ফার্মি কি ভুল করে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছিলেন

মহাবিশ্বের অর্ধেক কণা, অর্থাৎ সব পদার্থের কণার নাম রাখা হয়েছে তাঁর নামে—ফার্মিওন। সেই এনরিকো ফার্মি পদার্থবিজ্ঞানে ভুল করে নোবেল পেয়ে গেছেন! এর সূত্র ধরেই শুরু হয় পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রতিযোগিতা। দ্য পোপ অব ফিজিকস এনরিকো ফার্মির ভুল নোবেল জয়ের সেই রোমাঞ্চকর কাহিনি…

ইতালির রাজধানী রোম। ১৯৩৪ সালের মে মাস। বেশ আরামদায়ক আবহাওয়া। তবে সেটা উপভোগ করার সময় নেই এনরিকো ফার্মির। তিনি তখন ল্যাবের করিডর ধরে দ্রুতপায়ে হাঁটছেন। আসলে ছুটছেন বলাই ভালো। তাঁর সঙ্গে তাল মেলাতে পিছু পিছু প্রায় দৌড়াচ্ছেন তাঁরই ছাত্র। নাম এদোয়ার্দো আমালদি। দুজনের ধূসর ও নোংরা ল্যাবকোটগুলো তাঁদের পেছনে উড়ছে পতাকার মতো। তাঁদের উত্তেজিত পায়ের আঘাতে মেঝেতে কাঠের বোর্ডে প্রচণ্ড ধুপধাপ আওয়াজ তুলছে। ওপরতলায় ফার্মির গুরু প্রফেসর অরসো মারিও করবিনোর ফ্ল্যাট। এই শব্দ সেখানকার নিস্তব্ধতা খানখান করে দিচ্ছে। তাতে বিরক্ত হতেই পারেন করবিনো। কিন্তু আপাতত সেদিকে খেয়াল করার সময় নেই ফার্মির।

করিডরের শেষ মাথায় তাঁদের ল্যাব। সেখানে চলছে বিশেষ এক পরীক্ষা। নতুন মৌল বানানোর চেষ্টা করছে এই বিজ্ঞানী দল। কিন্তু নতুন মৌলটা দ্রুত অন্য মৌলে পরিণত হয়ে যাওয়ার কথা। তাঁদের এত দিনের চেষ্টার ফসল অন্য কিছুতে রূপান্তরিত হওয়ার আগেই ল্যাবে পৌঁছাতে চান তাঁরা। সে জন্য ছুটছেন এমন তড়িঘড়ি করে।

ফ্যাসিবাদী নেতা বেনিতো মুসোলিনির ইতালিতে তখন তারকা বিজ্ঞানী ফার্মি। বয়স ৩৩ বছর। মুখটা ছোটখাটো হলেও নাকটা লম্বা ও পাতলা। কপাল লম্বা ও উপবৃত্তাকার। চিবুকে সব সময় রহস্যময় মৃদু হাসির আভাস।

প্রায় এক দশক আগে, মাত্র ২৪ বছর বয়সে রোম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন ফার্মি। এর পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে একটা গবেষণাগার স্থাপন করেন। সেটা শহরকেন্দ্রের ভিয়া প্যানিস্পারনা সড়কের পাশে এক পুরোনো ভিলাতে। তখনো আধুনিক বিজ্ঞানচর্চায় ইতালি ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ পিছিয়ে। ফার্মি শপথ নেন, যে করে হোক ইতালীয় বিজ্ঞানকে সামনে এগিয়ে নেবেন। বিশেষ করে সে যুগে আলোচিত নিউক্লিয়ার ফিজিকসে। সেই লক্ষ্যে কিছুদিন পর সঙ্গে নেন তরুণ ও মেধাবী এক দলকে। কিন্তু বাস্তবে ফার্মি কিংবা তাঁর তরুণ দলের স্রেফ তাত্ত্বিক জ্ঞানটুকুই ছিল। নিউক্লিয়ার ফিজিকস সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল না কারোরই। এ ব্যাপারে তাঁরা ছিলেন সত্যিকারের ‌‘ফ্রেশ’। তাতেও পরোয়া নেই। এই তরুণদের চোখে ফার্মি হলেন ‘দ্য পোপ’। তিনি কোনো কিছু করতে বললেই ওই তরুণেরা তাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁরাই একসময় ইতিহাসে পরিচিত হয়ে ওঠেন ‘ভিয়া প্যানিস্পারনা বয়েজ’ নামে। আর ফার্মি পরিচিত হয়ে ওঠেন ‘পোপ অব ফিজিকস’ নামে।

ফার্মির আগ্রহ ছিল বিটা বিকিরণে। এ প্রক্রিয়ায় মৌল প্রোটন হারায় না, বরং নিউট্রন রূপান্তর হয় প্রোটনে। একটা ইলেকট্রনও ছিটকে বেরিয়ে আসে।

