আলোয় ভুবন ভরা

মাথায় যদি প্রশ্ন আসে, পুরো মহাবিশ্বে সবচেয়ে বেশি আছে কোন জিনিসটি? তার উত্তরে অনেকেই হয়ত তারাভরা রাতের কথা মনে করে গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ তথা বস্তুকণার কথা বলে বসবেন। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানে অবশ্য তেমনটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রকৃত সত্য হল, বস্তু বা পদার্থ নয়, যদি বলি গোটা মহাবিশ্বটা আলো দিয়ে তৈরি, তাতেও খুব বেশি ভুল হবে না।

আসলে মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে মহাবিশ্বের সৃষ্টি মুহূর্তে মহাবিশ্ব ভরে ছিল আলোর ঝলক আর শক্তি। সেগুলোই একসময় কোয়ার্কসহ অতিপারমাণবিক কণায় পরিণত হয়। কালে কালে গড়ে উঠে আমাদের চেনা মহাবিশ্ব। বিজ্ঞানীদের হিসেবে পুরো মহাবিশ্বটা যেনো আলোয় পরিপূর্ণ। হিসেব কষে দেখা গেছে, প্রতিটি অতিপারমাণবিক কণার বিপরীতে আলোর কণা ফোটনের পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি। আর মহাবিশ্বের পরমাণুর উপাদানসহ সবকিছুর মধ্যে হিসেব করলে দেখা যায়, ৯৯.৯৯ ভাগ জায়গা দখল করে আছে ওই ফোটন। মানে আলোর কণা। কাজেই মহাবিশ্ব যে আলো দিয়ে তৈরি সে কথায় কোন ভুল নেই। আর এখানে শুধু আমাদের চেনা পরিচিত দৃশ্যমান আলোই নয়, আসলে এসব আলোর বেশিরভাগটাই অদৃশ্য। সেগুলো আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না।

মহাবিশ্বে আলো এক বিস্ময়কর অস্তিত্ব। রহস্যময়ও বটে। প্রাচীনকাল থেকে যুগে যুগে আলোর প্রকৃতি ও রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করে গেছেন পণ্ডিতেরা। লিখিত ইতিহাসে আলো সম্পর্কে চিন্তাভাবনার উল্লেখ পাওয়া যায় প্রাচীন গ্রিস ও ভারতে। ভারতের প্রাচীন পণ্ডিতেরা আলো নিয়ে বেশ চিন্তাভাবনা করেছেন। তবে বিজ্ঞানের ইতিহাসে সেগুলো নিয়ে তেমন আলোচনা শোনা যায় না। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে ভিশেশিকা সূত্রে বলা হয়েছে, ‘আলো রঙিন এবং তা অন্যান্য পদার্থকে আলোকিত করে।’ আলোকে তারা একটা পদার্থ হিসেবে বিবেচনা করেছিল। আলো সম্পর্কে আরও কিছু জ্ঞানও অর্জন করেছিল ভারতের পণ্ডিতেরা। ওদিকে সম্ভবত ভুল ক্রমেই গ্রিকরা আলোর মূল দিকটা আবিষ্কার করেছিল। তারা বলেছিল, পর্যবেক্ষক হিসেবে আমাদের কাছে আলোর স্বাধীন অস্তিত্ব নেই। বর্তমানের পদার্থবিজ্ঞান অনুযায়ী, আলো হল চুম্বকীয় ও বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের পরস্পর বিজড়নে গঠিত। চুম্বকীয় বা বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র কোনটাই দেখতে পাই না। তাই সহজাতভাবেই এর মানে, আলো আসলে অদৃশ্য।

আমরা যখন উজ্জ্বল কমলা রঙের সূর্যাস্ত দেখি, তখন সরাসরি প্রকৃত আলো চোখে ধরা পড়ে না। তার বদলে এই বিদ্যুৎচুম্বকীয় পালস বা স্পন্দন থেকে আসা শক্তি আমাদের রেটিনা ও মস্তিষ্কের কোটি কোটি নিউরনকে উদ্দীপ্ত করে, যা জটিল নিউরোলজিকেল কাঠামোকে উত্তেজিত করে। সেটাই আমাদের কমলা রঙ দেখার অনুভূতি যোগায়। ফোটনের মতো এরকম উজ্জ্বলতা ও রঙ বোঝার জন্য এরকম জটিল জৈবিক প্রক্রিয়া অপরিহার্য।

