পরমাণু বোমার জনক ওপেনহাইমার: নায়ক নাকি খলনায়ক

রবার্ট ওপেনহাইমার। পারমাণবিক বোমার জনক। এ জন্য তাঁর অনেক সমালোচনা আছে। তিনি নিজেও নিজের কাজ নিয়ে দোলাচলে ছিলেন বলে জানা যায়। তবে বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে তাঁর ভূমিকা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

আজ ২২ এপ্রিল ওপেনহাইমারের জন্মদিন। এই দিনে জেনে নিন আধুনিক প্রমিথিউস ওপেনহাইমারের জীবনের নানা দিক, পারমাণবিক বোমা নিয়ে তাঁর ভাবনা...

১৬ জুলাই, ১৯৪৫ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়োর্নাদা দেল মুয়ের্তো মরুভূমি। সেখানে একটি বাঙ্কারের মধ্যে কাউন্টডাউনের অপেক্ষা করছেন একজন বিজ্ঞানী। বাঙ্কার থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা হতে যাচ্ছে। সাংকেতিক নাম ট্রিনিটি।

কাউন্টডাউন শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে যেন শেষ হচ্ছে না। প্রতিটি সেকেন্ডকে মনে হচ্ছে অনন্তকাল। ভেতরে ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে বিজ্ঞানীর মনে। সফলভাবে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরিত হলে তাঁর তিন বছরের পরিশ্রম সার্থক হবে। ইতিহাসের পাতায় উঠে আসবেন। বিজ্ঞানীর নাম জুলিয়াস রবার্ট ওপেনহাইমার।

উচ্চতা ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি। দেখতে হালকা পাতলা। মনে হয় একটা রোগা কঙ্কালসার শরীর হেঁটে যাচ্ছে। এই প্রজেক্টে কাজ করতে গিয়ে শরীরের এ হাল। ওজন হয়েছে মাত্র ৫২ কেজি। এরকম একজন লম্বা মানুষের জন্য এই ওজন অনেক কম। ট্রিনিটি টেস্ট, মানে প্রথম পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ পরীক্ষার আগের রাতে তাঁর ঘুম হয়েছে মাত্র চার ঘণ্টা। দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারেননি। মাথায় একটাই চিন্তা—পারবেন তো সফল হতে!

বিস্ফোরণের আগ মূহূর্তে ওপেনহাইমারের পাশে উপস্থিত ছিলেন এক সামরিক কর্মকর্তা। তিনি জানান, সে সময় ওপেনহাইমার আরও উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। যেন নিঃশ্বাস ফেলতে পারছিলেন না।

‘এখন আমিই মৃত্যু, আমিই বিশ্ব ধ্বংসকারী।’
—রবার্ট ওপেনহাইমার

কাউন্টডাউন শেষ হতেই ঘটল বিস্ফোরণ। যেন সূর্যকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ২১ কিলোটন টিএনটি সমৃদ্ধ বোমাটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিস্ফোরণ। এর শকওয়েভ ১৬০ কিলোমিটার দূর থেকেও টের পাওয়া গিয়েছিল। কেঁপে উঠেছিল মরুভূমি। আকাশজুড়ে দেখা গিয়েছিল মাশরুম আকৃতির মেঘ। এ ঘটনা দেখে ওপেনহাইমার দারুণ স্বস্তি পেয়েছিলেন।

১৯৪৫ সালের ট্রিনিটি টেস্ট

কয়েক মিনিট পরে ওপেনহাইমারের বন্ধু ও সহকর্মী ইসিডোর রবি তাঁকে দূর থেকে দেখতে পান। তিনি বলেন, ‘আমি কখনো তাঁর সেই হাঁটার দৃশ্য ভুলব না। যেভাবে গাড়ি থেকে নেমেছিলেন, তাও ভোলা সম্ভব নয়। তিনি এমন দৃপ্ত পায়ে হেঁটে এসেছিলেন, দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, নিজের কাজটা ঠিকভাবে করতে পেরেছেন।’

১৯৬০-এর দশকে এক সাক্ষাৎকারে ওপেনহাইমার নিজের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। তাঁর দাবি, বিস্ফোরণের কয়েক মিনিট পরে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ভগবত গীতার একটি শ্লোক মনে পড়ে তাঁর। শ্লোকটি ছিল, ‘এখন আমিই মৃত্যু, আমিই বিশ্ব ধ্বংসকারী।’ 

এরপর তাঁর বন্ধুদের থেকে জানা যায়, ওপেনহাইমার ধীরে ধীরে হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর মধ্যে ভর করে বিষণ্ণতা। কারণ তিনি জানতেন, এরপর কী ঘটতে চলেছে।

২০০৫ সালে ইতিহাসবিদ কা বার্ড ও মার্টিন জে শেরউইন ওপেনহাইমারকে নিয়ে জীবনীগ্রন্থ লেখেন। নাম আমেরিকান প্রমিথিউস। সেই বইয়ে উল্লেখ করা হয়, ১৯৪৫ সালের ওই দিনটি ছিল ওপেনহাইমারের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোর একটি। সেই বইয়ের ওপর নির্ভর করেই ২০২৩ সালের ২১ জুলাই মুক্তি পায় ক্রিস্টোফার নোলান পরিচালিত ওপেনহাইমার মুভিটি।

আমেরিকান প্রমিথিউস বইয়ের প্রচ্ছদ

জাপানের আসন্ন পরিণতি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করতেও শোনা গেছে তাঁকে। কিন্তু কয়েকদিন পরে তাঁর চিন্তা-চেতনা ফের পাল্টে যায়। কীভাবে বোমা ফেলে সর্বোচ্চ ক্ষতি করা যায়, সে চেষ্টা তিনি করেছিলেন। ২০০৫ সালে কা বার্ড ও মার্টিন জে শেরউইনের লেখা আমেরিকান প্রথিমিউস বইয়ে উল্লেখ করা হয়, ওপেনহাইমার সামরিক কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, যাতে বৃষ্টির দিনে বোমা বিস্ফোরণ না করা হয়। আর খুব বেশি ওপর থেকেও বোমা ফেলতে নিষেধ করেছিলেন। কারণ তাতে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কমে যেত। ট্রিনিটি টেস্টের এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে জাপানের হিরোশিমায় সফলভাবে বোমা বিস্ফোরিত হয়। ওপেনহাইমার তখন পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজয়ী যোদ্ধাদের মতো দু-হাত ওপরে তুলেছিলেন। যেন একই মানুষের দুটি ভিন্ন রূপ।

ওপেনহাইমার ছিলেন অন্যদের থেকে আলাদা। দুর্বল, লাজুক, কিন্তু ভীষণ বুদ্ধিমান

ওপেনহাইমার ছিলেন ম্যানহাটন প্রকল্পের প্রধান পরিচালক। তিনি ছাড়া হয়তো অন্য কেউ এত দ্রুত পরমাণু বোমাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারত না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর জেরেমি বার্নস্টাইন নামে এক ব্যক্তি ওপেনহাইমারের সঙ্গে কাজ করেন। ২০০৪ সালে আ পোর্ট্রেট অব অ্যান এনিগমা বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘ওপেনহাইমারের পরিবর্তে লস আলামোসের পরিচালক অন্য কেউ হলে, ভালো বা খারাপ যেভাবেই হোক, যুদ্ধ শেষ হতো—তবে পারমাণবিক বোমার ব্যবহার হতো না।’

ওপেনহাইমারের চরিত্রে উচ্চাকাঙ্ক্ষা, মহানুভবতা, হতাশা—সবই ছিল। বার্ড ও শেরউইন ওপেনহাইমারকে ‘রহস্য’ বলে অভিহিত করেছেন। একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী হয়েও তাঁর মধ্যে ছিল বড় নেতার গুণাবলি। শৈশব থেকেই তিনি বন্ধুদের কাছেও ছিলেন রহস্যময় এক মানুষ।

১৯০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন ওপেনহাইমার। তাঁর বাবা-মা জার্মান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। ইহুদি ছিলেন তাঁরা। বাবার ছিল টেক্সটাইলের ব্যবসা। এ ব্যবসার মাধ্যমেই ধনী হয়েছিল ওপেনহাইমারের পরিবার। নিউইয়র্কের আপার ওয়েস্ট সাইডে তাঁদের একটি বড় অ্যাপার্টমেন্ট ছিল। সেখানে ছিল তিনজন কাজের মেয়ে, একজন ড্রাইভার। আর বাড়ির দেয়ালে শোভা পেত ইউরোপের শিল্পীদের আঁকা ছবি। 

এই বিলাসবহুল বাড়িতে থেকেও ওপেনহাইমার ছোটবেলা থেকেই ছিলেন লাজুক স্বভাবের। তাঁর শৈশবের এক বন্ধুর মতে, ‘ওপেনহাইমার ছিলেন অন্যদের থেকে আলাদা। দুর্বল, লাজুক, কিন্তু ভীষণ বুদ্ধিমান।’

খেলাধুলার নেশা ওপেনহাইমের কস্মিনকালেও ছিল না। শৈশবে যখন বন্ধুরা মাঠে খেলত, তিনি তখন সেন্ট্রাল পার্ক ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন খনিজ পদার্থ সংগ্রহ করতেন। সমবয়সী বন্ধুরা তাঁকে দুর্বল বলে খ্যাপাত। নয় বছর বয়সেই গ্রিক ও লাতিন ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠেন তিনি। একবার নিউইর্কের মিনারেলজিক্যাল ক্লাবে তাঁর পাওয়া খনিজ পদার্থ সম্পর্কে একটি চিঠি লিখেছিলেন। ওই বয়সেই এত দক্ষতার সঙ্গে চিঠি লিখেছিলেন যে ক্লাবটি তাঁকে প্রাপ্তবয়স্ক ভেবে ভুল করে। খনিজ পদার্থের বিষয়ে একটি আলোচনা সভার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণও জানানো হয়েছিল। 

বার্ড ও শেরউইনের মতে, ‘ওপেনহাইমার যা ভাবতেন বা করতেন, তা নিয়েই সব সময় ব্যস্ত থাকতেন। খেলাধুলায় তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। সাধারণ বাচ্চাদের মতো না হওয়ায় তাঁকে প্রায়ই বিদ্রুপের শিকার হতে হতো। বন্ধুরা উপহাস করতে ছাড়ত না। কিন্তু তাঁর বাবা-মা ছেলের প্রতিভা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন।’ 

ওপেনহাইমার একবার বলেছিলেন, ‘আমি আবার বাবা-মায়ের আস্থার প্রতিদান দিয়েছি। যারা আমাকে শৈশবে অপমান করেছে, তারা আমার সংস্পর্শে আসতে পারেনি। এটা তাদের দুর্ভাগ্য।’ 

আরেকবার তিনি এক বন্ধুর উপহাসের জবাবে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন, ‘একটা বইয়ের যেকোনো পৃষ্ঠা উল্টে বলতে পারবে, হ্যাঁ আমি এ বিষয়ে অবশ্যই জানি?’ 

ওপেনহাইমার হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় গিয়েছিলেন রসায়ন পড়তে। একই সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞানের কোর্সও ছিল। পদার্থবিজ্ঞান পড়তে গিয়ে তাঁর ভালো লেগে যায়। কারণ ল্যাবে বসে বসে টেস্ট করতে ভালো লাগত না। এ নিয়ে শিক্ষকের সঙ্গে মনোমালিন্য লেগেই থাকত। একদিন একটি আপেলের মধ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক ভরে রেখে দিয়েছিলেন ওই শিক্ষকের টেবিলে। সৌভাগ্যবশত শিক্ষক সে আপেল খাননি। কিন্তু তিনি ধরা পড়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়ার তোড়জোড় চলছিল। কিন্তু তা না করে তাঁকে মনোবিজ্ঞানীর স্মরনাপন্ন হতে বলা হয়। মনোবিজ্ঞানী তাঁকে দেখে জানান, ‘ওপেনহাইমার সাইকোসিস রোগে ভুগছেন। চিকিৎসা করেও এ রোগ ভালো হবে না।’

মনোবিজ্ঞানীরা তাঁকে যে সমস্যার সমাধান দিতে পারেননি, সেই সমস্যার সমাধান তিনি পেয়েছিলেন সাহিত্যে

সেই সময়ের কথা স্মরণ করে ওপেনহাইমার পরে লিখেছিলেন, তিনি বড় দিনের ছুটিতে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সৌভাগ্যবশত সে কাজটি আর করেননি। 

পরের বছর বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যান প্যারিসে। সেখানে তাঁর এক কাছের বন্ধু ফ্রান্সিস ফার্গুসন ওপেনহাইমারের বান্ধবীকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। রেগে যান ওপেনহাইমার। পেছন থেকে ফ্রান্সিসকে শ্বাস রোধ করে মারার চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু এবারও সৌভাগ্য তাঁর সঙ্গে ছিল।

ফ্রান্সিস এ ব্যাপারে বলেছেন, ‘আমি ঘাড়ে আঘাত পেয়েছিলাম। তবে সময় মতো দূরে সরে যেতে সক্ষম হই। ওপেনহাইমার কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল।’

মনোবিজ্ঞানীরা তাঁকে যে সমস্যার সমাধান দিতে পারেননি, সেই সমস্যার সমাধান তিনি পেয়েছিলেন সাহিত্যে। মার্সেল প্রুস্তের আ লা রেচারচে ডু টেম্পস পারডু পড়ে তাঁর অভ্যাস পরিবর্তন হয়। সাহিত্য ও দর্শন পাঠ করতে করতে সেরে যায় তাঁর সাইকোসিস রোগ। ফলে প্যারিস থেকে তিনি ফেরেন সহনশীল হয়ে। 

১৯২৬ সালে ওপেনহাইমার গটিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা ইনস্টিটিউটের পরিচালকের সঙ্গে দেখা করেন। পরিচালক বুঝতে পারেন তাঁর প্রতিভা। তাঁকে সেখানে পড়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান পরিচালক। এখান থেকেই তিনি পিএইচডি ও পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপ অর্জন করেন। সেখানে তাঁর অনেক বন্ধু হয়েছিল। তাঁরাই পরে যোগ দিয়েছিল লস অ্যালামোসের ট্রিনিটি প্রকল্পে। 

যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে ওপেনহাইমার কিছুদিন কাজ করেন হাভার্ডে। কয়েকমাস কাজ করার পর চলে যান বার্কলির ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুরু করেন নিজের গবেষণা। এ সময় মহাজাগতিক রশ্মি ও পরমাণুর বিভাজন নিয়ে কাজ করেন তিনি। ১৯৩০-এর দশকের শুরুর দিকে ভগবত গীতা পড়ার জন্য সংস্কৃতি ভাষা শেখেন। কুরু-পাণ্ডবদের যুদ্ধের কাহিনী তাঁকে পারমাণবিক বোমা তৈরিতে উৎসাহিত করেছিল। ১৯৩২ সালে ওপেনহাইমার তাঁর ভাইকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন, ‘যুদ্ধের সময় গীতায় বর্ণিত দর্শন কাজে লাগানো যেতে পারে।’ 

১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ওপেনহাইমার দেখা করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জিন ট্যাটলকের সঙ্গে। তাঁর প্রেমে পড়ে যান ওপেনহাইমার। অবশ্য এই চিকিৎসকের চিন্তাভাবনাও ছিল ওপেনহাইমারের মতো রহস্যময়। ওপেনহাইমার তাঁকে একাধিকবার বিয়ের প্রস্তাব দিলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এ সময় ওপেনহাইমার ও ট্যাটলকের মধ্যে রাজনীতি, বিশেষ করে কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্র নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হতো। কারণ ট্যাটলক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। এ জন্য পরে ওপেনহাইমারকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। 

স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে ওপেনহাইমার
ছবি: আলফ্রেড আইজেনস্টায়েড

১৯৪০ সালে জীববিজ্ঞানী ক্যাথরিন কিটি হ্যারিসনকে বিয়ে করেন ওপেনহাইমার। তখনও ট্যাটলকের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্টতা ছিল। কিটি ওপেনহাইমারের সঙ্গে ম্যানহাটন প্রজেক্টে কাজ করেছিলেন। ফ্লেবোটোমিস্ট হিসেবে যুক্ত ছিলেন তিনি। তাঁর কাজ ছিল বিকিরণের ভয়াবহতা নিয়ে গবেষণা করা। 

১৯৩৯ সালে পদার্থবিদরা রাজনীতির চেয়ে যুদ্ধ নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন। এ বিষয়ে আলবার্ট আইনস্টাইন মার্কিন সরকারকে একটি চিঠি লেখেন। ১৯৪২ সালের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে যায়, পারমাণবিক বোমা বানানো সম্ভব। কিন্তু কে বানাবে? নিশ্চয়ই দেশের সেরা বিজ্ঞানীরা। তখন সেরা বিজ্ঞানীদের তালিকা করতে গেলে যে তাঁর নাম আসবে, ওপেনহাইমারও তা বুঝতে পেরেছিলেন। সেভাবে প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন নিজে। এ জন্যই কমিউনিস্টদের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেন তিনি। কারণ যুক্তরাষ্ট্র সরকার এ ব্যাপারে জানতে পারলে তাঁকে আর এ প্রকল্পে নেওয়া হতো না।

‘বিজ্ঞানী হিসেবে পারমাণবিক বোমা বানানো শুধু আমাদের কাজ। সেটা কীভাবে ব্যবহৃত হবে, তা দেখা আমাদের কাজ নয়।’
—রবার্ট ওপেনহাইমার

ওপেনহাইমার এ ব্যাপারে তাঁর এক বন্ধুকে বলেছিলেন, ‘আমি যদি কমিউনিস্ট কোনো বন্ধুর সঙ্গে শুধু যোগাযোগও রাখি, তবু সরকারের পক্ষে আমাকে ব্যবহার করা কঠিন হয়ে পড়বে। আমি চাই না জাতির কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা বিঘ্নিত হোক।’ 

মূলত এ কারণেই তাঁর প্রথম বান্ধবী ট্যাটলকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। গোপনে দেখা করার কারণে বিপদে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। পারমাণবিক বোমা প্রকল্পের জন্য ওপেনহাইমারের নাম প্রস্তাব করা হলে অনেকেই বিরোধিতা করেন। তবে তাঁর প্রতিভা সম্পর্কে কারো দ্বিমত ছিল না। তাই ম্যানহাটন প্রকল্পের সামরিক বাহিনির প্রধান জেনারেল লেসলি গ্রোভস তাঁকে প্রকল্পের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। 

লেসলি গ্রোভস ও ওপেনহাইমার

যুদ্ধের পরে ওপেনহাইমারের চিন্তায় পরিবর্তন আসে। তিনি পারমাণবিক অস্ত্রকে ‘শয়তানের কাজ’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। ১৯৪৫ সালের অক্টোবরে ওপেনহাইমারকে ডেকেছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান। ওপেনহাইমার রাষ্ট্রপতিকে বলেছিলেন, ‘আমি টের পাই, আমার হাতে রক্ত লেগে আছে।’ জবাবে ট্রুম্যান বলেছিলেন, ‘রক্ত লেগেছে আমার হাতে। ও নিয়ে আমাকেই ভাবতে দাও।’

গীতা পড়ে দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন ওপেনহাইমার। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুন হাতে অস্ত্র তুলে নিতে অস্বীকার করেছিলেন। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন, এতে তাঁর প্রিয়জনেরা মারা পড়বেন। কিন্তু কৃষ্ণ তাঁকে বোঝায়, যারা এ যুদ্ধে মারা যাবেন, তাঁদের মৃত্যু আগেই তিনি লিখে রেখেছেন। অর্জুন হবেন শুধু তাঁদের মৃত্যুর হাতিয়ার।

পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের আগে একই সুরে কথা বলেছিলেন ওপেনহাইমারও। তাঁর সহকর্মীদের বলেছিলেন, ‘বিজ্ঞানী হিসেবে পারমাণবিক বোমা বানানো শুধু আমাদের কাজ। সেটা কীভাবে ব্যবহৃত হবে, তা দেখা আমাদের কাজ নয়।’ 

কিন্তু যুদ্ধের পরে তাঁর এ মত পাল্টে যায়। পারমাণবিক বোমা সফলভাবে বিস্ফোরণের পরে তাঁকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল আরও শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমা তৈরির জন্য। কিন্তু ওপেনহাইমার সরাসরি এর বিরোধিতা করেন। হঠাৎ এ ধরনের বিরোধিতা ভালো চোখে দেখেনি মার্কিন সরকার। ১৯৫৪ সালে তাঁর বিরুদ্ধে মার্কিন সরকার তদন্ত শুরু করে। বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দেওয়া হয় তাঁকে। কেড়ে নেওয়া হয় তাঁর সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স। এ সময় অনেক একাডেমিক সদস্য তাঁর পক্ষ নিয়েছিলেন। সাহায্য করেছিলেন ওপেনহাইমারকে। কিন্তু মার্কিন সরকার তারপরও তদন্ত করে। অবশ্য তদন্তে তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। 

আইনস্টাইন ও ওপেনহাইমার
বিজ্ঞানের কাজ নতুন জিনিস শেখা, একই ভুল দুবার করা নয়

অনেক পরে মার্কিন সরকার নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। ১৯৬৩ সালে তাঁকে তাই এনরিকো ফার্মি পুরস্কার দেওয়া হয়। আর সিকিরিউটি ক্লিয়ারেন্সও ফেরত দেওয়া হয় তাঁর মৃত্যুর ৫৫ বছর পর, ২০২২ সালে। 

ওপেনহাইমারের বাকি জীবন কেটেছে দোলাচলের মধ্যে। একদিকে তিনি নিজের কাজ নিয়ে যেমন গর্বিত ছিলেন, তেমনি এর পরিণতি নিয়েও ভুগেছেন অপরাধবোধে। তাঁর জীবনের শেষ ২০ বছর কাটে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির প্রিন্সটন ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্স স্টাডির পরিচালক হিসেবে। এ সময় তিনি আইনস্টাইন ও অন্যান্য পদার্থবিদদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি স্বীকার করেছিলেন, বিজ্ঞানের নিজস্ব প্রভাবগুলো আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য মানবিকতার প্রয়োজন। 

বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই প্রচণ্ড ধূমপান করতেন ওপেনহাইমার। এর প্রভাবে তিনি যক্ষা রোগে আক্রান্ত হন। ১৯৬৭ সালে গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ৬৩ বছর বয়সে। মৃত্যুর দুই বছর আগে ওপেনহাইমার বলেছিলেন, ‘বিজ্ঞানের কাজ নতুন জিনিস শেখা, একই ভুল দুবার করা নয়।’

ওপেনহাইমারের অনেক সমালোচনা আছে। পারমাণবিক বোমার জনক হিসেবে ইতিহাসে তাঁর নাম লেখা আছে বটে, তবে এর মন্দ দিকের পাশাপাশি, বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে তাঁকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না।

সূত্র: বিবিসি ডট কম