কলার তেজস্ক্রিয়তা

সংগৃহীত
কলাতে তেজস্ক্রিয়তা আছে জেনে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ, একটা কলায় তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ এক সিভার্টের দশ লাখ ভাগের এক ভাগ (০.০০০১ মিলিসিভার্ট)।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে ভয়াবহ পরমাণু বোমা হামলা কিংবা ইউক্রেনের চেরনোবিল পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুর্ঘটনার কারণে তেজস্ক্রিয়তা সম্পর্কে আমাদের কম-বেশি সবারই জানা। সেজন্যই হয়ত তেজস্ক্রিয়তা বা রেডিওঅ্যাকটিভির কথা শুনলে অনেকেই আঁতকে ওঠেন। এসব মানুষের জন্য পোশাকি একটা নামও আছে। রেডিওফোবি। বাংলায় কি তেজস্ক্রিয়াতঙ্ক বলব?

তেজস্ক্রিয় কণা চার্জিত বা আধানযুক্ত। এরা খুব দ্রুত বেগে চলাচল করতে পারে। তাই চলার পথে অনেক কিছুকেই ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে তেজস্ক্রিয় কণা। এমনকি আপনার দেহের রাসায়নিক পদার্থগুলোকেও ধ্বংস করতে পারে এরা। কাজেই তীব্র কোনো তেজস্ক্রিয় রশ্মির সামনে যথেষ্ট সময় থাকলে আপনার কোষের ডিএনএ ভেঙে পড়ার আশঙ্কা থাকে। তাণ্ডব শুরু হতে পারে দেহের অন্যান্য অংশেও।

প্রচণ্ড তেজস্ক্রিয়তার প্রথম হামলার শিকার হয় সাধারণত আমাদের দেহের দ্রুত বর্ধনশীল অংশ (যেমন চুল ও নখ)। সে কারণেই তেজস্ক্রিয়তায় অসুস্থ হলে প্রথমেই মাথার চুল ঝরে যায় এবং হাত ও পায়ের নখ খসে পড়তে দেখা যায়। এরপর একে একে দেহের চামড়াও খসে যেতে পারে, হুট করে একদিন মুখ থেকে খুলে পরে যেতে পারে দাঁত। আরও ভয়ংকর ব্যাপার হলো, এরপর নাড়িভুঁড়ি ধীরে ধীরে দ্রবীভূত হয়ে থকথকে মণ্ডে পরিণত হতে পারে।

তেজস্ক্রিয়তা পরিমাপের একক সিভার্ট। এর মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয় মানবদেহে কতটুকু তেজস্ক্রিয় ডোজ দেওয়া যাবে, কিংবা কতটুকু হলে ক্ষতিকর। এক সিভার্টের মানে হলো, কোনো তেজস্ক্রিয় রশ্মি যতটুকু শক্তি বহন করে এবং যে ব্যক্তির দেহে তা ঢুকবে, তার ভরের সঙ্গে তুলনা। একে আবার মিলিসিভার্ট, মাইক্রোসিভার্টে ভাগ করা হয়। বোঝাই যাচ্ছে, এক সিভার্ট সমান ১০০০ মিলিসিভার্ট।

মানুষের জন্য কত সিভার্ট মারাত্মক, তা স্পষ্ট নয়। তবে বছরে মোটামুটি ২০ মিলিসিভার্ট তেজস্ক্রিয়তাকে নিরাপদ বলে গণ্য করা হয়। এর চেয়ে বেশি হলেই মানবদেহে নানা সমস্যা দেখা দেয়। সেটা হতে পারে ১ সিভার্টের ১০০ ভাগের পাঁচ ভাগ বা ৫০ মিলিসিভার্ট। দৈনন্দিন জীবনে আমাদের সেভাবে কোনো ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয়তা বিকিরণকারী বস্তুর মুখোমুখি হতে হয় না। তবে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে তেজস্ক্রিয় যেসব বস্তুর কাছে আসে, তার মধ্যে রয়েছে দাঁতের এক্স-রে বা ম্যামোগ্রাম স্ক্যান। একবার দাঁতের এক্স-রে করলে এখান থেকে প্রায় ০.০০৫ মিলিসিভার্ট তেজস্ক্রিয়তা দেহে প্রবেশ করে। একে নিরাপদ বলে মনে করা হয়। কারণ মোটামুটি ১০ দিনে মানবদেহে প্রাকৃতিক নানা উৎস থেকে এই পরিমাপ তেজস্ক্রিয়তা প্রবেশ করে। সেটা তেমন ক্ষতিকর নয়। শুনলে হয়ত বিশ্বাস করবেন না, প্রাকৃতিক এসব উৎসের একটি হলো কলা।

