বাঞ্জি জাম্পিংয়ে জাম্পাররা কোন সাহসে পাহাড় চূড়া থেকে লাফ দেন, কীভাবে থাকেন নিরাপদ

কল্পনা করুন, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন এক পাহাড়ের চূড়ায়। নিচে নীল-সবুজের হাতছানি। পায়ে ও কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়েছেন। এবারে লাফ! বাঞ্জি জাম্পিং। ভাবতে গিয়ে বুকটা কি একটু কেঁপে গেল? দুঃসাহসী এই কর্মকাণ্ডের পেছনের বিজ্ঞান…

বাঞ্জি জাম্পিংফাইল ছবি

পাহাড়ের চূড়া বা সেতুর রেলিং ধরে নিচে তাকালে বুকের ভেতরে কেমন কেঁপে ওঠে না? অনেক উঁচু বাড়ির ছাদ থেকে তাকালেও এমন মনে হয়। তবে পাহাড় চূড়া এবং নিচের সবুজ-নীলের এক অন্যরকম আকর্ষণ আছে। মনে হয়, প্রকৃতি যেন তার অদৃশ্য মায়াবী হাত বাড়িয়ে ডাকছে। আমরা বেশির ভাগই সেই ডাকে সাড়া না দিয়ে পিছিয়ে আসি। কিন্তু কিছু দুঃসাহসী মানুষ এই ডাক উপেক্ষা করতে পারেন না। তাঁরা এ ডাকে সাড়া দেন। না না, পাহাড় চূড়া থেকে কোনোরকম নিরাপত্তা ছাড়া ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা বলছি না। বরং তাঁরা পায়ের গোড়ালিতে সরু দড়ি বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়েন শূন্যে। এর পরের কিছু মুহূর্ত ধরে চলে মহাকর্ষের সঙ্গে রোমাঞ্চকর টানাপোড়েন। এই রোমাঞ্চকর টানাপোড়েনের নামই বাঞ্জি জাম্পিং।

এখানে কিন্তু কোনো জাদু নেই, আছে নিখাদ পদার্থবিজ্ঞান। দেখলে মনে হবে, এ তো স্রেফ ঝাঁপ দেওয়া; কিন্তু এর গভীরে লুকিয়ে আছে শক্তি আর বলের খেলা। পদার্থবিজ্ঞানের সেই মজার বিষয়গুলোই ব্যাখ্যা করব এই লেখায়।

বাঞ্জি জাম্পিংয়ে আগ্রহী মানুষটি যখন লাফ দেওয়ার জন্য পাহাড় চূড়ার সেই উঁচু প্ল্যাটফর্মের কিনারায় দাঁড়ান, তখন তাঁর শরীর হয়ে ওঠে স্থিতিশক্তির এক বিশাল ভাণ্ডার। ভূপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতাই এই শক্তির উৎস। উচ্চতা যত বেশি, এই শক্তির মানও হয় তত বেশি। একে বলা হয় অভিকর্ষজ স্থিতিশক্তি বা গ্র্যাভিটেশনাল পটেনশিয়াল এনার্জি। অনেকটা যেন কোনো বাঁধের চূড়ায় জমে থাকা বিপুল জলরাশি, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে প্রচুর শক্তি।

ধরুন, সেই মানুষটি আপনিই। লাফ দিতে প্রস্তুত…তিন… দুই… এক…

কাউন্টডাউন শেষে আপনি যখন শূন্যে শরীর ভাসিয়ে দেবেন, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে এই জমানো শক্তির রূপান্তরের খেলা শুরু। বাঁধের দরজা খুলে দিলে পানি যেমন তীব্র গতিতে নিচে নামে, ঠিক তেমনি মহাকর্ষের টানে আপনিও পড়তে থাকবেন প্রবল বেগে। আপনার দেহে জমা স্থিতিশক্তি তখন রূপান্তরিত হতে শুরু করবে গতিশক্তি বা কাইনেটিক এনার্জিতে। যত নিচে নামতে থাকবেন, আপনার বেগ তত বাড়তে থাকবে, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে গতিশক্তি। এই পতনের প্রথম কয়েক সেকেন্ড আপনি পুরোপুরি মুক্ত, যেন মহাকাশচারীর মতো ওজনহীন। কারণ পায়ের সঙ্গে বাঁধা বাঞ্জি দড়িটা তখনও ঢিলে, আলতোভাবে আপনাকে অনুসরণ করছে মাত্র।

বাঞ্জি কর্ড যখন প্রসারিত হতে শুরু করে, তখন আপনার পতন আর মুক্ত থাকে না
বাঞ্জি কর্ড যখন প্রসারিত হতে শুরু করে, তখন আপনার পতন আর মুক্ত থাকে না। কর্ডটি আপনার গতিশক্তি শুষে নিতে শুরু করে এবং নিজের ভেতরে স্থিতিস্থাপক স্থিতিশক্তি হিসেবে জমা করতে থাকে। আপনার বেগ প্রতি সেকেন্ডে কমছে, আর দড়ির ভেতরের শক্তি তত বাড়ছে। মহাকর্ষ আপনাকে নিচে টানছে, আর বাঞ্জি কর্ড টানছে ওপরে। এ যেন দুই বিপরীত শক্তির এক রুদ্ধশ্বাস প্রতিযোগিতা

এরপর এল সেই মুহূর্ত—চোখ বুজে একটুখানি কল্পনা করুন—এই তো, একটু পরেই ঘুরে যাবে গল্পের মোড়। ঢিলে দড়িটা টানটান হয়ে উঠল। এতক্ষণে শুরু হচ্ছে বাঞ্জি কর্ডের আসল খেলা। এই দড়িই এখানে স্থিতিস্থাপকতা বা ইলাস্টিসিটির চূড়ান্তটুকু দেখাবে।

এটি সাধারণ দড়ির মতো নয়। এর ধর্ম হলো, একে যত প্রসারিত করার চেষ্টা করা হবে, এটিও ঠিক ততটাই শক্তি দিয়ে আগের অবস্থায় ফিরতে চাইবে। ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী রবার্ট হুকের নামে এই সূত্রটির নাম ‘হুকের সূত্র’। আপনি হয়তো একে ‘স্প্রিংয়ের সূত্র’ নামেও চেনেন। বিষয়টা যেন অনেকটা গুলতি ছোড়ার আগে রবারটাকে টেনে ধরার মতো। রবার যত পেছনে টানবেন, পাথর তত জোরে ছুটবে।

বাঞ্জি কর্ড যখন প্রসারিত হতে শুরু করে, তখন আপনার পতন আর মুক্ত থাকে না। কর্ডটি আপনার গতিশক্তি শুষে নিতে শুরু করে এবং নিজের ভেতরে স্থিতিস্থাপক স্থিতিশক্তি হিসেবে জমা করতে থাকে। আপনার বেগ প্রতি সেকেন্ডে কমছে, আর দড়ির ভেতরের শক্তি তত বাড়ছে। মহাকর্ষ আপনাকে নিচে টানছে, আর বাঞ্জি কর্ড টানছে ওপরে। এ যেন দুই বিপরীত শক্তির এক রুদ্ধশ্বাস প্রতিযোগিতা।

একসময় আপনি এই যাত্রার সর্বনিম্ন বিন্দুতে পৌঁছাবেন। এক মুহূর্তের জন্য আপনার শরীরটা সেখানে স্থির হয়ে যাবে। আপনার গতিশক্তি তখন শূন্য। ঝাঁপ দেওয়ার আগের সব শক্তি এখন বন্দী হয়ে আছে প্রসারিত বাঞ্জি কর্ডের ভেতর। এই বিন্দুতে মহাকর্ষের টান সবচেয়ে দুর্বল, আর কর্ডের টান সবচেয়ে শক্তিশালী। তাই পরের মুহূর্তেই পাশার দান উল্টে যাবে। বিজয়ী বাঞ্জি কর্ড আপনাকে প্রচণ্ড শক্তিতে ছুড়ে দেবে ওপরের দিকে।

