আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব কতটা আপেক্ষিক!

মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের নাম শোনেননি এমন মানুষ কমই আছেন। যাঁরা নামটা শুনেছেন তাঁদের সবাই তাঁকে এক ফর্মুলাতেই চেনেন, সেটা হলো তাঁর আপেক্ষিকতার তত্ত্বের ফর্মুলা। কিন্তু এই তত্ত্বটা জটিল। তত্ত্বের মূল কথাটা বিভিন্নভাবে হয়তো অনেকেই জানেন। অনেকের ধারণা এর সঙ্গে আপেক্ষিক কোনো কিছুর ব্যাপার জড়িত। সাধারণভাবে তাঁদের অনেকে ধরে নেন, ‘সবকিছু আপেক্ষিক’, এটাই মূল ব্যাপার। কিন্তু আসলে তা নয়। বরং আইনস্টাইন যা বলেছেন, তাঁর তত্ত্বের সঙ্গে সাধারণ অর্থে ‘আপেক্ষিক’ শব্দটির সরাসরি সম্পর্ক নেই।

যেমন, চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে, আবার পৃথিবী চাঁদসহ সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। একই সঙ্গে সূর্যও কিন্তু ঘুরছে। সে তার চারপাশে বিভিন্ন কক্ষপথে পরিভ্রমণরত গ্রহ–উপগ্রহসহ আমাদের ছায়াপথে একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরছে। তাহলে যখন বলি চাঁদ ঘুরছে, তার মানে এই গতি পৃথিবী–সূর্য প্রভৃতির গতির তুলনায় আমরা যে গতি দেখছি তা বিবেচনায় রাখতে হবে। এ বিষয়টি বিবেচনায় তো অবশ্যই রাখতে হবে।

কিন্তু আইনস্টাইন এই অর্থে তাঁর আপেক্ষিকতার তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেননি। আসলে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ও প্রকৃতিতে যত ঘটনা ঘটছে, তা নির্দিষ্ট সূত্র অনুযায়ীই ঘটে চলেছে। এই যে চাঁদ বা পৃথিবী ঘুরছে, জোয়ার–ভাটা হচ্ছে, এগুলো কোনো ব্যক্তি কোন অবস্থানে থেকে কী রকম দেখছেন তার ওপর নির্ভর করে না। ব্যক্তির অবস্থান পরিবর্তন হলে হয়তো তিনি একই ঘটনা একটু অন্য রকম দেখেন, কিন্তু ঘটনাগুলো প্রকৃতির অভিন্ন সূত্র অনুযায়ীই ঘটে, ব্যক্তি কোন অবস্থান থেকে দেখছেন, তার ওপর নির্ভর করে না।

আলবার্ট আইনস্টাইন

একটা সাধারণ উদাহরণ দিই। ধরা যাক, আমি বিকেলবেলা খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে দেখছি একটি পাখি আকাশে ঘণ্টায় তিন কিলোমিটার বেগে উত্তর দিকে যাচ্ছে। আর আমার বন্ধু ঘণ্টায় তিন কিলোমিটার বেগে হেঁটে যাচ্ছেন। তিনি কিন্তু দেখছেন আকাশের পাখিটি স্থির অবস্থানে রয়েছে। এখন দুই বন্ধু তাঁদের অবস্থানের ভিন্নতার জন্য একই পাখির উড়ে যাওয়ার ঘটনাটি দুইভাবে দেখছেন। কিন্তু পাখির উড়ে চলার গতির সূত্র দুই ক্ষেত্রে একই, অপরিবর্তিত। গতিসূত্রের কিন্তু আপেক্ষিক পরিবর্তন ঘটছে না। এটাই আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্রের মূল ব্যাপার।

