আপেক্ষিক ভর: যে জুজুর মৃত্যু নেই

প্রথম কথা হলো, বেগ বা দ্রুতি যা–ই বলুন, এর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘ভর’ বাড়ে না। সেকেলে কোনো ‘আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান’ বইয়ে এটা লেখা আছে বলেই যে এই ধারণা সত্য হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। এমনকি আইনস্টাইনও তাঁর তত্ত্বের সব কটি ফলাফল বুঝতে পারেননি। তিনি বিভিন্ন সময়ে মহাকর্ষ তরঙ্গ এবং সেই কারণে মহাকর্ষ বিকিরণকে সন্দেহের চোখে দেখেছেন। ত্রিশের দশকের শেষের দিকে আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির জার্নাল ফিজিক্যাল রিভিউ–এ বিষয়ে তাঁর একটি গবেষণাপত্র ছাপতে অস্বীকার করে। এতে তিনি এতটাই হতাশ হয়েছিলেন যে তিনি এরপরে আর কোনো দিন ফিজিক্যাল রিভিউ-তে কোনো গবেষণাপত্রই জমা দেননি। তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত আরেক জার্নালে এই প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাঁর এই প্রবন্ধের সিদ্ধান্তগুলো ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। তার মানে দাঁড়াল যে বিজ্ঞানে ‘পীর’ বলে কিছু নেই। আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানীরাও ভুল উপসংহার টানতে পারেন।

অনেকেই আপেক্ষিক ভরের সপক্ষে আইনস্টাইনের লেখা সমীকরণ তুলে ধরেন এভাবে—

m = m0 / √{ 1- (v/c)2}.........(১)

কিন্তু আমরা গবেষণার কোথাও এই সমীকরণের সরাসরি কোনো ব্যবহার করি না। আমার মতে, এই সমীকরণের ভ্রমের মূল কারণ হলো কোনো সমীকরণ লেখা সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা। আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রায়ই সূত্র হাতড়ে বেড়ায়, কিন্তু সূত্রগুলো কোথা থেকে আসে বা কেনই–বা লেখা হয়, তার উৎস খুঁজতে ততটা উৎসাহ দেখায় না। যারা অল্পবিস্তর C বা C++ তে কোড করতে জানে, তারা a= b এবং a==b-এর পার্থক্যটা জানে। পদার্থবিজ্ঞানের সমীকরণগুলো মূলত a==b প্রকৃতির। অর্থাৎ দুই ভিন্ন ভিন্ন ধারণার মাঝে সেতুবন্ধ তৈরি করে। (১) নম্বর সমীকরণের সবচেয়ে দুর্বল দিক হচ্ছে বাম দিকটা। কারণ, আপেক্ষিক ভরের ধারণাটাই প্রশ্নবিদ্ধ। এটাকে খেলার মাঠে নামালে গোলের সংখ্যা না বেড়ে বরং ফাউলের সংখ্যা বাড়ে। আমার এই সিদ্ধান্তের সপক্ষে আমি দুটি যুক্তি দেখাচ্ছি।

গুরুগম্ভীর রূপান্তর পদ্ধতি

আমার ধারণা, আমাদের পাঠকদের বেশির ভাগেরই টেন্সর কী জিনিস তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই। আপেক্ষিক ভরের ধারণাটি যে আপেক্ষিকতার মূল ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক তা বোঝানোর জন্য টেন্সর ব্যবহার করলে সবচেয়ে সহজ হয়। কিন্তু টেন্সর কী, তা লিখতে গেলে একেবারে গণিতের ক্লাস নিতে হবে। তবে কেউ উৎসাহী হলে তাকে উইকিপিডিয়া দিয়ে ওই রাস্তায় হাঁটা শুরু করতে উপদেশ দেব।

