কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানে বাংলাদেশি বিজ্ঞানী জাহিদ হাসানের নতুন মাইলফলক

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন বিজ্ঞানী এম. জাহিদ হাসানের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী সম্প্রতি কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের নতুন মাইলফলক ছুঁয়েছেন। তুলনামূলক উচ্চ তাপমাত্রায় আরোনোভ-বোম ইন্টারফিয়ারেন্স ব্যবহার করে কোয়ান্টাম প্রভাব পর্যবেক্ষণ করেছেন তাঁরা। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান জার্নাল নেচার-এর ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁদের এ গবেষণাপত্র।

এ গবেষণাপত্র অনুযায়ী, জাহিদ হাসান ও তাঁর দল বিসমাথ ব্রোমাইড সংকরের টপোলজিক্যাল ইনসুলেটরে আরোনোভ-বোম ইন্টারফিয়ারেন্স ব্যবহার করে কোয়ান্টাম প্রভাব পর্যবেক্ষণ করেছেন। এটি ভবিষ্যতের বিভিন্ন প্রযুক্তি, যেমন উচ্চ গতির দ্রুততর কম্পিউটার ও অতি সুরক্ষিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বড় ভূমিকা রাখবে। এতদিন যে কোয়ান্টাম দশা শুধু পরম শূন্য তাপমাত্রার কাছাকাছি পাওয়া গেছে, সেটা তিনি ও তাঁর দল তুলনামূলক উচ্চ তাপমাত্রায় পর্যবেক্ষণ করেছেন। এরকমটা আগে কখনো দেখা যায়নি। বলা যায়, এর ফলে বৈদ্যুতিক যন্ত্রে এ ধরনের পদার্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরেক ধাপ এগিয়েছেন তাঁরা।

স্বাভাবিক তাপমাত্রায় পদার্থের কঠিন, তরল বা বায়বীয় অবস্থায় কোয়ান্টাম দশা উধাও হয়ে যায়। তাপমাত্রা কমানো হলে, পদার্থের ভেতরের পরমাণুর গতি কমতে থাকে। পরম শূন্যের কাছাকাছি তাপমাত্রায় এ গতি প্রায় শূন্য হয়ে যায়। ফলে এগুলো সহজে নিয়ন্ত্রণ যেমন করা যায়, তেমনি দেখা যায় বিভিন্ন রকম কোয়ান্টাম প্রভাব। কিন্তু এত কম তাপমাত্রায় গবেষণা করা আর প্রাত্যাহিক কাজে লাগার মতো যন্ত্র বানানোর মতো পদার্থ তৈরি করা তো এক কথা নয়। তাই বিজ্ঞানীদের দীর্ঘদিনের সাধনা ছিল, কক্ষতাপমাত্রা বা তুলনামূলক উচ্চতাপমাত্রায় যদি কোয়ান্টাম প্রভাব দেখা যেত!

সম্প্রতি জাহিদ হাসান ও তাঁর দল এই বিসমাথ ব্রোমাইড সংকরের টপোলজিক্যাল ইনসুলেটরে আরোনোভ-বোম ইন্টারফিয়ারেন্স ব্যবহার করে কোয়ান্টাম প্রভাব পর্যবেক্ষণ করেছেন।

সেই অসাধ্য সাধন করেন জাহিদ হাসান ও তাঁর দল, ২০২২ সালে। সে বছরের অক্টোবরে নেচার ম্যাটেরিয়ালস-এর মলাটে জায়গা করে নেয় তাঁর গবেষণা। তাঁর নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী বিসমাথ ব্রোমাইড সংকরের টপোলজিক্যাল ইনসুলেটরে কোয়ান্টাম হল ইফেক্ট পর্যবেক্ষকণ করেন কক্ষতাপমাত্রায়। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে প্রদীপ দেবের সেই লেখাটি পড়তে পারেন। সংক্ষেপে বললে, এমনিতে ইনসুলেটর মানে বিদ্যুতের অপরিবাহী। যেমন প্লাস্টিক বা রবার। তবে টপোলজিক্যাল ইনসুলেটরের ভেতরটা অপরিবাহী, কিন্তু কিনারা অতিপরিবাহীর মতো।

আগেই বলেছি, সম্প্রতি জাহিদ হাসান ও তাঁর দল এই বিসমাথ ব্রোমাইড সংকরের টপোলজিক্যাল ইনসুলেটরে আরোনোভ-বোম ইন্টারফিয়ারেন্স ব্যবহার করে কোয়ান্টাম প্রভাব পর্যবেক্ষণ করেছেন। বিদ্যুৎ ও চুম্বকক্ষেত্র—দুটোই শূন্য, এমন অবস্থায় বৈদ্যুতিকভাবে চার্জিত কণার তড়িৎ-চৌম্বক বিভব দ্বারা প্রভাবিত হওয়াকে বলে আরোনোভ বোম এফেক্ট। গবেষকেরা এটি ব্যবহার করে তুলনামূলক উচ্চতাপমাত্রায় বিসমাথ ব্রোমাইড সংকরের টপোলজিক্যাল ইনসুলেটরে কোয়ান্টাম প্রভাব পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দেখিয়েছেন, এগুলো বাস্তব বিশ্বে ব্যাবহারোপযোগী হতে পারে। এই ব্যাবহারের জন্যই গবেষণাটি এতটা আলোচিত হচ্ছে।

এই গবেষণায় জাহিদ হাসানের দল ইউনিভার্সিটি অব জুরিখ, দ্য বেইজিং ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করেছেন। এভাবেই খুলে গেছে নতুন সম্ভাবনার দ্বার।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশি বিজ্ঞানী জাহিদ হাসান
কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের জন্য এনট্যাঙ্গেলমেন্ট ও কোয়ান্টাম সুপারপজিশন বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে হয়। এ জন্য কক্ষ তাপমাত্রায় বা উচ্চ তাপমাত্রায় কোয়ান্টাম প্রভাব রয়েছে, এমন পদার্থই দরকার।

আরও আগে, ২০১৪-১৫ সালে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন একধরনের টপোলজিক্যাল চৌম্বকপদার্থ। এর নাম ম্যাগনেটিক ভাইল সেমিমেটাল।

কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের জন্য এনট্যাঙ্গেলমেন্ট ও কোয়ান্টাম সুপারপজিশন বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে হয়। এ জন্য কক্ষ তাপমাত্রায় বা উচ্চ তাপমাত্রায় কোয়ান্টাম প্রভাব রয়েছে, এমন পদার্থই দরকার। এসব গবেষণার মাধ্যমে জাহিদ হাসান ধীরে ধীরে আমাদের এগিয়ে নিচ্ছেন টপোলজিক্যাল ম্যাটেরিয়ালনির্ভর কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ও ভবিষ্যতের বৈদ্যুতিক প্রযুক্তির দিকে।

বিজ্ঞানী জাহিদ হাসান দীর্ঘদিন ধরে টপোলজিক্যাল ম্যাটেরিয়াল নিয়ে কাজ করছেন। তাঁর গবেষণা সম্পর্কে এর আগে বিজ্ঞানচিন্তায় বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছিল।  বিস্তারিত পড়ুন: কক্ষতাপমাত্রায় অদৃষ্টপূর্ব কোয়ান্টাম দশা

সূত্র: নেচার, দ্য ডেইলি স্টার, বিজ্ঞানচিন্তা