মহাকর্ষ সূত্রের আবিষ্কার ও এর গুরুত্ব

নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কারের কাহিনি আমরা জানি। তবে এ আবিষ্কারের মাহাত্ম্য আসলে কোথায়? সে কথা ও মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কারের ইতিহাস রিচার্ড ফাইনম্যান সংক্ষেপে তুলে ধরেছেন তাঁর ‘ক্যারেক্টার অব ফিজিক্যাল ল’—লেকচারে। খানিকটা সংক্ষিপ্ত ও পরিমার্জিত রূপে তা তুলে ধরা হলো বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য।

মহাকর্ষ সূত্রকে বলা হয় ‘মানব মস্তিষ্ক খাটিয়ে অর্জিত অসাধারণতম সার্বিকতা’। অর্থাৎ সব কিছুকে এক সুতোয় গাঁথার দারুণ এক প্রয়াস। তবে আমি প্রকৃতির বিষ্ময়কর কাজকর্মে যতটা আগ্রহী, মানব মস্তিষ্ক নিয়ে তত আগ্রহী না। প্রকৃতির একটা বড় বিষ্ময় হলো, সে মহাকর্ষ সূত্রের মতো সহজ কিন্তু চমৎকার কিছু সূত্র মেনে চলে। প্রকৃতি কী নিদারুণ চাতুর্যের সঙ্গে এসব সূত্র মেনে চলে, এখানে আমি তা নিয়ে আলোচনা করব।

মহাকর্ষ সূত্র বলে, মহাবিশ্বের সবকিছু একে অন্যকে একটা বল দিয়ে আকর্ষণ করে। যেকোনো দুটি বস্তুর জন্য এই বলের মান তাদের ভরের গুণফলের সমানুপাতিক এবং তাদের মধ্যকার দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। কথাটাকে গাণিতিকভাবে নিচের সমীকরণটি দিয়ে প্রকাশ করা যায়—

F = G.mm'/r2

এখানে একটি ধ্রুবক আছে। বস্তু দুটোর ভরের মোট গুণফলের সঙ্গে গুণ হয়ে গেছে এটা। তারপর ভাগ করা হয়েছে দূরত্বের বর্গ দিয়ে। এর সঙ্গে আরেকটা বিষয় যোগ করতে হবে। কোনো বস্তু বলের প্রতি সাড়া দিলে, বলের দিকে এর ত্বরণ ঘটে বা প্রতি সেকেন্ডে এর বেগের পরিবর্তন হয়। এটা হয় বস্তুর ভরের ব্যস্তানুপাতিক হারে। এটুকু বলার অর্থ, প্রয়োজনীয় সবকিছু আমি বলে দিয়েছি। বাকি সব হলো এর গাণিতিক ফলাফল। আমি জানি, এখানে আপনারা সবাই গণিতবিদ নন। সেজন্য আপনারা এই দুটি কথার সব ধরনের গাণিতিক ফলাফল বুঝতে পারবেন না। আমি তাই এখানে মহাকর্ষ আবিষ্কারের ইতিহাসটুকু সংক্ষেপে বলব। বলব এর ফলাফল এবং ইতিহাসের ওপর এর প্রভাব নিয়ে।

এই গল্পের শুরু সেই প্রাচীন কালে। প্রাচীন মানুষেরা নক্ষত্রদের মাঝে গ্রহদের গতি পর্যবেক্ষণ করে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন, গ্রহরা সূর্যকে ঘিরে ঘোরে। কিন্তু এক সময় এ কথা মানুষ ভুলে যায়। এই ব্যাপারটি-ই অনেক পরে কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) আবার পুনঃআবিষ্কার করেন।

নিকোলাস কোপার্নিকাস
উইকিপিডিয়া

পরবর্তী যে প্রশ্নটা দেখা দেয়, তা হলো, ঠিক কীভাবে এবং কী গতিতে এরা সূর্যের চারপাশে ঘুরপাক খায়? এরা কি সূর্যকে বৃত্তের একেবারে কেন্দ্রে রেখে ঘোরে, নাকি অন্য কোনো ধরনের বক্রপথে ঘরে? কত দ্রুত ঘোরে এরা? এরকম নানা প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেতে অনেকটা সময় লেগেছে। কোপার্নিকাস-পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে বেশ ভালোরকম বিতর্ক বেঁধে গেল। প্রশ্ন উঠল, গ্রহগুলো আসলেই সূর্যের চারপাশে ঘোরে, নাকি এরা পৃথিবীকে কেন্দ্রে রেখে ঘোরে? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করার উপায় খুঁজে বের করেন টাইকো ব্রাহে (ড্যানিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী, ১৫৪৬-১৬০১)। তিনি বললেন, গ্রহদের গতির প্রকৃতি নিয়ে এই বিতর্ক সমাধানের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, সাবধানে, যত্ন নিয়ে আকাশে চোখ রাখা এবং বিভিন্ন সময়ে আকাশে এদের সঠিক অবস্থান রেকর্ড করে নেওয়া। যদি এই হিসেব থেকে গ্রহগুলো কীভাবে ছুটছে, সেটা দেখা যায়—তাহলেই কেবল বিকল্প হাইপোথিসিসগুলো থেকে সঠিক তত্ত্বটিকে আলাদা করা যাবে। এভাবেই কেবল সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিটি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এই যে সাবধানে কোনোকিছু পর্যবেক্ষণ করা, বিস্তারিত রেকর্ড রাখা এবং আশা করা যে এসব তথ্য থেকে কোনো না কোনো সূত্র পাওয়া যাবে। সেই সূত্র ব্যবহার করে পৌঁছানো যাবে তাত্ত্বিক কোনো ব্যাখ্যায়—এভাবেই মানুষ সত্যিকার অর্থে প্রকৃতিকে বুঝতে শুরু করেছিল। এটিই আধুনিক বিজ্ঞানের মূল কথা।

টাইকো ব্রাহে
উইকিপিডিয়া

টাইকো ব্রাহে মানুষটি ছিলেন বেশ ধনী। কোপেনহেগেনের কাছাকাছি তাঁর একটি দ্বীপ ছিল। এর নাম ভেনের দ্বীপ। তিনি সেই দ্বীপটিকে বেশ কিছু রূপালি বৃত্ত দিয়ে তৈরি গ্লোব ও পর্যবেক্ষণের নানা যন্ত্রপাতি দিয়ে সাজালেন। পাশাপাশি পর্যবেক্ষণের জন্য মানমন্দির বানালেন। সেই মানমন্দিরে থেকে টাইকো ব্রাহে রাতের পর রাত গ্রহদের অবস্থান নিয়ে গবেষণা করেন। এরকম কঠিন পরিশ্রম করেই কেবল আমরা কোনো কিছু খুঁজে বের করতে পারি।

তাঁর সংগৃহীত সব তথ্য পরে জোহান কেপলারের (১৫৭১-১৬৩০, জার্মান জ্যোতির্বিদ ও গণিতজ্ঞ) হাতে আসে। কারণ, তিনি ছিলেন টাইকো ব্রাহের সহকারী। তিনি তখন বিশ্লেষণ করে বের করার চেষ্টা করলেন, সূর্যের চারপাশে গ্রহগুলো কীভাবে ঘোরে। তিনি এটা করেছিলেন ট্রায়াল অ্যান্ড এরর পদ্ধতিতে। এক পর্যায়ে তিনি ভেবেছিলেন, সঠিক উত্তরটি বের করে ফেলেছেন। তিনি জানতে পারলেন, সূর্যকে কেন্দ্রে রেখে গ্রহগুলো ঘোরে। তারপর কেপলার খেয়াল করলেন একটি গ্রহ, আমার ধারণা ওটা সম্ভবত মঙ্গল গ্রহ ছিল, নিজের কক্ষপথ থেকে আট মিনিট (সময় নয়, কোণ) দূরে। তিনি ভাবলেন, টাইকো ব্রাহের এত বড় ভুল করার কথা না। তার মানে, এটা সঠিক উত্তর হতে পারে না। অর্থাৎ এক্সপেরিমেন্টের নিখুঁততার জন্যই তিনি আবার ট্রায়াল দিয়ে দেখলেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনটি বিষয় খুঁজে পেলেন। 

জোহান কেপলার
উইকিপিডিয়া

প্রথমত, কেপলার আবিষ্কার করলেন, গ্রহরা সূর্যকে ঘিরে উপবৃত্তাকার পথে ঘোরে। বৃত্তের যেমন একটি কেন্দ্র থাকে, তেমনি উপবৃত্তের দুটি ফোকাস থাকে। এরকম একটি ফোকাসে থাকে সূর্য। পরের প্রশ্নটি হলো, উপবৃত্তাকার পথে ঘোরার সময় গ্রহগুলো ঘোরে কীভাবে? মানে, সূর্যের কাছে থাকলে কি দ্রুত চলে? সূর্য থেকে দূরে থাকলে কি ধীরে চলে? এসব আরকি। কেপলার এ প্রশ্নেরও উত্তর বের করলেন।

তিনি দেখলেন, আপনি যদি একটি গ্রহের অবস্থানকে দুটো ভিন্ন সময়ে পরিমাপ করেন—সময়ের পরিমাণ সুনির্দিষ্ট হতে হবে, যেমন তিন সপ্তাহ—তারপর এর কক্ষপথের আরেকটি অবস্থানে তিন সপ্তাহ আগে-পরে আবারও পর্যবেক্ষণ করেন, আর এ দুক্ষেত্রেই সূর্য থেকে গ্রহের অবস্থান পর্যন্ত রেখা টানেন (পারিভাষিকভাবে একে বলা হয় ব্যাসার্ধ ভেক্টর), তাহলে দেখবেন, দুক্ষেত্রেই তিন সপ্তাহ আগে-পরের কক্ষপথের দূরত্ব ও ব্যাসার্ধ ভেক্টর মিলে যে ক্ষেত্রফল তৈরি করে, তার মান সমান। এটা কক্ষপথের যেকোনো জায়গার জন্য সত্য। অর্থাৎ গ্রহটি সূর্যের কাছাকাছি, মানে উপবৃত্তের যে ফোকাসে সূর্য আছে, সেদিকে থাকলে দ্রুত বেগে চলে। আর সূর্য থেকে দূরে থাকলে তুলনামূলকভাবে ধীরে চলে। যেন দুক্ষেত্রেই ক্ষেত্রফলের মান একদম সমান থাকে। অর্থাৎ কেপলারের দ্বিতীয় সূত্রটি বলে, কক্ষপথ বরাবর প্রতিটি গ্রহের বেগ বা কক্ষীয় বেগ এমন হয় যে সমান সময়ে ব্যাসার্ধ ভেক্টর দিয়ে আবদ্ধ ক্ষেত্রফল একদম সমান হয়।

তৃতীয় সূত্রটি কেপলার কয়েক বছর পরে আবিষ্কার করেন। এটি কেবল সূর্যের চারপাশে একটি গ্রহের বেগ নিয়ে কাজ করে না, বরং এক গ্রহের সঙ্গে আরেক গ্রহের সম্পর্ক তৈরি করে। এই সূত্র বলে, যেকোনো দুটি গ্রহের কক্ষীয় পর্যায়কাল আর কক্ষপথের আকার তুলনা করলে দেখা যায়, পর্যায়কাল এবং কক্ষপথের আকারের ৩/২ ঘাত—একে অন্যের সমানুপাতিক। এখানে পর্যায়কাল মানে, পুরো কক্ষপথ একবার পাড়ি দিতে একটি গ্রহের যে সময় লাগে, তা। আর কক্ষপথের আকার মানে, উপবৃত্তাকার কক্ষপথের সবচেয়ে বড় ব্যাসের দৈর্ঘ্য। এই তৃতীয় সূত্রটি সম্ভবত একটু জটিল শোনাচ্ছে। সহজ করে বললে, গ্রহগুলো যদি বৃত্তাকার পথে ঘুরত, তাহলে একবার পুরো কক্ষপথ ঘুরে আসতে যে সময় লাগত, তা ওই বৃত্তের ব্যাসের (অথবা ব্যাসার্ধের) ৩/২ ঘাতের সমানুপাতিক হতো।