এরপর কিছুক্ষণ ধরে মহাকর্ষের সঙ্গে চলবে সেই টানাপোড়েনের খেলা। আপনি স্প্রিংয়ের মতো কয়েকবার ওঠানামা করবেন। প্রতিবারই দড়ির অভ্যন্তরীণ ঘর্ষণ আর বাতাসের বাধার কারণে কিছু শক্তি তাপ হিসেবে পরিবেশে হারিয়ে যাবে। তাই ধীরে ধীরে কমবে আপনার এই লাফালাফি-ঝাঁপাঝাঁপি বা টানাপোড়েন, একসময় আপনি শান্ত হয়ে ঝুলে থাকবেন শূন্যে।

বাঞ্জি কর্ডের টানে পা ভেঙে যায় না কেন

এখন দুটি প্রশ্ন। এক, দড়িটা যখন আপনার দেহকে সজোরে ওপরের দিকে টেনে তুলবে, সেই প্রচণ্ড টানে পা ভেঙে যায় না কেন? কিংবা দড়িটা ছিঁড়ে যায় না কেন?

আসলে বাঞ্জি কর্ড আকস্মিকভাবে আপনাকে থামিয়ে দেবে না। এর প্রসারণশীলতাই এই কর্ডের আসল রক্ষাকবচ। ব্যাপারটা অনেকটা দ্রুতগতিতে আসা ক্রিকেট বল ধরার মতো। আপনি কি হাত শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকেন? না, বরং বলটা হাতে লাগার সঙ্গে সঙ্গে হাতটা কিছুটা পিছিয়ে নেন। এতে বলটা থামার জন্য অনেকটা সময় পায়, ফলে আপনার হাতেও আঘাত লাগে কম। বাঞ্জি কর্ড ঠিক এই ‘শক অ্যাবজরবার’ বা ঘাতশোষকের কাজটাই করে। এটি কয়েক সেকেন্ড ধরে প্রসারিত হতে হতে আপনার পতনের গতিকে ধীরে ধীরে শূন্যে নামিয়ে আনে। ফলে আপনার শরীরের ওপর যে বল প্রযুক্ত হয়, তা আকস্মিক না হয়ে সহনীয় মাত্রার মধ্যে থাকে। এ ছাড়া আধুনিক বাঞ্জি জাম্পিংয়ে শুধু পায়ে নয়, কোমর ও শরীরজুড়েও কয়েকটি দড়ি ব্যবহার করা হয়, যা এই টানকে পুরো শরীরে ছড়িয়ে দিয়ে ঝুঁকি একদম কমিয়ে আনে।

প্রকৌশলীরা এই কর্ড ডিজাইনের সময় খেয়াল রাখেন, একজন মানুষের ওজনের ফলে যে পরিমাণ বল তৈরি হতে পারে, দড়িটি যেন তার চেয়ে পাঁচ থেকে দশ গুণ বেশি বল সহ্য করার ক্ষমতা রাখে। এ ছাড়াও প্রতিটি কর্ড কতবার ব্যবহার করা হবে, তার একটি নির্দিষ্ট সীমা থাকে। সেই সীমা পার হওয়ার অনেক আগেই কর্ডটি ব্যবহার করা বন্ধ করে দেওয়া হয়

