শুধু মানুষই নয়, বিজ্ঞান চর্চা করে প্রাণীরাও!
সত্যি বলছি। খুদে কীটপতঙ্গ থেকে বিশালাকার সব প্রাণীর আচরণ খেয়াল করলে বোঝা যায়, এদের জীবন-যাপন শুধু সহজাত প্রবৃত্তির ওপর নির্ভরশীল নয়। মানুষের মতো উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা না থাকলেও, বিজ্ঞানের প্রয়োগ যে ওদের জীবনে আছে, তা বোঝা যায় নানা পর্যবেক্ষণে। ওদের দৈনন্দিন নানা কাজে পদার্থবিজ্ঞানের প্রয়োগ দেখলে রীতিমতো থমকে যেতে হয়! এও সম্ভব!
বিড়ালের কথাই ধরুন। যেকোনো উচ্চতা থেকে বিড়ালকে ছেড়ে দিলে দেখবেন, বিড়ালটা সোজা হয়ে মাটিতে নামছে। মানে, অবতরণের সময় ওর পা-ই মাটিতে পড়ে। সাধারণত অভিকর্ষজ ত্বরণের কারণে কোনো বস্তুর যে অংশটা সবচেয়ে ভারী, সেই অংশটাই প্রথমে মাটিতে পড়ার কথা। কিন্তু বিড়াল এ ক্ষেত্রে নিজেকে এমনভাবে অভিযোজিত করে নিয়েছে যে শূন্যে থাকতেই শারীরিক কসরত করে এটি পা নিচের দিকে নিয়ে আসতে পারে এবং সেভাবেই মাটিতে অবতরণের প্রস্তুতি নেয়। এ সময় মহাকর্ষীয় ত্বরণের (অনেকে বলেন অভিকর্ষজ ত্বরণ) বিপরীতে তার কসরত করতে হয়। বিড়ালের এই দক্ষতাকে বলা হয় ‘রাইটিং রিফ্লেক্স’। এটা বিড়ালের প্রাকৃতিক দক্ষতা। অথচ দেখে মনে হয়, বিড়াল যে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম জেনে-শুনে এই কসরত করছে!
সাধারণত ৩-৪ সপ্তাহ বয়সেই বিড়াল এ দক্ষতা রপ্ত করে। ৬-৯ সপ্তাহের মধ্যেই হয়ে ওঠে পারদর্শী। কিন্তু শূন্যে ভেসে থেকে এই প্রায় অসম্ভব কসরত বিড়াল কীভাবে করে? আসলে, পড়ন্ত অবস্থায় বিড়াল প্রথমে শরীরের সামনের অংশ ঘুরিয়ে নেয়। একটু পর পেছনের অংশও ঘুরিয়ে নেয় একইভাবে। গবেষণায় দেখা যায়, নিজের ভরকেন্দ্র কাজে লাগিয়ে চমৎকার এই শারীরিক কসরত করতে ০.২ থেকে ০.৩ তিন সেকেন্ডের মতো সময় লাগে বিড়ালের! ফলে উল্টো করে ফেলে দিলেও সে চমৎকারভাবে চারপায়েই ল্যান্ড বা অবতরণ করে মাটিতে। এ ছাড়াও বিড়াল উঁচু জায়গা থেকে পড়ার সময় দেহকে যথাসম্ভব ছড়িয়ে দেয়। এতে যেমন পতনের গতি কমে আসে, তেমনি ভরবেগ ছড়িয়ে পড়ে অনেকখানি জায়গা জুড়ে। মোটের ওপর মৃত্যুঝুঁকি কমে যায়। বিড়ালের এ দক্ষতা আধুনিক রোবোটিকসে প্রয়োগ করতে চাইলে আমাদের হয়তো পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র মেনে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা গণিত করতে হবে। অথচ বিড়াল স্বাভাবিকভাবেই এ দক্ষতা রপ্ত করে ফেলে! (বিড়াল কত ওপর থেকে লাফ দিয়ে বাঁচতে পারে? পড়ুন।)
বাংলায় বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে—সাপের পাঁচ পা দেখা। কিন্তু বাস্তবে সাপের কোনো পা নেই। তবু আমরা প্রায়ই সাপকে জলে, স্থলে, পাথুরে উঁচু-নিচু ভূমির ওপর দিয়ে কিংবা মরুভূমিতে উষ্ণ বালুতে চলাচল করতে দেখি। এমনকি উলম্ব (লম্বালম্বি) তল, যেমন গাছের কাণ্ড বেয়ে ওপরেও উঠে যেতে দেখা যায় এগুলোকে। সাপের বিশেষ এ চলনকে বলে ‘স্লিদারিং মোশন’। বাংলায় বলা যেতে পারে সর্পিল গতি।
সাপের দেহ নরম মাংসপেশী দিয়ে গঠিত। এদের বুকের দিকটায় ছোট ছোট আঁশ থাকে। চলাচলের সময় সাপ তার দেহে বিভিন্ন পয়েন্ট বা বিন্দু তৈরি করে নেয়। এ বিন্দুগুলো মাটির ওপরে স্থির এবং শক্ত চাপ প্রয়োগ করে। এরপর এ চাপ কাজে লাগিয়ে দেহের বাকি অংশকে সামনের দিকে ছড়িয়ে দেয়। এভাবে এগিয়ে চলে। সাপের এই চলাচলে মাংসপেশী এবং আঁশ—দুটো একসঙ্গে কাজ করে। মাংসপেশী বল প্রয়োগের মাধ্যমে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। আর দেহের আঁশগুলো মাটিতে ঘর্ষণ বল তৈরি করে সাপকে পিছলে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। এভাবে হাত-পা ছাড়াই প্রায় সবরকম পথে চলাচল করে সাপ। খেয়াল করলে দেখবেন, পদার্থবিজ্ঞানে নীতি কাজে লাগিয়েই চলাফেরা করে এরা। কিন্তু সাপ নিজে বিজ্ঞান জেনে কাজটা করছে, সে কথা বললে যে আপনিও হাসবেন, তা আর বলতে!