এভাবে কেপলার তিনটি সূত্র পেলেন। এগুলোর সারকথা হলো—প্রতিটি গ্রহের কক্ষপথ একটি উপবৃত্ত, যার একটি ফোকাসে রয়েছে সূর্য। সূর্য এবং যেকোনো গ্রহের সংযোগকারী ব্যাসার্ধ রেখা গ্রহের আবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমান সময়ে সমান ক্ষেত্রফল অতিক্রম করে। আর যেকোনো দুটি গ্রহের কক্ষীয় পর্যায়কালের বর্গ তাদের কক্ষপথের পরাক্ষের ঘনফলের সমানুপাতিক। এই তিনটি সূত্রের মাধ্যমে কেপলার সূর্যের চারপাশে গ্রহগুলোর গতির পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দিলেন।

এর পরের প্রশ্নটা হলো, সূর্যের চারপাশে গ্রহগুলোর ঘোরার পেছনে কারিকুরিটা ফলাচ্ছে কে? গ্যালিলেও তখন আবিষ্কার করেন জড়তার নীতি—চলমান কোনো বস্তুকে যদি কোনো কিছু স্পর্শ না করে বা কোনোভাবে প্রভাবিত না করে, তাহলে বস্তুটি আজীবন সেই একই বেগে সরলরেখা বরাবর চলতে-ই থাকবে।

পরের কাজটি করলেন নিউটন। তিনি যে প্রশ্নটি নিয়ে কাজ করলেন, সেটা হলো, ‘বলটা যখন সরলরেখা বরাবর চলবে না, তখন কী ঘটবে?’ প্রশ্নটির জবাব তিনি এভাবে দিলেন—কোনো বস্তুর গতি পাল্টানোর একমাত্র উপায় এর ওপরে বল প্রয়োগ করা। যেমন বলটা যেদিকে যাচ্ছে, আপনি যদি সেদিকেই আরও বল বা ধাক্কা দেন, তবে ওটার গতি বেড়ে যাবে। আবার, যদি দেখেন এটা দিক বদলেছে, তার মানে, গতির দিকে নয় বরং পাশের কোনো দিকে বল প্রয়োগ করা হয়েছে। এই বলটা প্রভাব দুটোর গুণফল হিসেব করে পরিমাপ করা যায়। অতিক্ষুদ্র সময়ে বেগের পরিবর্তন কত? এটাকে বলা হয় ত্বরণ। আর এটাকে যখন ‘বস্তুর ভর’ দিয়ে গুণ করা হয়, কিংবা ‘জড়তা’ দিয়ে; তখন পাওয়া যায় বল। অর্থাৎ, F = ma।

এটাকে চাইলে সহজেই পরিমাপ করা যায়। উদাহরণ দিই। ধরুন, কেউ সুতোর সঙ্গে বাঁধা একটা পাথরকে বৃত্তাকারে ঘোরাচ্ছে। ঘোরানোর সময় টের পাওয়া যাবে, সুতোটাকে টানতে হচ্ছে। অর্থাৎ বল প্রয়োগ করতে হচ্ছে। কারণ, বেগের মানের কোনো পরিবর্তন না হলেও বৃত্তাকার পথে ঘোরার ফলে দিকের পরিবর্তন হচ্ছে। তাই ভেতরের দিকে সবসময় একটা বল প্রয়োগ করতে হচ্ছে। আর এই বলের মান ভরের সমানুপাতিক। অর্থাৎ ভর বেশি হলে বা পাথরটি বড় হলে বল দিতে হবে বেশি। ভর কম হলে অল্প বল দিলেই চলবে। নিউটন এ থেকে বুঝলেন—সহজ একটা উদাহরণ দিয়ে যদি বলি—গ্রহগুলো যদি সূর্যের চারপাশে বৃত্তাকার পথে ঘোরে, তবে তাদেরকে কক্ষপথ বরাবর, অর্থাৎ সরলরেখা বরাবর ছুটে যাওয়ার জন্য পাশের দিকে বা স্পর্শক বরাবর কোনো বল দিতে হয় না। বরং বল প্রয়োগ না করলে গ্রহগুলো এমনিতে-ই এ পথ ধরে ছুটবে। কিন্তু বাস্তবে বল প্রয়োগ না করলে যে রেখা বরাবর তাদের চলার কথা, সেখান থেকে তারা সরে আসে। এই সরে আসাটা তাদের গতির দিকে হয় না। বরং তাদের গতির সঙ্গে সমকোণে, অর্থাৎ সূর্যের দিকে ঘটে। মানে, তারা বৃত্তাকার পথে সূর্যের দিকে সরে আসে। কথাটা এভাবে বলা যেতে পারে—জড়তার নীতির কারণে, সূর্যের চারপাশে গ্রহদের ঘুরপাক নিয়ন্ত্রণের জন্য যে বল দরকার হয়, সেটা গ্রহদের কক্ষপথ বরাবর কাজ করে না, বরং সূর্যের দিকে কাজ করে।