প্রথমেই আমাদের যে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে—ভর বলতে আপনি কী বোঝেন? আমি ধরে নিচ্ছি যে আমরা জড়তার ভর নিয়ে কথা বলছি। প্রথমে একটি চলমান কণার কথা চিন্তা করা যাক। তাহলে এর সংজ্ঞা দেওয়া হয় নিচের সম্পর্কের মাধ্যমে।

p = mv...(২), যেখানে p ও v যথাক্রমে পর্যবেক্ষক কণার যে ভরবেগ ও বেগ দেখছে। এই সমীকরণকে একটি প্রসঙ্গ কাঠামো বা একজন পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে লেখা হয়। সহজ একটি সমীকরণ কিন্তু এর মাধ্যমেই যে ভর আমাদের পদার্থবিজ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করছে, তা কিন্তু অনেকেই খেয়াল করেন না।

এখন ওই একই কণার জন্য যদি আরেকজন পর্যবেক্ষক (পূর্বের পর্যবেক্ষকের তুলনায় সমবেগে চলমান) ভরবেগের সমীকরণ লেখেন তা হবে—

p’ = m’ v’...(৩)

লক্ষ করুন যে আমরা ভরের পরিবর্তনের সম্ভবতা ধরে নিয়েই m-এর পরিবর্তে m’ লিখেছি।

আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা প্রণয়নের অল্প কিছুদিন পরেই যে জিনিসটা গণিতবিদ হারম্যান মিনকোস্কি (ইনি আবার আইনস্টাইনের শিক্ষকও ছিলেন) লক্ষ করেছিলেন যে লরেঞ্জ রূপান্তরকে চতুর্মাত্রিক জগতে ঘূর্ণন বলে চিন্তা করা যায়। বোঝানোর সুবিধার্থে আমরা সাধারণ ত্রিমাত্রিক ঘূর্ণনের কথা মাথায় রেখেই আমাদের আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাই।

যদি আমরা স্থানাঙ্ক ব্যবস্থার কেন্দ্র O-তে একটা ভেক্টর u চিন্তা করি, তাহলে ওই বিন্দুকে কেন্দ্র করে একটা ঘূর্ণন করলে আমরা ভেক্টরটিকে লিখব—

u’ = L u...(৪)

এখানে L হচ্ছে একটা ম্যাট্রিক্স বা কারক। এর মাধ্যমে ঘূর্ণনটাকে বিমূর্তভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। যেহেতু আমরা ঘূর্ণন উল্টো দিকেও করতে পারি, তাহলে অবশ্যই L-এর বিপরীত L-1 আছে এবং ধর্ম হচ্ছে—

L L-1 = L-1L = 1

এখন আমাদের ভরবেগের সমীকরণের দুই ধারেই ভেক্টর।

অতএব, p’ = Lp

আর v’ = Lv.

সম্পর্ক দুটো (৩) নম্বর সমীকরণে বসিয়ে পাই Lp = m Lv . দুই দিকেই বাম দিক দিয়ে L-1 দ্বারা গুণ করে পাই—

m‌‌’ =L-1m L .

এখন এই সম্পর্ক যেকোনো ঘূর্ণনের জন্য প্রযোজ্য।

এটা সম্ভব যখন, m’ = L-1 m L = mL-1 L = m 1 = m !

তার মানে, সব পর্যবেক্ষকই একই ভর দেখবে! যদিও ভরবেগের মান ভিন্ন হতে পারে।

তারপরেও যদি আপনি ইনিয়ে-বিনিয়ে যুক্তি দেখাতে থাকেন, তাহলে আমি আপনাকে বলব, আপনি আপেক্ষিকতার প্রথম স্বীকার্যই বোঝেন না। আপেক্ষিকতার প্রথম স্বীকার্যটা আসলে গাণিতিক ভাষায় প্রকাশ করলে সেটা বলে, পদার্থবিদ্যার সব কটি সমীকরণকে টেন্সর সমীকরণ হতে হবে, কারণ এগুলোকে সব কাঠামোয় একই রকম দেখাতে হবে।

চিন্তাবহির্ভূত উপায় – ভেলকিবাজি পদ্ধতি = হ্যারিপটার পদ্ধতি

বেগ বাড়ার সঙ্গে ভর বাড়ার ধারণা ভুল প্রমাণ করার এটি অপেক্ষাকৃত সরল উপায়। কারণ, এতে সাধারণ আপেক্ষিকতার সঙ্গে দেখা যায়। মনে রাখতে হবে, বিশেষ আপেক্ষিকতা কিন্তু সাধারণ আপেক্ষিকতারই একটি বিশেষরূপ। তার মানে, আপনার অবশ্যই কোথাও ভুল হচ্ছে।