মস্তিষ্কের কাঠামো বা কার্যপ্রণালী সম্পর্কে প্রাচীন গ্রিক বা অন্য কোন সভ্যতার মানুষেরা কিছুই জানতো না। কিন্তু তারপরও ঠিকই বুঝতে পেরেছিল যে আলো এমন এক ধরনের সংবেদন, পর্যবেক্ষক ছাড়া যার স্বাধীন কোন অস্তিত্ব নেই। পাশাপাশি আলো সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণাও ছিল গ্রিকদের। তারা মনে করত, আলো তাৎক্ষণিকভাবে আবির্ভূত হয়। আলোর যে একটা সসীম গতি থাকতে পারে তা তখনও কারও মাথায় আসেনি। আবার গ্রিকদের আরও বড় ধরনের ভুল ধারণা ছিল আলো সম্পর্কে। তারা ভাবত, কোন বস্তুকে দেখার জন্য আমাদের চোখ থেকে আলো ঠিকরে বের হয়। তাই আমরা বস্তুটিকে দেখতে পাই। দীর্ঘদিন সেই ভুল ধারণা আঁকড়ে ছিল গ্রিক পণ্ডিতরা। তবে এ ধরনের ত্রুটি থেকে মুক্ত ছিলেন ভারতীয় পণ্ডিতেরা।

রোমান সভ্যতাতেও সেই ভুল ধারণা ভাঙেনি। তবে রোমানরা আলো সম্পর্কে নতুন একটা কথা বলতে পেরেছিল। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে রোমান পণ্ডিত লুক্রেটিয়াস বললেন, ‘সূর্যের আলো ও তাপ অতিক্ষুদ্র পরমাণু দিয়ে গঠিত।’ এভাবে জন্ম নিল আলোর কণাবাদী তত্ত্ব। অনেক পরে সেই তত্ত্বকে আরও যৌক্তিকভাবে পরিবেশন করেন আইজ্যাক নিউটন।

আলো সম্পর্কে যুগান্তকারী ধারণার জন্ম হয় আরব বিজ্ঞানীদের হাতে। সেই কাজ করেন মধ্যযুগে আরব গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ আল হাজেন। তার পুরো নাম আবু আলী আল হাসান ইবনে আল হাইথাম। ইউরোপে তিনি আল হাজেন নামেই বেশি পরিচিত। মধ্যযুগে ইউরোপ যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানে চরম খরা চলছে তখন ভারত, চীন ও আরবের পণ্ডিতদের হাতে জ্বলছিল আলোর মশাল। ইউরোপের জ্ঞানের এই বন্ধ্যাত্বকে এখন বলা হয় অন্ধকার যুগ। সেটা শুধু ইউরোপের জন্য প্রযোজ্য, বাকী বিশ্বের জন্য নয়। সে যুগকে আরবের জন্য বলা হয় বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ। সেই যুগেই, ১০২০ সালের দিকে মিশরে থাকতেন আল হাজেন। আলো সম্পর্কে গ্রিকদের ভুল ধারণা ভাঙেন এই বিজ্ঞানী। তিনি বললেন, কোন বস্তু থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে পড়লে, সেই বস্তু আমরা দেখতে পাই। আমাদের চোখ থেকে কোন আলো ঠিকরে বের হয় না। মধ্য যুগে সেটাই ছিল যুগান্তকারী এক ভাবনা।

আল হাজেনের তৈরি পিন হোল ক্যামেরাও বেশ নামকরা। এই যন্ত্রের সাহায্য দেয়ালে আলোর খেলা দেখাতেন তিনি। আল হাজেন বললেন, আলো হল অতিক্ষুদ্র, সোজাভাবে চলমান এক ধরনের কণার স্রোত, যা সূর্য থেকে আসে এবং বিভিন্ন বস্তুতে প্রতিফলিত হয়। এ কথাটা এখন আমাদের কাছে জলভাতের মতো। আলোর আধুনিক ধারণার জন্মের প্রায় ৬০০ বছর আগেই এমন কথা বলতে পেরেছিলেন এই আরব বিজ্ঞানী। কিন্তু আলোর চরিত্র সম্পর্কে তখনও অনেক কিছু জানা বাকী ছিল মানুষের।

২.

আলো কী?—তা নিয়ে প্রাচীন ও মধ্যযুগে এই বাইরে পণ্ডিতদের মধ্যে খুব বেশি তর্ক-বির্তক শোনা যায় না। অবশেষে সেই বির্তক দানা বাধে ইউরোপে; রেনেসাঁর কালে। ১৭ শতকের শেষ দিকে আল হাজেন এবং জ্যোতির্বিদ জোহানেস কেপলারের সাথে গলা মিলিয়ে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী নিউটন বললেন, আলো হল কণার স্রোত। সমসাময়িক অন্য বিজ্ঞানীরা বললেন আলো হল তরঙ্গ। তাহলে কার কথা ঠিক?

