মৌলিক কণার অদ্ভুত জগৎ

আগের পর্বে আমরা কেবল আমাদের অতিপরিচিত ইলেকট্রন-প্রোটন-নিউট্রন আর তাদের প্রতিকণা নিয়ে কথা বলেছিলাম। এরপর আরও অনেকগুলো নতুন কণা আবিষ্কৃত হয়েছে। আসুন, এবার তাদের কথা জেনে নেওয়া যাক।

পজিট্রন আবিষ্কারের সমসাময়িককালে আবিষ্কৃত হয় আরেকটি অদ্ভুত কণা, যার নাম নিউট্রিনো। অদ্ভুত বলছি কেন? কারণ, এ কণাটি কোনো বস্তুর সঙ্গেই মিথস্ক্রিয়া করে না, একেবারে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে। আপনি যদি কয়েক শ আলোকবর্ষ দীর্ঘ একটা মোটাসোটা রড বানান, তবু কোনো রকম বাধা ছাড়াই নিউট্রিনো এর ভেতর দিয়ে পার হয়ে যেতে পারবে, রডটি টেরই পাবে না! এ রকম একটি কণার অস্তিত্ব কল্পনা করাও কষ্টকর, ধরে ফেলা তো আরও বহু দূরের ব্যাপার। কিন্তু বিজ্ঞানীদের কল্পনাশক্তির কোনো সীমা নেই, নইলে পাউলি এ রকম একটা কণার অস্তিত্বের কথা ভাবলেন কীভাবে? ঘটনাটা একটু খুলেই বলি।

১৯৩০ সালের দিকে তেজস্ক্রিয় পদার্থের বিকিরণ বিজ্ঞানীদের কাছে অজানা ছিল না। আলফা কণা বিকিরণ, বিটা কণা বিকিরণ এবং গামা বিকিরণ আবিষ্কৃত হয়েছিল বেশ আগেই। আলফা কণা যে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস, বিটা হলো ইলেকট্রন আর গামা হলো আলোর কণা—এগুলোও জানা হয়ে গিয়েছিল তত দিনে। ভারী নিউক্লিয়াসের ভেতর থেকে আলফা ও গামা বিকিরণের ব্যাখ্যা দিতেও সমস্যা হয়নি, ঝামেলা হলো বিটা কণার বিকিরণ নিয়ে। নিউক্লিয়াস থেকে ইলেকট্রন বেরোয় কীভাবে, ওখানে তো ইলেকট্রন নেই! একমাত্র সম্ভাবনা নিউক্লিয়াসের কোনো একটা কণা ভেঙে গিয়ে ইলেকট্রন বেরিয়ে আসে। তখন পর্যন্ত নিউট্রন আবিষ্কৃত হয়নি, ফলে কী যে ভাঙে আর কীভাবে ভাঙে তা–ও জানা ছিল না। নিউট্রন আবিষ্কারের পর অবশ্য এ রকম বলা হলো যে, একটা নিউট্রন ভেঙে একটা প্রোটন ও একটা ইলেকট্রনে পরিণত হয়, আর সেই ইলেকট্রনটিই বেরিয়ে আসে। এই ব্যাখ্যায় চার্জের সংরক্ষণ নীতি (Conservation law) ঠিক থাকে বটে, কিন্তু শক্তি এবং ভরবেগের সংরক্ষণ নীতি ভেঙে পড়ে। প্রথম দিকে ভাবা হয়েছিল, এ ঘটনায় হয়তো সংরক্ষণ নীতির সত্যিই ব্যত্যয় ঘটে। কিন্তু তা কী করে হয়?