মুসোলিনির পৃষ্ঠপোষকতা সত্ত্বেও এই তরুণদের মনোবল শুরুতে কিছুটা ভেঙে গিয়েছিল। কারণ, তাঁদের ব্রিটিশ, ফরাসি ও মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছিল সেকালের সেরা যন্ত্রপাতি। সে তুলনায় তাঁরা যেন খালি হাতে লড়ছিলেন বাঘের সঙ্গে। এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। সে জন্য বলতে গেলে, কুটিরশিল্পের আশ্রয় নিল দলটি। নিজেরাই বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বানাতে লাগল। এভাবে একনাগাড়ে ট্রায়াল আর এরর পদ্ধতিতে বানিয়ে ফেলল একটা গাইগার কাউন্টার। তেজস্ক্রিয় মৌলের গবেষণার সময় ক্ষতিকর বিকিরণ থেকে বাঁচার জন্য প্রতিরক্ষা যন্ত্রপাতিও ছিল না তাদের। সে জন্য পরীক্ষার সময় করিডরের শেষ মাথায় দৌড়ে গিয়ে লুকাতে হতো। কিছুক্ষণ পরই পরীক্ষার ফলাফল দেখতে আবার দ্রুতপায়ে ছুটতে হতো ল্যাবের দিকে। সেদিনও ঠিক সেভাবেই ল্যাবের দিকে ছুটছিলেন ফার্মি ও আমালদি। 

এর কয়েক দশক আগে তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে বিকিরণের তিনটি ধরন আবিষ্কার করেন আর্নেস্ট রাদারফোর্ড। চুম্বকের প্রভাবে এই বিকিরণের কিছু অংশ একদিকে সামান্য একটু বেঁকে যায়। কিছু অংশ বেঁকে যায় আরেক দিকে। তৃতীয় অংশটা এমনভাবে সোজা পথে চলতে থাকে, যেন সেখানে কোনো চুম্বকের উপস্থিতি নেই। এই তিন বিকিরণের নাম দেওয়া হয় গ্রিক বর্ণ দিয়ে—আলফা, বিটা ও গামা রশ্মি। পরে জানা গেল, আলফা কণা আসলে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস। এতে দুটি প্রোটন ও দুটি নিউট্রন থাকে। ভরও হাইড্রোজেন পরমাণুর চার গুণ। ১৯০১ সালের দিকে এক পরীক্ষায় থোরিয়ামকে (মৌল ৯০) দুটি প্রোটন হারিয়ে রেডিয়ামে (মৌল ৮৮) রূপান্তরিত হতে দেখেছিলেন রাদারফোর্ড ও ফ্রেডরিক সোডি। আসলে দুটি প্রোটন হারিয়ে সেটা পর্যায় সারণির দুই ধাপ নিচে নেমে এসেছিল। তেজস্ক্রিয়তার মাধ্যমে কোনো মৌল এভাবে ক্ষয় হয়ে অর্ধেক হতে যে সময় নেয়, তাকে এখন বলা হয় হাফ লাইফ বা অর্ধায়ু।

তবে ফার্মির আগ্রহ ছিল বিটা বিকিরণে। এ প্রক্রিয়ায় মৌল প্রোটন হারায় না, বরং নিউট্রন রূপান্তর হয় প্রোটনে। একটা ইলেকট্রনও ছিটকে বেরিয়ে আসে। ফলে মৌলটি পর্যায় সারণির এক ধাপ সামনে এগিয়ে যায়। অর্থাৎ রূপান্তরিত হয় তুলনামূলক ভারী মৌলে। কিন্তু এতে যথেষ্ট শক্তি ক্ষয় হয় না। ফার্মি ধারণা করলেন, এ প্রক্রিয়ায় নিউক্লিয়াস থেকে ছোট একটা কণাও বেরিয়ে আসে। তার আকার ইলেকট্রনের চেয়েও ছোট। এ–সংক্রান্ত একটা গবেষণাপত্র ছাপানোর জন্য নেচার জার্নালে পাঠালেন তিনি। কিন্তু জার্নাল কর্তৃপক্ষ তা বিশ্বাস করল না। ফার্মির গবেষণাপত্র বাতিল করা হলো। তাতেও দমানো গেল না ফার্মিকে। প্যানিস্পারনাদের সঙ্গে নিয়ে আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেন। অনেকটা মজার ছলে। হতাশা ও ক্ষোভ ভুলতেই বোধ হয় সে চেষ্টা। এ সময়ে তাঁর মাথায় নতুন আরেকটা চিন্তা খেলে যায়।

বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি (ডানে) ও তাঁর দল প্যানিস্পারনা বয়েজ
চিন্তাটাকে হাতে–কলমে করে দেখতে চাইলেন ফার্মি। কিন্তু বেশ কটি ঝামেলার মুখোমুখি হতে হলো। প্রথমটা নিউট্রন কণা ধরে রাখা। সেটা কীভাবে করা সম্ভব? সমাধান পাওয়া গেল একদম হাতের নাগালে। ওই বিল্ডিংয়ের নিচতলায় কাজ করতেন আরেক বিজ্ঞানী।

বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রমাণ পাওয়া গেছে, কোনো পরমাণুর নিউক্লিয়াসে আলফা কণা দিয়ে আঘাত করলে তাতে দুটি প্রোটন ও দুটি নিউট্রন যুক্ত হয়। ফ্রান্সে সেটি করেছেন আইরিন জুলিও কুরি এবং তাঁর স্বামী ফ্রেডরিক। এভাবে অ্যালুমিনিয়ামকে (মৌল ১৩) ফসফরাসে (মৌল ১৫) রূপান্তর করতে সক্ষম হন ওই দম্পতি। নামকরা মেরি ও পিয়ের কুরির মেয়ে আইরিন। তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে তাঁদের পারিবারিক কাজকারবার দীর্ঘদিনের। নিউক্লিয়াসের মতো আলফা কণাও ধনাত্মক চার্জবাহী। এতে ধনাত্মক চার্জযুক্ত দুটি প্রোটন থাকে। কিন্তু সে কারণে নিউক্লিয়াসে আলফা কণা দিয়ে আঘাত করার বেলায় একটা সমস্যা দেখা যায়। নিউক্লিয়াস ও আলফা কণা—দুটোর চার্জই ধনাত্মক হওয়ায় পরস্পরকে বিকর্ষণ করে। চুম্বকের সমমেরুর মতো। তাই এই আঘাত কার্যকর করতে আলফা কণাকে অনেক বেশি শক্তিতে ছুড়তে হয়, যাতে ওই বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বিকর্ষণ কাটিয়ে ওঠা যায়। সে জন্য দরকার পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটর বা কণাত্বরক যন্ত্র।

দুর্ভাগ্যের বিষয়, ফার্মির কাছে পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটর ছিল না। আসলে সেটা কেনার সামর্থ্যই ছিল না তাঁদের। অভাব থেকেও যে ভালো কিছু হয়, সেই প্রবাদসম বাক্যটা এবার প্রমাণ করলেন ফার্মি। কাজটা করতে বিকল্প এক উপায়ের খোঁজ করতে লাগলেন। ভাবলেন, নিউক্লিয়াসে যদি আলফা কণার বদলে নিউট্রন কণা দিয়ে আঘাত হানা হয়, তাহলে কী ঘটবে? কারণ, নিউট্রনের চার্জ নেই। তাই নিউক্লিয়াস তাকে বিকর্ষণ করবে না। অনেক শক্তি ব্যয় না করেই নিউক্লিয়াসে কণাটা ঢুকিয়ে দেওয়াও সহজ। কোনোভাবে নিউট্রনটা যদি নিউক্লিয়াসের কেন্দ্রে ঢুকে যেতে পারে, তাহলে সেখানে শক্তি বেড়ে যাবে। শুরু হবে বিটা ক্ষয়প্রক্রিয়া। মানে নিউট্রনটা রূপান্তরিত হবে প্রোটনে। তাতে মজার কিছু ঘটতেও পারে।

চিন্তাটাকে হাতে–কলমে করে দেখতে চাইলেন ফার্মি। কিন্তু বেশ কটি ঝামেলার মুখোমুখি হতে হলো। প্রথমটা নিউট্রন কণা ধরে রাখা। সেটা কীভাবে করা সম্ভব? সমাধান পাওয়া গেল একদম হাতের নাগালে। ওই বিল্ডিংয়ের নিচতলায় কাজ করতেন আরেক বিজ্ঞানী। গুইলিও সিজার ট্রাব্বাচি। তাঁর কাছে এক গ্রাম রেডিয়াম ছিল। যার তৎকালীন বাজারমূল্য প্রায় ১০ লাখ লিরার বেশি। ভিয়া প্যানিস্পারনা বয়েজদের বার্ষিক বাজেটের প্রায় ২০ গুণ। কাজেই রেডিয়ামটুকু রাখা হয়েছিল একটা সিন্দুকের ভেতর। সেটা কোনোভাবে চুরি করার কথা ভাবলেন ফার্মি। কিন্তু তা সম্ভব হলো না। কাজেই প্ল্যান বি। মানে বিকল্প চিন্তা করতে হলো। রেডিয়াম তেজস্ক্রিয় মৌল, যা আলফা বিকিরণ নিঃসরণ করে গ্যাসে পরিণত হয়—রেডন গ্যাস। সিন্দুকের ভেতর একটা পাইপ ঢুকিয়ে পাম্প করে জমে থাকা রেডন গ্যাসটুকু বের করে আনলেন ফার্মি। একটা ছোট্ট শিশিতে ভরে নিলেন সেটুকু। শিশিতে ছিল বেরিলিয়াম পাউডার। গ্যাসটা পাউডারের সঙ্গে মিশে গেল। অতি তেজস্ক্রিয় রেডন গ্যাস থেকে বেরিয়ে আসা আলফা কণা বেরিলিয়াম পরমাণুতে আঘাত করতে লাগল। ফলে সজোরে বেরিয়ে আসতে লাগল নিউট্রন। ব্যস, এভাবে নিজেদের কুটিরশিল্পে একটা নিউট্রন বিম বানিয়ে ফেললেন ফার্মি। এখন এমন কোনো মৌল দরকার, যেখানে এসব কণা ছুড়ে দেখা যাবে, কী ঘটে। কিন্তু কোন মৌল বেছে নেওয়া যায়?

