নিউক্লিওসিনথেসিস

তরুন জার্মান বিজ্ঞানী হ্যানস বেথের গবেষণার আগে সূর্য এবং অন্যান্য নক্ষত্রগুলো কীভাবে এত বিপুল পরিমাণ আলো, তাপ ও অন্যান্য বিকিরণ করে, তা কেউই নিশ্চিতভাবে জানতেন না। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত আইনস্টাইনের ভর-শক্তি সমীকরণ এবং ১৯২৬ সালে এডিংটনের তত্ত্ব এই রহস্য সমাধানের পথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন দুটি ধাপ। কিন্তু মূল সাফল্য আসে বেথের হাত ধরে ১৯৩৮ সালে।

দুই

ঘটনার শুরু ১৯১৯ সালে। ব্রিটিশ রসায়নবিদ ফ্রান্সিস অ্যাস্টন লক্ষ্য করেন, চারটি হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ভরের যোগফল ও একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের ভর সমান নয়। হিলিয়ামের ভর সামান্য কম। বর্তমানে আমরা জানি, হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসে থাকে একটি প্রোটন। অন্যদিকে, হিলিয়াম নিউক্লিয়াসে প্রোটন এবং নিউট্রনের সংখ্যা সমান, দুটি করে মোট চারটি। সে সময়ে বিজ্ঞানীদের নিউট্রনের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা ছিল না। ১৯৩২ সালে আবিষ্কৃত হয় নিউট্রন। প্রোটনের তুলনায় এদের ভর সামান্য বেশি। তাই কোনোভাবেই একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের ভর চারটি হাইড্রোজেনের চেয়ে কম হতে পারে না। অন্তত গানিতিকভাবে তো নয়ই। ঘটনাটি বিজ্ঞানীদের বেশ ভাবিয়ে তুলে।

সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসেন ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন এবং ফরাসী পদার্থবিদ পেরিন। তাঁরা আলাদাভাবে গবেষণা করে এই ঘটনার ব্যাখ্যা দেন। তাঁদের মতে, নক্ষত্রের ভেতর চারটি হাইড্রোজেন একত্রিত হয়ে হিলিয়াম তৈরি করে। এ সময় সামান্য পরিমাণ ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এ সময় তাঁরা আইনস্টাইনের ভর-শক্তি সমীকরণ মেনে চলে। এই প্রক্রিয়ার নাম নিউক্লিয়ার ফিউশন। এভাবে উৎপন্ন শক্তির বদৌলতে নক্ষত্রগুলো মিলিয়ন বা বিলিয়ন বছর ধরে তাপ ও আলো বিকিরণ করে।

এডিংটনের তত্ত্বটি প্রকাশিত হওয়ার পর খুব বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। কারণ ফিউশন হওয়ার জন্য যে তাপমাত্রা প্রয়োজন, বাস্তবে সূর্যের তাপমাত্রা তার চেয়ে অনেক কম। তাই এডিংটনের দেখানো পথে ফিউশন সম্পন্ন হওয়া অসম্ভব। পরবর্তীতে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আবির্ভাবে এডিংটনের তত্ত্ব নতুন জীবন ফিরে পায়। প্রমাণ পাওয়া যায়, কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের মাধ্যমে কম তাপমাত্রাতেই ফিউশন সংঘটিত হতে পারে।

এরপরই দৃশ্যপটে আসেন হ্যানস বেথ। তিনি এডিংটনের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ফিউশন সংঘটিত হবার সঠিক পদ্ধতি খুঁজে বের করেন। এর নাম দেওয়া হয় প্রোটন-প্রোটন চেইন। নিচের ছবিটি লক্ষ্য করুন।

প্রোটন প্রোটন চেইন
লেখক

প্রথম ধাপে দুটি প্রোটন ফিউশনের মাধ্যমে ডিউটেরিয়াম উৎপন্ন করে। যা হাইড্রোজেনের একটি আইসোটোপ। এই বিক্রিয়াতে একটি করে পজিট্রন এবং নিউট্রনও উৎপন্ন হয়। দ্বিতীয় ধাপে, ডিউটেরিয়ামের সঙ্গে আরেকটি প্রোটন যুক্ত হয়। তৈরি হয় হিলিয়াম-৩ নিউক্লিয়াস। আর সর্বশেষ ধাপে দুটি হিলিয়াম-৩ ফিউশনের মাধ্যমে তৈরি হয় সাধারণ হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস বা হিলিয়াম-৪ নিউক্লিয়াস। এই পদ্ধতি অনুসরণ করে সূর্যসহ তুলনামূলক কম ভরের নক্ষত্রগুলো (যাদের ভর ১.৩ সৌরভরের কম) শক্তি উৎপাদন করে।