সংরক্ষণ নীতি তো প্রকৃতির মৌলিক নিয়ম বা আইন, কোথাও এর ব্যত্যয় ঘটলে পুরো প্রাকৃতিক ব্যবস্থাটি নিয়েই নতুন করে ভাবতে হবে। আরেকটি সমস্যা ছিল। বিটা বিকিরণের ফলে ইলেকট্রনের যে নির্দিষ্ট শক্তিস্তর থাকার কথা, তা থাকে না, বরং শূন্য থেকে শুরু করে একটা সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত উঠে যায়। এর ব্যাখ্যাই–বা কী? সমস্যাটির সমাধানে এগিয়ে এলেন পাউলি। বললেন, এই বিকিরণে ইলেকট্রনের সঙ্গে আরেকটি শক্তিশালী চার্জ শূন্য কণা বেরিয়ে আসে। পাউলি এর নাম দিতে চেয়েছিলেন নিউট্রন, কিন্তু চ্যাডউইক তাঁর আবিষ্কৃত কণার জন্য নামটি গ্রহণ করায় সেটি আর সম্ভব হয়নি। ১৯৩৩ সালে এনরিকো ফার্মি বিটা বিকিরণের জন্য একটা তত্ত্ব হাজির করেন এবং পাউলির প্রস্তাব মেনেই সেই অচেনা কণাটির নামকরণ করেন নিউট্রিনো, যার অর্থ ‘ছোট্ট নিরপেক্ষ একজন’! অবশ্য পরে দেখা গেছে, এটি আসলে নিউট্রিনো নয়, বরং এর প্রতিকণা অ্যান্টিনিউট্রিনো।

এ সময়টি ছিল আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ। অসম্ভব প্রতিভাবান বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী পৃথিবীর নানা প্রান্তে বসে একসঙ্গে অকল্পনীয় সব কাজ করছিলেন। কত নতুন তত্ত্ব, কত নতুন চিন্তা, নতুন ব্যাখ্যা যে এল এ সময়ে! প্রতিকণার আবিষ্কার বা বিটা বিকিরণের ব্যাখ্যা যখন এসেছিল, তখন আরেকটি বিষয় নিয়েও বিজ্ঞানীরা ভাবছিলেন গভীরভাবে। তত দিনে পরমাণু এবং এর নিউক্লিয়াসের গঠন জানা হয়ে গেছে। পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস, তার চারদিকে ইলেকট্রন ঘুরে বেড়ায়; আর নিউক্লিয়াসের ভেতরে থাকে প্রোটন আর নিউট্রন নামক দুই ধরনের কণা, নিউট্রন চার্জনিরপেক্ষ হলেও প্রোটন ধনাত্মক চার্জবিশিষ্ট কণা, এসবই আবিষ্কৃত হয়ে গেছে। কিন্তু একটা বিষয় বোঝা যাচ্ছিল না—নিউক্লিয়াসের ভেতরে প্রোটনগুলো একসঙ্গে থাকে কী করে? একই ধরনের চার্জবাহী কণা তো পরস্পরকে বিকর্ষণ করে এবং এই বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বিকর্ষণ বেশ শক্তিশালীও বটে, এত বিকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও একটা অতি ক্ষুদ্র জায়গার মধ্যে প্রোটনগুলো জড়ো হয়ে থাকে কীভাবে? মহাকর্ষ বলের প্রভাবে নিশ্চয়ই নয়, কারণ বলটি খুবই দুর্বল। তাহলে নিশ্চয়ই এমন কোনো শক্তিশালী আকর্ষণ বল আছে, যা বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বিকর্ষণের চেয়েও শক্তিশালী এবং সে জন্যই প্রোটনকে শক্ত করে বেঁধে রাখতে পারে! এই বোঝাপড়ার পর বলটির নাম দেওয়া হলো সবল নিউক্লীয় বল। কিন্তু এটি কাজ করে কীভাবে? ১৯৩৫ সালে জাপানি পদার্থবিদ হেডকি ইয়োকাওয়া এ বিষয়টির একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করালেন। তিনি ‘মেসন’ নামের এক ধরনের কণার কথা বললেন, যে কণার বিনিময়ের ফলে নিউট্রন প্রোটনে পরিণত হয়, আবার প্রোটন পরিণত হয় নিউট্রনে। এর ভূমিকা অনেকটা ফোটনের মতো, মাধ্যম-কণা বা বিনিময়-কণা হিসেবে কাজ করে সে। ফোটন কণা বিনিময়ের ফলে যেমন দুটো চার্জের মধ্যে বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় মিথস্ক্রিয়া ঘটে, মেসন বিনিময়ের ফলে তেমনই সবল নিউক্লীয় মিথস্ক্রিয়া ঘটে। ইউকাওয়া ভেবেছিলেন, যেহেতু ফোটন এবং গ্র্যাভিটন দীর্ঘ দূরত্বে (অসীম দূরত্বে বললেই ঠিক হয়) কাজ করে তাই এদের ভর শূন্য। অন্যদিকে সবল নিউক্লীয় মিথস্ক্রিয়া কাজ করে খুবই স্বল্প দূরত্বে, একটা নিউক্লিয়াসের ব্যাসের মধ্যেই এর সীমা। সে ক্ষেত্রে এর মাধ্যম বা বিনিময় কণাটির অর্থাৎ মেসনের কিছু ভর থাকবে। এর ভর হবে প্রোটনের চেয়ে কম কিন্তু ইলেকট্রনের চেয়ে বেশি। এই মাঝামাঝি ভরের কারণেই তার নাম হলো মেসন, যার অর্থ মধ্যম-ভর (Middle-weight), যেমনটি ইলেকট্রন এবং ইলেকট্রনসদৃশ কণাগুলোকে ডাকা হয় লেপটন নামে, যার অর্থ স্বল্প-ভর (Little-weight), আর প্রোটন-নিউট্রনের মতো ভারী কণাগুলোকে ডাকা হয় ব্যারিয়ন নামে, যার অর্থ অধিক-ভর (Heavy-weight)। এই মেসন কণাকে কখনো কখনো পায়ন (Pion) নামেও ডাকা হয়। তিন ধরনের পায়ন কণা আছে, যথাক্রমে—পাই প্লাস (ধনাত্মক চার্জবিশিষ্ট পায়ন), পাই মাইনাস (ঋণাত্মক চার্জবিশিষ্ট পায়ন) এবং পাই জিরো (চার্জনিরপেক্ষ পায়ন)। এগুলোকে মেসন বলার চেয়ে পায়ন বলাই ভালো, কারণ আমরা দেখব—পরবর্তীকালে আরও কয়েক ধরনের মেসন আবিষ্কৃত হয়েছে। অর্থাৎ মেসন হলো একটা পরিবার, আর পায়ন হলো সেই পরিবারের একজন সদস্য। যা হোক, কোয়ার্ক মডেল প্রস্তাবের পর সবল নিউক্লীয় বলের এই ব্যাখ্যা অবশ্য পাল্টে যায়, সে আলোচনা অন্য একটি লেখায় বিস্তারিতভাবে করেছি।

