পদার্থবিজ্ঞান
নিউক্লিয়াস থেকে গভীর মহাকাশে - ২
বিগ ব্যাংয়ের পর বিজ্ঞানের শাখাগুলোর মধ্যে নাকি সর্বপ্রথম জন্ম হয়েছিল পদার্থবিজ্ঞানের। বিজ্ঞানের এই শাখাটি বেশ মজার। তবে বিভিন্ন ধারণা ও তত্ত্বের কারণে অনেকের কাছেই বিষয়টি জটিল, কঠিন, দুর্বোধ্য। তাঁদের জন্যই পদার্থবিজ্ঞানের সমীকরণ ও কঠিন তথ্যের পেছনের অপার সৌন্দর্য ও সারল্য তুলে এনেছেন জ্যোতিঃপদার্থবিদ ওয়াল্টার লুইন, লিখেছেন ফর দ্য লাভ অব ফিজিকস—পদার্থবিজ্ঞানের জন্য ভালোবাসা। প্রথমা প্রকাশন প্রকাশিত বইটি অনুবাদ করেছেন আবুল বাসার। বইটির নির্বাচিত কিছু অংশ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকের জন্য।
আগের পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
পদার্থবিজ্ঞান কল্পনাতীত বিপুলতা খুঁজে বেড়ায়। একই সঙ্গে অতি ক্ষুদ্রতম জগতের গভীরেও খুঁড়ে ফেলতে পারে এই বিদ্যা। নিউট্রিনোর মতো পদার্থের অতি খুদে কণাও রয়েছে এর অনুসন্ধানের আওতায়। কণাটা প্রোটনের অতিক্ষুদ্র ভগ্নাংশের মতো। শুরুর দিনগুলোয় আমি ঠিক এই জায়গায় বেশির ভাগ সময় ব্যয় করতাম। মানে এই অতিখুদে জগতে। তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে আসা বিভিন্ন কণা এবং বিকিরণ পরিমাপ ও ম্যাপিং করা হয় এখানে। এটাই নিউক্লিয়ার ফিজিকস। তবে এটা পারমাণবিক বোমা তৈরির ব্যাপারস্যাপার নয়। একটা মৌলিক স্তরে পদার্থ কেন ও রকম আচরণ করে, তা নিয়ে গবেষণা করেছি আমি।
জানেন হয়তো, আমরা যেসব পদার্থ দেখতে পাই ও স্পর্শ করতে পারি, সেগুলো গঠিত হয়েছে কিছু মৌলিক পদার্থ দিয়ে। যেমন হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ও কার্বন মিলিত হয়ে অণু গঠন করে। আবার মৌলের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম একক হলো পরমাণু। এটি গঠিত হয় নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রন দিয়ে। আবারও মনে করিয়ে দিই, নিউক্লিয়াসে থাকে প্রোটন ও নিউট্রন কণা। মহাবিশ্বের সবচেয়ে হালকা ও প্রাচুর্যময় মৌলের নাম হাইড্রোজেন। এই মৌলে থাকে একটা প্রোটন ও একটা ইলেকট্রন। তবে হাইড্রোজেনের আরেকটা রূপ রয়েছে, যার নিউক্লিয়াসে একটা প্রোটনের সঙ্গে একটা নিউট্রনও থাকে। এটা হাইড্রোজেনের একটা আইসোটোপ বা সমস্থানিক। আইসোটোপ মানে একই মৌলের ভিন্ন রূপ। হাইড্রোজেনের এ আইসোটোপকে বলা হয় ডিউটেরিয়াম। মৌলটির তৃতীয় আরেকটি আইসোটোপও আছে। এর নিউক্লিয়াসে একটি প্রোটনের সঙ্গে থাকে দুটি নিউট্রন। একে বলা হয় ট্রিটিয়াম। কোনো মৌলের সব আইসোটোপের প্রোটন সংখ্যা সব সময় একই থাকে, তবে তফাত থাকে তাদের নিউট্রন সংখ্যায়। বিভিন্ন মৌলের আইসোটোপের সংখ্যাও বিভিন্ন। যেমন অক্সিজেনের আইসোটোপের সংখ্যা ১৩। স্বর্ণের আবার ৩৬টি আইসোটোপ আছে।
আমার গবেষণার কাজটা ছিল সত্যি রোমাঞ্চকর। আক্ষরিক অর্থেই আমার হাতের তালুতে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ক্ষয়ে যেত। সেটা ঘটত খুব তীব্রভাবে। আমি যেসব আইসোটোপ নিয়ে কাজ করেছি, সাধারণত সেগুলোর অর্ধায়ু ছিল মাত্র এক দিন বা কয়েক দিন