আইজ্যাক নিউটন
উইকিপিডিয়া
চাঁদ এক সেকেন্ডে কতটুকু পড়ছে, সেটা হিসেব করে বের করা যায় সহজেই। কারণ, আপনি এর কক্ষপথের আকার জানেন। জানেন, চাঁদ পৃথিবীকে ঘিরে একবার ঘুরে আসতে এক মাসের মতো লাগে।

এখানে একটু বলি, কোনো বল প্রয়োগ না করলে গ্রহগুলো যে সরলরেখা বরাবর চলতেই থাকবে, এটার কোনো কারণ আমাদের জানা নেই। কোনো বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ না করলে সেটা কেন সবসময় সমান বেগে সরলরেখা বরাবর চলতেই থাকে, তার কারণ আজও খুঁজে বের করা যায়নি। আমরা জানি, এই চিরায়ত গতির অস্তিত্ব আছে। সে যাহোক, গ্রহগুলোকে সূর্যের দিকে ঘোরাতে হলে একটা বল লাগবে। সত্যি বলতে, নিউটন দেখিয়েছিলেন ‘গ্রহগুলোর বেগের সব ধরনের পরিবর্তন হয় সূর্যের দিকে’—এই সাধারণ ধারণাটি থেকেই গ্রহগুলোর সমান সময়ে সমান ক্ষেত্রফল অতিক্রম করার বিষয়টি আসে। গ্রহদের উপবৃত্তাকার গতিপথের জন্যও এটা সত্যি।

এ থেকে নিউটন নিশ্চিত করলেন, গ্রহগুলোর ওপর প্রযুক্ত বল সূর্যের দিকে কাজ করে। আর সূর্য থেকে গ্রহগুলোর দূরত্বের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন গ্রহের পর্যায়কাল—মানে, সূর্যের চারপাশে একবার ঘুরে আসতে যত সময় লাগে, তা কীভাবে বদলে যায়, সেটা জানতে পারলে দূরত্বভেদে এ বল কতটা সবল বা দুর্বলভাবে কাজ করে, তা বের করা সম্ভব। তিনি বের করলেন, এই বল সবসময় দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক হারে কাজ করে।

এ পর্যন্ত নিউটন কিন্তু নিজে থেকে কিছু বলেননি। তিনি শুধু দুটো জিনিস বলেছেন, যেগুলো কেপলার আগেই ভিন্ন ভাষায় বলে গিয়েছিলেন। এর একটা ‘গ্রহদের ওপর প্রযুক্ত বল সূর্যের দিকে কাজ করে’—এ কথার সমতুল্য। আরেকটি ‘বলের মান দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক’—এ বক্তব্যের সমতুল্য।

