দৈনন্দিন জীবনে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা

জাগতিক প্রায় সবকিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। প্রতিটি বস্তুই অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দিয়ে তৈরি। এদের কাজকর্মের বেশির ভাগই অবশ্য আমাদের দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও উপলব্ধির মাধ্যমে তাদের কার্যকলাপ বুঝতে হয়। তবে কিছু কিছু উদাহরণ আছে যেগুলোয় বাস্তবে কোয়ান্টাম মেকানিকসের প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়।

এমআরআই স্ক্যানার

দেহের অভ্যন্তরের খোঁজ জানতে হয় চিকিত্সাবিজ্ঞানীদের। স্বাভাবিক ক্যামেরায় সেসব কাজ করা যায় না তেমন একটা। এ ক্ষেত্রে এক্স-রে বা আলট্রাসনোগ্রাফি ভালো কাজে দেয়। এক্স-রের মাধ্যমে ভেদযোগ্য নমনীয় মাংস পেরিয়ে ভেতরের দৃঢ় অস্থি বা টিউমারের ছবি তোলা যায়। কিছু কিছু ছবি এক্স-রের মাধ্যমে তোলা যায় না। যেমন গর্ভে থাকা ভ্রূণের ছবি। এ ক্ষেত্রে আলট্রাসনোগ্রাফি ব্যবহার করা হয়। একটি মেশিন থেকে উচ্চ কম্পাঙ্কের শব্দ পাঠানো হয় দেহের ভেতর। সেসব শব্দতরঙ্গ শরীরের বিভিন্ন স্তরে প্রতিফলিত হয়, ত্বক ও তরল অংশের মধ্যে, তরল অংশ ও মাংসপেশির মধ্যে, মাংসপেশি ও অস্থির মধ্যে। সেই প্রতিফলিত শব্দ ধারণ করা হয় আরেকটি যন্ত্রে। সেসব শব্দের ধরন এবং প্রতিফলনের ব্যাপ্তির সময় বিশ্লেষণ করে একটি দ্বিমাত্রিক ছবি তৈরি করে যন্ত্রটি। সেটা দেখে বলে দেওয়া যায় দেহের ভেতরের খবর।

তবে মানুষের প্রয়োজন আরও বেশি। অস্থির ভেতরের খবরও মানুষের দরকার। কলার (টিস্যু) পুঙ্খানুপুঙ্খ ছবিও দরকার। এই কাজগুলো করে দিতে পারে এমআরআই স্ক্যানার। আর এই স্ক্যানারের মূল ভিত্তিই হচ্ছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো স্পিন। এ মেশিনে কণার স্পিন ধর্মটিকেই কাজে লাগানো হয়। স্পিন কী? একটি ফুটবলকে যদি ঘূর্ণনের সঙ্গে লাথি দেওয়া হয় তাহলে বলটি সামনের দিকে এগিয়ে যাবে এবং লাটিমের মতো ঘুরবেও। মৌলিক কণাগুলোর মধ্যেও এ রকম ঘূর্ণন বৈশিষ্ট্য আছে। একে বলা যেতে পারে কণার স্পিন। কোনোটির স্পিন ১, কোনোটির ২, আবার কোনোটির ১/২ কিংবা ৩। মানুষের দেহে কণাদের স্পিন বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগানোর প্রক্রিয়াটি বেশ মজার। মানুষের দেহের বেশির ভাগই পানি। পানির উপাদানে আছে হাইড্রোজেন। পানিতে হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসে থাকে একটি প্রোটন। এর মানে হলো একক প্রোটন। প্রোটনের মধ্যে স্পিন বৈশিষ্ট্য কাজ করে। প্রোটনের এই স্পিন আবার চৌম্বক ক্ষেত্র দ্বারা প্রভাবিত হয়। এমআরআই মেশিন দিয়ে শক্তিশালী একটি চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি করা হয়। চৌম্বকক্ষেত্রের তীব্রতার মান ০.২ টেসলা থেকে ৩ টেসলা পর্যন্ত হয়। একটি সাধারণ রেফ্রিজারেটরে যে পরিমাণ চৌম্বকক্ষেত্র থাকে তার প্রায় হাজার গুণ শক্তিশালী এই চৌম্বকক্ষেত্র।

যখন দেহের হাইড্রোজেনের প্রোটনগুলো শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যে পড়ে তখন তাদের স্পিন উল্টে যায়। ঘড়ির কাঁটার দিকেরগুলো বিপরীত দিকে চলে যায়, বিপরীত দিকেরগুলো ঘড়ির কাঁটার দিকে চলে আসে। যখন যন্ত্র থেকে চৌম্বকক্ষেত্র বন্ধ করে ফেলা হয় তখন প্রোটনের ঘূর্ণন আগের অবস্থায় ফিরে আসে। অয়নচলন বা চত্বপবংংরড়হ নামে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই ব্যাপারটি সম্পন্ন হয়। পরিবর্তিত অবস্থা থেকে যখন মূল অবস্থায় ফিরে আসে তখন প্রোটন থেকে রেডিও সিগন্যাল নির্গত হয়। এই সিগন্যাল আবার ধারণ করা হয় স্ক্যানারের রিসিভারে। ধারণ করা সিগন্যাল বিশ্লেষণ করে ছবিতে রূপান্তর করে দেখায় আমাদের।

দেহের ভিন্ন ভিন্ন অংশে, ভিন্ন ভিন্ন টিস্যুতে পানির ঘনত্ব আলাদা। তাই প্রোটনের ঘনতও্ব আলাদা। এজন্য বিভিন্ন টিস্যুতে স্পিন পরিবর্তনের হারও আলাদা হয়। রক্তের ক্ষেত্রে যে হার, মাংসপেশির ক্ষেত্রে তেমন নয়। মাংসপেশির ক্ষেত্রে স্পিনের পরিবর্তনের হার যেমন, মস্তিষ্কের ক্ষেত্রে হার তেমন নয়। মস্তিষ্কের ক্ষেত্রে যেমন, অস্থির ক্ষেত্রে আবার তেমন নয়। তাই কোনো অংশের স্পিন পরিবর্তনের হার কেমন, তা বিশ্লেষণ করে বলে দেওয়া যায় এটি দেহের কোন অংশের টিস্যু। এভাবে মস্তিষ্কের ভেতরের রূপ কিংবা অস্থিমজ্জার কলকবজা সম্বন্ধেও পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে চৌম্বকক্ষেত্র প্রয়োগ করে দেহের অভ্যন্তরীণ গঠনের ত্রিমাত্রিক ছবিও পাওয়া যায়। আরও অসুস্থ হলে মানুষের দেহের কোন অংশে সুক্ষাতিসূক্ষ পরিবর্তনও এই রেডিও সিগন্যালে ধরা পড়ে। চিকিত্সকরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারেন।

লেজার

লেজারের মূল ভিত্তি লুকিয়ে আছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যারর ভেতর। এই ভিত্তি প্রদান করেছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। ১৯১৭ সালের দিকে তিনি আলোক নিঃসরণ নিয়ে একটি তত্ত্ব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যদি কোনো পরমাণুতে মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রদান করা হয় তাহলে সেটি উদ্দীপিত হয়ে ফোটন নিঃসরণ করবে। নিজে তো করবেই পাশাপাশি পাশের পরমাণুকেও ফোটন নিঃসরণের জন্য উদ্দীপিত করবে। পাশের পরমাণুটি আবার তার পাশের পরমাণুকে উদ্দীপিত করবে। এভাবে একটি প্রক্রিয়া চলতে থাকবে। এ প্রক্রিয়ায় নিঃসরিত সব ফোটন একই শক্তির হবে এবং একই দিকে ছুটবে। এ কারণেই লেজারের আলো এক রঙের হয় এবং এক দিকে অনেক দূর পর্যন্ত যায়।

কম্পিউটার ও স্মার্টফোন

কম্পিউটার, স্মার্টফোন ও অন্যান্য আধুনিক যন্ত্রপাতির প্রায় সবগুলোতেই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রয়োগ আছে। যন্ত্রগুলো তৈরির জন্য যে চিপ ব্যবহার করা হয় সেগুলোতে অর্ধপরিবাহী, ক্রিস্টাল, ব্যান্ড স্ট্র্যাকচার ইত্যাদি অনেক নিয়মনীতির প্রয়োগ থাকে। আর এসব নিয়মনীতি গড়ে উঠেছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ওপর ভিত্তি করে। যতবারই আমরা ফোনে কথা বলি, যতবারই আমরা এলইডি ডিসপ্লেতে তাকাই ততবারই আসলে আমরা কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে ব্যবহার করে চলেছি।

জগতের সবকিছুই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৌলিক কণিকার কণা দিয়ে তৈরি। ক্ষুদ্র কণা মানেই সেখানে আছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বিষয়। জগতে যা কিছু হচ্ছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে মেনেই হচ্ছে। বলা যায় আমরা কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সাগরেই ডুবে আছি। হয়তো তাদের অস্তিত্বের দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু তারা ঠিকই বিরাজ করছে।

সূত্র: লাইভ সায়েন্স, আইওপি, ব্রায়ান কোবারলিন