এসব আইসোটোপের কিছু বেশ স্থিতিশীল। মানে, সেগুলো কমবেশি চিরদিন টেকে। তবে বেশির ভাগ আইসোটোপ অস্থিতিশীল। কথাটা আরেকভাবে বলা যায়, এগুলো রেডিওঅ্যাকটিভ বা তেজস্ক্রিয়। এসব তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যায়। অর্থাত্ বেশ দ্রুত বা কিছুটা ধীরে এসব আইসোটোপ নিজেরা অন্য মৌলে রূপান্তরিত হয়। এরা যেসব মৌলে রূপান্তরিত হয়, তাদের কিছু কিছু স্থিতিশীলও হতে পারে। এভাবে একসময় থেমে যায় তাদের তেজস্ক্রিয় ক্ষয় প্রক্রিয়া। তবে রূপান্তরিত কিছু মৌল অস্থিতিশীলও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ক্ষয় প্রক্রিয়া অবিরাম চলতেই থাকে, যতক্ষণ না সেটা কোনো স্থিতিশীল পর্যায়ে পৌঁছায়। হাইড্রোজেনের তিনটি আইসোটোপের মাত্র একটি তেজস্ক্রিয়। ট্রিটিয়াম। এটি ক্ষয় হয়ে হিলিয়ামের স্থিতিশীল আইসোটোপে পরিণত হয়। অক্সিজেনের ১৩টি আইসোটোপের মধ্যে মাত্র তিনটি স্থিতিশীল। ওদিকে স্বর্ণের ৩৬টি আইসোটোপের মধ্যে স্থিতিশীল মাত্র একটি।
তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ কত দ্রুত ক্ষয় হয়, তা মাপা হয় তাদের হাফ লাইফ বা অর্ধায়ু দিয়ে। আশা করছি, কথাটা মনে রাখতে পারবেন। অর্ধায়ু এক মাইক্রোসেকেন্ড (এক সেকেন্ডের এক মিলিয়ন বা ১০ লাখ ভাগের এক ভাগ) থেকে কয়েক বিলিয়ন বছর পর্যন্ত হতে পারে। যদি বলা হয়, ট্রিটিয়ামের অর্ধায়ু প্রায় ১২ বছর, তাহলে তার মানে, ট্রিটিয়ামের প্রদত্ত নমুনার অর্ধেক ১২ বছরে ক্ষয় হবে (২৪ বছর পর টিকে থাকবে ওই নমুনার মাত্র এক-চতুর্থাংশ)। নিউক্লিয়ার ডিকে বা পারমাণবিক ক্ষয় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে বেশ কিছু ভিন্ন ভিন্ন মৌল রূপান্তরিত ও গঠিত হতে পারে। তবে এটা কিন্তু মোটেও আলকেমি বা অপরসায়ন নয়। আমার পিএইচডি গবেষণার সময় মাঝেমধ্যে তেজস্ক্রিয় স্বর্ণের আইসোটোপকে ক্ষয় হয়ে পারদে রূপান্তরিত হতে দেখেছি। তবে প্রক্রিয়াটি মধ্যযুগের আলকেমিস্টদের ঠিক পছন্দ হতো না। অবশ্য পারদের বেশ কিছু আইসোটোপ ক্ষয় হয়ে স্বর্ণে পরিণত হয়। প্লাটিনামের কিছু আইসোটোপের ক্ষেত্রেও ঘটে একই ঘটনা। তবে প্লাটিনামের একটামাত্র আইসোটোপ ও পারদের একটামাত্র আইসোটোপ ক্ষয় হয়ে স্থিতিশীল স্বর্ণে পরিণত হয়। মানে, আমরা হাতে-গায়ে গহনা হিসেবে যে রকম স্থিতিশীল স্বর্ণ ব্যবহার করি, সে রকম।
আমার গবেষণার কাজটা ছিল সত্যি রোমাঞ্চকর। আক্ষরিক অর্থেই আমার হাতের তালুতে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ক্ষয়ে যেত। সেটা ঘটত খুব তীব্রভাবে। আমি যেসব আইসোটোপ নিয়ে কাজ করেছি, সাধারণত সেগুলোর অর্ধায়ু ছিল মাত্র এক দিন বা কয়েক দিন। যেমন স্বর্ণ-১৯৮ আইসোটোপের অর্ধায়ু আড়াই দিনের একটু বেশি। কাজেই আমাকে কাজ সারতে হতো খুব তড়িঘড়ি করে। ডেলফ থেকে গাড়ি চালিয়ে সোজা আমস্টারডামে যেতাম। সাইক্লোট্রন ব্যবহার করে সেখানে এসব আইসোটোপ বানানো হতো। এরপর সেগুলো সঙ্গে নিয়ে পড়িমরি করে আবারও ফিরতাম ডেলফের ল্যাবে। ল্যাবে এসেই আইসোটোপগুলো একটা অ্যাসিডে দ্রবীভূত করে তরল বানাতাম। পরে রেখে দিতাম খুব পাতলা ফিল্মে। এরপর ঢুকিয়ে দিতাম একটা ডিটেক্টরে। সে সময় পারমাণবিক ক্ষয় সম্পর্কিত একটা তত্ত্ব যাচাইয়ের চেষ্টা করছিলাম আমি। তত্ত্বটা নিউক্লিয়াস থেকে গামা রশ্মির সঙ্গে ইলেকট্রন নিঃসরণের অনুপাতের ভবিষ্যদ্বাণী করে। আমার কাজের জন্য প্রয়োজন ছিল নিখুঁত পরিমাপ। কাজটা ইতিমধ্যে বেশ কিছু তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের জন্য সম্পন্ন করা হয়েছিল। তবে সাম্প্রতিক পরিমাপে দেখা গেল, তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণীর চেয়ে বাস্তব ফলাফল কিছুটা আলাদা। আমার সুপারভাইজার প্রফেসর অ্যালডার্ট ওয়াপস্ট্রা পরামর্শ দিলেন, তত্ত্বটা নাকি পরিমাপ—ভুল কোনটির মধ্যে, আমি যেন তা নির্ণয়ের চেষ্টা করি। কাজটা আমার জন্য ছিল খুব আনন্দের। দারুণ কোনো জটিল ধাঁধা মেলানোর মতো। এখানে চ্যালেঞ্জটা ছিল, আগের গবেষকদের তুলনায় আমার পরিমাপগুলো অনেক বেশি নিখুঁত হতে হবে।