সিদ্ধান্তে আসতে না পেরে সব কটি মৌল পরীক্ষা করে দেখতে চাইলেন ফার্মি। সে জন্য একটা বাজারের ফর্দ লিখে ফেললেন। সেখানে টার্গেট হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব সব কটি মৌল বা যৌগের নাম লিখলেন। তারপর তুলে দিলেন এমিলিও সের্গির হাতে। কারণ, ফার্মির স্ত্রী লরার মতে, বাজারসদাই খুবই অপছন্দের ছিল ফার্মির। তাই বাসায় ফিরে দুপুরে দিলেন একপ্রস্ত ‘ভাতঘুম’।

ওদিকে ফর্দে লেখা সদাইপাতি রোমের অলিগলি তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলেন সের্গি। অচিরেই এক দোকানে সব কটি রাসায়নিক পেয়ে গেলেন। দোকানদার খুশি হয়ে বাড়তি আরও কিছু রাসায়নিক ফ্রিতে গছিয়ে দিলেন তাঁকে। কারণ, ১৫ বছর ধরে ওসব রাসায়নিকের খোঁজ করেনি কেউ। আলমারির তাকে পড়ে থাকতে থাকতে ধুলা জমে গেছে। সেগুলোও গবেষণাগারে বয়ে নিয়ে এলেন সের্গি।

এবার শুরু হলো আসল কাজ। পারমাণবিক সংখ্যা অনুযায়ী প্রতিটি মৌলকে টার্গেট হিসেবে বেছে নিল প্যানিস্পারনা বয়েজ। পর্যায় সারণির প্রথম দিককার মৌলগুলোয় খুব বেশি সুবিধা হলো না। কিছুই ঘটল না বলা চলে। পরের মৌলগুলোয় নিউট্রন কণার আঘাতে পাওয়া গেল আলফা কণার বিকিরণ। তাতে মৌলগুলো নিজেদের জায়গা ছেড়ে পর্যায় সারণির দুই ধাপ পেছনের মৌলে রূপান্তরিত হলো। কিন্তু মুশকিল হলো ভারী মৌলগুলোর বেলায়। সেখান থেকে আলফা কণা পাওয়া সহজ হলো না। নিউক্লিয়াসকে যে বলটি একত্রে বেঁধে রাখে (সবল নিউক্লিয়ার বল), তা নিউট্রনকে শক্তভাবে আটকে রেখেছে বলে ধারণা করলেন ফার্মি। ফলে হিসাবমতো মৌলটিতে একসময় শুরু হবে বিটা ক্ষয়। স্বাভাবিকভাবে সেটা পর্যায় সারণিতে এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে রূপান্তরিত হবে আরও ভারী মৌলে। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় নিউট্রন ক্যাপচার।

এনরিকো ফার্মি
নিজের আবিষ্কার সম্পর্কে আরও নিঃসন্দেহ হতে তখনো কাজ করে যাচ্ছিলেন ফার্মি ও তাঁর দল। এ সময় আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করে বসেন তিনি।

এভাবে মাত্র কয়েক সপ্তাহে পর্যায় সারণির প্রায় সব কটি মৌলই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা শেষ হয়ে গেল। বাকি রইল সর্বশেষ মৌল। নম্বর ৯২। সবাই চেনে ইউরেনিয়াম নামে। এখন দেখার পালা, এই ভারী মৌলে নিউট্রন কণার আঘাতে কী ঘটে। সেদিনও নিউট্রন বিম ছুড়ে করিডরের অন্য মাথায় দৌড়ে গেলেন ফার্মি ও আমালদি। কিছুক্ষণ পর আবারও ল্যাবের দিকে দৌড়াচ্ছিলেন ফার্মি। কারণ, দ্রুত ফলাফলটা দেখতে চান তাঁরা। বিশ্লেষণ করে দেখা গেল, ইউরেনিয়াম অন্য কিছুতে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রশ্ন হলো, কিসে? হালকা নাকি ভারী মৌলে? কোন প্রক্রিয়ায় সেটা ঘটেছে? সেটা কি আলফা বিকিরণ প্রক্রিয়ায় জানা কোনো মৌলে রূপান্তরিত হয়েছে? নাকি বিটা ক্ষয়প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে নতুন কোনো মৌলে?

