সুপারকন্ডাক্টরের বিজ্ঞান

বিদ্যুৎকেন্দ্র ভেদে নানা ধরনের জ্বালানি, যেমন গ্যাস, তেল, পানি ইত্যাদি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এই কেন্দ্রগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এগুলো থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ একটি সমন্বিত ব্যবস্থার মাধ্যমে পৌঁছে দেয়া হয় সারা দেশের মানুষের দোরগোড়ায়। সেই ব্যবস্থার নাম জাতীয় গ্রিড। দেশের সকল প্রান্তের বিদ্যুৎকেন্দ্র যুক্ত থাকে এর সাথে। গ্রিডের অন্যতম উপকরণ হল উঁচু উঁচু সব টাওয়ার, দেখতে অনেকটা আইফেল টাওয়ারের মতো। এগুলো ব্যবহার করে বৈদ্যুতিক তার টেনে নিয়ে যাওয়া হয় বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে গ্রাহকের কাছে। এসব পরিবাহী তারের মধ্যে দিয়ে চলাচল করে বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ পরিবহনের সময় তারগুলোর মধ্যে উচ্চমাত্রার বিভব পার্থক্য বজায় রাখা হয়। সেটা কয়েক হাজার ভোল্ট হতে পারে। অন্যদিকে, গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ ব্যবহারের সময় বিভব পার্থক্যের মান থাকে অনেক কম। আমাদের দেশে মাত্র ২২০ ভোল্ট। তাহলে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের সময়ে এত উঁচু বিভব পার্থক্য বজায় রাখার কারণটা কী?

বিদ্যুৎ প্রবাহ আসলে ইলেকট্রনের প্রবাহ। কোনো পরিবাহী তারের দুই প্রান্তে যদি বিভব পার্থক্য প্রয়োগ করা হয়, তাহলে তারের মধ্যে দিয়ে চলাচলকারী ইলেকট্রনগুলো ত্বরিত হয়। এই ইলেকট্রনগুলোকে হাইওয়েতে চলমান গাড়ির সাথে তুলনা করা যেতে পারে। তবে চলাচলের সময় গাড়িগুলো চেষ্টা করে, যেন অন্য কোনো গাড়ির সাথে ধাক্কা না লাগে অথবা রোড ডিভাইডারের সাথে সংঘর্ষ না হয়। ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। চলাচলের সময়ে এরা পরিবাহক তারের পরমাণুর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ফলে বিদ্যুৎ প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। এই ঘটনার নাম রোধ। এটি পরিবাহকের বিশেষ ধর্ম। ওহমের সূত্র (V=IR) থেকে রোধের মান পরিমাপ করা যায়। সংঘর্ষের ফলে শক্তির আদান-প্রদানের মাধ্যমে পরিবাহী তার উত্তপ্ত হওয়া শুরু করে। ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদ্যুৎ শক্তির অপচয় ঘটে। যদি তারের মধ্যে উচ্চ মাত্রার বিভব পার্থক্য বজায় রাখা যায়, তাহলে এই প্রক্রিয়ায় শক্তি অপচয়ের মাত্রা কমে আসে। ট্রান্সফর্মার ব্যবহারের মাধ্যমে বিভব পার্থক্য বাড়ানোর কাজটি করা হয়। বিদ্যুৎ কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার পর উচ্চ ভোল্টেজের প্রয়োজন থাকে না। তাই পুনরায় ট্রান্সফর্মার ব্যবহার করে ভোল্টেজের মান কমানো হয়। এই পদ্ধতি ব্যবহারের পরও আমাদের দেশে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রায় ৩ শতাংশ অপচয় হয়। যুক্তরাষ্ট্রে অপচয়ের মাত্রা ৫ শতাংশেরও বেশি ।

এমন কোনো উপায় কি আছে, যাতে অপচয়ের মাত্রা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা যায়?

২.