ইলেকট্রন অতিক্ষুদ্র কণা। তাই অনেকে বলেন, এ কণার কোনো কার্যকরী আকার নেই। এর আকার এক সেন্টিমিটারের এক হাজার ট্রিলিয়ন (১-এর পর ১৫টি শূন্য) ভাগের এক ভাগেরও কম। তবু পদার্থবিজ্ঞানের মাধ্যমে এদের শনাক্ত করা ও গোনা যায়। পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানের এ ব্যাপারটা আমি ভালোবাসি। এর মাধ্যমে আমরা অদৃশ্যকে ‘স্পর্শ’ করার মতো ক্ষমতা পাই।
প্রয়োজনীয় পরিমাপ পেতে আমাকে নমুনাটি যত দ্রুত সম্ভব কাজে লাগাতে হতো। কারণ, যত বেশি গুনতে পারব, ফলাফল পাব তত নিখুঁত। প্রায়ই না ঘুমিয়ে টানা ৬০ ঘণ্টার মতো কাজ করতাম। মানসিকভাবে এতে আমি কিছুটা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম।
যেকোনো পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানীর জন্য সবকিছুর মধ্যে নির্ভুলতা হলো মূল চাবিকাঠি। নির্ভুলতাই একমাত্র ব্যাপার, যা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। কোনো পরিমাপ যদি তার নির্ভুলতার মাত্রা নির্দেশ না করে, তাহলে তা অর্থহীন। এই সহজ, শক্তিশালী ও পুরোপুরি মৌলিক ধারণাটি প্রায় সব সময় পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কে কলেজের পাঠ্যবইয়ে অবহেলা করা হয়। নির্ভুলতার মাত্রা জানা আমাদের জীবনসহ আরও অনেক কিছুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ নিয়ে আমার গবেষণার সময় নির্ভুলতার সঠিক মাত্রা অর্জন করা ছিল খুব চ্যালেঞ্জিং। তবে তিন বা চার বছরের মধ্যে আমি ক্রমে ভালো পরিমাপের ফল পেতে থাকি। কিছু ডিটেক্টর উন্নত করার পর সেগুলো প্রায় নির্ভুল বলে প্রমাণিত হলো। এর মাধ্যমে তত্ত্বটা নিশ্চিত করতে পারলাম। এরপর আমার ফলাফল প্রকাশ করলাম। গবেষণাটা শেষ হয়েছিল আমার পিএইচডি থিসিস হিসেবে। একটা ব্যাপার আমাকে সন্তুষ্ট করেছিল। আমার ফলাফল ছিল সিদ্ধান্তমূলক। সচরাচর যা ঘটে না। সাধারণত পদার্থবিজ্ঞান ও বিজ্ঞানে ফলাফল সব সময় সুস্পষ্ট হয় না। কিন্তু সৌভাগ্যই বলতে হবে, আমি একটা নিশ্চিত উপসংহারে পৌঁছাতে পেরেছিলাম। এই ধাঁধার সমাধান করে নিজেকে পদার্থবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলাম। এভাবে অতিপারমাণবিক [আসলে কথাটা হবে ‘উপপারমাণবিক’] জগতের অজানা রাজ্যের মানচিত্র তৈরি করতে সহায়তা করতে পেরেছি আমি। তখন আমার বয়স ২৯ বছর। এ রকম একটা অবদান রাখতে পেরে রোমাঞ্চিত হলাম। নিউটন ও আইনস্টাইনের মতো বড় ধরনের মৌলিক আবিষ্কার করার সৌভাগ্য আমাদের সবার হয় না। তবে বিজ্ঞানে এখনো এমন অজানা অনেক কিছু রয়ে গেছে, যেগুলো নিয়ে কাজ করার, অনুসন্ধানের অনেক সুযোগ আছে।