কিন্তু মানুষ ততদিনে টেলিস্কোপ দিয়ে দেখেছে, বৃহস্পতির চারদিকে এর উপগ্রহগুলো ঘুরছে। ঠিক ছোট্ট একটা সৌরজগতের মতো। উপগ্রহগুলো যেন বৃহস্পতির প্রতি আকর্ষিত হচ্ছে। আবার চাঁদ পৃথিবীর প্রতি আকর্ষিত হচ্ছে, এর চারপাশে ঘুরছে। এটিও আকর্ষিত হচ্ছে একইভাবে। দেখে মনে হচ্ছে যেন সব কিছুই অন্য সব কিছুর প্রতি আকর্ষিত হয়। তাই নিউটনের পরবর্তী বক্তব্যটা ছিল পুরো বিষয়টিকে সার্বিকভাবে বিবৃত করা। তিনি বললেন, সব বস্তুই একে অন্যকে আকর্ষণ করে। এটা যদি সত্য হয়, তাহলে সূর্য যেমন গ্রহগুলোকে টানছে, পৃথিবীও তেমনি টানছে চাঁদকে। বলে রাখি, মানুষের ইতিমধ্যেই জানা ছিল, পৃথিবী সব কিছুকে নিজের দিকে টানে। কারণ, আপনারা সবাই বাতাসে ভেসে বেড়াতে চাইলেও শক্তভাবে নিজের আসনেই বসে আছেন! পৃথিবী যে তার পৃষ্ঠের ওপরের সবকিছুকে নিজের দিকে টানে—মহাকর্ষবিষয়ক এই ধারণটি ততদিনে সুপরিচিত ছিল। এখানে নিউটনের আইডিয়াটা ছিল, যে মহাকর্ষ চাঁদকে তার কক্ষপথে ধরে রেখেছে, সম্ভবত সেই একই মহাকর্ষই বিভিন্ন বস্তুকে পৃথিবীর দিকে টানছে।

চাঁদ এক সেকেন্ডে কতটুকু পড়ছে, সেটা হিসেব করে বের করা যায় সহজেই। কারণ, আপনি এর কক্ষপথের আকার জানেন। জানেন, চাঁদ পৃথিবীকে ঘিরে একবার ঘুরে আসতে এক মাসের মতো লাগে। তাহলে, এখান থেকে যদি আপনি হিসেব করে বের করতে পারেন চাঁদ এক সেকেন্ডে কত দূর যায়; আপনি বের করতে পারবেন, চাঁদ তার কক্ষপথের কোনো বিন্দুগামী সরলরেখা বা স্পর্শক থেকে প্রতি সেকেন্ডে বৃত্তাকার পথে কতটা নেমে আসে। অর্থাৎ এর ওপর কোনো বল প্রযুক্ত না হলে; এটা বর্তমানে যে বৃত্তাকার পথে ছুটছে, সেই পথে না গেলে যে সরলরেখা বরাবর ছুটে যেত, সেখান থেকে প্রতি সেকেন্ডে এটা কতটুকু নিচে পড়ছে, এভাবে সেটা বের করা যায়। এই দূরত্বটা হলো এক ইঞ্চির বিশ ভাগের এক ভাগ। ১/২০ ইঞ্চি।

আমরা পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে যতটা দূরে আছি, চাঁদ তার চেয়ে ষাটগুণ দূরে আছে। আমরা আছি পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে ৪ হাজার মাইল দূরে। আর চাঁদ আছে ২ লাখ ৪০ হাজার মাইল দূরে। এখন, দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতের সূত্র যদি ঠিক হয়, তবে ভূপৃষ্ঠের কোনো বস্তুর প্রতি সেকেন্ডে পড়া উচিৎ ৩৬০০ × (১/২০) ইঞ্চি। (৩৬০০ মানে, ৬০-এর বর্গ।) কারণ, চাঁদে যে বল গিয়ে পৌঁছাচ্ছে, সেটা দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক সূত্র অনুসারে ৬০ ×৬০  হারে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তাই পৃথিবীপৃষ্ঠে সেই বলটা ৩৬০০ গুণ শক্তিশালীভাবে কাজ করবে। সেটা দিয়ে চাঁদের পতনকে গুণ করে পাব পৃথিবীপৃষ্ঠে বস্তুর কী হারে পড়া উচিৎ, তা। আর চাঁদ তার কক্ষপথে পড়ছে সেকেন্ডে ১/২০ ইঞ্চি, এটা আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি। তাহলে, ১/২০ ইঞ্চি×৩৬০০ = প্রায় ১৬ ফিট। ততদিনে গ্যালিলেওর এক্সপেরিমেন্ট থেকে জানাই ছিল, পৃথিবীপৃষ্ঠের কোনো বস্তু এক সেকেন্ডে ১৬ ফিটের মতোই পড়ে। তার মানে, নিউটন সঠিক পথে আছেন। এখন আর ফেরার উপায় নেই। কারণ, আগে থেকে সম্পর্কহীন, সম্পূর্ণ স্বাধীন একটা বিষয়—চাঁদের কক্ষপথের পর্যায়কাল এবং পৃথিবী থেকে এর দূরত্বকে বর্তমানে আরেকটি বিষয়—এক সেকেন্ডে পৃথিবীপৃষ্ঠের কোনো বস্তু কতটুকু পড়ে, তার সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয়েছে। খুবই রোমাঞ্চকর ও নাটকীয় এক পরীক্ষা। যে পরীক্ষা আমাদের বলছে, সব ঠিক আছে।