এ ব্যাপারটা অনেকের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। সে জন্যই আইনস্টাইন কিন্তু তাঁর তত্ত্বের নাম প্রথমে দিতে চেয়েছিলেন ‘অপরিবর্তনীয়তার সূত্র’ (থিওরি অব ইনভেরিয়েন্টস)। কিন্তু আইনস্টাইনের সমসাময়িক অনুসারীদের কাছে সেটা গ্রহণযোগ্য হয়নি। আপেক্ষিকতার সূত্র বা থিওরি অব রিলেটিভিটি নামটিই সবাই গ্রহণ করেন।

আপেক্ষিকতা কী বলে আর আমরা কী দেখি

অনেক সময় ধাঁধা লাগে। মনে হয় আপেক্ষিকতার সূত্র তো আমাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে খাপ খায় না। যেমন, এই সূত্র অনুযায়ী আলোর গতির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কোনো বস্তু বা কণা এই গতির চেয়ে বেশি গতিতে কখনো চলতে পারে না। কিন্তু কেন না, সেটাই প্রশ্ন। আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা কিন্তু ভিন্ন। ধরা যাক আমি একটি বাসে যাচ্ছি। এর গতি ঘণ্টায় ৪০ মাইল। চলন্ত অবস্থায় আমি বাসের গতির দিকেই বাইরে একটি ঢিল ঘণ্টায় ১০ মাইল বেগে ছুড়ে মারলাম। আমার বন্ধু বাইরে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে ঢিলটি ঘণ্টায় (৪০ ‍+ ১০) = ৫০ মাইল বেগে যাচ্ছে। আমি যদি ঘণ্টায় ২০ মাইল বেগে ঢিলটি ছুড়তাম, তাহলে বন্ধু দেখত, ঢিলটি (৪০ ‍+ ২০) = ৬০ মাইল বেগে যাচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যদি আমি চলন্ত বাসের জানালা দিয়ে একঝলক আলোকরশ্মি ছুড়ে দিই, তাহলে সেই গতি একই থাকবে, বাসের গতি যোগ হবে না। আলোর গতি ঘণ্টায় ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল বেগেই চলবে।

কেন এই ব্যতিক্রম

মূল ব্যাপার হলো, আমার বন্ধু যদি আলোর গতি বেড়ে যেতে দেখে আর, অর্থাৎ দুই অবস্থানের পর্যবেক্ষকদের জন্য আলোর গতি যদি অভিন্ন না হয়, তাহলে ম্যাক্সওয়েলের সূত্র দুই পর্যবেক্ষকের জন্য অভিন্ন থাকবে না। অথচ আপেক্ষিকতার সূত্র ম্যাক্সওয়েলের সূত্রের ভিত্তিতেই গ্রোথিত। প্রকৃতির এই সূত্র ভিন্ন হওয়া সম্ভব নয়। তাহলে তো আপেক্ষিকতার সূত্র ভুল প্রমাণিত হতো। অথচ বিজ্ঞানীরা এর সত্যতা বাস্তব পরীক্ষায় প্রমাণ করেছেন। সুতরাং বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতায় বিজ্ঞানীরা এই ব্যতিক্রম গ্রহণ করে নিয়েছেন।

আলোর চেয়ে বেশি গতি কেন অসম্ভব?

আপেক্ষিকতার সূত্র অনুযায়ী আলোর চেয়ে বেশি গতি অসম্ভব। কিন্তু আসলে এটা অন্যভাবে বুঝতে হবে। ঘটনা হলো, কোনো বস্তুর গতি আলোর গতির যত কাছাকাছি যাবে, ততই মনে হবে সেটা যেন ভারী হয়ে যাচ্ছে। যদি সেই বস্তু আলোর গতির একদম কাছাকাছি চলে যায়, তাহলে সেটা অসীম ভরসম্পন্ন বস্তুর মতোই ভারী হয়ে যাবে। তখন এর চেয়ে আরও বেশি গতি অর্জন করতে হলে অসীম পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হবে, যা অসম্ভব। তাই তাত্ত্বিকভাবেই বলা যায়, কোনো বস্তুর পক্ষে আলোর গতির সমান বা তার চেয়ে বেশি গতি অর্জন সম্ভব নয়।