আমার আরও সৌভাগ্য, ওই ডিগ্রিটা পাওয়ার সময় মহাবিশ্বের প্রকৃতি সম্পর্কে আবিষ্কারের একদম নতুন একটা যুগের সূচনা হচ্ছিল। বিস্ময়কর গতিতে একের পর এক আবিষ্কার করে যাচ্ছিলেন জ্যোতির্বিদেরা। কেউ কেউ মঙ্গল ও শুক্র গ্রহের আবহমণ্ডল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। জলীয় বাষ্পের সন্ধান চলছিল সেখানে। পৃথিবীর চুম্বকীয় ক্ষেত্ররেখাগুলো ঘিরে ঘূর্ণমান চার্জিত কণার বলয় আবিষ্কার করছিলেন অনেকে। এই বলয়কে এখন বলা হয় ভ্যান অ্যালেন বেল্ট। অনেকে আবিষ্কারের চেষ্টা করছিলেন বিপুল ও শক্তিশালী বেতার তরঙ্গ। এটা কোয়াসার নামে পরিচিত (কোয়াসি স্টেলার রেডিও সোর্সেস)। এদিকে কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন (সিএমবি) বা মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ আবিষ্কৃত হলো ১৯৬৫ সালে। বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে নিঃসৃত শক্তির প্রকাশ এ বিকিরণ। মহাবিশ্বের জন্ম বা বিগ ব্যাং থিওরির শক্তিশালী প্রমাণ ছিল এ আবিষ্কার। এর আগপর্যন্ত তত্ত্বটা বিতর্কের মুখে পড়েছিল। অল্প কিছুদিন পর, মানে ১৯৬৭ সালে নতুন ধরনের নক্ষত্র আবিষ্কার করেন জ্যোতির্বিদেরা। একে বলা হয় পালসার।
আমি হয়তো তখন নিউক্লিয়ার ফিজিকস নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যেতে পারতাম। কারণ, সে যুগে একের পর এক আবিষ্কার হচ্ছিল ক্ষেত্রটিতে। এসব গবেষণার বেশির ভাগ ছিল অতিপারমাণবিক কণাগুলোর দ্রুত বর্ধনশীল চিড়িয়াখানার খোঁজ ও নতুন কণা আবিষ্কারের পেছনে। অতিপারমাণবিক এসব কণার মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কোয়ার্ক। কণাটি প্রোটন ও নিউট্রনের গাঠনিক এককে পরিণত হয়েছিল। নিজেদের ধর্মের পরিসরে কোয়ার্ক এত অদ্ভুত যে এদের শ্রেণিবদ্ধ করতে বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করলেন পদার্থবিদেরা। একে বলা হয় ফ্লেভার। যেমন: আপ, ডাউন, স্ট্রেঞ্জ, চার্জ, টপ ও বটম কোয়ার্ক। কোয়ার্কের আবিষ্কার ছিল বিজ্ঞানের সেই সুন্দরতম মুহূর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম, যখন পুরোপুরি তাত্ত্বিক কোনো ধারণা প্রমাণিত হয়।
কোয়ার্ক কণার অস্তিত্ব সম্পর্কে শুরুতে ভবিষ্যদ্বাণী করেন তাত্ত্বিক পদার্থবিদেরা। পরে এদের খুঁজে বের করতে সক্ষম হন পরীক্ষাবিদেরা। ব্যাপারটা সত্যি বিচিত্র। এদের কারণে একসময় বোঝা গেল, পদার্থ সম্পর্কে আমরা আগে যা জানতাম, পদার্থের ভিত্তি বা মৌলিক কণাগুলো এবং তাদের সম্পর্ক আসলে আরও অনেক জটিল। যেমন আমরা এখন জানি, প্রোটন গঠিত হয় দুটি আপ কোয়ার্ক ও একটি ডাউন কোয়ার্ক দিয়ে। এ কোয়ার্কগুলো পরস্পরের সঙ্গে আটকে থাকে শক্তিশালী পারমাণবিক বলের মাধ্যমে। বলটি আবার থাকে আরেকটি অদ্ভুত কণার রূপে, যাকে বলা হয় গ্লুয়ন। কোনো কোনো তাত্ত্বিক পদার্থবিদের সাম্প্রতিক হিসাবে, আপ কোয়ার্কের ভর প্রোটনের প্রায় ০.২ শতাংশ। অন্যদিকে ডাউন কোয়ার্কের ভর প্রোটনের প্রায় ০.৫ শতাংশ। কাজেই নিউক্লিয়াস এখন আর কোনোভাবে আপনার দাদার আমলের মতো নেই। আমি নিশ্চিত, গবেষণা করতে চাইলে সে সময় আমার জন্য আকর্ষণীয় ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারত কণাদের এই চিড়িয়াখানা— পার্টিকেল জু। কিন্তু সুখকর এক দুর্ঘটনায় সব পাল্টে গেল। নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে আসা বিকিরণ পরিমাপের যে দক্ষতা আমি অর্জন করেছিলাম, একসময় দেখা গেল সেটা মহাবিশ্বে অনুসন্ধানের জন্য অতি দরকারি। কাজেই এমআইটির প্রফেসর ব্রুনো রসির কাছ থেকে ১৯৬৫ সালে একটা আমন্ত্রণপত্র পেলাম। তাতে এক্স-রে জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে কাজ করার আহ্বান। ক্ষেত্রটা তখন একদম নতুন। সবে কয়েক বছর বয়স হয়েছে এর। আসলে ১৯৫৯ সালে কাজটা প্রথম শুরু করেন এই অধ্যাপক রসিই।