তিন

নক্ষত্রের মধ্যে শক্তি উৎপাদনের আরেকটি চক্র রয়েছে। যার নাম CNO (কার্বন-নাইট্রোজেন-অক্সিজেন) চক্র। যে সব নক্ষত্রের ভর ১.৩ সৌরভরের বেশি, সেগুলোতে এই চক্রের মাধ্যমে বেশিরভাগ শক্তি উৎপন্ন হয়। প্রোটন-প্রোটন চেইন এবং কার্বন-নাইট্রোজেন-অক্সিজেন চক্র দুটিতেই হাইড্রোজেন থেকে শেষ পর্যায়ে গিয়ে হিলিয়াম উৎপন্ন হয়। নিচের ছবিতে চক্রটি দেখানো হয়েছে।

কার্বন-নাইট্রোজেন-অক্সিজেন চক্র
লেখক

CNO চক্রে চারটি হাইড্রোজেন পরমাণু বিভিন্ন ধাপে কার্বন এবং নাইট্রোজেনের পরমাণুর সঙ্গে সংযুক্ত হয়। প্রথম ধাপে, কার্বন-১২ এর নিউক্লিয়াসের সঙ্গে হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস যুক্ত হয়ে নাইট্রোজেন-১৩ উৎপন্ন হয়। পরবর্তী ধাপে, এই অস্থায়ী নাইট্রোজেন-১৩ পজিট্রনের বিকিরণের মাধ্যমে পরিণত হয় কার্বন-১৩ তে। তৃতীয় ধাপে, এটি আরেকটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের সঙ্গে ফিউশনের মাধ্যমে তৈরি হয় নাইট্রোজেন-১৪। সেখান থেকে আরেকটি হাইড্রোজেন সংযোজিত হয়ে তৈরি হয় অক্সিজেন-১৫। অস্থায়ী অক্সিজেন পজিট্রন বিকিরণ করে রুপান্তরিত হয় নাইট্রোজেন-১৫ তে। আর সর্বশেষ ধাপে, এটি নতুন আরেকটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে উৎপন্ন করে কার্বন-১২ নিউক্লিয়াস এবং একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াস। এভাবে প্রতি চক্রে সামগ্রিকভাবে ২৬.৭৩ মেগা ইলেক্ট্রন ভোল্ট শক্তি বিকিরিত হয়। নিচে প্রতিটি ধাপের রাসায়নিক বিক্রিয়ার সমীকরণগুলো দেখানো হয়েছে।

কার্বন-নাইট্রোজেন-অক্সিজেন চক্রে সংঘটিত রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো
লেখক

চার

১৯৪০ সালের আগে মহাবিশ্বে প্রাপ্ত মৌলগুলোর উৎপত্তি সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা বিজ্ঞানীদের ছিল না। ১৯২০ সালে প্রথমবারে মতো বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হন, প্রকৃতিতে পাওয়া সবচেয়ে হালকা দুটি মৌল, হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম, দিয়েই মহাবিশ্বের বেশিভাগটা গঠিত। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে জর্জ গ্যামো এবং রালফ আলফার প্রমাণ করেন, বিগ ব্যাংয়ের সময় মাত্র তিনটি মৌলের অস্তিত্ব ছিল। হাইড্রোজেন, হিলিয়াম এবং লিথিয়াম। এদের মধ্যে হাইড্রোজেনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি ছিল এবং লিথিয়ামের পরিমাণ ছিল অত্যন্ত নগন্য। তাহলে পর্যায় সারণির বাকি মৌলগুলো সৃষ্টি হলো কীভাবে?

এই প্রশ্নের গ্রহণযোগ্য উত্তর দেন ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ ফ্রেড হোয়েল। তাঁর মতে, বেশিরভাগ মৌলের উৎপত্তির স্থান নক্ষত্রগুলো। সেখানে ধাপে ধাপে সংঘটিত নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় মৌলগুলো। এই প্রক্রিয়ার নাম নিউক্লিওসিনথেসিস ।

নক্ষত্রের কেন্দ্রে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেন হ্যানস বেথ। কিন্তু কার্বন বা আয়রনের মতো মৌলগুলোর ব্যপারে কোনো সমাধান দিয়ে যেতে পারেননি তিনি। নিউক্লিয়ার ফিউশনের মাধ্যমে এই মৌলগুলো তৈরি হতে প্রয়োজন অকল্পনীয় তাপ। মহাবিশ্বের ছোট বা মাঝারি নক্ষত্রের (মহাবিশ্বের প্রায় ৯০% নক্ষত্র) কেন্দ্রে এই তাপমাত্রা অর্জিত হওয়া সম্ভব নয়।