চোখে কম দেখলেও গাছ তো বটেই, কাছে কোথায় কোন পাকা ফল আছে, সেটাও বাদুড় খুব সহজে বের করতে পারে। এ জন্য কাজে লাগায় ইকোলোকেশন নামে একটি প্রক্রিয়া।
ধরুন, এক সন্ধ্যায় বাসায় ফিরছেন। হঠাৎ পথের পাশে একটা কলা গাছে কিছু নড়তে দেখলেন। ভালোভাবে লক্ষ করার পর বুঝলেন, একটা বাদুড় উল্টো হয়ে ঝুলে কলা খাচ্ছে। এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু আপনার মাথায় প্রশ্ন আসতে পারে— বাদুড় তো চোখে অতো ভালো দেখে না, তাহলে সে এই কলা গাছের সন্ধান পেল কী করে?
চোখে কম দেখলেও গাছ তো বটেই, কাছে কোথায় কোন পাকা ফল আছে, সেটাও বাদুড় খুব সহজে বের করতে পারে। এ জন্য কাজে লাগায় ইকোলোকেশন নামে একটি প্রক্রিয়া। বাদুড় চলাচলের সময় খুব উচ্চ কম্পাংকের শব্দ (Ultrasonic sound) তৈরি করে। এ শব্দ আমাদের শ্রবণ সীমার বাইরে। আমরা শুনতে পাই না। কিন্তু বাদুড় শুনতে পায়। শুধু তাই নয়, বাদুড়ের এই উৎপন্ন শব্দ যখন কোথাও বাধা পেয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে, তখন সেই প্রতিধ্বনি শুনে দূরত্ব ও প্রতিফলকের নানা বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারে প্রাণীটি।
ধরা যাক, রাতের অন্ধকারে একটা পোকার শরীর থেকে বাদুড়ের উৎপন্ন শব্দটি ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল। এ প্রতিধ্বনি শুনে বাদুড় হিসেব কষে বুঝতে পারে, পোকাটি তার কাছ থেকে কত দূরে অবস্থান করছে, এর আকার কেমন, গঠন-প্রকৃতি শক্ত না নরম ইত্যাদি। আবার অনেকগুলো বাদুড় যখন একসঙ্গে ওড়ে, তখন তাদের তৈরি শব্দগুলো যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে না যায়, এ জন্য তারা নিজ নিজ শব্দের মধ্যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য যোগ করে। ফলে আলাদা করে চেনা যায়। অনেকটা আমরা যেমন অনেক ভিড়ের মধ্যেও নিজের প্রিয়জনদের গলার স্বর বুঝতে পারি, সেরকম। ঠিক এরকম প্রযুক্তি ব্যবহার করেই সমুদ্রের গভীরতা মাপা হয়। সে জন্য যন্ত্র তৈরি করতে পদার্থবিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার করতে হয়েছে মানুষকে। তার ওপর সূত্রে বসিয়ে হিসাব-নিকাশ করে বের করতে হয় গভীরতা কতদূর বা কেমন। অথচ বাদুড় প্রাকৃতিকভাবেই এ দক্ষতা নিয়ে জন্মায়।
এরকম আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রাণী পেঙ্গুইন। এই প্রাণীর ডানা থাকলেও তা ওড়ার উপযোগী নয়। এরা তাই মাটিতেই থাকে বেশির ভাগ সময়। অ্যান্টার্কটিকার বরফে ঢাকা সাগড়পাড়ে এদের বাস। জীবনের প্রয়োজনে পানির সঙ্গে পেঙ্গুইনের দারুণ সখ্যতা। কখনো শিকার ধরতে, কখনো-বা শিকারির হাত থেকে রক্ষা পেতে পেঙ্গুইনকে দ্রুতগতিতে সাঁতার কাটতে হয়। পেঙ্গুইন তা পারেও। এদের ডানা অন্যসব পাখির মতো নয়। বরং হাতের সঙ্গে অনেকটা মেলে। এগুলোকে তাই ‘ফ্লিপার’ বলা হয়। সাঁতার কাটার সময় পেঙ্গুইন