আমার ভাগ্যে যেসব ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা ছিল, তার মধ্যে এমআইটি ছিল সেরা ব্যাপার। মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে অধ্যাপক রসির গবেষণা তত দিনে পরিণত হয়েছে কিংবদন্তিতে। যুদ্ধকালে লস অ্যালামোসে একটা বিভাগের প্রধান ছিলেন তিনি। সেখানে সৌরবায়ু পরিমাপে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সৌরবায়ুর আরেক নাম আন্তঃগ্রহগত প্লাজমা। মানে, সূর্য থেকে নির্গত চার্জিত কণাদের একটা প্রবাহ। পৃথিবীর অরোরা বোরিয়ালিস ও ধূমকেতুর লেজ সূর্য থেকে দূরে প্রবাহিত হওয়ার জন্য এটি দায়ী। এরপর এক্স-রে দিয়ে মহাজাগতিক অনুসন্ধান চালানোর আইডিয়া এল তাঁর মাথায়। সেটা পুরোপুরি অনুসন্ধানমূলক কাজ। সেগুলো আদৌ খুঁজে পাওয়া যাবে কি যাবে না, তা নিয়ে তাঁর কোনো ধারণা ছিল না। সে যুগে এমআইটিতে প্রায় সবকিছুই সম্ভব ছিল। কারও কাছে যদি আইডিয়া থাকে এবং অন্যদের যদি তা বোঝাতে পারে, তাহলে তা নিয়ে গবেষণা করা সম্ভব ছিল। নেদারল্যান্ডসের চেয়ে একেবারে ভিন্ন! ডেলফে কঠোরভাবে শ্রেণিবিন্যাস মেনে চলা হতো (ডেলফ নেদারল্যান্ডসের পশ্চিমাংশের একটি শহর। এখানে অবস্থিত দেশটির সবচেয়ে পুরোনো ও সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় ডেলফ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি)। সেখানকার গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের মনে করা হতো নিম্নশ্রেণির। আমাদের বিল্ডিংয়ের প্রধান দরজার চাবি থাকত অধ্যাপকদের হাতে। কিন্তু কেউ গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী হলে, তাঁকে দেওয়া হতো বেজমেন্টের দরজার চাবি। সেখানে সে শুধু সাইকেল রাখতে পারত। প্রতিবার যখনই বিল্ডিংয়ে ঢুকবেন, তখন আপনাকে অবশ্যই সাইকেল স্টোরেজ রুমগুলোর মধ্য দিয়ে পথ বেছে নিতে হবে। সেই সঙ্গে একটা কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে যে আপনি আসলে কিছু নন। আবার বিকেল পাঁচটার পরে কাজ করতে চাইলে অবশ্যই একটা ফরম পূরণ করতে হতো, প্রতিদিন বিকেল ৪টার মধ্যে। তাতে দেরি হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে হতো। বলা বাহুল্য, কাজটা আমাকে প্রায়ই করতে হয়েছে। এই আমলাতন্ত্র আসলে বিড়ম্বনার।
আমাদের ইনস্টিটিউটে দায়িত্বরত তিন অধ্যাপকের পার্কিংয়ের জায়গা ছিল সংরক্ষিত। ঠিক সামনের দরজার কাছে। তাঁদের মধ্যে একজন কাজ করতেন আমস্টারডামে (তিনি আমার সুপারভাইজার)। ডেলফে আসতেন সপ্তাহে একবার। প্রতি মঙ্গলবার। একদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি যখন এখানে থাকেন না, তখন আপনার পার্কিংয়ের জায়গাটা আমি যদি ব্যবহার করি, তাহলে কি কিছু মনে করবেন?’ জবাবে তিনি বললেন, ‘অবশ্যই না।’ তবে এরপর সেখানে গাড়ি পার্ক করার প্রথম দিনেই পাবলিক ইন্টারকমে আমাকে ডাকা হলো। যতটা সম্ভব কঠোরভাবে আমাকে হুঁশিয়ার করা হলো যেন আমার গাড়িটা সেখান থেকে সরিয়ে নিই। আরেকটা ব্যাপার আছে। নিজের আইসোটোপগুলো নিয়ে আমাকে যেহেতু প্রায়ই আমস্টারডামে যেতে হতো, তাই এক কাপ কফির জন্য ২৫ সেন্ট ও দুপুরের খাবারের জন্য ১.২৫ গিল্ডার অনুমোদন করা হয়েছিল (তখন এক গিল্ডার ছিল এক মার্কিন ডলারের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ)। কিন্তু প্রতিটির জন্য আমাকে রসিদ জমা দিতে হতো আলাদা আলাদা। একবার জিজ্ঞেস করলাম, দুপুরের খাবারের রসিদে ২৫ সেন্ট যোগ করে শুধু ১.৫০ গিল্ডারের একটা রসিদ জমা দিতে পারি কি না। এতে ডিপার্টমেন্টের প্রধান প্রফেসর ব্লেইস আমাকে চিঠি লিখলেন। চিঠিতে বলা হলো, আমি যদি পান-ভোজনে বিলাসী হই, তাহলে তা করতেই পারি। তবে তা করতে হবে নিজ খরচে।
