পারমাণবিক ফিউশন: পরবর্তী জ্বালানি বিপ্লব
সূর্যের বুকে যে আগুন জ্বলে, তা কি বন্দি করা সম্ভব পৃথিবীর বুকে? বর্তমানে পৃথিবী কাঁপছে জলবায়ু পরিবর্তনের আতঙ্কে। ঠিক এই মুহূর্তে বিজ্ঞানীরা স্বপ্ন দেখছেন এক অসীম শক্তির—নিউক্লিয়ার ফিউশন। রাশিয়ায় তৈরি হচ্ছে কৃত্রিম সূর্য, আর সেই মহাযজ্ঞে ডাক পেয়েছে বাংলাদেশও…
মানবসভ্যতার বিকাশের ইতিহাস মূলত শক্তির ইতিহাস। আগুনের ব্যবহার, এরপর কয়লানির্ভর শিল্পযুগ, তেল-গ্যাসভিত্তিক আধুনিকতা আর পরমাণু ফিশন—প্রতিটি নতুন শক্তির উৎস মানবজাতিকে প্রযুক্তি ও অর্থনীতির নতুন স্তরে নিয়ে গেছে।
কিন্তু একবিংশ শতকে এসে পৃথিবী শক্তির চাহিদার তুলনায় অস্বস্তিকর সংকটে পড়ে গেছে। জীবাশ্ম জ্বালানি দ্রুত নিঃশেষ হচ্ছে এবং এর ব্যবহার পরিবেশকে করছে বিপর্যস্ত। জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্রতা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং চরম আবহাওয়া মিলিয়ে এখন পরিষ্কার, নিরাপদ ও দীর্ঘমেয়াদি একটি জ্বালানি উৎসের প্রয়োজনীয়তা আগের যেকোনো সময়ের মতো স্পষ্ট।
এই প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞানীরা ফিরেছেন সূর্যের দিকে। সূর্যের ভেতরে যে প্রক্রিয়ায় অপরিমেয় শক্তি উৎপন্ন হয়, সেই পারমাণবিক ফিউশনকেই তাঁরা দেখছেন ভবিষ্যতের সমাধান হিসেবে। ফিউশনে হাইড্রোজেনের দুটি সমস্থানিক বা আইসোটোপ একীভূত হয়ে শক্তি তৈরি করে। সেগুলো হলো ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম। এই বিক্রিয়ায় কোনো কার্বন নিঃসরণ নেই, তেজস্ক্রিয় বর্জ্য প্রায় নেই বললেই চলে। আর জ্বালানি হিসেবে যে ডিউটেরিয়াম লাগে, তা প্রায় অসীম পরিমাণে রয়েছে পৃথিবীর সমুদ্রজলে। মাত্র এক লিটার সমুদ্রের পানিতে এমন পরিমাণ ডিউটেরিয়াম থাকে, যা থেকে উৎপন্ন শক্তি দিয়ে একজন মানুষের সারা জীবনের বিদ্যুৎচাহিদা মেটানো সম্ভব।
কিন্তু সমস্যাও কম নয়। সূর্যের ভেতরে যে তাপমাত্রা, অর্থাৎ ১.৫ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস, তা পৃথিবীতে ফিউশন ঘটাতে যথেষ্ট নয়। গবেষণাগারে ফিউশনের জন্য প্রয়োজন প্রায় ১০ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। অর্থাৎ সূর্যের চেয়েও সাত-আট গুণ বেশি উত্তাপ।
এ অবস্থায় পদার্থ প্লাজমা নামে এক চরম উত্তপ্ত অবস্থায় পৌঁছায়, যাকে আমরা বলি পদার্থের চতুর্থ অবস্থা। কোনো ধাতব পাত্রে এমন প্লাজমা রাখা সম্ভব নয়। ছোঁয়া মাত্রই সেটি গলে বা বাষ্প হয়ে যাবে।
টোকামাক প্রযুক্তির ধারণাগত ভিত্তি তৈরি হয় আরও আগেই। তবে রুশ বিজ্ঞানী আন্দ্রে শাখারভ ও ইগর তামের কাজ একে পরিপূর্ণ রূপ দেয়।
তাই বিজ্ঞানীরা প্লাজমাকে ধরে রাখতে বেছে নিয়েছেন চৌম্বকক্ষেত্র। এই চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যে প্লাজমাকে ডোনাটের মতো দেখতে একটি চেম্বারে আটকে রাখা হয়, যাতে তা দেয়ালে স্পর্শ না করে শূন্যে ভেসে স্থিরভাবে ঘুরতে পারে। এই চেম্বারটির নাম টোকামাক। এর জন্ম হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে পঞ্চাশের দশকে।
টোকামাক প্রযুক্তির ধারণাগত ভিত্তি তৈরি হয় আরও আগেই। তবে রুশ বিজ্ঞানী আন্দ্রে শাখারভ ও ইগর তামের কাজ একে পরিপূর্ণ রূপ দেয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টোকামাক হয়ে ওঠে ফিউশন গবেষণার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। কারণ এটি প্লাজমাকে সবচেয়ে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ ও স্থিতিশীল রাখতে পারে। টোকামাকে দুটি প্রধান চৌম্বকক্ষেত্র—টরয়ডাল ও পোলয়ডাল—একসঙ্গে কাজ করে স্ক্রুর মতো প্যাঁচানো আকৃতির বলয় তৈরি করে। এই বলয়ের মাঝে প্লাজমা ঘুরতে থাকে। আর বাইরের শক্তি দিয়ে তাকে উত্তপ্ত করা হয়। যেমন ওহমিক হিটিং, রেডিও তরঙ্গ এবং নিউট্রাল রশ্মি প্রবেশের মাধ্যমে।
ফিউশনকে বাস্তবে কাজে লাগাতে হলে শুধু উচ্চ তাপমাত্রা নয়, দীর্ঘ সময় ধরে প্লাজমা ধরে রাখার ক্ষমতাও জরুরি। কারণ একটি বাণিজ্যিক চুল্লি দিনে ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করবে, এটাই লক্ষ্য। বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান তাই দীর্ঘ স্পন্দনের টোকামাক প্রযুক্তির দিকে এগোচ্ছে। চীনের ইস্ট (EAST) টোকামাক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একের পর এক রেকর্ড গড়ছে। ২০২৫ সালে তারা প্রায় ১ হাজার ৬৬ সেকেন্ড ধরে উচ্চ তাপমাত্রার প্লাজমা বজায় রাখতে সক্ষম হয়। এটি কেবল একটি গবেষণাগারের সাফল্য নয়, ভবিষ্যতের শিল্পমানের ফিউশন চুল্লির সম্ভাবনার প্রতীক। ইস্ট উচ্চতাপমাত্রা অতিপরিবাহী চুম্বক ব্যবহার করে, যা কম খরচে বেশি ও স্থিতিশীল শক্তি দিতে পারে।
ফিউশন গবেষণায় বেসরকারি খাতের আগ্রহও দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাজ্যের টোকামাক এনার্জি এবং আমেরিকা ও ইউরোপের যৌথ প্রকল্প স্মার্ট ছোট আকারের টোকামাক নিয়ে কাজ করছে।
ইউরোপে ফ্রান্সের ওয়েস্ট (WEST) টোকামাকও গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি দেখিয়েছে। ওয়েস্ট সম্প্রতি ১ হাজার ৩৩৭ সেকেন্ড ধরে প্লাজমা ধরে রেখে নতুন এক রেকর্ড তৈরি করেছে। এই পরীক্ষা শুধু প্লাজমার স্থায়িত্ব নয়, চুল্লির ভেতরের উপাদান, বিশেষত ডাইভার্টরগুলোর সহনশীলতাও যাচাই করে।
একই সময়ে ইউরোপ-জাপান যৌথ প্রকল্প জেটি-৬০এসএ (JT-60SA) বিশ্বব্যাপী কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু। এটি আইটিইআর-এর আগে সবচেয়ে উন্নত টোকামাক হিসেবে বিবেচিত। ভবিষ্যতে যে ডেমো নামে প্রথম শিল্পমানের ফিউশন চুল্লি তৈরি হবে, তার নকশা জেটি-৬০এসএর তথ্যকে ভিত্তি ধরেই তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ।
ফিউশন গবেষণায় বেসরকারি খাতের আগ্রহও দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাজ্যের টোকামাক এনার্জি এবং আমেরিকা ও ইউরোপের যৌথ প্রকল্প স্মার্ট (SMART) ছোট আকারের টোকামাক নিয়ে কাজ করছে। এতে অল্প খরচে উন্নত গবেষণা করা সম্ভব।
রাশিয়া টোকামাক প্রযুক্তির জন্মস্থান তথা সূতিকাগার হিসেবে আজও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে রাশিয়ার সবচেয়ে উন্নত টোকামাক হলো টি-১৫এমডি। এটি ২০২৩ সালে প্রথম প্লাজমা উৎপাদনের পর এখন আরও উন্নত পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২০২৫ সালে এতে ৫০০ কিলো-অ্যাম্পিয়ারের কাছাকাছি কারেন্ট অর্জন করা গেছে।
রাশিয়া এখন দীর্ঘ স্পন্দন ক্রিয়া এবং উন্নত দেয়াল-উপাদান নিয়ে কাজ করছে। বিশেষ করে লিথিয়াম প্রলেপযুক্ত দেয়াল প্রযুক্তি প্লাজমার স্থিতিশীলতা এবং তাপ সহনশীলতাও বাড়ায়। রাশিয়ার নতুন প্রকল্প টিআরটি টোকামাকও নজরকাড়া। এখানে লক্ষ্য হচ্ছে উচ্চতাপমাত্রা অতিপরিবাহী ব্যবহার করে তুলনামূলক ছোট ও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন চুল্লি তৈরি করা। পাশাপাশি রাশিয়ান গবেষকেরা উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল টাংস্টেন-তামা যৌগিক ডাইভার্টর উপাদান তৈরি করছেন, যা চুল্লির সবচেয়ে বেশি তাপপ্রবাহ পাওয়া অংশটির জন্য অপরিহার্য।
এই পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য ফিউশন চুল্লির দেয়াল, বিশেষ করে ডাইভার্টরের সর্বোচ্চ উন্নতি করা, যাতে দীর্ঘ সময় প্লাজমার আঘাত সহ্য করতে পারে।
