যান নিউটন। নিউটন আর লিবনিজ দুজনই আলাদাভাবে গণিতের এই নতুন শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু নিউটন লিবনিজের আগেই এই কাজ করলেও প্রকাশ করেছেন আরও অনেক দিন পর। কিন্তু লিবনিজ প্রকাশ করেছেন নিউটনের আগে।
ক্যালকুলাস আবিষ্কারের কৃতিত্ব কাকে বেশি দেওয়া হবে, এ নিয়ে বিজ্ঞানীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলেন। লিবনিজের সমর্থনে একদল বিজ্ঞানী লিখলেন, নিউটনের পক্ষে লিখছেন আরেক দল। নিউটনের বন্ধুসংখ্যা কম হলেও তিনি অন্য পথ নিলেন। নিজেই নিজের পক্ষ সমর্থন করে লিখে তা বন্ধুদের নামে প্রকাশ করতে শুরু করলেন। এভাবে নিয়মিত লিবনিজবিরোধী চিঠি প্রকাশিত হতে থাকলে লিবনিজ ব্যাপারটার একটা স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে রয়্যাল সোসাইটির কাছেই বিচার দিলেন। কিন্তু লিবনিজ ভুলটা করলেন সেখানেই। নিউটন নিজেই তখন রয়্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট। তিনি ‘নিরপেক্ষ’ তদন্ত কমিটি গঠন করবেন বলে নিজের বন্ধুদের দিয়ে একটি কমিটি গঠন করলেন। তাতেও শান্তি নেই তাঁর। নিজেই কমিটির রিপোর্ট লিখলেন এবং রয়্যাল সোসাইটিকে দিয়ে তা প্রকাশ করালেন। সেই রিপোর্টে লিবনিজকে সরাসরি দায়ী করা হয় নিউটনের কাজ চুরি করেছেন বলে। তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে এই রিপোর্টের পক্ষে অনেক সুনাম করে বেনামে একটা চিঠিও প্রকাশ করলেন রয়্যাল সোসাইটির জার্নালে। ১৭১৬ সালে লিবনিজের মৃত্যুর পর নির্লজ্জভাবে আনন্দ প্রকাশ করেন নিউটন।
১৭২৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শেষবারের মতো রয়্যাল সোসাইটির মিটিংয়ে সভাপতিত্ব করেছেন নিউটন। এর এক মাস পরে ১৭২৭ সালের ২০ মার্চ ৮৪ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর তাঁকে রাজকীয় সম্মান দিয়ে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে সমাহিত করা হয়।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, বায়োমেডিকেল ফিজিকস, আরএমআইটি, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
সূত্র:
১. স্টিফেন হকিং—আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম
২. আইওয়ান জেমস—রিমার্কেবল ফিজিসিস্ট
৩. পিটার মুর—সায়েন্স
৪. স্টিভ পার্কার—আইজ্যাক নিউটন অ্যান্ড গ্র্যাভিটি
৫. লয়েড মর্টজ অ্যান্ড জেফারসন ওয়েভার—দ্য স্টোরি অব ফিজিকস
৬. জন গ্রিবিন—দ্য সায়েন্টিস্টস