তাই এমআইটিতে যাওয়াটা আমার জন্য ছিল সত্যি খুব আনন্দের। আগের অহেতুক ঝামেলা থেকে মুক্তি। কাজেই খবরটা শুনে যেন পুনর্জন্মের অনুভূতি পেলাম। আমাকে উত্সাহ দিতে সেখানে সবকিছুই করা হলো। সদর দরজার একটা চাবিও পেলাম। নিজের অফিসে কাজ করতে পারলাম দিনে বা রাতে যখন খুশি। ঠিক যেমনটা চাই। আমার কাছে বিল্ডিংয়ের চাবি মানে সবকিছুর চাবিকাঠি। সেখানে ছয় মাস পার হওয়ার পর আমাকে ফ্যাকাল্টির একটা পদের প্রস্তাব দিলেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান। সেটা ১৯৬৬ সালের জুনের ঘটনা। প্রস্তাবটা গ্রহণ করলাম সানন্দে। এরপর সেটা আর ছাড়িনি।
এমআইটিতে আসার সময় ভাগ্য আমার সঙ্গেই ছিল। সেখানে আবিষ্কারের মুহুর্মুহু বিস্ফোরণ হচ্ছিল তখন। তারই মাঝখানে একদিন নিজেকে আবিষ্কার করলাম। আমার যে দক্ষতা ছিল, তা ব্রুনো রসির এক্স-রে জ্যোতির্বিজ্ঞান দলের জন্য ছিল একদম মানানসই। অবশ্য মহাকাশ গবেষণা সম্পর্কে তখনো কিছুই জানতাম না আমি।
যেদিন এমআইটিতে পৌঁছাই, সে দিনটা আমার এখনো মনে আছে। তারিখটা ছিল ১৯৬৬ সালের ১১ জানুয়ারি। কারণ, সেবার আমাদের একটা বাচ্চার মাম্পস হয়েছিল। তাই বস্টনে যেতে দেরি হয়ে গেল। আমাদের বিমানে চড়ার অনুমতি দেয়নি কেএলএম এয়ারলাইনস। কারণ, মাম্পস ছোঁয়াচে রোগ। এমআইটিতে এসে প্রথম দিনেই দেখা করি ব্রুনো রসির সঙ্গে। দেখা করি জর্জ ক্লার্কের সঙ্গেও। অতি উচ্চশক্তির এক্স-রে নিঃসরণকারী উৎসের খোঁজে ১৯৬৪ সালে তিনিই প্রথমবার অতি উচ্চতায় বেলুন ওড়ান। সে উচ্চতা ছিল প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার ফুট। এ রকম উচ্চতায় এ ধরনের এক্স-রে পৌঁছাতে পারে। জর্জ বলেছিল, ‘তুমি যদি আমার দলে যোগ দিতে চাও, তাহলে খুব ভালো হবে।’ আসলে আমি সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় ছিলাম।
সবার আগে প্রথমজন হিসেবে কিছু করলে সফলতা আসতে বাধ্য। আমাদের টিম একের পর এক আবিষ্কার করে যাচ্ছিল। জর্জ ছিলেন খুব উদার মনের মানুষ। দুই বছর পর পুরো দলের দায়িত্ব আমার হাতে তুলে দেন তিনি। জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের নতুন ঢেউয়ের অগ্রগতির মধ্যে থাকাটা ছিল আমার জন্য অসাধারণ একটা ব্যাপার।
মহাবিশ্বের একেবারে প্রান্তসীমায় কালের অনেক পেছনে দেখার সুযোগ দিয়েছে পদার্থবিজ্ঞান। পাশাপাশি হাবল আল্ট্রা ফিল্ড নামে পরিচিত বিস্ময়কর চিত্র তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। এর মাধ্যমে গ্যালাক্সিদের অসীমতা প্রকাশিত হয়েছে। অনলাইনে আল্ট্রা ডিপ ফিল্ড সম্পর্কে খোঁজ না করে এ অধ্যায়টা শেষ করা উচিত নয়