নতুন পদার্থের অর্ধায়ু ও রাসায়নিক ধর্ম বিভিন্ন জানা মৌলের সঙ্গে একে একে তুলনা করে দেখলেন তাঁরা। পর্যায় সারণির নিচের দিকে মৌল নম্বর ৮২ বা সিসা পর্যন্ত। আলফা কণা নিঃসরণ যদি ঘটে, তাহলে চেইন ক্ষয় প্রক্রিয়ায় সেটা ক্রমান্বয়ে মৌল ৯০, ৮৮, ৮৬ ইত্যাদিতে রূপান্তরিত হতে পারে। কিন্তু পরীক্ষায় আলফা ক্ষয়ের এ রকম কোনো প্রমাণ মিলল না। তাহলে এর একমাত্র ব্যাখ্যা হতে পারে, মৌলটিতে বিটা ক্ষয় ঘটেছে। এমনটাই মনে হলো ফার্মির। আরও পরীক্ষার পর আরেকটা রহস্যের জন্ম হলো। তারও একমাত্র সমাধান ওই বিটা ক্ষয়।

তখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস ছিল, ইউরেনিয়ামের পরে আর ভারী কোনো মৌল নেই। এটাই যেন পর্যায় সারণির সমাপ্তির সিলমোহর। মৌলটি সম্পর্কে ১৭৮৯ সাল থেকে মানুষের জানা ছিল। তখনো ল্যাভয়েসিয়ে জীবিত। এমনকি পর্যায় সারণিরও জন্ম হয়নি। ফার্মি এবং তাঁর দল কুটিরশিল্পে বানানো যন্ত্রপাতি দিয়ে এমন কিছু আবিষ্কারের দাবি করে বসলেন, যা সেকালের আধুনিক ল্যাবে উন্নত মানের যন্ত্রপাতি দিয়েও কেউ করতে পারেনি। এমন কিছু করার কথা কখনো চিন্তাও করেনি। অথচ ইতালির এই অখ্যাত দলটিই সেদিন দিমিত্রি মেন্ডেলিভের পর্যায় সারণির সীমানা ভেঙে ফেলল। তৈরি হলো ইউরেনিয়ামের পরের মৌল। একে বলে ট্রান্সইউরেনিক মৌল বা ট্রান্সইউরেনিয়াম। অচিরেই বিশ্ববাসীর কাছে ৯৩ ও ৯৪ নম্বর মৌল আবিষ্কারের ঘোষণা দিলেন এনরিকো ফার্মি।

ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াসে নিউট্রন দিয়ে আঘাত করলে তৈরি হয় বেরিয়াম ও ক্রিপটন

২.

ফার্মির ঘোষণার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা নড়েচড়ে বসতে শুরু করলেন। ১৯৩৪ সালে ট্রান্সইউরেনিক বা ট্রান্সইউরেনিয়াম মৌল হইচই ফেলে দিল। ফার্মির আইডিয়া ব্যবহার পরীক্ষাটি নিজেদের মতো করে দেখতে চাইলেন অনেকে। তবে এই আবিষ্কার নিয়ে সন্দেহও করলেন কেউ কেউ। বিশেষ করে জার্মান রসায়নবিদ ইডা নোড্যাক। তাঁর ধারণা, এখানে নতুন মৌল তৈরি হয়নি, বরং ইউরেনিয়াম ভেঙে তার চেয়ে হালকা মৌল তৈরি হয়েছে। কিন্তু তাঁর কথায় কান দিল না কেউই।

এদিকে মুসোলিনি সরকারনিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হলো ফার্মির দলের আবিষ্কারের কথা। তাঁর ফ্যাসিস্ট সরকার যে শিক্ষা-সংস্কৃতিতে পিছিয়ে নেই, তা দাবি করতে লাগল। দেশটির দ্বিতীয় সারির এক দৈনিকে দাবি করা হলো, ইতালির রানির জন্য উপহার হিসেবে ছোট্ট একটা শিশিতে নতুন মৌলটা নিয়ে গেছেন ফার্মি। কিন্তু সেটা সত্যি নয়। আসলে তেজস্ক্রিয় মৌলের বিপদ জানতেন তিনি। কারণ, মেরি কুরিও এককালে নিজের কাছে সব সময় একটা শিশিতে রেডিয়াম রাখতেন। এতে পরে ক্যানসারে আক্রান্ত হন তিনি। সেটাই তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়েছিল।

মুসোলিনির ইচ্ছা, নতুন মৌলটার নাম ইতালির রেক্টরের নামে হোক। রেক্টর হলো প্রাচীন রোমের সরকারি কর্মচারী, যার হাতে রোমের প্রতীক ফ্যাসেস ধরা থাকত। এই প্রতীক থেকে মুসোলিনি নিজের মতবাদের নাম দিয়েছেন ফ্যাসিজম বা ফ্যাসিবাদ। কিন্তু ফার্মি চাইলেন, নতুন মৌল দুটির নাম হোক ইতালির গ্রিক নামানুসারে—অসোনিয়াম ও হেসপেরিয়াম। কথিত আছে, মুসোলিনিকে খুশি করতে তাঁর নামেও একটা মৌলের নামকরণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন ফার্মি। তাহলে হয়তো মৌলটার নাম হতো মুসোলিয়াম!