এখন, এই সূত্র ধরে নিউটন অনেকগুলো অনুমান করলেন। দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতের সূত্র অনুযায়ী গ্রহগুলোর কক্ষপথের আকৃতি কেমন হওয়া উচিৎ, তিনি সেটা হিসেব করে বের করলেন। দেখলেন, আসলেই সেটা উপবৃত্তাকার হওয়ার কথা। এ ছাড়াও আরও অনেকগুলো নতুন ঘটনারও স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া গেল। যেমন জোয়ার-ভাটা। পৃথিবী এবং ভূপৃষ্ঠের পানির ওপর চাঁদের আকর্ষণের কারণে জোয়ার-ভাটা হয়। চাঁদের আকর্ষণের কথা অবশ্য মানুষ আগেও ভেবেছে। সমস্যা হলো, জোয়ার-ভাটা যদি চাঁদের আকর্ষণের কারণেই ঘটে, তাহলে চাঁদ যেদিকে, শুধু সেদিকের পানি চাঁদের টানে ওপরে উঠে আসবে। সেক্ষেত্রে দিনে শুধু একবারই জোয়ার হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে আমরা জানি, প্রতি বারো ঘণ্টায় একবার জোয়ার আসে, দিনে দুবার। ভিন্নচিন্তার আরেক ধরনের মানুষ ছিলেন, যাঁরা অন্য সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। তাঁদের ভাবনা ছিল, চাঁদ পৃথিবীকে টেনে পানি থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। তাই চাঁদ পৃথিবীর যে পাশে, তার উল্টোদিকে জোয়ার হয়। কিন্তু নিউটন প্রথমবারের মতো বুঝতে পারলেন, আসলে কী ঘটে। তিনি বুঝেছিলেন, পৃথিবী ও ভূপৃষ্ঠের পানির ওপর চাঁদ একই দূরত্ব থেকে সমান বল প্রয়োগ করে আকর্ষণ করে। তাই যে পাশে পানি তুলনামূলক চাঁদের কাছাকাছি, সেটা চাঁদের দিকে খানিকটা উঠে আসে। আর যে বিন্দুতে নিরেট পৃথিবীর চেয়ে ভূপৃষ্ঠের পানি চাঁদের চেয়ে খানিকটা দূরে, সেখানে ভূপৃষ্ঠ চাঁদের দিকে সরে আসে। তাই উল্টোপাশে পানি উপচে ওঠে। এই দুইয়ে মিলে পৃথিবীর যেকোনো স্থানে দিনে দুবার জোয়ার-ভাটা হয়।

আরও অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে গেল। যেমন পৃথিবী গোল কেন—কারণ, সবকিছু টান খেয়ে একসঙ্গে জড়ো হয়ে থাকে। আর, গোলাকৃতির ফলে মহাকর্ষ বল ভারসাম্যপূর্ণ্যভাবে প্রতিটি কণার ওপর কাজ করতে পারে। জানা গেল, পৃথিবী নিখুঁত গোলাকার নয় কেন—কারণ, এটি ঘুরছে। ফলে এর দুপাশ খানিকটা বেরিয়ে রয়েছে, আর অন্য দুপাশে খানিকটা চাপা—এভাবে ভারসাম্য হয়ে গেছে। জানা গেল, চাঁদ-সূর্য কেন গোলাকার ইত্যাদি।

অনুবাদক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

মূল: দ্য ক্যারেক্টার অব ফিজিক্যাল ল, রিচার্ড ফাইনম্যান