সেই সময় জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে যে রোমহর্ষক কর্মকাণ্ড চলছিল, তার ভেতর নিজেকে আবিষ্কার করাটা ছিল আমার জন্য পরম সৌভাগ্যের। তবে সত্যটা হলো, পদার্থবিজ্ঞানের সব ক্ষেত্রই আসলে চমত্কার। এর সবই কৌতূহলী আনন্দে ভরপুর। প্রায় সব সময় বিস্ময়কর ও নতুন নতুন আবিষ্কার করে চলেছে সব ক্ষেত্র। আমরা যখন নতুন এক্স-রে উত্স খুঁজছি, কণাপদার্থবিদেরা তখন খুঁজে বেড়াচ্ছেন নিউক্লিয়াসের আরও মৌলিক গাঠনিক একক। এভাবে নিউক্লিয়াসকে একত্রে বেঁধে রাখার রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা চলছিল। একসময় ডব্লিউ ও জেড বোসন এবং কোয়ার্ক ও গ্লুয়ন কণা আবিষ্কার করেন ওই বিজ্ঞানীরা। দুর্বল নিউক্লিয়ার মিথস্ক্রিয়া (বা বল) বহন করে ডব্লিউ ও জেড বোসন। অন্যদিকে সবল বা শক্তিশালী নিউক্লিয়ার মিথস্ক্রিয়া (বা বল) বহন করে কোয়ার্ক ও গ্লুয়ন।
মহাবিশ্বের একেবারে প্রান্তসীমায় কালের অনেক পেছনে দেখার সুযোগ দিয়েছে পদার্থবিজ্ঞান। পাশাপাশি হাবল আল্ট্রা ফিল্ড নামে পরিচিত বিস্ময়কর চিত্র তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। এর মাধ্যমে গ্যালাক্সিদের অসীমতা প্রকাশিত হয়েছে। অনলাইনে আল্ট্রা ডিপ ফিল্ড সম্পর্কে খোঁজ না করে এ অধ্যায়টা শেষ করা উচিত নয়। এ ছবিটা দিয়ে কম্পিউটারের স্ক্রিন সেভার বানিয়েছে আমার এক বন্ধু! [হাবল আলট্রা ফিল্ড বা এইচইউডিএফ হলো ফরনাক্স নক্ষত্রমণ্ডলে মহাকাশের ছোট্ট এক অঞ্চল। সেখানে প্রায় ১০ হাজার গ্যালাক্সি আছে বলে অনুমান করা হয়। ২০০৩ থেকে ২০০৪ সালে নাসার হাবল স্পেস টেলিস্কোপের সংগৃহীত উপাত্ত থেকে তৈরি চিত্রটি। এতে প্রায় ১৩ বিলিয়ন বছর আগে, অর্থাত্ বিগ ব্যাংয়ের প্রায় ৪০০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন বছর পরের গ্যালাক্সির আলোও রয়েছে।—অনুবাদক]
আধুনিক হিসাবে, মহাবিশ্বের বয়স প্রায় ১৩.৭ বিলিয়ন বা ১৩৭০ কোটি বছর। যা-ই হোক, মহাবিস্ফোরণের পর থেকে স্থান নিজেই ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছে। তাই আমরা বর্তমানে যেসব গ্যালাক্সি দেখি, সেগুলো গঠিত হয়েছে মহাবিস্ফোরণের প্রায় ৪০০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন বছর পর [এ ধারণাটা বর্তমানে বদলে যাচ্ছে]। সেগুলো ১৩.৭ আলোকবর্ষের চেয়েও অনেক দূরে। জ্যোতির্বিদেরা এখন হিসাব করে দেখেছেন, আমাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের কিনারা আমাদের কাছ থেকে সব দিকে প্রায় ৪৭ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে। স্থানের প্রসারণের কারণে বহুদূরের গ্যালাক্সিগুলো বর্তমানে আমাদের কাছ থেকে আলোর চেয়েও দ্রুত বেগে দূরে সরে যাচ্ছে। ধারণাটা অবিশ্বাস্য, এমনকি অসম্ভবও মনে হতে পারে। কারণ, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বে অনুমান করা হয়েছে, আলোর চেয়ে বেশি গতিতে কোনো কিছু যেতে পারে না। তবে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুসারে, দুটি গ্যালাক্সির মাঝখানের স্থান যখন প্রসারিত হয়, তখন তার গতির কোনো সীমা নেই। আমরা এখন কসমোলজির (গোটা মহাবিশ্বের উত্পত্তি ও বিবর্তন নিয়ে গবেষণা) স্বর্ণযুগে বাস করছি—বিজ্ঞানীদের এ রকম ধারণা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
