আমরা কি আলো দেখতে পাই

আইনস্টাইনের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে, ‘কে কীভাবে একটি বিষয়কে ব্যাখ্যা করল, এর ভিত্তিতে একটি প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ হতে পারে, আবার ‘না-ও’ হতে পারে’। যৌক্তিকভাবে ধাঁধাগুলো দূর করার জন্য আমরা প্রত্যেকেই যার যার মতো করে ভাবব, বিশ্লেষণ করব ও সিদ্ধান্ত নেব। যৌক্তিক বিশ্লেষণের জন্য বিষয়গুলো ভেঙে ভেঙে আলাদা করে ফেলাটা একটি বড় উপায়। উদাহরণ হিসেবে আমার দৃষ্টিতে যেভাবে উল্লিখিত বিষয়টিকে ভেঙে দেখতে পারি তা এ রকম-

(ক) আমরা আলো দেখতে পাই কি না, (খ) আমরা একটি বস্তু কীভাবে দেখতে পাই, (গ) আমরা একটি বস্তুকে কীভাবে চিনতে পারি, (ঘ) কোনো বস্তু সামনে থাকলেও কখনো আমরা দেখতে পাই না, বা না দেখা বস্তুকেও অনেক সময় দেখতে পাই, তা কীভাবে হয়।

এবার প্রতিটির একটু বিশ্লেষণে যাওয়া যাক। প্রথম প্রশ্ন, আমরা আলো দেখতে পাই কি না। আলো একটি শক্তি, যাকে মূলত একটি বিদ্যুত্চুম্বকীয় তরঙ্গ হিসেবে আমরা পেয়ে থাকি। মনে করি, একটি আলোকরশ্মি আমার চোখে এসে ঢুকল। রশ্মিটি কোথা থেকে এল, তা জানা জরুরি নয়। সেটি একটি তারা, সূর্য, আগুন বা এলইডি থেকে হতে পারে, আবার কোনো বস্তু থেকে প্রতিফলিত হয়েও আসতে পারে। মূল কথা হচ্ছে আলোকরশ্মিটি আমার চোখে ঢুকল। আমার চোখের পেছনের রেটিনায় ‘রড’ এবং ‘কোন’ নামে আলোক সংবেদনশীল কতগুলো কোষ আছে। আলোকরশ্মি পড়লে এ কোষগুলো বৈদ্যুতিক সংকেত তৈরি করে, যা স্নায়ুর মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অংশে পৌঁছায়।

মস্তিষ্ক তখন এ আলোররশ্মিটি একটি বিন্দুর আকারে দেখার অনুভূতি তৈরি করে। আলোক তরঙ্গের দৈর্ঘ্যের ভিন্নতার কারণে বিভিন্ন রঙের অনুভূতিও সৃষ্টি করে। এটি কিন্তু আমাকে শিখতে হয়নি। জন্ম নেওয়ার পরপরই প্রতিটি মানুষই এ ধরনের অনুভূতি তৈরি করার ক্ষমতা রাখে। অন্য জন্তুর জন্য এ অনুভূতি কিছুটা ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু যেসব প্রাণীর চোখ আছে, তাদের সবারই এ ধরনের একটি অনুভূতি তৈরি হয়। আলো দেখার এ কয়টি ধাপের একটিও নষ্ট হয়ে গেলে আমরা আলো দেখতে পাই না, তখন আমরা হয়ে যাই অন্ধ। এখন প্রথম প্রশ্নটি সম্পর্কে পাঠক নিজেই উত্তর খুঁজে নিন, আমরা আলোকরশ্মি, অর্থাৎ আলোকশক্তি ‘দেখতে পাই’ কি না। কারণ, ‘দেখতে পাওয়া’ বিষয়টি আপনার নিজস্ব ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করবে। তবে সাধারণ দৃষ্টিতে যাকে ‘দেখা’ বলে, সে দৃষ্টিভঙ্গিতেও বিচার করাটা বোধ হয় উচিত হবে। তবে খুব জোরে হাঁচি দিলে কখনো আমরা চোখে আলোর ছটা বা ফসফিন দেখতে পাই। আলো ছাড়াই অন্য কোনো কারণে রেটিনা, অপটিক নার্ভ বা মাথার পেছনের মস্তিষ্কের যে অংশ দেখার অনুভূতি তৈরি করে তাদের কোনো একটি এ ক্ষেত্রে উত্তেজিত হয়েছে। কৃত্রিমভাবেও আমরা এদের উত্তেজিত করে আলো দেখার অনুভূতি তৈরি করতে পারি। এভাবে অন্ধদের দেখার অনুভূতি তৈরি করার গবেষণাও অনেক বিজ্ঞানীরা করছেন এবং কিছু সফলতা ইদানীং এসেছে।

এবার আসি দ্বিতীয় প্রশ্নে, আমরা একটি বস্তু কীভাবে দেখতে পাই? দুই ধরনের বস্তু আছে-একদল নিজেরাই আলোক তরঙ্গ তৈরি করে, অপর দল করে না। প্রথম দলের উত্সটি একটি বিন্দু হলে তাকে আমরা একটি বিন্দুর আকারে দেখব। আবার সেটি সূর্যের মতো গোলাকার হলে তাকে গোল দেখব। অর্থাৎ সেটি হবে অনেক বিন্দুর সমষ্টিগত একটি ছবি। আবার টিউবলাইটের মতো লম্বা হলে তাকে লম্বা দেখব। আর দ্বিতীয় দলের বস্তু দেখতে হলে প্রথম দলের কোনো উত্স থেকে আলো আসতে হবে এবং বস্তুটি থেকে কিছুটা হলেও সে আলো প্রতিফলিত হতে হবে। না হয় এ দ্বিতীয় দলের বস্তুটি আমরা দেখতে পাব না। এ জন্য চারদিকে আটকানো একটি ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে কোনো বস্তুই আমরা দেখব না। আবার একটি সম্পূর্ণ নিখাদ কালো ঘরে রাখা সব বস্তুও যদি নিখাদ কালো হয়, তবে সেখানে টর্চের আলো ফেলেও আমি কিছু দেখতে পাব না। অবশ্য এখানে ধরে নিচ্ছি যে আমার চোখে টর্চের আলো সরাসরি এসে পড়ছে না।

এবার আসি তৃতীয় প্রশ্নে, আমরা একটি বস্তুকে কীভাবে চিনতে পাই? বিষয়টি সম্পূর্ণ আমাদের শিশুকাল থেকে শিক্ষার ওপর নির্ভর করে। ফুটবল যে কখনোই দেখেনি, সে ফুটবল দেখে গোলাকার একটি বস্তু ঠিকই দেখবে কিন্তু এটি যে একটি খেলার জিনিস, তা সে জানবে না। আর যে শিখেছে, সে ঠিকই চিনবে। যদি শিখে থাকে এটি ফুটবল না বাস্কেটবল, তবে তা-ও আলাদা করে ফেলতে পারবে। তাই যখন বলা হয় যে রেড ইন্ডিয়ানরা জাহাজ দেখতে পায়নি, সেটি বোধ হয় ঠিক নয়। কিছু একটা নিশ্চয়ই দেখেছে, কিন্তু সেটি যে একটি জাহাজ, তা হয়তো তাদের অজানা ছিল।

চতুর্থ প্রশ্নে আসা যাক এবার। কোনো বস্তু সামনে থাকলেও কখনো আমরা দেখতে পাই না, বা না দেখা বস্তুকেও অনেক সময় দেখতে পাই, তা কীভাবে হয়? কিছুদিন আগে আমি রেফ্রিজারেটরে রাখা একটি জিনিস কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সাধারণত এটি ফ্রিজের একটি শেলফের একটু পেছন দিকে রাখা হতো। আমার স্ত্রীকে জানালে তিনি এসে শেলফের একেবারে সামনে রাখা ওই জিনিসটি ধরিয়ে দিলেন। আমার চোখে নিশ্চয়ই এর থেকে আলো এসে পড়েছে, আমার রেটিনা ও অপটিক নার্ভ হয়ে এর সংকেত মস্তিষ্কে ঠিকই পৌঁছেছে, কিন্তু আমার মস্তিষ্ক সেটি দেখতে পায়নি, কারণ মস্তিষ্ক শেলফের পেছন দিকে জিনিসটি খুঁজছিল, সামনে নয়।

‘পয়লা বৈশাখে বাংলাদেশের রাজধনীতে উত্সবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে’—বাক্যটি পড়ুন। কেউ কেউ ধরতে পারলেও কারও কারও কিন্তু চোখ এড়িয়ে যাবে যে বাক্যটির ‘রাজধানীতে’ শব্দে ‘ধ’ বর্ণের আকারটি নেই। কারণ, আমাদের মস্তিষ্ক শব্দটির সঙ্গে বহুল পরিচিত বলেই না দেখা ‘আকার’টিকে কল্পনা করে নিয়েছে। চতুর্থ প্রশ্নের এই বিষয় দুটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘আমরা আলো দেখতে পাই কি না’ প্রশ্নটি আনা কতটা যৌক্তিক, তা পাঠকের বিবেচনার ওপরই ছেড়ে দিলাম। এটি জ্ঞানের বহু শাখার সমন্বয়ে জটিল কগনিটিভ সায়েন্স-এর আওতাভুক্ত, ভৌত পদার্থবিজ্ঞানের আওতার বিষয় হয়তো নয়।

লেখক: অধ্যাপক, বায়োমেডিকেল ফিজিকস অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মে সংখ্যায় প্রকাশিত