সাধারণ আপেক্ষিকতার অন্যতম একটি ধারণা হলো দুই ধরনের ভরের সমতুল্যতা— সেগুলো হলো ওপরে বলা জড়তার ভর এবং মহাকর্ষীয় ভর। দুটো ধারণারই জনক ছিলেন নিউটন। আর হ্যাঁ, তিনি জানতেন এই জিনিস দুটি একেবারেই আলাদা হতে পারে। যদি তা–ই হতো, তাহলে সরল দোলক (অন্যান্য অনেক জিনিসের মধ্যে) বানানো সম্ভব হতো না। কারণ, এর পর্যায়কাল তাহলে ভরের ওপর নির্ভর করত। ধরে নিই, জড় ভর গতির সঙ্গে বাড়ে। তাহলে এটা বাড়লে মহাকর্ষীয় ভর বাড়বে, উল্টোভাবে আবার মহাকর্ষীয় ভর বাড়লে জড় ভরও বাড়বে। এই ধারণাই আমি ব্যবহার করব। আইনস্টাইনের জাদুর সর্বোচ্চ এই ব্যবহারই আমরা করব। তবে আগেও বলেছি, বিষয়টি নিউটন ও অন্যরাও জানতেন। অতএব, এটা বুঝতে পারা কোনো কঠিন কাজ হবে না।

অতএব, ধরা যাক, আমরা দুটি গোলক আকৃতির বস্তু নিলাম (নিছক মজার ছলে আমরা ধরে নিলাম দুটোর ভরই M)। এদের একটি রাস্তার ওপর স্থিরভাবে রাখা হলো (x-অক্ষ বরাবর), যেখানে তাদের মধ্যবর্তী অনুভূমিক দূরত্ব D। নিউটনের সূত্র অনুসারে, তাদের মধ্যে মহাকর্ষীয় বল—

F = G M2/ D2

এবার আমরা গোলকগুলোকে রাস্তায় ফেলে একটি বেলুনে চড়ি। ধরা যাক, আমরা এভাবে একটি নির্দিষ্ট বেগে খাড়া ওপরের দিকে উঠছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আমাদের এক বন্ধু ওসব ‘আধুনিক’ পদার্থবিদ্যার বই পড়ে আমাদের উদ্দেশে লেকচার দিচ্ছে যে ভর বেগের ওপর নির্ভরশীল। তার মতে, আমরা বেলুনের যাত্রীরা ভর মাপলে বেশি মান পাব। ধরা যাক, সেটা M’ এখন আমাদের গতি খাড়া ওপরের দিকে হওয়ার কারণে ভরগুলোর মধ্যে আনুভূমিক দূরত্বের কোনো লরেন্টজ সংকোচন হবে না। অতএব, তাদের দূরত্ব এখনো আমাদের কাছে D–ই মনে হবে।

অতএব, আমাদের ‘আধুনিক’ পদার্থবিদ্যায় শিক্ষিত বন্ধুর দাবি, বস্তু দুটির মধ্যে মহাকর্ষীয় বলের মান বেড়ে গেছে।

F’ = G M’2 / D2

ফলে, এই যুক্তিতে বস্তু দুটির মধ্যে আকর্ষণ বাড়তে থাকায় একে অপরের দিকে গড়াতে থাকার কথা। কারণ, আমরা ধ্রুব বেগে বেলুন যাত্রা করছি। যান, নিজেই পরীক্ষা চালিয়ে দেখুন, কী হয়!

আমার তো মনে হয়, ‘হ্যারিপটার’–এর উপন্যাস ছাড়া অন্য কোথাও এই ঘটনা ঘটবে না। এবার আপনারাই বলুন, আমি বেগের সঙ্গে ভর বাড়ার এই ধারণাকে ছাইপাঁশ বলে কী ভুল করলাম?

লেখক: অধ্যাপক, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়