মস্কো ইনস্টিটিউট অব ফিজিকস অ্যান্ড টেকনোলজি রাশিয়ায় ফিউশন শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি বিশ্বের প্রথম অনলাইন নিয়ন্ত্রিত শিক্ষামূলক টোকামাক মেফিস্ট (MEPhIST) তৈরি করেছে, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দিচ্ছে। তারা ফিউশন চুল্লির দেয়ালে ব্যবহৃত উপাদান তৈরি এবং সেই উপাদানকে তাদের নিজস্ব টোকামাক মেফিস্টে ব্যবহার করছে। এই পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য ফিউশন চুল্লির দেয়াল, বিশেষ করে ডাইভার্টরের সর্বোচ্চ উন্নতি করা, যাতে দীর্ঘ সময় প্লাজমার আঘাত সহ্য করতে পারে।
মেফির প্লাজমা পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রধান ইউরি মিকায়েলোভিচ গ্যাসপারিয়ান বলেছেন, ‘আমরা জানি, বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। সেখানে শক্তির চাহিদা অনেক বেশি এবং ভবিষ্যতে তা বাড়বে। তাই দেশের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে ফিউশন প্রযুক্তি বিকাশ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি বাংলাদেশকে অবশ্যই ফিউশন শক্তি উন্নয়নের এই বিজয়ের পথে যোগদান করতে হবে। আমাদের পক্ষ থেকে মেফি (MEPhI) এবং আমাদের বিভাগ বাংলাদেশকে ব্যাপক শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা প্রদান করতে প্রস্তুত। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি নিজস্ব টোকামাক মেফিস্ট তৈরি করেছে, যেখানে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং গবেষণা পরিচালিত হয়। দূরবর্তী কাজ এখন বিদেশি দেশগুলোর জন্য উন্মুক্ত করা হচ্ছে। ফলে বিদেশ থেকে মানুষ আমাদের পরীক্ষাগারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারবে। আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ও সহযোগিতা আরও উন্নত করার জন্য উন্মুখ।’
ফিউশন শক্তিকে অনেকেই ভবিষ্যতের জ্বালানি বলে মনে করেন। কারণ এটি পরিষ্কার, নিরাপদ এবং সীমাহীন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফিউশন শক্তি একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত সম্ভাবনা। দেশের গ্যাসভান্ডার দ্রুত কমে আসছে এবং আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। ফিউশন শক্তি বাস্তবায়িত হলে এটি হবে কার্যত অসীম জ্বালানির উৎস।
বাংলাদেশ রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের মাধ্যমে ফিশন প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জন করছে। এই অভিজ্ঞতা ফিউশন গবেষণায় প্রবেশের ভিত্তি তৈরি করতে পারে। প্লাজমা পদার্থবিজ্ঞান, উপাদানবিজ্ঞান, নিউট্রন প্রযুক্তি, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রকৌশল—সব মিলিয়ে একটি সম্পূর্ণ নতুন খাত তৈরি হবে, যা প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখবে।
ফিউশন শক্তিকে অনেকেই ভবিষ্যতের জ্বালানি বলে মনে করেন। কারণ এটি পরিষ্কার, নিরাপদ এবং সীমাহীন। যদিও এখনো অনেক প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ রয়েছে, বিশেষ করে স্থিতিশীল উচ্চ তাপমাত্রার প্লাজমা ধরে রাখা, চুল্লির দেয়ালের সহনশীলতা, অতিপরিবাহী চুম্বকের উন্নয়নের মতো ব্যাপার। তবু বিশ্বের দ্রুত অগ্রগতি দেখিয়ে দিচ্ছে, এই স্বপ্ন খুব দূরে নয়। সম্ভবত আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই প্রথম শিল্পমানের ফিউশন চুল্লি চালু হবে।
বাংলাদেশের মতো শক্তি-সংকটাপন্ন দেশগুলোর জন্য এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। বিশ্ব যখন কৃত্রিম সূর্যের দিকে এগোচ্ছে, সেখানে পিছিয়ে থাকা ভবিষ্যতের জন্য বিরাট ক্ষতি হতে পারে।