নিজের আবিষ্কার সম্পর্কে আরও নিঃসন্দেহ হতে তখনো কাজ করে যাচ্ছিলেন ফার্মি ও তাঁর দল। এ সময় আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করে বসেন তিনি। নিউক্লিয়াস লক্ষ্য করে নিউট্রন বিম ছোড়ার সময় গতিপথে যদি এমন কিছু রাখা হয়, যা নিউট্রন কণার গতি কমাতে পারে, তাহলে ভালো ফল পাওয়া যায়। প্যারাফিন মোম কাজটি করতে পারে। ফার্মি বুঝতে পারলেন, মোমের হাইড্রোজেন পরমাণু নিউট্রনকে ধীরগতির করে দিচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘ফ্যান্টাস্টিক! অবিশ্বাস্য! এ তো ব্ল্যাক ম্যাজিক!’

সদ্য আবিষ্কারটা আরেকটু ঝালিয়ে নিতে চাইলেন। যন্ত্রপাতি হাতে তুলে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলেন ফার্মি। তারপর একলাফে পার্শ্ববর্তী মাছের পুকুরে। পানিতে যন্ত্রটা চুবিয়ে ধরলেন। কারণ, পানিই সবচেয়ে হাইড্রোজেনসমৃদ্ধ। ধীরগতির বা স্লো নিউট্রন মানে নিউক্লিয়াসের পাশে তার বেশি সময় থাকা। তাতে নিউক্লিয়াসে সেটা আটকে পড়ার সম্ভাবনা বাড়ে। তাতে বাড়ে পারমাণবিক বিক্রিয়ার পরিমাণও। পানিই নিউট্রন কণার গতি সবচেয়ে কার্যকরভাবে ধীর করে দেয়। এভাবে নতুন এক পদ্ধতি আবিষ্কার করেন ফার্মি। বর্তমানে পারমাণবিক চুল্লিতে তাঁর আবিষ্কৃত পদ্ধতিটি ব্যবহার করা হয়।

স্লো নিউট্রন নিয়ে ফার্মির আবিষ্কার আরেকটা হইচইয়ের জন্ম দিল। একই পদ্ধতিতে কাজ শুরু করল বিশ্বের বড় কিছু দলও। এগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও জার্মানি। এসব দেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হলো। তাঁদের ল্যাব ফার্মিদের চেয়ে অনেক উন্নত। যন্ত্রপাতিও আধুনিক। তাঁদেরও ইচ্ছা, নতুন মৌল বা নিদেনপক্ষে নতুন আইসোটোপ তৈরি করা।

তবে ফার্মির দলের হাসি অচিরেই মুছে গেল। শেষ হয়ে গেল ভিয়া প্যানিস্পারনা বয়েজের সুখের দিনও। ইউরোপে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসি আসি করছে। নাৎসি জার্মানির একনায়ক অ্যাডলফ হিটলার শুরু করেছেন ইহুদি বিতাড়ন। তাঁর সঙ্গী হলেন মুসোলিনিও। নিজেদের পৃষ্ঠপোষকের আসল চেহারা এত দিনে স্পষ্ট হলো ফার্মির দলের কাছে। ইতালি থেকেও ইহুদিদের তাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন মুসোলিনি।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে ফার্মির জন্য খুবই হতাশাজনক একটা খবর অপেক্ষা করছিল। সেখানে গিয়ে বুঝতে পারলেন, তিনি এবং তাঁর ছেলেরা আসলে পুরো ভুল ছিলেন। আসলে নতুন কোনো মৌল আবিষ্কার করেননি তাঁরা! তাহলে, বিষয়টা আসলে কী?

ফার্মির স্ত্রী লরা ছিলেন ইহুদি। কাজেই স্ত্রী-সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ইতালি থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। পালানোর পথও ঠিক করে ফেলেন। কিছুদিন আগে এক বিজ্ঞান সম্মেলনে গিয়েছিলেন ফার্মি। সেখানে নীলস বোর তাঁকে একপাশে ডেকে নিয়ে একান্তে জানান, তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। ফার্মি ভাবলেন, নোবেল পুরস্কার পেলে সব ছেড়েছুড়ে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন জীবন শুরু করা কঠিন হবে না। কাজেই দিন গুনতে লাগলেন তিনি।