তাপমাত্রার সাথে পরিবাহকের রোধের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। পরিবাহকের ক্ষেত্রে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে রোধ বাড়ে। অপরিবাহকে ঘটে উল্টোটা। আর সেমিকন্ডাক্টর সাধারণ তাপমাত্রায় অপরিবাহকের মতো আচরণ করলেও, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে পরিবাহকের মতো আচরণ শুরু করে। তাপমাত্রার সঙ্গে রোধের তারতম্য হওয়ার বিষয়টি বিজ্ঞানীদের বেশ আগে থেকেই জানা ছিল। ১৯১১ সালে মারকারি বা পারদের রোধ নিয়ে গবেষণা করছিলেন ডাচ পদার্থবিদ হেইক কামেরলিং ওনেস। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, অতি নিম্ন তাপমাত্রায় রোধের সাথে তাপমাত্রার সম্পর্ক যাচাই করা। এ লক্ষে তিনি তরল হিলিয়াম ব্যবহার করে মারকারির তাপমাত্রা নামিয়ে আনেন প্রায় পরম শূন্য তাপমাত্রার কাছে—মাইনাস ২৬৮.৭৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৪.৪ কেলভিনে। আমরা জানি, তাপমাত্রার সাথে পদার্থের পরমাণুর চলাচল সম্পর্কযুক্ত। শূন্য কেলভিন তাপমাত্রায় যে কোনো পদার্থের পরমাণু সম্পূর্ণরূপে চলাচলের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। অর্থাৎ, এরা স্থির হয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। ৪.৪ কেলভিন কিন্তু এর চেয়ে খুব বেশি দূরে নয়। যাই হোক, ওনেস পর্যবেক্ষণ করেন, এই তাপমাত্রায় রোধের মান বেশ কমে যায়। এরপর তিনি ধীরে ধীরে তাপমাত্রা নামিয়ে নিয়ে আসেন ৪.২ কেলভিনে এবং হঠাৎ করেই পর্যবেক্ষণ করেন বিস্ময়কর এক ঘটনা। তিনি দেখেন, এক লাফে মারকারির রোধ সম্পূর্ণ শূন্য হয়ে গিয়েছে। এভাবে আকস্মিকভাবে রোধ শূন্য হয়ে যাওয়ার কোন ব্যাখ্যা দিতে পরেনি ওনেস। তবে এই পর্যবেক্ষণ তাঁকে ১৯১৩ সালে নোবেল পুরষ্কার এনে দেয়।

৩.

ওনেসের পর্যবেক্ষণ করা ঘটনার নামই সুপারকন্ডাক্টিভিটি। এতে অতি নিম্ন তাপমাত্রায় কোন বাঁধা ছাড়াই বিদ্যুৎ পরিবহনের ইঙ্গিত ছিল। যেসব পদার্থ এই ধর্ম প্রদর্শন করে সেগুলোকে বলা হয় সুপারকন্ডাক্টর। তাত্ত্বিকভাবে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার নিচে সকল ধাতুর এই ধর্ম দেখানোর কথা। কিন্তু বেশ ভালো পরিবাহক হিসেবে পরিচিত এমন কয়েকটি ধাতু—যেমন, সোনা, তামা, রুপা ইত্যাদি সুপারকন্ডাক্টিভিটি প্রদর্শন করে না। এটা বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো এক রহস্য। যাই হোক, আবিষ্কৃত হওয়ার প্রায় ৫০ বছর পর পর্যন্ত সুপারকন্ডাক্টিভিটির কোনো ব্যাখ্যা ছিল না বিজ্ঞানীদের কাছে। অবশেষে ১৯৫৭ সালে তিন মার্কিন পদার্থবিদ জন বার্ডিন, লিওন কুপার এবং রবার্ট স্রিফারের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই রহস্যের সমাধান হয়। তাদের তিন জনের নামের আদ্যক্ষর নিয়ে তত্ত্বটির নাম দেয়া হয় বিসিএস থিওরি।

একটু গোড়া শুরু করা যাক। ধরুন, আপনার কাছে একটি পরিবাহী তার আছে। ধরা যাক, সেটা একটা ধাতু। তাহলে এর পরমাণুর শেষ কক্ষপথে ইলেকট্রনের সংখ্যা হবে ১, ২ বা ৩টি। পরিবাহী তারের সামান্য দৈর্ঘ্যের মধ্যেই থাকেতে পারে মিলিয়ন মিলিয়ন পরমাণু। এদের শেষ কক্ষপথের ইলেকট্রনগুলো সাধারণত নিউক্লিয়াসের সাথে অপেক্ষাকৃত দুর্বল বন্ধনের মাধ্যমে আবদ্ধ থাকে। ফলে এরা কক্ষপথ থেকে বের হয়ে গোটা পরিবাহীতে বিচরণ করতে পারে। অর্থাৎ, এরা কোনো একটি নির্দিষ্ট পরমাণুর অধীনে না থেকে সমগ্র তারের অধীনে চলে যায়। এদের নাম মুক্ত ইলেকট্রন। পরমাণুগুলো এভাবে ইলেকট্রন হারিয়ে কিছুটা ধনাত্মক আধান বিশিষ্ট হয়ে থাকে।