অন্য পণ্ডিতদের মতো কথায় চিড়ে ভেজানোর লোক ছিলেন না নিউটন। রীতিমত হাতেকলমে প্রমাণ করেও ছাড়লেন ব্যাপারটা। প্লেগের মহামারীতে লন্ডন তখন পর্যুদস্ত। ভয়ংকর এ রোগের ছোয়াচ থেকে বাঁচতে নিজের গ্রামে চলে গেলেন নিউটন। নিজেদের খামারবাড়িতে সেই অবসরে বসে আলো নিয়ে আরও কিছু গবেষণা করলেন। নিউটনই প্রথম বলেন, সূর্যের আলো আসলে সাতটি রঙের মিশ্রণ। প্রিজমের মাধ্যমে সূর্যের আলো চালিয়ে তা প্রমাণ করেও দেখালেন। এ বিষয়ে কারও আর দ্বিমত পোষণ করার কোন উপায় রইল না।

নিউটন যখন আলোর কণা তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছেন, প্রায় একই সময়ে আলোর বিপরীত ধর্মী একটা তত্ত্ব গুছিয়ে আনার কাজ করেছিলেন কিছু গবেষক। এদের মধ্যে ছিলেন সে কালের নামকরা বিজ্ঞানী রবার্ট হুক, ক্রিস্টিয়ান হাইগেনস। এদের সাথে অচিরেই যোগ দেন গণিতবিদ লিওনার্দো অয়েলার। তাদের মতে, আলো হল এক ধরনের তরঙ্গ। তাদের কথার সপক্ষে প্রমাণও হাজির করেন।

তবে তরঙ্গ বললেই আরেকটা সমস্যা হাজির হয়। সমুদ্রের ঢেউ বা শব্দ এগুলোও তরঙ্গ। ঢেউ হল পানির ভেতরের তরঙ্গ, শব্দ হল বাতাসের তরঙ্গ। তাহলে আলো কিসের ভেতর তরঙ্গ? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কিছুটা গলদঘর্ম হলেও এক ধরনের পদার্থের কথা কল্পনা করে নিলেন এই বিজ্ঞানীরা। তারা ধরে নিলেন, গোটা মহাবিশ্ব বিশেষ এক পদার্থে ডুবে আছে। তা অদৃশ্য। সেই পদার্থের ভেতর দিয়ে চলাচল করছে আলো তরঙ্গ। সেই পদার্থের নাম দেওয়া হল প্লিনাম। পরবর্তীতে তার নাম দাঁড়াল ইথার।

নিউটনের কণাবাদী তত্ত্বের সপক্ষে বেশকিছু প্রমাণ জুটেছিল। তার মধ্যে একটা এরকম: সূর্য থেকে আসা আলো যখন কোন বাড়ির দেয়ালের মতো কোন তীক্ষ্ণ কিনারা অতিক্রম করে, তখন তা থেকে পার্শ্ববর্তী কোন বস্তুতে তীক্ষ্ণ ছায়া পড়ে। আলো যদি কণা হয়, তাহলে তা সোজা পথে চলবে। তখনই কেবল এ ধরনের ঘটনা ঘটার কথা। কিন্তু আলোর চরিত্র তরঙ্গধর্মী হলে, তা ছড়িয়ে পড়ার কথা। মানে বিচ্ছুরিত হওয়া উচিত। সাগরের ঢেউ যখন কোন জেটি অতিক্রম করে তখন এমনটি ঘটতে দেখা যায়।

মহাকর্ষ তত্ত্বসহ আরও কিছু কারণে সেকালে নিউটন ছিলেন গোটা ইউরোপে জিনিয়াস বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত। তাই তার মতো বিজ্ঞানীর প্রায় কোন কথাই ফেলনা ছিল না। আবার দেয়ালের ছায়াকে চাক্ষুস প্রমাণ হিসেবেও নেওয়া হল। কাজেই আলোর কণাবাদী তত্ত্বের সমর্থকরা তাই তরঙ্গ তত্ত্বকে পাত্তা না দিয়ে নিউটনের কথাটাই মেনে নিলেন। কয়েক শতাব্দী সেটাই শাসন করল গোটা পদার্থবিজ্ঞান জগত। তবে উনিশ শতকে এসে মুখ থুবড়ে পড়ল নিউটনের কণা তত্ত্ব। প্রাকৃতিক কিছু পরিঘটনার আলোর তরঙ্গ তত্ত্বই হয়ে উঠল প্রধান ব্যাখ্যাকারী। তার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছিল বিদ্যুৎ ও চুম্বক নিয়ে বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের ধারাবাহিক গবেষণা। উনিশ শতকের দিকে বিদ্যুৎ ও চুম্বকের কিছু সেরা আবিষ্কার করে বসেন ফ্যারাডে। অচিরেই তিনি প্রমাণ করেন, একটা তারের বলয়ের মধ্যে একটা চুম্বকে ঘোরালে ওই তারে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে। সেটা ছিল বিস্ময়কর আর গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ। কারণ বিদ্যুৎ ও চুম্বকের মধ্যে কোন সম্পর্কের কথা এর আগে একদম অজানা ছিল। আবার এর বিপরীতটাও দেখানো সম্ভব। অর্থাৎ একটা চলমান বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রও চুম্বক শক্তি তৈরি করতে পারে। এভাবে ফ্যারাডে একসময় বুঝতে পারেন, এই দুটো পরিঘটনা আসলে একই মূদ্রার এপিঠ ওপিঠ। এই সরল পর্যবেক্ষণটা সূচনা করল বৈদ্যুতিক যুগ।

ফ্যারাডে ছিলেন গরীব ঘরের সন্তান। ছোটবেলায় সংসারের দায়িত্ব ঘাড়ে চাপায় পড়ালেখাো তেমন করতে পারেননি। কাজ করতেন বইবাঁধানোর একটা দোকানে। তাই তার কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। ছিল না কোন গাণিতিক দক্ষতাও। তাই নিজের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটা গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারলেন না তিনি। তার বদলে নিজের নোটবুকের পাতায় পাতায় আঁকিবুকি করলেন অদ্ভুত সব ডায়াগ্রাম। সেগুলোতে বলের রেখা দেখালেন, যেটা দেখতে এক গুচ্ছ রেখার জালের মতো। আসলে একটা চুম্বকের চারপাশে লোহার গুড়ো যেভাবে অবস্থান নেয়, ওই রেখাগুলোও ছিল তেমনি। এভাবে ক্ষেত্র বা ফিল্ডের ধারণা আবিষ্কার করেন ফ্যারাডে।

ফ্যারাডের এই ক্ষেত্রকে গণিতের ভাষায় প্রকাশ করতে এগিয়ে এলেন জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। ১৮৬৫ সালে মাইকেল ফ্যারাডের বিদ্যুৎ ও চুম্বকীয় বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ গাণিতিক সমীকরণে প্রকাশ করেন তিনি। ম্যাক্সওয়েল ছিলেন গণিতে পণ্ডিত। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানে বিস্ময়কর সফলতার জন্ম দেন তিনি। ম্যাক্সওয়েল বুঝতে পেরেছিলেন, ফ্যারাডে ও অন্য বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত বিদ্যুৎ ও চুম্বকত্বের আচরণকে গাণিতিক ভাষায় নিখুঁতভাবে সংক্ষিপ্ত করা সম্ভব। তার একটা সূত্র মতে, একটা চলমান চুম্বকীয় ক্ষেত্র একটা বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। আরেকটি সূত্র ঠিক উল্টো কথা বলে। এ সূত্রটি মতে, চলমান বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র একটা চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করবে।

এরপর ম্যাক্সওয়েলের মাথায় এমন একটা ধারণা এলো, যা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি ভাবলেন, পরিবর্তনশীল বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র যদি একটা চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে, এরপর সেটি যদি আরেকটি বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি করে, এরপর সেটি যদি আরেকটি চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে, এভাবে চলতেই থাকলে কী ঘটবে? মেধাবী অন্তর্দৃষ্টির মানুষ ম্যাক্সওয়েল অচিরেই বুঝতে পারলেন, এই দ্রুত পরিবর্তনশীল গতির সর্বশেষ ফলাফল হবে একটা চলমান তরঙ্গ। সেখানে বৈদ্যুতিক ও চুম্বকীয় ক্ষেত্রগুলো অনবরত একটা আরেকটায় বদলে যেতে থাকবে। রূপান্তরের এই অসীম পর্যায়ক্রমের নিজস্ব একটা জীবনও রয়েছে, যা কম্পনশীল বৈদ্যুতিক ও চুম্বকীয় ক্ষেত্রের চলমান তরঙ্গ তৈরি করে। সমীকরণ থেকে তিনি চরম বিস্ময়ের সাথে দেখতে পান, আলো আসলে এক ধরনের বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ বা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ। সেই থেকে বিজ্ঞান জগতে আলোর পরিচতি পেল বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় পরিঘটনা হিসেবে।