কলায় তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ এক সিভার্টের দশ লাখ ভাগের এক ভাগ (০.০০০১ মিলিসিভার্ট)
সংগৃহীত

সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বলে রাখি, নিদিষ্ট কিছু পরমাণুর নিউক্লিয়াস অন্য পরমাণুর চেয়ে বেশি স্থিতিশীল থাকতে দেখা যায়। প্রোটন ও নিউট্রনের জন্য শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণ ব্যবহার করে আমরা বিশেষভাবে স্থিতিশীল নিউক্লিয়াসের মান কত কত হবে, তার তালিকা বের করতে পারি। সেই সংখ্যাকে ম্যাজিক সংখ্যা হিসেবে ডাকা যায়। এই ম্যাজিক সংখ্যার প্রোটন ও নিউট্রন কেন কাজ করে, তা জানা যায়নি। তবে এটুকুই কেবল জানি, পরমাণুতে নিদিষ্ট সংখ্যক প্রোটন ও নিউট্রনই ভালো, অন্যগুলো ভালো নয়।

এরকম একটা উদাহরণ হতে পারে পটাশিয়াম পরমাণু। মহাবিশ্বের বেশিরভাগ পটাশিয়াম স্থিতিশীল। এতে ১৯টি প্রোটন এবং ২০টি নিউট্রন থাকে। তবে এর বাইরে ০.০১২ শতাংশ পটাশিয়ামে নিউট্রন থাকে ২১টি। এ ধরনের পটায়শিয়ামকে বলা হয় পটাশিয়াম-৪০। আর এই কনফিগারেশনের কারণে নিউক্লিয়াস অস্থিতিশীল হয়। তাই পটাশিয়াম-৪০ এ বিটা ক্ষয় শুরু হয়। তাতে পটাশিয়ামের যেকোনো নমুণা থেকে খুবই হালকা তেজস্ক্রিয় রশ্মি বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। আমাদের পরিচিত ফলমূলের ভেতরে কলার মধ্যেই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পটাশিয়াম থাকে। সে কারণে ১৯৯৫ সালে লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির গবেষক গ্যারি ম্যান্সফিল্ড রসিকতা করে কলাকেও তেজস্ক্রিয়তা পরিমাপের একক হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। এই এককের নাম ব্যানানা ইকুয়েভ্যালেন্ট ডোজ (বিইডি) বা কলার সমতূল্য ডোজ! তবে এটি কোনো আনুষ্ঠানিক একক নয়। একটা কলা খেলে যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া যায়, সেটাকেই বলা হয় এক কলার সমতূল্য ডোজ বা এক বিইডি। এভাবে চাইলে আপনার খাবারের তেজস্ক্রিয়তা পরিমাপ করতে পারবেন।

কলাতে তেজস্ক্রিয়তা আছে জেনে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ, একটা কলায় তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ এক সিভার্টের দশ লাখ ভাগের এক ভাগ (০.০০০১ মিলিসিভার্ট)। ভয় পাবেন না, খাদ্যতালিকা থেকে কলাকে বয়কট করতেও যাবেন না। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কিছু অংক কষা যাক। ধরে নিই, বছরে এক সিভার্টের ১০০ ভাগের পাঁচ ভাগ মানবদেহের জন্য মারাত্মক। তাহলে কলা থেকে ওই পরিমাণ সিভার্ট আপনার দেহে প্রবেশ করতে হলে আপনাকে বছরে অন্তত ৫ হাজার কলা খেতে হবে। সেই হিসেবে দিনে খেতে হবে অন্তত ১৪টি কলা। এত কলা কেউ একদিনে খায় বলে মনে হয় না। তাই অযথা ভয় পাওয়ার কিছু নেই। নিয়ম করে পরিমিত কলা খান!

সূত্র : এলিমেন্টাল/টিম জেমস; উইকিপিডিয়া