পরিবাহী তারকে যদি কোন ব্যাটারির দুই প্রান্তের সাথে যুক্ত করা হয়, তাহলে বিভব পার্থক্য সৃষ্টির দরুন ইলেকট্রনগুলো ব্যাটারির ধনাত্মক প্রান্তের দিকে আকৃষ্ট হয় এবং সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া শুরু করে। ঋণাত্মক আধান বিশিষ্ট ইলেকট্রনগুলো পরস্পরকে বিকর্ষণ করে। তাই চলাচলের সময়ে এরা একে অন্যের থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে। তবে এই সময়ে এরা পরিবাহীর কিছুটা ধনাত্মক পরমাণুর ওপরে প্রভাব বিস্তার করে। ফলশ্রুতিতে ধাতব পরমাণুগুলোর কেলাস গঠনে পরিবর্তন আসে। আমরা জানি, কিছু কিছু ধাতব কঠিন পদার্থে পরমাণুগুলো সুসজ্জিতভাবে নির্দিষ্ট জায়গায় অবস্থান করে। এই ধরনের গঠনের নাম ক্রিস্টাল বা কেলাস। ইলেকট্রনের প্রভাবে কিছুটা ধনাত্মক পরমাণুগুলো নিজ জায়গা থেকে বিচ্যুত হয়ে ইলেকট্রনের দিকে কিছুটা সরে আসে। এতে পরমাণুগুলোর সম্মিলিত ধনাত্মক আধানের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।

এভাবে সামগ্রিকভাবে ধনাত্মক আধান বৃদ্ধির কারণে এদের দিকে আকৃষ্ট হওয়া ইলেকট্রনের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। তখন দুইটি বিপরীতমুখী অবস্থার সৃষ্টি হয়। একদিকে ইলেকট্রনগুলো নব্য গঠিত ধনাত্মক আধানের দিকে আকর্ষিত হয়। অন্যদিকে, ইলেকট্রনগুলো নিজেদের মধ্যকার ঋণাত্মক আধানের কারণে একে অন্যের কাছে থেকে দূরে সরে যেতে চায়। উপরের বর্ণিত ঘটনাগুলো ঘটার সময়ে পরিবাহকের তাপমাত্রা যদি খুব কম থাকে (শূন্য কেলভিনের কাছাকাছি), তাহলে একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। বিকর্ষণ বল উপেক্ষা করে দুটি ইলেকট্রন এক সাথে জোড়া লেগে যায়। এই ইলেকট্রন জোড়ের নাম কুপার পেয়ার। এরাই সুপারকন্ডাক্টিভিটির মূল চাবিকাঠি।

৪.

মহাবিশ্বে দুই ধরনের কণা আছে—ফার্মিয়ন এবং বোসন। ফার্মিয়ন কণাগুলোর স্পিন ভগ্নাংশ সংখ্যা ১/২-এর গুণিতক যেমন—১/২, ৩/২ ইত্যাদি এবং বোসন কণাগুলোর স্পিন পূর্ণসংখ্যা ০, ১ ইত্যাদি। প্রথমটি মেনে চলে ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান এবং অন্যটি মানে বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান। সবচেয়ে পরিচিত বোসনের নাম ফোটন এবং ফার্মিয়নদের মুখপাত্র ইলেকট্রন। সেই হিসাবে ইলেকট্রনের স্পিন হচ্ছে ১/২। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সাধারণ ইলেকট্রন ফার্মিয়ন হলেও, দুইটি ইলেকট্রনের জোড় বা কুপার পেয়ার হল বোসন। কারণ দুইটি ইলেকট্রনের স্পিনের অভিমুখ যদি একই দিকে হয়, তাহলে এদের স্পিন হবে ১ (১/২ + ১/২)। আর স্পিনের অভিমুখ বিপরীত দিকে হলে স্পিন হবে ০ (১/২ – ১/২)। অর্থাৎ, কুপার পেয়ার বোসনের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে।

বোসনগুলোর ক্ষেত্রে পলির বর্জন নীতি প্রযোজ্য নয়। এর অর্থ হলো, একই শক্তিস্তরে যত ইচ্ছা তত বোসন থাকতে পারে। কুপার পেয়ারও এর ব্যতিক্রম নয়। এর প্রভাবে পরিবাহীর মধ্যে দিয়ে এরা কোন রকমের বাঁধা ছাড়াই চলাচল করার সক্ষমতা অর্জন করে। আর আমরা পাই শূন্য রোধ বিশিষ্ট পরিবাহক তথা সুপারকন্ডাক্টর।

কেন সাধারণত স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাক্টিভিটি দেখা যায় না? শুধু অতি নিম্ন তাপমাত্রাতে (আধুনিক গবেষণাতে ব্যতিক্রম খুঁজে পাওয়া গিয়েছে) কেন এর দেখা মেলে? উত্তরটা খুব সহজ। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় কুপার পেয়ার গঠিত হতে পারে না। কারণ এদের ভেঙে ফেলতে খুব সামান্য শক্তি দরকার—মাত্র ১০-৩ ইলেকট্রন ভোল্ট। অন্যদিকে, স্বাভাবিক তাপমাত্রায় প্রাপ্ত শক্তির মান ০.০২৫ ইলেকট্রন ভোল্টের কাছাকাছি। তাই খুব কম তাপমাত্রা ছাড়া কুপার পেয়ারের অস্তিত্ব থাকে না। সর্বোচ্চ যে তাপমাত্রার নিচে আলাদাভাবে কুপার পেয়ারের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব, অর্থাৎ সুপারকন্ডাক্টিভিটি দেখা যায়, তার নাম ক্রিটিক্যাল টেম্পারেচার (Tc)। এর মান বস্তুভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।

৫.

হ্যারি পটারের কাহিনিতে Wingardium Leviosa শব্দটা বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। এই স্পেল ব্যবহার করে এই সিরিজের জাদুকররা যে কোনো বস্তুকে শূন্যে ভাসিয়ে রাখতে পারত। সেজন্য শুধু প্রয়োজন হয় জাদুদণ্ডের মোচড় এবং সঠিকভাবে স্পেলের উচ্চারণ। বিখ্যাত লেখিকা জে কে রাওলিংয়ের কল্পনাপ্রসূত সেই বিষয়টিকে কোন ধরনের জাদুর ছোঁয়া ছাড়াই সুপারকন্ডাক্টরের সাহায্যে সম্ভব করে দেখিয়েছে আধুনিক বিজ্ঞান।

ধরুন, একটি কাঁচের পাত্রে একটি ধাতব পদার্থ রাখা হয়েছে। এবার সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ তরল নাইট্রোজেনের দ্রবণ এমনভাবে রাখা হল, যেন ধাতব পদার্থটি এর মধ্যে সম্পূর্ণ ডুবে থাকে। দ্রবণের প্রভাবে ধাতুটির তাপমাত্রা নেমে যায় পরম শূন্য তাপমাত্রার কাছাকাছি। এবার যদি একটি চুম্বককে সেই পাত্রের ওপরে রাখা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে, সেটি কোনো অবলম্বন ছাড়াই শূন্যে ভেসে আছে। কী ব্যাখ্যা এই চমকপ্রদ ঘটনার?

যখন কোন সাধারণ পরিবাহককে একটি চৌম্বক ক্ষেত্রে স্থাপন করা হয়, তখন এর চৌম্বক বলরেখাগুলো পরিবাহককে ভেদ করে চলে যায়। কিন্তু সুপারকন্ডাক্টরে ঘটে সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘটনা। বলরেখাগুলো ভেদ না করে নিচের চিত্রের মত করে বেঁকে পাশে দিয়ে চলে যায়। এই ঘটনার নাম মেইসনার ইফেক্ট। পদার্থবিদ ওয়ালথার মেইসনার এবং রবার্ট অক্সেনফেল্ড প্রথম সুপারকন্ডাক্টরের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করেন।

