নিউরনের জাল এবং মহাবিশ্ব

Kazi Akash

মহাবিশ্বের গতিপ্রকৃতি অত্যন্ত জটিল। কয়েক হাজার বছর ধরে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের তথ্য সংগ্রহ করছেন। শুরুতে খালি চোখে, পরে আধুনিক টেলিস্কোপের সাহায্যে। কোটি কোটি তথ্যবিন্দু বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের জটিল নিয়ম বুঝতে চেষ্টা করে চলেছেন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। মহাবিশ্বের প্রকৃতিকে বিজ্ঞানের সূত্রে বেঁধে ফেলার অনেক চেষ্টা হয়েছে। মহাবিশ্বের বৈজ্ঞানিক নিয়ম সম্পর্কে আইরিশ নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কয়েকটি কথা বলেছিলেন। ১৯৩০ সালে লন্ডনের একটি অনুষ্ঠানে আলবার্ট আইনস্টাইনকে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘টলেমি একটি বৈজ্ঞানিক মহাবিশ্ব তৈরি করেছিলেন, যা ১ হাজার ৪০০ বছর টিকে ছিল। এরপর নিউটন একটি বৈজ্ঞানিক মহাবিশ্ব তৈরি করেছিলেন, যা টিকে ছিল ৩০০ বছর। এরপর এলেন আইনস্টাইন। আমরা এখনো জানি না আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক মহাবিশ্ব কত বছর টিকে থাকবে। আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব থেকে আমরা যে মহাবিশ্বের ধারণা পেয়েছি, তা এখনো সঠিকভাবে টিকে আছে। অভিকর্ষ বলের স্থান-কালের নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মহাবিশ্বে ছড়ানো বিপুল পরিমাণ অদৃশ্য বস্তু বা ডার্ক ম্যাটার এবং অদৃশ্য শক্তি বা ডার্ক এনার্জি।’

শক্তিশালী টেলিস্কোপের সাহায্যে প্রাপ্ত তথ্য ও উপাত্ত এবং আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্বের সমন্বয়ে মহাবিশ্বকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উপস্থাপন করার সর্বাধুনিক মডেল হলো ল্যামডা কোল্ড ডার্ক ম্যাটার মডেল বা ল্যামডা-সিডিএম (LCDM) মডেল। মহাবিশ্বের তিনটি প্রধান উপাদান হলো গুপ্ত শক্তি (ডার্ক এনার্জি), গুপ্তবস্তু (ডার্ক ম্যাটার) এবং সাধারণ পদার্থ ও শক্তি। এই তিন ধরনের উপাদানকে ল্যামডা-সিডিএম মডেলে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাই এ মডেলকে মহাবিশ্বের স্ট্যান্ডার্ড মডেল বলা হয়। ল্যামডা হলো মহাজাগতিক ধ্রুবক (কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট), যা ডার্ক এনার্জির অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। মহাবিশ্বের গতিপ্রকৃতি সার্থক ও সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় এ মডেলের সাহায্যে। কিন্তু এরপরও ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি যেহেতু সরাসরি শনাক্ত করা যাচ্ছে না এখনো, মহাবিশ্বের অনেক রহস্য এখনো অধরাই রয়ে গেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এত উন্নতির পরও দেখা যাচ্ছে, মহাবিশ্বের জটিল রহস্যের জট খুব সামান্যই খুলতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা।

কিন্তু মহাবিশ্বের কাজকর্মের চেয়েও জটিল একটি অঙ্গ নিয়ে আমাদের জীবন। সেটা হলো আমাদের মস্তিষ্ক। আমাদের মস্তিষ্কে প্রায় ১০ হাজার কোটি (১০০ বিলিয়ন) নিউরন আছে। এই ১০ হাজার কোটি নিউরনের প্রায় ১ কোটি (১০০ ট্রিলিয়ন) জটিল স্নায়বিক সংযোগের মাধ্যমে চলে আমাদের মস্তিষ্কের সব কাজকর্ম। আমাদের মস্তিষ্ককে সুপারকম্পিউটারের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তা আমরা জানি। কিন্তু আমাদের মস্তিষ্কের মরফোলজি বা গঠনবিজ্ঞান আর মহাবিশ্বের গঠনবিজ্ঞানের মধ্যে যে আশ্চর্য মিল আছে, তার সুনির্দিষ্ট তুলনামূলক বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ পাওয়া গেছে অতিসম্প্রতি। ইতালির বোলোগনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী ফ্রাঙ্কো ভাজ্জা এবং ভেরোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব নিউরোসার্জারির স্নায়ুবিজ্ঞানী আলবার্তো ফেলেত্তি মহাবিশ্বের কসমিক নেটওয়ার্ক বা মহাজাগতিক জাল এবং মস্তিষ্কের নিউরাল নেটওয়ার্ক বা নিউরনের জালের গঠনবিজ্ঞানের মধ্যে চমকপ্রদ মিল খুঁজে পেয়েছেন। ২০২০ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি ফ্রন্টিয়ার্স ইন ফিজিকস জার্নালে তাঁদের গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে।

আমাদের মস্তিষ্ককে থ্রি পাউন্ড ইউনিভার্স বা দেড় কেজি ভরের মহাবিশ্ব বলা হয়। এই তুলনা যে কেবল বাহ্যিক সাদৃশ্যের কারণে তুলনা নয়, তা প্রমাণ করার জন্য অধ্যাপক ভাজ্জা ও অধ্যাপক ফেলেত্তি নিউরাল নেটওয়ার্ক ও কসমিক নেটওয়ার্কের বিস্তারিত গাণিতিক বিশ্লেষণ করেন। পদার্থবিজ্ঞানের অনেক মৌলিক সূত্রের মধ্যে গঠনগত সাদৃশ্য আছে, তা আমরা জানি। যেমন নিউটনের মহাকর্ষ বলের সূত্রের সঙ্গে বিদ্যুৎ–চুম্বক বলের কুলম্বের সূত্রের মিল আছে। উভয় বলই দূরত্বের বর্গের বিপরীত অনুপাতিক। কিন্তু তাদের প্রকৃতি অনেকটাই ভিন্ন। যেমন মহাকর্ষ বল মহাবিশ্বের সব জায়গায় সব ধরনের পদার্থের ওপর কাজ করে। কিন্তু বিদ্যুৎ–চুম্বক বল কাজ করে শুধু চার্জযুক্ত কণার মধ্যে। তেমনি মস্তিষ্কের নিউরনের নেটওয়ার্ক এবং মহাবিশ্বের কসমিক নেটওয়ার্কের কার্যপদ্ধতির মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকলেও তাদের গাণিতিক গঠনবিজ্ঞানে আশ্চর্য সাদৃশ্য রয়েছে।

আমাদের মস্তিষ্কের মোট ভরের ৮০ শতাংশ হলো গ্রে ম্যাটার। এই গ্রে ম্যাটারে আছে প্রায় ৬০০ কোটি নিউরন এবং ৯০০ কোটি অন্যান্য কোষ। মস্তিষ্কের সেরিবিলামে (cerebellum) আছে প্রায় ৭ হাজার কোটি নিউরন এবং প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি অন্যান্য কোষ। মানুষের মস্তিষ্কের মোট নিউরনের সংখ্যা মহাবিশ্বের মোট গ্যালাক্সির সংখ্যার প্রায় সমান। নিউরনগুলো মস্তিষ্কে জোটবদ্ধ হয়ে পরস্পরের মধ্যে স্নায়বিক সংযোগের মাধ্যমে তৈরি করে জটিল নিউরাল নেটওয়ার্ক। একইভাবে মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যে মাধ্যাকর্ষণ এবং অন্যান্য জটিল প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় কসমিক নেটওয়ার্ক। যদিও কসমিক নেটওয়ার্ক নিউরাল নেটওয়ার্কের তুলনায় বিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন (১০২৭) বা ১০ লাখ কোটি কোটি কোটি গুণ বড়। নিউরাল নেটওয়ার্ক ও কসমিক নেটওয়ার্কের মধ্যে আছে আশ্চর্য দৃশ্যমান সাদৃশ্য।

ছবি ১-এর বাঁ পাশে দেখা যাচ্ছে, কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে তৈরি মহাবিশ্বের একটি বাস্তব নমুনা। ১০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরত্বের ভেতর কসমিক নেটওয়ার্কের যতটুকু দেখা যায়, তা দেখা যাচ্ছে এই ছবিতে। ডান পাশের ছবিটি হলো মস্তিষ্কের সেরিবিলামের ৪ মাইক্রোমিটার পুরু একটি স্লাইসের আণুবীক্ষণিক চিত্র। দৃশ্যত, একই আকারের দুটি চিত্রের পাওয়ার স্পেকট্রাম অ্যানালাইসিস করে দেখা গেছে, এই দুটি নেটওয়ার্কের গঠনবিজ্ঞান প্রায় কাছাকাছি। কসমিক নেটওয়ার্কে পাওয়া গেছে ৩ হাজার ৮০০ থেকে ৪ হাজার ৭০০ নোড বা সংযোগস্থল। প্রতিটি সংযোগস্থলে গড়ে ৩ দশমিক ৮ থেকে ৪ দশমিক ১টি সংযোগ পাওয়া গেছে। অন্যদিকে নিউরাল নেটওয়ার্কে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার নোড পাওয়া গেছে। প্রতিটি নোডে আছে ৪ দশমিক ৬ থেকে ৫ দশমিক ৪ স্নায়বিক সংযোগ।

ছবি ১: কসমিক নেটওয়ার্ক (বাঁয়ে) এবং নিউরাল নেটওয়ার্ক (ডানে)
Kazi Akash

মস্তিষ্কের উপাদানের ৭৭-৭৮ শতাংশ পানি, ১০-১২ শতাংশ লিপিড, ৮ শতাংশ প্রোটিন, ১ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট, ২ শতাংশ অন্যান্য জৈব যৌগ, লবণ ১ শতাংশ। পানি স্নায়বিক সংযোগে কোনো ভূমিকা রাখে না। দেখা যাচ্ছে, মস্তিষ্কের মোট ভরের ৭৭ থেকে ৭৮ শতাংশ কোনো ধরনের স্নায়বিক সংযোগে অংশ নেয় না। এদিকে মহাবিশ্বের মোট শক্তির প্রায় ৭৫ শতাংশ অদৃশ্য শক্তি বা ডার্ক এনার্জি। কসমিক নেটওয়ার্কে এই অদৃশ্য শক্তির সরাসরি কোনো ভূমিকা আমরা এখনো দেখতে পাই না। দেখা যাচ্ছে, নিউরাল ও কসমিক উভয় নেটওয়ার্কেই প্রায় ৭৫ শতাংশ উপাদানের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নেই।

কসমিক নেটওয়ার্কের উদ্ভব কীভাবে হয়েছে, তা সঠিকভাবে খুঁজে বের করা খুব সহজ কাজ নয় বলেই বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না ঠিক কীভাবে কী হয়েছে। কারণ, কম্পিউটারে মহাবিশ্বের একটি সার্থক মডেল তৈরি করতে ১ থেকে ১০ পেটাবাইট (১ পেটাবাইট = ১০২৪ টেরাবাইট) ডেটা দরকার। আর এত বিপুল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করার জন্য দরকার সুপারকম্পিউটার। আমাদের মস্তিষ্কের সঙ্গে কি এর তুলনা চলে?

আমাদের মস্তিষ্কের সব নিউরনকে কাজে লাগালে আমরা ২ দশমিক ৫ পেটাবাইট ডেটা আমাদের মাথার মধ্যে রাখতে পারব। আমরা আমাদের মস্তিষ্ককে যত বেশি খাটাব, মস্তিষ্কের নিউরাল নেটওয়ার্ক তত বেশি শক্তিশালী হবে, তত বেশি জটিল সমস্যার সমাধান আমরা করতে পারব। পুরো মহাবিশ্বের নেটওয়ার্কে যত তথ্য আছে, তার সব তথ্য ধরে রাখার মতো ক্ষমতা আমাদের মস্তিষ্কের নিউরনে আছে। এই ক্ষমতাকে কাজে লাগানোর জন্য দরকার নিয়মিত মাথা খাটানো। অর্থাৎ মগজের চর্চা। যে যত বেশি চর্চা করবে, তার নিউরাল নেটওয়ার্ক হবে ততই কার্যকর।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, বায়োমেডিকেল ফিজিকস বিভাগ, আরএমআইটি, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া

সূত্র: ফ্রাঙ্কো ভাজ্জা ও আলবার্তো ফেলেত্তি, ফ্রন্টিয়ার্স ইন ফিজিকস (২০২০); নটিলাস (২০১৯)