নিউট্রনের ইতিকথা

বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অবদানের কারণে আজ আমরা পরমাণুর অভ্যন্তরে উঁকি দিতে পেরেছি। আজ আমরা জানি, পরমাণু ধনাত্মক চার্জবিশিষ্ট প্রোটন, ঋণাত্মক চার্জবিশিষ্ট ইলেকট্রন ও চার্জ–নিরপেক্ষ ইলেকট্রন দিয়ে তৈরি। ১৮৯১ সালে স্যার জে জে থমসন তাঁর ‘ক্যাথোড রে’ এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে ইলেকট্রন আবিষ্কার করেন। ১৯২০ সাল নাগাদ বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন যে পরমাণুর ধনাত্মক চার্জ পরমাণুর কেন্দ্রে নিউক্লিয়াসে রয়েছে। বিজ্ঞানীরা তখন ভেবেছিলেন, নিউক্লিয়াস শুধু প্রোটন দিয়েই তৈরি। কিন্তু নিউট্রন কণাটা তখনো মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই নিউট্রন আবিষ্কার করেন জেমস চ্যাডউইক ১৯৩২ সালে।

জেমস চ্যাডউইকের জন্ম ১৮৯১ সালে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে। ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারে তিনি রাদারফোর্ডের অধীনে বিভিন্ন ধরনের তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে কাজ করেন। ১৯১৪ সালে তিনি হ্যান্স গেইজারের সঙ্গে গবেষণার জন্য জার্মানি যান। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বদলে যায় তাঁর ভাগ্য। বন্দী হন, প্রায় চার বছর কাটে জেলে। জেলের ভেতেরও চলে বিজ্ঞানচর্চা। কয়েকজন সহবন্দীকে নিয়ে একটি বিজ্ঞান ক্লাব গঠন করেন এবং কারারক্ষীদের রাজি করিয়ে একটি ছোটখাটো গবেষণাগার তৈরি করেন এবং সেখানে তাঁর গবেষণা চালান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জেল থেকে ছাড়া পান। দেশে ফেরেন ১৯২১ সালে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর পিএইচডি সম্পন্ন করেন রাদারফোর্ডের অধীনে। রাদারফোর্ড তখন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরির পরিচালক। ১৯২৩ সালে ক্যাডউইক ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরির সহকারী পরিচালক নিযুক্ত হন।

১৯১১ সালে নিউক্লিয়াস এবং ১৯২০ সালে প্রোটন আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা পারমাণবিক সংখ্যা ও ভর সংখ্যা নিয়ে সমস্যায় পড়েন। তাঁরা দেখলেন, হিলিয়ামের পারমাণবিক সংখ্যা ২, কিন্তু ভর সংখ্যা ৪। তাঁরা ভাবলেন, নিশ্চয়ই নিউক্লিয়াসে অতিরিক্ত কিছু গা ঢাকা দিয়ে আছে। নিউক্লিয়াসে কিছু অতিরিক্ত প্রোটন আছে, সঙ্গে সমানসংখ্যক ইলেকট্রন। এর ফলে পরমাণু চার্জ–নিরপেক্ষ হয়। ১৯২০ সালে রাদারফোর্ড প্রস্তাব করেন যে একটি ইলেকট্রন ও প্রোটন মিলে একটি নতুন নিরপেক্ষ কণা তৈরি করে। কিন্তু এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ ছিল না।

১৯৩০ সালে জার্মান পদার্থবিদ ওয়াল্টার বোথে ও কয়েকজন বিজ্ঞানী মিলে একটি পরীক্ষা চালান। সে পরীক্ষায় তাঁরা আলফা কণা দিয়ে বেরিলিয়ামকে আঘাত করেন। ফলে উৎপন্ন হয় তেজস্ক্রিয় বিকিরণ। তাঁরা ধারণা করেন, এই তেজস্ক্রিয় বিকিরণ উচ্চশক্তির ফোটন দিয়ে তৈরি। অন্যদিকে চ্যাডউইক এই বিকিরণের ভিন্নধর্মী এক আচরণ লক্ষ করেন। তিনি বলেন, এই বিকিরণ রাদারফোর্ডের প্রস্তাবিত নিরপেক্ষ কণা দিয়ে তৈরি।

তখন আরেকটা পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন ফ্রেডরিক ও আইরিন কুরি। সেই পরীক্ষায় বেরিলিয়ামের অজ্ঞাত বিকিরণ দিয়ে প্যারাফিন মোমকে আঘাত করেন তাঁরা। তা পর্যবেক্ষণ করেন। দেখেন, বিকিরণের আঘাতের ফলে হাইড্রোজেনের পরমাণু থেকে প্রোটন উচ্চগতিতে বিচ্যুত হচ্ছে। কুরি দম্পত্তি ধারণা করেন, উচ্চ শক্তির গামা রশ্মির কারণে এমনটি হচ্ছে। কিন্তু চ্যাডউইক ভাবলেন আলাদা ভাবনা। তাঁর যুক্তি, কোনো ভরহীন ফোটনের পক্ষে প্রোটনের মতো ভারী কণাকে বিচ্যুত করা সম্ভব নয়। পরে তিনি নিজেই এ রকম একটা পরীক্ষা করেন। তিনি সিদ্ধান্তে আসেন, বেরিলিয়ামের বিকিরণ কিছু নিরপেক্ষ কণা দিয়ে তৈরি। সেই কণার ভর প্রোটনের ভরের চেয়ে সামান্য বেশি। তিনি দেখান, নিউট্রন চার্জ–নিরপেক্ষ হওয়ায় তা প্রোটনের চেয়ে নিউক্লিয়াসের বেশি কাছে যেতে পারে।

দুই সপ্তাহ চলে তাঁর পরীক্ষা। ১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি একটি পেপার প্রকাশ করে নিউট্রনের অস্তিত্বের ঘোষণা দেন। আরও কয়েক মাস পর তিনি আরেকটি প্রবন্ধ লিখে নিউট্রন কণা শনাক্তের ঘোষণা ও ব্যাখ্যা দেন। ১৯৩৪ সালে আরও ব্যাপক গবেষণার পর প্রমাণিত হয়, নিউট্রন প্রোটন আর ইলেকট্রনের সমন্বয়ে গঠিত কোনো কণা নয়; বরং তা একটি মৌলিক কণা। আরও পরে জানা যায় যে নিউট্রন মৌলিক নয়, বরং কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি। নিউট্রন আবিষ্কারের জন্য চ্যাডউইক ১৯৩৫ সালে নোবেল পুরস্কার পান।

লেখক: শিক্ষার্থী, মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়

সূত্র: এপিএস ফিজিকস

*লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার নভেম্বর ২০১৯ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়