তরল নাইট্রোজেনে ডুবে থাকা ধাতব পদার্থটি ঠাণ্ডা হয়ে সুপারকন্ডাক্টরে পরিণত হলে এর পৃষ্ঠে এক ধরণের সার্ফেস কারেন্ট উৎপন্ন হয়। সুপারকন্ডাক্টরে কোন ধরনের রোধ না থাকায় এই কারেন্ট অনন্তকাল ধরে প্রবাহিত হতে পারে। সার্ফেস কারেন্ট থেকে উৎপন্ন হয় চৌম্বক ক্ষেত্র। যার বলরেখাগুলো পাত্রের উপরে রাখা চুম্বকের সৃষ্টি করা বলরেখাগুলোকে বিকর্ষণ করে। তাই সেগুলো সুপারকন্ডাক্টরকে ভেদ করে চলে যেতে পারে না। ফলস্বরূপ চুম্বকটি শূন্যে ভেসে থাকে। অবশ্য যদি চুম্বক দ্বারা সৃষ্ট বাহ্যিক চৌম্বক ক্ষেত্রটি অনেক বেশি শক্তিশালী হয়, তাহলে সেটির বলরেখা জোরপূর্বক ভেদ করে চলে যাবে। সেই সময়ে ধাতব পদার্থটি আর সুপারকন্ডাক্টিভিটি প্রদর্শন করবে না। তবে এক শ্রেণির সুপারকন্ডাক্টরে বাহ্যিক বলরেখা আংশিক ভেদ করতে পারে। এদের বলা হয় টাইপ ২ সুপারকন্ডাক্টর।

৬.

সুপারকন্ডাক্টরগুলোকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। টাইপ-১ এবং টাইপ-২। প্রথম ধরনের সুপারকন্ডাক্টরগুলো সম্পূর্ণভাবে মেইসনার ইফেক্ট প্রদর্শন করে। অর্থাৎ, একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত বাহ্যিক চৌম্বক ক্ষেত্রের বলরেখাগুলোকে ঠেকিয়ে রাখে। মাত্রা অতিক্রম করলে বলরেখাগুলো এক সাথে ভেদ করে চলে যায় এবং এই সময়ে সুপারকন্ডাক্টিভিটির বিলুপ্তি ঘটে। সাধারণত খাঁটি ধাতব পদার্থ—যেমন, অ্যালুমিনিয়াম, লেড, মারকারি ইত্যাদি এই ধরনের হয়।

টাইপ-২ সুপারকন্ডাক্টরগুলো একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত টাইপ-১-এর মতোই বাহ্যিক চৌম্বক ক্ষেত্রের বলরেখাকে বাঁধা দেয়। তবে এই সীমা অতিক্রম করলে এদের সুপারকন্ডাক্টিভিটি একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায় না। এই সময়ে সামান্য পরিমাণ বলরেখা ধাতব পদার্থকে ভেদ করা সত্ত্বেও এরা সুপারকন্ডাক্টিভিটি প্রদর্শন করে। অর্থাৎ, এটি একটি মিশ্র অবস্থা। বাহ্যিক চৌম্বকক্ষেত্রের মান আরও বাড়ালে এক সময়ে সুপারকিন্ডাক্টিভিটি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। ১৯৩০ সালে সর্বপ্রথম পদার্থবিদ হ্যাস এবং ভোগড লেড ও বিসমাথের সংকর ব্যবহার করে এগুলো তৈরি করেন। তবে মজার ব্যপার হলো, তারা তখনও জানতেন না সেটি ভিন্ন ধরনের সুপারকন্ডাক্টর। কারণ তখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা মেইসনার ইফেক্ট সম্পর্কে জানতেন না। পরবর্তীতে ১৯৩৬ সালে এই ধরনের সুপারকন্ডাক্টরগুলোকে আলাদা শ্রেণিতে স্থান দেয়া হয়। এদের সংকট তাপমাত্রার মান টাইপ-১ সুপারকন্ডাক্টরগুলোর চেয়ে বেশি থাকে। সাধারণত ১০ কেলভিনের বেশি হয়। তাই ‌এগুলো তৈরি করা অপেক্ষাকৃত সহজ। এদের সুপারকন্ডাক্টিভিটি সহজে নষ্ট হয় না বলে এদেরকে হার্ড সুপারকন্ডাক্টর নামে ডাকা হয়। অন্যদিকে, টাইপ-১-এর সুপারকন্ডাক্টরগুলোকে বলা হয় সফট সুপারকন্ডাক্টর।

৭.