কোনো কোনো বিজ্ঞানী মনে করেন, আলোর গতির চেয়ে বেশি গতিসম্পন্ন বস্তুকণা থাকতে পারে। তবে এর কোনো প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।

যমজ ভাইদের কাহিনি অবাস্তব নয়

আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্র অনুযায়ী খুব জোরে চলন্ত অবস্থায় ঘড়ির সময় ধীরে চলে। এখন ধরা যাক লিটন ও রিটন দুই যমজ ভাই পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। লিটন রকেটে মহাকাশ ভ্রমণে গেল। রকেটে সে খুব বেশি গতিতে ঘুরে বেড়াল। রিটন থেকে গেল ঢাকায়ই। ১০–১৫ বছর পর লিটন ফিরে এলে দেখবে তার যমজ ভাইয়ের বয়স অনেক বেড়ে গেছে, সেই তুলনায় তার বয়স প্রায় আগের মতোই রয়ে গেছে। এটা কোনো রহস্য নয়। বাস্তবেই এটা হয়।

কেন এ রকম হয়, তা বোঝার জন্য আমরা একটা উদাহরণ দিতে পারি। সময়ের পার্থক্য বোঝার জন্য একটি অ্যাটমিক ক্লক দরকার। ট্রেনের একটি কক্ষের মেঝেতে অ্যাটমিক ক্লকের পাশে একটি ফ্ল্যাশলাইট ও ট্রেনের ছাদে একটি আয়না এমনভাবে রাখি যেন ফ্ল্যাশলাইট জ্বললে তার আলো আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে পাশের অ্যাটমিক ক্লকে ফিরে আসে। আলোকরশ্মি এসে পৌঁছানোমাত্র ঘড়িটি ক্লিক করে একক সময় নির্দেশ করে। এখন ট্রেনটি দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় একবার ফ্ল্যাশলাইট জ্বলে উঠল। আমি বাইরে থেকে দেখব, আলো সঙ্গে সঙ্গে সরল পথে সোজা উঠে ওপরের ছাদে স্থাপিত আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে ফিরে এল এবং অ্যাটমিক ক্লক একবার টিক শব্দে একক সময় নির্দেশ করল। এবার ট্রেনটি দ্রুতগতিতে চলা অবস্থায় আগের মতো আবার ফ্ল্যাশলাইট জ্বালানো হলো। এ অবস্থায় আমি বাইরে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখব, আলোকরশ্মি আগের মতো সরল পথে ওপরে উঠছে না। ট্রেনের গতির দিকে কোনাকুনি বাঁকা পথে উঠে আবার বাঁকা পথে ফিরে এসে অ্যাটমিক ক্লকে পৌঁছাল। ফলে এবার আলোকরশ্মি অ্যাটমিক ক্লকে পৌঁছাতে একটু বেশি সময় নেবে এবং অ্যাটমিক ক্লক ক্লিক করবে একটু দেরিতে। অর্থাৎ চলন্ত অবস্থায় সময় ধীরে চলে।

সময় যে চলন্ত অবস্থায় আসলেই ধীরে চলে সেটা পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে। আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানে একদল বিজ্ঞানী দুটি অ্যাটমিক ক্লক নিয়ে পরীক্ষা চালান। একটি ঘড়ি রাখা হয় অ্যারোপ্লেনে ও আরেকটি এয়ারপোর্টে। পরে দুটি ঘড়ির সময় মিলিয়ে দেখা যায় অ্যারোপ্লেনে রাখা ঘড়ির সময় ধীরে চলেছে।

এখন অবশ্য আরও বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায়। কৃত্রিম উপগ্রহের ঘড়ি পৃথিবীর ঘড়ির চেয়ে ধীরগতিতে চলে। তাই হিসাব ঠিক রাখার জন্য সংশোধন করে নিতে হয়।

লেখক: সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা