অধরা এনট্রপি

এনট্রপি মহাবিশ্বের সবচেয়ে অদ্ভুত রাশি। সময়ের সঙ্গে এনট্রপি শুধু সামনেই এগিয়ে চলে। তাই প্রতিনিয়ত বাড়ছে মহাবিশ্বের তাপীয় বিশৃঙ্খলা। এর ব্যাখ্যা কী?

এনট্রপি কী? প্রকৃতিকে বুঝতে পদার্থবিজ্ঞান এ পর্যন্ত যতগুলো ধারণা আমাদের উপহার দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে এনট্রপির ধারণা সবচেয়ে ফান্ডামেন্টাল এবং একই সঙ্গে এটি সবচেয়ে ইলুসিভ (elusive) বা অধরা। এটি মরীচিকার মতো—যতই পড়ি ততই শিখি, আবার যতই শিখি ততই বিভ্রান্ত হই। এনট্রপি এত অধরা বলেই নানা নামে নানাভাবে বিজ্ঞানীরা এটিকে ধরার চেষ্টা করেছেন। যেমন বোলজমান এনট্রপি, শ্যানন এনট্রপি, রেনি এনট্রপি, গিবস এনট্রপি, স্যালিস এনট্রপি ইত্যাদি।

অথচ পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে ফান্ডামেন্টাল ল, যাকে থার্মোডিনামিকসের দ্বিতীয় সূত্র বলে, সেটি বুঝতে হলে এই এনট্রপিকে বুঝতে হবে। এটি এমন একটি ধারণা, যা মাপার কোনো যন্ত্র নেই। থার্মোডিনামিকসের প্রথম সূত্র থেকে আমরা ইন্টারনাল এনার্জির ধারণা পাই, যা এনট্রপি, সিস্টেমের ভলিউম ও নম্বরের ওপর নির্ভর করে। যেহেতু এনট্রপিকে যন্ত্র দিয়ে মাপা যায় না, তাই ইন্টারনাল এনার্জিকে আমরা লেজেন্ডার ট্রান্সফর্ম করে এনট্রপির পরিবর্তে তাপমাত্রার ফাংশনে পরিবর্তন করি। এটা মাপার জন্য থার্মোমিটার আছে এবং নতুন কোয়ান্টিটিকে আমরা ফ্রি এনার্জি বলি। কিন্তু যত যা–ই করি না কেন, এনট্রপিকে অবজ্ঞা করে পার পাওয়া যাবে না। পদার্থবিজ্ঞান পড়লে এনট্রপিকে বুঝতেই হবে। তাই আজ এনট্রপিকে সহজভাবে বোঝার চেষ্টা করব।

কোনো কিছু বুঝতে সহজ উদাহরণই শ্রেষ্ঠ উপায়। তাই প্রথম এনট্রপি বৃদ্ধির কয়েকটি উদাহরণের কথা ভাবি। একটি পানিভর্তি বিকারের কোনায় এক চিমটি রং ছেড়ে দিলে কী দেখা যাবে? রং চারদিকে ছড়িয়ে যায়, তাই তো? কখনো কি ছড়ানো রংকে আবার আগের অবস্থায় আনা যাবে? অর্থাৎ যেখানে ছাড়া হয়েছিল, সেখানে এক চিমটি রঙে ফিরে যেতে কি কখনো দেখা যাবে? একটি গ্লাস যদি একটু কোমর উঁচু জায়গা থেকে ফেলে দিই, গ্লাসটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। কখনো কি টুকরো গ্লাসকে স্বতঃস্ফূর্ত একটি গ্লাসে পরিণত হতে দেখি? একটি পাত্রে এক টুকরো বরফ রাখলে দেখা যায়, এটি ধীরে ধীরে গলে যায়। কখনো কি সেই পাত্রভর্তি পানি স্বতঃস্ফূর্ত বরফে পরিণত হতে দেখি? এসব রিভার্স সিচুয়েশন স্বতঃস্ফূর্তভাবে না ঘটতে দেখার কারণ হলো, এনট্রপি ইউনি-ডিরেকশনাল, যা আপনাআপনি কেবল বৃদ্ধিই পেতে পারে, কমে না। কেন এমন হয়? সিস্টেম যে পার্টিকেল দ্বারা তৈরি সেগুলোর কি প্রাণ আছে, এগুলো বুঝেশুনে সব সময় এক দিকেই যাবে?

এবার ‘রং কেন ছড়ায়’ এ প্রশ্নের উত্তরের দিকে নজর দিতে পারি। তাহলে অন্য প্রশ্নগুলোরও উত্তর বেরিয়ে আসবে। এক চিমটি রং থেকে ছড়ানো ব্যবস্থাকে যদি আমরা জুম করি, যেন রং যে পার্টিকেল দিয়ে তৈরি সেগুলোর ইনডিভিজ্যুয়াল মোশন দেখা যায়। সেই ইনডিভিজ্যুয়াল পার্টিকেলের মোশনকে ভিডিও করা যেতে পারে। তারপর সেই ভিডিও যদি ফরোয়ার্ড এবং রিভার্স করে দেখা যেতে পারে, তাহলে দেখা যাবে, এই দুই মোশনের কোনোটিই ফিজিকসের কোনো সূত্রকেই লঙ্ঘন করছে না। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে ফরোয়ার্ড এবং রিভার্স দুটির কোনোটিই পদার্থবিজ্ঞানের কোনো আইন বা সূত্রকে লঙ্ঘন করে না। অথচ ম্যাক্রোস্কপিক্যালি দেখলে ঘটনা কেবল একদিকেই ঘটে। মাইক্রোস্কপিক ওয়ার্ল্ডে দুই দিকেই যাওয়া সম্ভব হলেও ম্যাক্রোস্কপিক এক ডিরেকশনাল। কেন? কেন রিভার্স ঘটনা কখনো দেখি না, যদিও মাইক্রোস্কপিক্যালি উভয় ঘটনাই সম্ভব।

অ্যাটম কিংবা পার্টিকেলের তো প্রাণ নেই যে জেনেবুঝে এগুলো একটি পথ বেছে নেবে। একটি উদাহরণের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে। একটি খেলার মাঠকে ৩০টি ছোট ভাগে মার্ক করা যাক। তারপর ৩টি ভেড়া ছেড়ে দেওয়া হোক। ৩টি ভেড়াকে মার্ক করা ৩ অংশে কতভাবে পাওয়া যেতে পারে? উত্তরটি বোস-আইনস্টাইনের স্ট্যাটিসটিকসের মাধ্যমেও পাওয়া যেতে পারে। কারণ, যেকোনো স্টেটে (মাঠের যেকোনো অংশে) যেকোনো সংখ্যক ভেড়া থাকতে পারে। একটু অঙ্ক করলেই বোঝা যাবে, ভিন্ন রকমের সর্বোচ্চ দশভাবে এগুলো পাওয়া যেতে পারে। ভেড়া যদি তিনটির জায়গায় চারটি হতো, পনেরোভাবে এগুলো পাওয়া যেত। এ রকম যদি দুটি মাঠকে পাশাপাশি আনা হয় এবং মোট ছয়টি ভেড়াকে দুটি মাঠের কোনো একটির এক কোণ থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়, তখন কী ঘটবে? ভেড়াগুলো দুই মাঠেই র৵ানডমলি দৌড়াদৌড়ি করতে পারে। এ অবস্থায় যদি ছবি তোলা হয়, তাহলে কী দেখা যাবে? দেখা যাবে, অধিকাংশ ছবিতেই ভেড়াগুলো দুই মাঠে সমানসংখ্যকভাবে ছড়িয়ে আছে। খুব কম ছবিতেই তাদের একটি মাঠের এক কোনায়, যেখান থেকে সেগুলো ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, সেখানে পাওয়া যাবে। ভেড়ার সংখ্যা এবং মাঠ বিভক্তির সংখ্যা যদি বাড়ানো হয়, তাহলে আরও বেশি ছবিতে সেগুলোকে ছড়ানোভাবে পাওয়া যাবে। ভেড়ার সংখ্যা এবং মাঠ বিভক্তির সংখ্যা যদি আভোগেড্রো সংখ্যার কাছাকাছি হয়, তাহলে প্রায় শতভাগ ছবিতেই তাদের ছড়ানো অবস্থায় পাওয়া যাবে। কিন্তু কেন?

এবার একটু দেখি কতভাবে তিনটি ভেড়াকে দুটি মাঠে তিনটি করে মোট কতভাবে সাজানো সম্ভব। এর উত্তর হবে ১০০। চারটি ভেড়া একটি মাঠে এবং দুটি অন্য মাঠে কতভাবে সাজানো সম্ভব? উত্তর হলো ৯০। পাঁচটি ভেড়া একটি মাঠে এবং একটি অন্য মাঠে কত ভাবে সাজানো সম্ভব? উত্তর হলো ৬৩। আর ছয়টি ভেড়াকেই একটি মাঠে কত ভাবে সাজানো সম্ভব? উত্তর হলো ২৮ । এখন ভেড়া ৬টির জায়গায় যদি ৮টি আর মাঠকে ৪ ভাগে ভাগ করা হয়, তখন ৪টি এক মাঠে এবং ৪টি অন্য মাঠে মোট ১ হাজার ২২৫ ভাবে সাজানো যেত। আর যদি ভেড়া হতো ১০টি আর প্রতিটি মাঠকে ৮ ভাগে ভাগ করা হতো, তাহলে ৫টি এক মাঠে এবং ৫টি অন্য মাঠে মোট ৬ লাখ ২৭ হাজার ২৬৪ ভাবে সাজানো যেত। আর ১০টি ভেড়াকেই একটি মাঠে সাজানো যেত মাত্র ১৯ হাজার ভাবে। তাই ভেড়া এবং মাঠের সংখ্যা যতই বাড়বে, সবগুলোকে একই জায়গায় পাওয়ার সম্ভাবনা দ্রুত হারে কমতে থাকবে।

তাহলে কী দাঁড়াল? কণার কোনো জীবন নেই যে সেগুলো একটি দিকেই ধাবিত হবে। পানিতে রং কিন্তু ছড়ায় diffusion প্রসেসের মাধ্যমে। আবার ডিফিউশন প্রসেস মানে হলো রঙের কণাগুলো র‍্যানডম ওয়াকে চলে। র‍্যানডম ওয়াক মানে হলো, সব দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা সমান। কিন্তু ম্যাক্রোস্কপিক্যালি রং কেবল ছড়িয়ে যায়। মজার না? রং ছড়িয়ে যায়, কারণ, ছড়ানোভাবে সেগুলোকে এত বেশি ভাবে সাজানো যাবে, এই সংখ্যা অন্যগুলোর তুলনায় প্রায় ডেলটা ফাংশন। এ জন্যই আমরা যখন বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিকস করি, তখন পার্টিকেল আর স্টেটগুলোর মধ্যে কতভাবে সাজানো যায়, বের করে সেটিকে ম্যাক্সিমাইজ করি। কারণ, ম্যাক্সিমাম ডিস্ট্রিবিউশনই হলো মোস্ট প্রবাবল ডিস্ট্রিবিউশন।

লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়