সুপারকন্ডাক্টরের মাধ্যমে উন্মোচিত হওয়া নতুন সম্ভাবনাগুলোর দিকে এবার নজর দেয়া যাক। আলোচনার শুরুতেই আমরা বলেছিলাম যে, দূর-দূরান্তে বিদ্যুৎ পাঠানোর সময় তারের মধ্যে উৎপন্ন হওয়া রোধের কারণে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদ্যুৎশক্তির অপচয় হয়। সুপারকন্ডাক্টর ব্যবহারের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। যদি পরিবাহক তারে কোন রোধ না থাকে, তাহলে সেটি উত্তপ্ত হবে না। এতে করে বিদ্যুৎ শক্তি অপচয় রোধ হওয়ার পাশাপাশি অধিক পরিমাণ শক্তি পরিবহন করা সম্ভব হবে। নিচের ছবিটি লক্ষ করুন।

নরম্যাল ক্যাবল বনাম সুপারকন্ডাক্টর ক্যাবল

ছবিতে দুই ধরনের তার দেখা যাচ্ছে। যাদের উভয়েই ১২,৫০০ অ্যাম্পিয়ার করে বিদ্যুৎ পরিবহণে সক্ষম। মোটা কালো তারগুলো চিরাচরিত পরিবাহক দিয়ে তৈরি। বিদ্যুৎ পরিবহনের সময়ে এদের পানির নিচে রেখে ঠাণ্ডা করার প্রয়োজন পড়ে। ছবির সাদা রঙের তারগুলো তৈরি সুপারকন্ডাক্টর দিয়ে। যার আকৃতিই নির্দেশ করছে এর সক্ষমতা। সার্নের পার্টিকেল এক্সিলারেটরে ব্যবহার করা হয় এই ধরনের তার।

যোগাযোগ ব্যবস্থাতেও বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম সুপারকন্ডাক্টর। বিগত দুই দশক ধরে জাপানে গবেষণাধীন রয়েছে বিশেষ এক ধরনের ট্রেন। এগুলো সুপারকন্ডাক্টিং ম্যাগনেট দিয়ে তৈরি। লেভিটেশন ইফেক্টের মাধ্যমে ট্রেনগুলো রেল লাইনের উপরে ভেসে চলাচল করতে পারে। এতে ঘর্ষণজনিত শক্তি অপচয় নেমে আসে শূন্যের কোঠায়। সাধারণ ট্রেনের চেয়ে এগুলো গতিবেগ অনেক বেশি হয়ে থাকে।

একটি কথা বলে রাখা ভালো। সুপারকন্ডাক্টর তৈরি করতে প্রয়োজনীয় অতি নিম্ন তাপমাত্রা অর্জনের পদ্ধতি এখনো বেশ জটিল এবং ব্যয়বহুল। বিজ্ঞানীরা পদ্ধতিগুলোর উন্নয়নের চেষ্টা করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। পাশাপাশি হন্যে হয়ে খুজছেন এমন সুপারকন্ডাক্টর, যাদের ক্রিটিক্যাল টেম্পারেচার (Tc) বেশি। অর্থাৎ, কম তাপমাত্রাতেই যারা সুপারকন্ডাক্টিভিটি প্রদর্শন করে। এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে বেশি ক্রিটিক্যাল টেম্পারেচার বিশিষ্ট সুপারকন্ডাক্টরের নাম মারকারি বেরিয়াম থ্যালিয়াম কপার অক্সাইড ( Hg0.2Tl0.8Ca2Cu3O)। যার Tc এর মান ১৩৯ কেলভিন। এই তাপমাত্রার নিচে সংকরটিকে নিয়ে গেলেই পাওয়া যায় সুপারকন্ডাকটিভিটি। তবে বিজ্ঞানীদের চূড়ান্ত লক্ষ হল স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাক্টিভিটি প্রদর্শনকারী পদার্থ খুঁজে বের করা। সময় বলে দিবে যে তারা তাদের লক্ষে পৌঁছাতে পারেন কিনা।

লেখক: সহকারী ব্যবস্থাপক, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড, রূপপুর, পাবনা

সুত্র:

১. বেসিক অফ সুপারকন্ডাক্টিভিটি, ড. আশুতোষ কুমার

২. এ কার্টুন গাইড টু দ্য ফ্যাসিনেটিং রেলম অফ ফিজিকস

৩. সুপারকিন্ডাক্টিভিটি, ইউসিএসসি ফিজিক্স ডেমোনেস্ট্রেশন রুম