সেই আশায় ১৯৩৮ সালের ১০ অক্টোবর সন্ধ্যায় রেডিও শুনতে বসলেন ফার্মি ও লরা। ইতালিতে ইহুদিদের আরও কোণঠাসা করতে নতুন আইন পাসের ঘোষণার কথা জানানো হলো খবরে। অজানা আশঙ্কায় তাঁর রক্ত ছলকে উঠল। এর কিছুক্ষণ পরেই বাসার ফোন বেজে উঠল। ফোন তুলে কানে লাগালেন ফার্মি। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত খবর শুনলেন টেলিফোনে। নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ফার্মি। পুরস্কারটা পেয়েছেন, ‘নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল ও ধীরগতির নিউট্রনের মাধ্যমে পারমাণবিক বিক্রিয়া আবিষ্কারের জন্য।’

ভীষণ খুশি পুরো পরিবার। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল তারা। কিছুদিন পর কোনো দ্বিধা ছাড়াই সুইডেনে পুরস্কার নিতে গেলেন ফার্মি। সঙ্গে লরা ও সন্তানেরা। এরপর সেখান থেকে আটলান্টিক পেরিয়ে সোজা যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। সবাই জানে, একটা লেকচার দিতে এসেছেন। কিন্তু ততক্ষণে মুসোলিনি সরকারের বোধোদয় হলো। তারা বুঝতে পারল, সপরিবার দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন ফার্মি।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে ফার্মির জন্য খুবই হতাশাজনক একটা খবর অপেক্ষা করছিল। সেখানে গিয়ে বুঝতে পারলেন, তিনি এবং তাঁর ছেলেরা আসলে পুরো ভুল ছিলেন। আসলে নতুন কোনো মৌল আবিষ্কার করেননি তাঁরা! তাহলে, বিষয়টা আসলে কী?

৩.

আসলে সে সময় নোবেল কমিটি মাঝেমধ্যেই ভুল করত। মানে, ভুল আবিষ্কারের জন্যও পুরস্কার দিয়ে বসত। যেমন ১৯৪৯ সালে লোবোটোমিস (একধরনের মস্তিষ্ক সার্জারি) আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুদিন পরেই একে গোটা বিশ্বে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯২৬ সালে পুরস্কার দেওয়া হয় জোহানেস ফিবিজারকে। তিনি আবিষ্কার করেন, পরজীবী কৃমির কারণে ক্যানসার হয়। পরে দেখা গেল, সেটা ভুল ধারণা। একইভাবে ১৯৩৮ সালে ফার্মিকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় ইউরেনিয়ামের পরের নতুন মৌল আবিষ্কারের জন্য। কিন্তু আসলে সেটা কোনো দিনই আবিষ্কার করেননি ফার্মি। তাহলে ঘটনা কী? ফার্মি আসলে কী করেছিলেন?

নতুন মৌল তৈরির বেশ কিছু সমস্যা আছে। যেমন সেটা যে নতুন মৌল, তা প্রমাণ করা যাবে কীভাবে? কারণ, হয়তো সেটা এমন কিছু, যা আগে কেউ করেনি বা দেখেনি। এখানেই ভুলটা করেন ফার্মি। তিনি যদি তাঁর ফলাফলটা আরও ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখতেন, তাহলে হয়তো ভুলটা চোখে পড়ত। হয়তো বুঝতে পারতেন, তাঁরা যাকে নতুন বলে দাবি করেছেন, সেটা আসলে বেরিয়াম, ক্রিপটন এবং অন্যান্য মৌলের ধ্বংসাবশেষ। সেটা আগে বুঝতে পারলে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে মাথার চুল ছিঁড়তে হতো না। তবে তাঁরা নিজেদের অজান্তে যা করেছেন, সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ, পরমাণুকে দুই ভাগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন ফার্মির দল। মানে পরমাণুর বিস্ফোরণ।

কিন্তু ওই আবিষ্কারের কৃতিত্ব পেয়ে যায় এক জার্মান দল। আসলে জার্মানির বার্লিনে কাইজার উইলহেম ইনস্টিটিউট ফর কেমিস্ট্রির ওই দলও ফার্মির আবিষ্কৃত পদ্ধতিতে নতুন মৌল তৈরি করতে চাচ্ছিল। এ দলে ছিলেন অটো হান ও ফ্রিটজ স্ট্রার্সম্যান। ১৯৩৮ সালের শেষ দিকে ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াস লক্ষ্য করে স্লো নিউট্রন ছুড়ছিলেন দুই বিজ্ঞানী। কিন্তু ফলাফলটা ছিল খুবই বিভ্রান্তিকর। অনেক চেষ্টাতেও ইউরেনিয়ামের পরের ভারী মৌল তৈরি সম্ভব হলো না। বদলে পাওয়া গেল বেরিয়াম। মানে মৌল ৫৬। এর গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা কী হতে পারে? উত্তর হলো, তাঁদের প্রক্রিয়ায় ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসটা যদি কোনোভাবে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে থাকে, তাহলেই শুধু সেটা ঘটা সম্ভব।

কয়েক মাস আগে অটো হানের ঘনিষ্ঠ ল্যাব পার্টনার ছিলেন লিজ মাইটনার। জাতে ইহুদি। তাই নাৎসি বাহিনীর ভয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন সুইডেনের কুনগালভে। সঙ্গে আছেন তাঁর আত্মীয় অটো ফ্রিটজ। জার্মানি থেকে অটো হানের চিঠিতে বিষয়টা জানতে পারেন মাইটনার। চিঠির ভাষ্য: তুমি হয়তো ভালো কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারবে...বুঝতে পারছি, এটা কিছুতেই বেরিয়ামে ভেঙে যেতে পারে না।

মাইটনার বেশ কিছুদিন বিষয়টা নিয়ে ভাবলেন। একসময় বুঝতে পারলেন, হানের পরীক্ষায় আসলে কী ঘটেছে। ১৯৩০-এর দশকে পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে আর ভঙ্গুর কেন্দ্র হিসেবে ভাবা হতো না, যা ফেটে বা ভেঙে যায়। বরং একে কল্পনা করা হতো উচ্চ ঘনত্বের তরলের ফোটার মতো। এ রকম নিউক্লিয়াসের সঙ্গে নতুন নিউট্রন যুক্ত হওয়া মানে তরল কেন্দ্রটায় আকস্মিক একটা ঝাঁকি। মাইটনার কাগজ, পেনসিল নিয়ে আঁকতে শুরু করলেন। ওই ঝাঁকির শক্তির কারণে তরলটা যদি ডাম্বেল আকৃতির কিছুতে পরিণত হয়, তাহলে কী হবে? কিছু ক্ষেত্রে যে বল নিউক্লিয়াসকে একত্রে আটকে রাখে এবং বিদ্যুৎচুম্বকীয় বিকর্ষণ তাকে ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করতে চায়, উভয়ই পরস্পরকে বাতিল করে দেয়। সে কারণে তরলটা ভেঙে পরিণত হবে ছোট ছোট ফোঁটার মতো কিছু একটায়।

আগেই বলেছি, ফার্মিদের আবিষ্কার নিয়ে শুরুতে সন্দেহ করেছিলেন ইডা নোড্যাক। তাঁর সন্দেহ আসলে সঠিক ছিল। নতুন মৌল তৈরি করতে অনেক বেশি শক্তির দরকার, যাতে আক্ষরিক অর্থেই নিউক্লিয়াসটা নড়েচড়ে ওঠে। কিন্তু অতিরিক্ত শক্তি ব্যবহারের কারণে নিউক্লিয়াসটা ধসে ছিন্নবিচ্ছিন্নও হয়ে যেতে পারে। হান ও স্ট্রার্সম্যানের পরীক্ষাতেও সেটাই দেখা গিয়েছিল বলে ধারণা করেন মাইটনার। তাঁরা এ ঘটনাকে বললেন নিউক্লিয়ার ফিশন। বাংলায় পারমাণবিক বিভাজন।

নিউট্রনের পরে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। কিন্তু ফার্মিসহ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অন্য বিজ্ঞানীরা কেউ ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারেননি। হান ও মাইটনারের এই আবিষ্কারের পর ফার্মির দাবিকৃত মৌল ৯৩ ও ৯৪ স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। আসল ঘটনা হলো, পরমাণুর নিউক্লিয়াস বিভাজিত হওয়ার কারণে সেখানে আটকে থাকা বিপুল পরিমাণ শক্তি বেরিয়ে আসে। একটিমাত্র পরমাণু থেকে আসা শক্তির পরিমাণ খুব বেশি নয়। কিন্তু অনেকগুলো পরমাণু একই সঙ্গে ভেঙে চেইন রিঅ্যাকশন শুরু হলে বেরিয়ে আসতে থাকে বিপুল শক্তি। একে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে গোটা একটা শহর আলোকিত করা সম্ভব। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে শহরটা মাটির সঙ্গে মিশে যাবে চোখের নিমেষে।

ফার্মি-দলের গবেষণার কারণে বিজ্ঞানীদের মধ্যে নতুন মৌল তৈরির হিড়িক পড়েছিল। কিন্তু হান ও মাইটনারের আবিষ্কারে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানে খুলে গেল সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। তখন আর সেটা শুধু একাডেমিক আগ্রহের জায়গায় সীমাবদ্ধ রইল না। বরং শুরু হলো প্রথম পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রতিযোগিতা। পরিণতিতে ধুলায় মিশে গেল জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহর। সে আরেক গল্প।

সূত্র: দ্য পোপ অব ফিজিকস: এনরিকো ফার্মি অ্যান্ড দ্য বার্থ অব অ্যাটমিক এজ/ জিনো সার্গে

সুপারহেভি: মেকিং অ্যান্ড ব্রেকিং দ্য পিরিওডিক টেবিল/ কিট চ্যাপম্যান

দ্য লাস্ট ম্যান হু নিউ এভরিথিং: দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস অব এনরিকো ফার্মি/ ডেভিড এন, শ্যাওয়ার্জ

উইকিপিডিয়া

* লেখাটি