আর দড়ি ছেঁড়ার যে ভয়, তার সমাধান লুকিয়ে আছে এর নির্মাণশৈলী আর কঠোর নিরাপত্তা নীতিতে। বাঞ্জি কর্ড কোনো একক দড়ি নয়; এটি আসলে শত শত পাতলা কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী ল্যাটেক্স বা রবারের সুতোর এক নিখুঁত গোছা। এই গোছা আবার একটা মজবুত আবরণে মোড়া থাকে। শত শত সুতো একসঙ্গে থাকায় এর ভার বহন করার ক্ষমতা বেড়ে যায়। প্রকৌশলীরা এই কর্ড ডিজাইনের সময় খেয়াল রাখেন, একজন মানুষের ওজনের ফলে যে পরিমাণ বল তৈরি হতে পারে, দড়িটি যেন তার চেয়ে পাঁচ থেকে দশ গুণ বেশি বল সহ্য করার ক্ষমতা রাখে। এ ছাড়াও প্রতিটি কর্ড কতবার ব্যবহার করা হবে, তার একটি নির্দিষ্ট সীমা থাকে। সেই সীমা পার হওয়ার অনেক আগেই কর্ডটি ব্যবহার করা বন্ধ করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই অবসরে পাঠানো হয় প্রতিটি কর্ডকে। ফলে কোনো দুর্ঘটনার বিন্দুমাত্র আশঙ্কাও থাকে না।

বাঞ্জি জাম্পিংয়ের রোমাঞ্চকর পর্ব শেষ হওয়ার পর জাম্পার যখন শান্ত হয়ে শূন্যে ঝুলতে থাকেন, তখন শুরু হয় উদ্ধারের পালা
স্পোর্টসমাটিক ডটকম

ঝুলন্ত দড়ি থেকে স্থির ভূমে

হয়তো ভাবছেন, জাম্প তো শেষ, আমি তো শূন্য ঝুলছি! এরপর কী? বাঞ্জি জাম্পিংয়ের রোমাঞ্চকর পর্ব শেষ হওয়ার পর জাম্পার যখন শান্ত হয়ে শূন্যে ঝুলতে থাকেন, তখন শুরু হয় উদ্ধারের পালা। তাঁকে তুলে আনার পদ্ধতিটি নির্ভর করে জাম্পিংয়ের স্থানটির ওপর। মূলত দুটি উপায়ে এটি করা হয়।

এক, নিচে নামিয়ে আনা। এটি সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতি। বিশেষ করে ব্রিজ বা গভীর উপত্যকার ওপর থেকে ঝাঁপ দিলে প্রায়ই নিচে একটি উদ্ধারকারী নৌকা বা বিশেষ দল অপেক্ষা করে। জাম্পারকে তখন ধীরে ধীরে মূল দড়ির সাহায্যে নিচে নামিয়ে আনা হয়। উদ্ধারকারী দলটি তখন তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নেয়।

আর দুই, ওপরে তুলে আনা। বুঝতেই পারছেন, ঝাঁপটা যদি উঁচু কোনো প্ল্যাটফর্ম থেকে দেন, তাহলে একটা মোটরচালিত সিস্টেম বা উইঞ্চ ব্যবহার করে আপনাকে টেনে ওপরে তোলা হবে। অনেক সময় একজন উদ্ধারকারী নিচে নেমে এসে জাম্পারকে সঠিকভাবে বেঁধে দেন, যাতে ওপরে তোলার প্রক্রিয়াটি নিরাপদ হয়।

এ থেকে হয়তো বুঝতে পারছেন, বাঞ্জি জাম্পিংয়ে কেন এত সাহস করে জাম্পাররা লাফ দেন, সাড়া দেন প্রকৃতির হাতছানির আহ্বানে। কিন্তু সাবধান, বুকে অসম সাহস না থাকলে ও কাজ করতে যাবেন না। হৃৎপিণ্ডটি ব্যাপক হতবাক হয়ে নিজের কাজটা বন্ধ করে দিলেই কিন্তু সেরেছে। শেষ করার আগে এটুকু সংবিধিবদ্ধ সতর্কতা দিয়ে দিচ্ছি, বাকিটা নাহয় আপনিই ঠিক করে নিন!

লেখক: শিক্ষার্থী, পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

সূত্র: লাইভ সায়েন্স, উনিভার্সিতেত ভ্যান আমস্টারডাম (ইউনিভার্সিটি অব আমস্টারডাম), আইওপি সায়েন্স