কেমন করে সূচনা হলো কণাত্বরক যন্ত্রের

কেমন করে সূচনা হলো কণাত্বরক যন্ত্রের? এর প্রয়োজনই-বা পড়ল কেন? পরমাণুর ভেতরে উঁকি দেওয়ার প্রচেষ্টায় বিজ্ঞানীদের এই নবযাত্রার পেছনের কথা নিয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ আরশাদ মোমেন লিখছেন ‘নিউক্লিয়ার বলের কাহন’। এই পর্বে উঠে এসেছে সাইক্লোট্রন আবিষ্কারের কাহিনি।

বেশি ভরের মৌলিক কণা তৈরি করতে গেলে বেশি শক্তির পরিবর্তন করতে হয়মিডজার্নির সাহায্যে তৈরি

আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ: E=mc2-এর বদৌলতে আমরা জানি, বেশি ভরের মৌলিক কণা বা কণাসমগ্র তৈরি করতে গেলে আমাদের বেশি শক্তির পরিবর্তন বা ক্ষয় করতে হবে। কসমিক বা মহাজাগতিক রশ্মি আমাদের এ রকম শক্তি জোগান দেয়। তবে কসমিক রশ্মি কোত্থেকে আসে, তার কোনো ধারণা আমাদের ছিল না। এর শক্তির বিচ্ছুরণ (Distribution) কেমন, জানা ছিল না তা–ও। তাই পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে ভালো পরিসংখ্যান তৈরি করা সম্ভব হচ্ছিল না। এ জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ে কণাত্বরক যন্ত্র, যা ‘মৌলিক কণা’র শক্তি অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়। আগেই লিখেছিলাম, এই অতিরিক্ত শক্তিটা আসে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র থেকে। কিন্তু এ রকম বলক্ষেত্র অনেক জায়গা জুড়ে তৈরি করা কষ্টসাধ্য ও ব্যয়সাপেক্ষ। এই সমস্যার সমাধান করেন বিজ্ঞানী আর্নস্ট লরেন্স। কথিত আছে, লরেন্স এই সমাধান বের করেছিলেন বাইবেলে বর্ণিত ডেভিড [যাঁকে আমরা নবী দাউদ (আ.) হিসেবে অভিহিত করি] ও বিশাল আকারের যোদ্ধা গোলিয়াথের মধ্যকার লড়াইয়ের থেকে।

সেই বর্ণনায় আছে, বালক ডেভিড তার চামড়ার থলের মাঝে একটি পাথর নিয়ে দ্রুত ঘুরিয়ে গোলিয়াথের মাথার দিকে ছুড়ে মারলে গোলিয়াথ হেরে যায়। লরেন্স এই ঘটনা থেকে চার্জ কণাগুলোকে বৃত্তাকার পথে ঘোরানোর আইডিয়াটি পান। কিন্তু এই বৃত্তাকার পথে ঘোরানোর জন্য প্রয়োজন হয় সুষম চৌম্বকক্ষেত্রের। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীমাত্রই জানেন, সুষম চৌম্বকক্ষেত্র কোনো চার্জের গতিপথ পরিবর্তন করতে পারলেও কণার গতিশক্তি বাড়াতে পারে না।

লরেন্স কর্তৃক জমা দেওয়া প্যাটেন্ট আবেদনে সংযুক্ত সাইক্লোট্রনের ইঞ্জিনিয়ারিং চিত্র