এ পর্যন্ত আমরা যেসব কণার কথা আলোচনা করেছি তার তালিকাটি একবার দেখা যাক: লেপটন পরিবারভুক্ত ইলেকট্রন, পজিট্রন, নিউট্রিনো এবং অ্যান্টিনিউট্রিনো; ব্যারিয়ন পরিবারভুক্ত প্রোটন, নিউট্রন এবং তাদের প্রতিকণাগুলো যথাক্রমে অ্যান্টিপ্রোটন, অ্যান্টিনিউট্রন। সঙ্গে আছে ফোটন, গ্র্যাভিটন এবং মেসন পরিবারভুক্ত তিন ধরনের পায়ন। এই পর্যন্ত এসে থেমে গেলে মন্দ হতো না, মোটামুটি সহজেই জগতের মৌলিক কণাগুলো সম্বন্ধে আমরা বোঝাপড়ায় উপনীত হতে পারতাম। কিন্তু তা হলো না। মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে যাঁরা গবেষণা করছিলেন, তাঁরা নতুন নতুন আরও অনেক কণার সন্ধান পেতে লাগলেন। সে আলোচনা অনেক দীর্ঘ, দু-একটির কথা বলে আমরা চলে যাব কোয়ার্ক মডেলের আলোচনায়।

মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েই কার্ল এন্ডারসন পজিট্রনের সন্ধান পেয়েছিলেন ১৯৩২ সালে, চার বছর পর ১৯৩৬ সালে তিনি আরেকটি নতুন কণার সন্ধান পেলেন। এ কণাটির ভর ইলেকট্রনের চেয়ে ২০৭ গুণ বেশি, অর্থাৎ প্রোটন বা নিউট্রনের ভরের ৯ ভাগের ১ ভাগ। তার মানে এটি ‘মাঝামাঝি’ ভরের কোনো কণা, অর্থাৎ মেসন পরিবারভুক্ত। এ কণাটি পরবর্তীকালে মিউ মেসন বা মিউয়ন নামে পরিচিত লাভ করল। তবে শুরুতে একে মেসন ভাবা হলেও পরবর্তীকালে দেখা গেল এটি আসলে লেপটন পরিবারের সদস্য। সমস্যা হলো, এ কণাটি একটা ধাঁধার মতো। এর কাজ যে কী, সেটিই এক রহস্য। পরমাণুর গঠন ব্যাখ্যায় এটি কোনো কাজে লাগে না, নিউট্রিনো যেমন সংরক্ষণনীতি অক্ষুণ্ন রাখতে ভূমিকা রাখে, মিউয়নের তেমন কোনো ভূমিকাও নেই, কিংবা কোনো ধরনের মিথস্ক্রিয়া প্রশমনের জন্যও এটি কোনো কাজ করে না। তাহলে করেটা কী? নিজে ভেঙে গিয়ে অন্য কণা উত্পাদন করার জন্যই কি তার জন্ম? যা হোক, বিটা নিঃসরণের ঘটনায় ইলেকট্রনের সঙ্গে যেমন নিউট্রিনো এবং অ্যান্টিনিউট্রিনো নির্গত হওয়ার ঘটনা ঘটে; মিউয়নের ক্ষেত্রেও সে রকম নিউট্রিনো-অ্যান্টিনিউট্রিনোর দেখা পাওয়া গেল। এরা পূর্ববর্তী নিউট্রিনো এবং অ্যান্টিনিউট্রিনো থেকে একটু আলাদা বলে তাদের নাম হলো মিউ-নিউট্রিনো (পূর্ববর্তীটি হলো ইলেকট্রন-নিউট্রিনো)।

১৯৪৭ সালে রচেস্টার ও বাটলার মহাজাগতিক রশ্মি বিশ্লেষণ করে আরও একটি কণার সন্ধান পেলেন, যার নাম দেওয়া হলো কায়ন। এর ভর পায়নের প্রায় সাড়ে তিন গুণ, অর্থাৎ প্রোটনের অর্ধেক। এ কণাটি ভেঙে গিয়ে পায়ন উত্পাদন করে, ফলে এটি যে মেসন পরিবারভুক্ত সেটি বুঝতে অসুবিধা হলো না। মেসন পরিবারে সদস্যসংখ্যা এইভাবে বাড়তে লাগল।

অবশ্য লেপটন পরিবারেও যুক্ত হওয়ার মতো কণা পাওয়া গিয়েছিল মহাজাগতিক রশ্মি থেকে। তার একটির নাম টাউ লেপটন বা টাউয়ন। এটি ইলেকট্রন বা মিউয়নের মতোই আচরণ করে, তবে এর ভর ইলেকট্রনের চেয়ে প্রায় ৩৫০০ গুণ বেশি, এমনকি প্রোটন-নিউট্রনের চেয়েও দ্বিগুণ ভারী এটি। এত ভারী কণাকে লেপটন বলতে একটু অস্বস্তি লাগে, কারণ লেপটন মানেই স্বল্প-ভরের কণা, তবু বলতে হয় অন্যান্য লেপটনের সঙ্গে এর আচরণগত সাদৃশ্যের জন্য।

সবল মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যম বা বিনিময় কণা হিসেবে যেমন মেসনের প্রসঙ্গ এসেছিল, তেমনই ১৯৬৭ সালে দুর্বল নিউক্লীয় মিথস্ক্রিয়ার বিনিময় কণা হিসেবে এসেছিল আরও দুটো নাম, ডব্লিউ (W) ও জেড (Z) বোসন। ডব্লিউ আবার ধনাত্মক বা ঋণাত্মক চার্জবিশিষ্ট হতে পারে। সেই অর্থে এখানে কণা হলো তিনটি। দুর্বল নিউক্লীয় বলও স্বল্প দূরত্বে কাজ করে, আর তাই এর বিনিময়-কণাদেরও কিছু ভর থাকবে। হ্যাঁ, এই কণাগুলো পায়নের চেয়ে প্রায় ৭০০ গুণ ভারী, অর্থাৎ প্রোটনের চেয়ে ১০০ গুণ ভারী।

এই পর্বে আমরা লেপটন, মেসন ও ব্যারিয়ন পরিবারভুক্ত কিছু মৌলিক কণা নিয়ে কথা বললাম। কণাগুলোকে আরও নানাভাবে ভাগ করা যায়, তাদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে। আগামী পর্বে আমরা সেগুলো নিয়ে আলোচনা করব, কথা বলব কোয়ার্ক মডেল সম্পর্কেও।

লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়