১৯৪৬ সালে ফ্রেড হোয়েল প্রমাণ করেন, বিশাল ভরের নক্ষত্রগুলোর কেন্দ্র নিউক্লিওসিনথেসিস প্রক্রিয়ার জন্য আদর্শ স্থান। এদের কেন্দ্রের তাপমাত্রা কয়েক বিলিয়ন ডিগ্রি পর্যন্ত হতে পারে। অতি উচ্চ তাপমাত্রায় কার্বন থেকে শুরু করে আয়রন পর্যন্ত মৌলগুলো সহজেই ফিউশনের মাধ্যমে তৈরি হতে পারে। নিচের ছবিতে একটি সুপার রেড জায়ান্ট নক্ষত্রের ভেতরে কোথায় কোন মৌল তৈরি হতে পারে, তা দেখানো হয়েছে।

নিউক্লিওসিনথেসিস
লেখক

বিশাল ভরের নক্ষত্রগুলোর হাইড্রোজেন জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে মহাকর্ষের প্রভাবে এদের কেন্দ্র সংকুচিত এবং উত্তপ্ত হতে থাকে। তখন হিলিয়াম পরিণত হয় কার্বনে। ক্রমান্বয়ে কার্বন পরিণত হয় নিয়নে, নিয়ন পরিণত হয় অক্সিজেন ও ম্যাগনেসিয়ামে। তারপর অক্সিজেন রূপান্তরিত হয় সিলিকন, সালফার এবং অন্যান্য মৌলতে। সবার শেষে তৈরি হয় আয়রন বা লোহা। এই নিউক্লিয়ার বিক্রিয়াগুলো সংঘটনের সময় তৈরি হয় প্রচুর পরিমাণে মুক্ত নিউট্রন। এদের সঙ্গে আগেই সৃষ্টি হওয়া মৌলরা যুক্ত হবার মাধ্যমে তৈরি হয় পর্যায় সারণির বাকি ভারি মৌলগুলো। এরপর সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্টি হওয়া সকল মৌল মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। নিচের ছবিতে হিলিয়াম থেকে কার্বন তৈরির বিক্রিয়াটি দেখানো হয়েছে। এটি ট্রিপল আলফা প্রসেস নামে পরিচিত।

ট্রিপল আলফা প্রসেস
লেখক

পাঁচ

ওপরে বলা প্রক্রিয়ায় নক্ষত্রের ভেতরে তিনটি ছাড়া পর্যায় সারণির সকল মৌল সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। সেগুলো হলো লিথিয়াম, বেরিলিয়াম এবং বোরন, যাদের পারমানবিক সংখ্যা যথাক্রমে ৩, ৪ এবং ৫। হালকা মৌলগুলোর ফিউশনের মাধ্যমে এদের প্রস্তুত করা যায় না। যেমন, হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম যুক্ত হয়ে প্রাথমিকভাবে লিথিয়াম তৈরি হলেও সেগুলো স্থায়ী হয় না। আবার, দুটি হিলিয়াম মিলে বেরিলিয়াম তৈরিতেও একই সমস্যা। এটিও স্থায়ী হয় না। এভাবে কার্বন বা অন্য মৌল যুক্ত করেও স্থায়ী লিথিয়াম, বেরিলিয়াম এবং বোরন পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু প্রকৃতিতে এদের স্থায়ী অবস্থায় পাওয়া যায়। উদ্ভিদ কোষের দেয়ালের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন উপাদান বোরন। তাই বোরন ছাড়া পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব ছিল না। তাহলে এই তিনটি মৌল এলো কোথা থেকে?

সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে নক্ষত্রের মধ্যে তৈরি হওয়া সকল মৌল মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তখন ভারী মৌলগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষ হয় মহাজাগতিক রশ্মির। এই রশ্মিগুলো আসলে অতি উচ্চ শক্তি সম্পন্ন কণা। সংঘর্ষের ফলে ভারী মৌলগুলো বিশ্লেষিত হয়ে হালকা মৌল উৎপন্ন করে। এই প্রক্রিয়ার নাম স্প্যালেশন। আর এভাবেই মহাশূন্যে তৈরি হয় দুর্লভ তিনটি মৌল—লিথিয়াম, বেরিলিয়াম এবং বোরন।

লেখক : সহকারি ব্যবস্থাপক, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড, রূপপুর, পাবনা

সুত্র : দ্য অ্যাস্ট্রোনমি বুক; বিগ আইডিয়াস সিম্পলি এক্সপ্লেইন্ড