আগের পর্বে (বিজ্ঞানচিন্তার মে ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত) আমরা আলোচনা করেছিলাম, কীভাবে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র ব্যবহার করে চার্জিত কণার শক্তি বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু সমস্যা হলো, সে জন্য আমাদের একটি লম্বা পথ বরাবর কণাটিকে চলতে দিতে হবে। বৃত্তাকার পথে চললে কণার চলার জায়গা লাগবে কম, কিন্তু সে কাজের জন্য আমাদের লাগবে একটি চৌম্বকক্ষেত্র, যার ভেতরেই কণাটি চলমান থাকবে। এ জন্য এক বিশেষ আকারের ধাতব ইলেকট্রোড (Electrode) ডিজাইন করা লাগে, যা চৌম্বকক্ষেত্রের মাঝে রাখা থাকে। এই ইলেকট্রোডগুলো অর্ধবৃত্তাকার, কিন্তু এর ভেতরটা ফাঁপা। অনেকটা ফোলানো গোল লুচিকে তার মাঝ (ব্যাস) বরাবর দুই টুকরা করে কাটলে যে রকম দেখাবে, সে রকম। আর তাদের মাঝে থাকে অত্যন্ত সামান্য ফাঁক। প্রতিটি ইলেকট্রোডকে তাদের আকৃতির কারণে ‘ডি’ (Dee) বলে অভিহিত করা হয়। এই ‘ডি’গুলোর ফাঁপা জায়গার ভেতরে অবস্থানকালে চার্জবিশিষ্ট কণা কোনো বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র অনুভব করবে না (কারণ, বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র ধাতুর অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে না। যে কারণে উড়োজাহাজে উড্ডীয়মান অবস্থায় বজ্রপাত আক্রান্ত হলেও যাত্রীদের কোনো ক্ষতি হয় না বা লিফট বন্ধ হয়ে গেলে তার ভেতরে মোবাইল কানেকশন কেটে যায়)। তবে এই ফাঁপা জায়গায় চৌম্বকক্ষেত্র কাজ করতে থাকে আর তার প্রভাবে চার্জিত কণা (এর পর থেকে শুধু কণা বলে অভিহিত করব) গোলাকার পথে পরিচালিত হয়।

১৯৩০ সালের মধ্যেই লরেন্স সাইক্লোট্রনের একটি ছোট কিন্তু কর্মক্ষম সংস্করণ তৈরি করে ফেলেন। এটার ব্যাসার্ধ ছিল প্রায় সাড়ে চার ইঞ্চি।

আর এই দুই অর্ধবৃত্তাকার ‘ডি’র মাঝের জায়গাটায় (যা ওপরের ছবিতে সরলরেখা দিয়ে সীমাবদ্ধ দেখানো হয়েছে) বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র কাজ করে (এটা তৈরি হয় দুই ‘ডি’র মাঝে)। ফলে প্রতিবার এই গ্যাপ অতিক্রম করার সময় কণার গতিশক্তি বৃদ্ধি পায়। আর গতিশক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে কণার বৃত্তাকার পথে ব্যাসার্ধ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়।

লরেন্স ও বানানো প্রথম সাইক্লোট্রন (হাতে ধরা)

আর দুই ‘ডি’র মধ্যে যে বিভব দেওয়া হয়, তা কিন্তু একবর্তী নয়, বরং সেটাকে অল্টারনেটিং হতে হয়। কারণ, ‘ডি’র ভেতর থেকে অর্ধবৃত্তাকার পথ ঘুরে এলে কণার ওপর উল্টো দিকে বল প্রয়োগ করার প্রয়োজন পড়ে। ব্যাপারটা চিন্তা করার জন্য আমরা টেবিল টেনিসে পিংপং বলের ওপর খেলোয়াড়েরা যে ধারাবাহিক হিট করেন, তার কথা চিন্তা করতে পারি। দুই দলের খেলোয়াড়েরা কিন্তু একদিকেই বলকে আঘাত করেন না, বরং ক্রমান্বয়ে বিপরীত দিকে আঘাত করেন। এই ডিজাইনটির কথা লরেন্সের পাশাপাশি অন্যরা চিন্তা করলেও লরেন্সই সর্বপ্রথম বানাতে সক্ষম হয়েছিলেন। কথিত আছে, লরেন্স তাঁর এই আইডিয়া ১৯২৯ সালে লাইব্রেরিতে বসে চিন্তা করেছিলেন এবং একটি পেপার ন্যাপকিনে এঁকেছিলেন। এটা থেকে প্রমাণ মেলে, পদার্থবিজ্ঞানীদের গবেষণাকালীন জীবনে পেপার ন্যাপকিনের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ, কফি খাওয়ার সময় অন্য কোনো বিজ্ঞানীর কাছে আইডিয়া শেয়ার করার জন্য ন্যাপকিনের ওপর লেখাই সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি!

১৯৩০ সালের মধ্যেই লরেন্স সাইক্লোট্রনের একটি ছোট কিন্তু কর্মক্ষম সংস্করণ তৈরি করে ফেলেন। এটার ব্যাসার্ধ ছিল প্রায় সাড়ে চার ইঞ্চি। আর এটা বানাতে নাকি ওই সময়ে তাঁর ২৫ ডলারের মতো খরচ পড়েছিল (যা আজকের বাজারে প্রায় ৫০০ ডলারের সামান্য বেশি)। বর্তমান যুগে এত কম খরচে এ রকম নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কথা কি আমরা চিন্তা করতে পারি?

লরেন্স তাঁর এই যন্ত্র আবিষ্কারের জন্য ১৯৩৯ সালেই নোবেল পুরস্কার পেয়ে যান । কারণ, তাঁর এ যন্ত্র নিউক্লিয়ার ফিজিকসের পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

লরেন্সের ডিজাইনটি সফল প্রমাণিত হওয়ার পর বিজ্ঞানীরা প্রকৃত পরীক্ষণে ব্যবহার করা যায়, এমন সাইজের যন্ত্র বানাতে হাত দিলেন। এই ডিজাইন ব্যবহার করার দুটি মূল ঝামেলা রয়ে গেছে। প্রথমত, কণার শক্তি বাড়াতে গেলে (আমরা সেটা আগেই আলোচনা করেছি) বৃত্তাকার কক্ষপথের আকার বড় হতে থাকে। তাই সাইক্লোট্রনের ‘ডি’গুলোর সাইজও বড় হতে হয়। দ্বিতীয়ত, পুরো কক্ষপথকে চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যে থাকতে হয় এবং সে জন্য বিশাল আকারের চুম্বক বানানোর প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বলতে দ্বিধা নেই, সেগুলো অত্যন্ত ভারী এবং সেগুলো জায়গামতো রাখার জন্য বেশ জটিল ইঞ্জিনিয়ারিং কাজকারবার করার প্রয়োজন পড়ে। এ জন্য সহজেই বোঝা যায়, নিউক্লিয়ার ল্যাবগুলোতে পদার্থবিদদের পাশাপাশি কেন বেশি না হলেও প্রায় কাছাকাছি সংখ্যক ইঞ্জিনিয়ারিং বিশেষজ্ঞদের অবস্থান করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

লরেন্স তাঁর এই যন্ত্র আবিষ্কারের জন্য ১৯৩৯ সালেই নোবেল পুরস্কার পেয়ে যান । কারণ, তাঁর এ যন্ত্র নিউক্লিয়ার ফিজিকসের পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। সেটা কী রকম গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা সাধারণ লোকজন বুঝতে পারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর। অবশ্য লরেন্স তার সাইক্লোট্রনের ব্যবহার চিকিৎসাবিজ্ঞানে হবে, এ রকম ধারণা করেছিলেন, কিন্তু পারমাণবিক বোমা আবিষ্কার নিউক্লিয়ার গবেষণার ওপর সাধারণ জনগণের মনোযোগ অন্য দিকে ধাবিত করে।

পাশাপাশি বিজ্ঞানীরা আরও শক্তিশালী কণাত্বরক যন্ত্র বানানোর চিন্তাভাবনা শুরু করেন, যা সাইক্লোট্রনের ডিজাইন দিয়ে করা সম্ভব ছিল না, বিশেষত ভারী ও বিশাল চুম্বক বানানো কষ্ট ও ব্যয়সাধ্য হওয়ায়। এ জন্য ১৯৫০-এর পর থেকে সাইক্লোট্রনের পরিবর্তে সবাই সিনক্রোট্রন (Synchrotron) নামের নতুন ডিজাইনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। কিন্তু নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানে সাইক্লোট্রন যে বিশাল ভূমিকা রেখেছিল, তা অনস্বীকার্য।

(চলবে)

লেখক: অধ্যাপক, ফিজিক্যাল সায়েন্সেস বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