তার ডানাগুলো সামনে থেকে সজোরে পেছনে নিয়ে আসে। অর্থাৎ পানি ঠেলে পেছনে পাঠিয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। বলা যায়, অনেকটা যেন নৌকার বৈঠার মতো। আর লেজের সাহায্যে এরা মাছের মতো—কিংবা বলতে পারেন, নৌকার হালের মতো—যেকোনো মুহূর্তে দিক পরিবর্তন করতে পারে। দেহের ডিম্বাকার আকৃতির কারণে অনেকটা এড়াতে পারে পানিতে ঘর্ষণ বল। পেঙ্গুইনের চলাচলের এই কৌশল নৌযান চালনায় আমরা ব্যবহার করি সভ্যতার প্রায় শুরু থেকেই।
আট পায়ের ও আট চোখের মাকড়সার কথা এলেই আসবে মাকড়সার জালের কথা। এই প্রাণীটির পেটে আছে স্পিনারেট নামে একধরনের যন্ত্র। সেখান থেকে এটি একপ্রকার তরল রাসায়নিক নিঃসরণ করে, যা বাতাসের সংস্পর্শে এলে শক্ত ও আঠালো হয়ে যায়। তখন রেশমের মতো তন্তু মতন দেখা যায়। এরপর মাকড়সা তার কারিগরি শৈলীর মাধ্যমে নিখুঁত ফ্রেম তৈরি করে। একের পর এক সুতো নির্দিষ্ট প্যাটার্নে জুড়ে দিয়ে সুনিপুণভাবে তৈরি করে জালের মতো কাঠামো। এটাই তার দুর্গ। এই দুর্গ দেখতে যতটা সুন্দর, ততটাই ভয়ঙ্কর। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা গেছে, একই পুরুত্বের স্টিল বা ইস্পাতের তারের চেয়ে মাকড়সার জালের সুতো প্রায় পাঁচগুণ বেশি ভারসহ। এমন মিহি, স্বচ্ছ, আঠালো এবং অধিক ভার বইতে সক্ষম এ জাল ছোট কীটপতঙ্গদের জন্য মরণ ফাঁদ হিসেবে কাজ করে। কোনো পোকা এই জালের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় সেখানে আটকা পড়ে। জাল ছিন্ন করে বের হওয়ার জন্য কসরত করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যায় এক পর্যায়ে। তবু মুক্তি মেলে না।
এসব গল্প বলার কারণ আর কিছু নয়—প্রাণীদের চলাফেরা, শিকার পদ্ধতি ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই খেয়াল করলে বোঝা যায়, এরা প্রতিনিয়ত পদার্থবিজ্ঞানের স্বতঃসিদ্ধ নীতিগুলো ব্যবহার করছে। সাধারণ দৃষ্টিতে আমরা যখন এগুলো দেখি, তখন মনে হয় যেন আপনাআপনিই ঘটছে। কিন্তু বিজ্ঞানের আলোকে যখন এসবের ব্যাখ্যা খুঁজতে যাব, আমাদের কাছে জোরালোভাবে প্রতীয়মান হবে, এগুলো নিছক কোনো ঘটনা নয়। শেষ করার আগে তাই শুরুর প্রশ্নটিই আবার ফিরে আসে। পদার্থবিজ্ঞানের এই নিয়মগুলো কি জেনে-বুঝে ব্যবহার করে প্রাণীরা?
সত্যি বলতে, সে উত্তর জানার সুযোগ বিজ্ঞানের হাতে এখন পর্যন্ত নেই। কারণ, আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি না। কথা বলতে বা আলাপ করতে পারি না। তাই আমরা এগুলোকে এসব প্রাণীর অভ্যাসগত প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করি। তবে প্রকৃতির নানা ঘটনা বারবার আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক নীতিগুলো সবার ক্ষেত্রেই কার্যকর। এগুলোকে উপেক্ষা করে জীবনযাপন করা সম্ভব নয়, তা সে মানুষই হোক আর পেঙ্গুইন বা মাকড়সা—সবার জন্যই এ কথা সত্যি।