পদার্থবিজ্ঞান ব্যাখ্যা করেছে রংধনুর সৌন্দর্য ও ভঙ্গুরতা, কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব, গ্রহগুলো নিজস্ব গতিপথে চলে কেন, নক্ষত্র বিস্ফোরিত হলে কী ঘটে, ঘূর্ণমান আইস স্কেটার গতি বাড়ানোর সময় তার বাহু প্রসারিত করে কেন, নভোচারীরা মহাকাশে ওজনশূন্য অনুভব করেন কেন, মহাবিশ্বে মৌল গঠিত হলো কীভাবে, আমাদের মহাবিশ্বের সূচনা হলো কবে, বাঁশি থেকে সুর কীভাবে সৃষ্টি হয়, আমরা কীভাবে বিদ্যুত্ তৈরি করি (যা আমাদের দেহের পাশাপাশি আমাদের অর্থনীতির দিকে নিয়ে যায়) এবং মহাবিস্ফোরণ আসলে কেমন ছিল। একই সঙ্গে অতিপারমাণবিক স্থান ও মহাবিশ্বের সবচেয়ে দূরবর্তী এলাকার মানচিত্র তৈরি করতে পেরেছে পদার্থবিজ্ঞান।
আমি যখন এমআইটিতে আসি, তার আগেই সেখানকার বয়স্কদের একজন ছিলেন আমার বন্ধু ও সহকর্মী ভিক্টর ওয়েইসকফ। তিনি একটা বই লিখেছেন। নাম দ্য প্রিভিলেজ অব বিয়িং আ ফিজিসিস্ট। নারী ও পুরুষেরা রাতের আকাশে সতর্ক চোখে তাকানোর পর থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিদ্যাসংক্রান্ত আবিষ্কারের অন্যতম রোমাঞ্চকর সময়ের মধ্যে আমি যে অনুভূতিতে মুগ্ধ হয়েছি, বইটার এই দুর্দান্ত শিরোনাম সেই অনুভূতির খানিকটা তুলে ধরতে পেরেছে। এমআইটিতে যাঁদের সঙ্গে কাজ করেছি, তাঁরা বিজ্ঞানের সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে কাজ করে যাচ্ছেন অক্লান্তভাবে। ফলে তার জন্য উদ্ভাবন করতে হয়েছে বিস্ময়কর রকম সৃজনশীল ও পরিশীলিত বিভিন্ন কৌশল। নক্ষত্র ও মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানবজাতির সম্মিলিত জ্ঞান প্রসারিত করা ও কয়েক প্রজন্মের তরুণদের এই মহত্ ক্ষেত্রটি সঠিকভাবে উপলব্ধি করাতে পারা এবং ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পারাটাই আমার সৌভাগ্য।
আমার হাতের তালুতে ক্ষয়িষ্ণু আইসোটোপগুলো ধরে রাখার সেই প্রথম দিনগুলো থেকে আমি কখনোই পুরোনো ও নতুন উভয় পদার্থবিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলোর কারণে আনন্দিত না হয়ে পারিনি। আমি আনন্দ পেয়েছি এর সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সদা চলমান অগ্রগতির চরম সীমার কারণে। আবার চারপাশের জগতের অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ের সামনে এসে আমার চোখ খুলে গেছে। এর মধ্য দিয়েও অনাবিল আনন্দ পেয়েছি আমি। আমার জন্য পদার্থবিজ্ঞান হলো দেখার একটা পথ—দৃষ্টি আকর্ষক ও জাগতিক, বিশাল ও ক্ষুদ্র—সামগ্রিকভাবে সুন্দর, রোমাঞ্চকরভাবে জড়িয়ে থাকা কিছু একটা।
এভাবে আমি সব সময় আমার শিক্ষার্থীদের জন্য পদার্থবিজ্ঞানকে জীবন্ত করার চেষ্টা করেছি। আমি বিশ্বাস করি, তাদের জন্য জটিল গণিতের ওপর মনোযোগ দেওয়ার চেয়ে আবিষ্কারের সৌন্দর্য মনে রাখা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তাদের বেশির ভাগই আসলে পরবর্তীকালে পদার্থবিদ হতে যাচ্ছে না। পৃথিবীকে অন্যভাবে দেখতে তাদের সহায়তা করার সব রকম চেষ্টা করেছি আমি। তাদের এমন সব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি, যেগুলো আগে কখনো করার কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি তারা। তাদের এমনভাবে রংধনু দেখিয়েছি, যা আগে কখনো দেখেনি। গাণিতিক বিবরণের বদলে পদার্থবিজ্ঞানের চমত্কার সৌন্দর্যের দিকে তারা যেন মনোযোগ দেয়, সেই চেষ্টা করেছি। এ বইটা লেখার উদ্দেশ্যও আসলে তা-ই। অসাধারণ সব উপায়ে আমাদের জগতের কাজকারবার এবং তার বিস্ময়কর আভিজাত্য ও সৌন্দর্য আলোকিত করে তোলে পদার্থবিজ্ঞান। সেসব অসাধারণ উপায় দেখার জন্য আপনার চোখ খুলে দেওয়াই এ বইয়ের মূল উদ্দেশ্য।