সব আলোই আসলে দ্বৈত তরঙ্গ থাকে। একটা চুম্বকীয় স্পন্দন এবং তার সাথে সমকোণে থাকে একটা বৈদ্যুতিক স্পন্দন। একটা স্পন্দন আরেকটাকে উদ্দীপিত করে। সে কারণেই বৈদ্যুতিক ও চুম্বকীয় তরঙ্গ দুটোই অনিদিষ্টকালের জন্য চলতেই থাকে।

প্রতিটি আলোতে থাকে দ্বৈত তরঙ্গ। একটা চুম্বকীয় স্পন্দনের সাথে থাকে একটা বৈদ্যুতিক স্পন্দন, যারা পরস্পর সমকোণে অবস্থিত।

৩.

কিন্তু এই পরিঘটনার উৎস কোথায়? ১৮৯৬ সালে ডাচ পদার্থবিদ হেনড্রিক লরেঞ্জ এক পরীক্ষায় একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করলেন। কোন শক্তিশালী চুম্বকীয় ক্ষেত্রের মধ্যে আলো নিজেই দুইভাগ হয়ে যাচ্ছে। লরেঞ্জ ভাবলেন, এর মানে হল, সেখানে দ্রুত গতি সম্পন্ন কোন অতিক্ষুদ্র, এবং ঋণাত্মক চার্জের কণা রয়েছে। আর সেই অজানা কণাটাই এমন ঘটনার জন্য দায়ী। অর্থাৎ এই কণাই মহাবিশ্বের সব আলোর উৎস। এর বছরখানেক পরে এক পরীক্ষায় সেই কণাটি আবিষ্কার করেন জে জে টমসন। কণাটির নাম দেওয়া হল ইলেকট্রন। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেল, ইলেকট্রন চলাফেরার কারণে আসলেই আলো তৈরি হচ্ছে। এভাবে লরেঞ্জের কথাই সত্যি প্রমাণিত হল। ইলেকট্রনের প্রকৃত আবিষ্কারের আগেই তার অস্তিত্ব অনুমানের কারণে ১৯০২ সালে নোবেল পুরস্কার পান তিনি। আর ইলেকট্রন আবিষ্কারের জন্য টমসন নোবেল পুরস্কার পান ১৯০৬ সালে।

তখন আরেকটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি: আলো সৃষ্টি হয় কীভাবে? কোনো পরমাণু যখন শক্তির সংস্পর্শে আসে (যেমন কোন বৈদ্যুতিক শক্তির ধাক্কা বা বিচ্যুত কোনো ইলেকট্রনের সাথে সংঘর্ষ বা তাপ শক্তির সংস্পর্শ), তখন তা প্রবলভাবে আন্দোলিত হতে থাকে। এই বাড়তি শক্তি পরমাণুর ইলেকট্রনগুলোকে উত্তেজিত করে। এতে ইলেকট্রন লাফ দিয়ে পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে দূরের কক্ষপথে চলে যায়। কিন্তু তাদের তো এখানে থাকার কথা নয়। তাই ভগ্নাংশ সময়ের মধ্যে তারা আবারও নিউক্লিয়াসের কাছে চলে যায়, অর্থাৎ ছোট কক্ষপথে। সেটি করতে গিয়ে ইলেকট্রনগুলো কিছু শক্তি নিঃসৃত করতে বাধ্য হয়। কিন্ত কোনো অবস্থাতেই তাদের ওই বাড়তি শক্তি হারিয়ে যেতে পারে না, কোনো না কোনোভাবে শক্তি নিজেকে প্রকাশ করবেই। তাই সেই শক্তিটা যেনো শূন্য থেকে ম্যাজিকের মতো আলোয় পরিণত হয়। সেই আলোই তাৎক্ষণিকভাবে হুড়োহুড়ি করে বাইরে বেরিয়ে আসে তার নিজস্ব বিখ্যাত গতিতে (সেকেন্ডে প্রায় এক লাখ ৮৬ হাজার মাইল)। আসলে একমাত্র এভাবেই আলো জন্ম নিতে পারে। পরমাণুর কেন্দ্রের দিকে ইলেকট্রন গেলে আপাতদৃষ্টিতে শূন্য থেকে আলো বেরিয়ে আসে।

কাজেই আলোকে দুটি তরঙ্গের সেট হিসেবে ভাবা যায়। একটা বৈদ্যুতিক তরঙ্গ এবং আরেকটা চুম্বকীয় তরঙ্গ। আবার একে ভরহীন কণা হিসেবেও ভাবা যায়, যার নাম ফোটন। আলোকে ফোটন কণা হিসেবে ভাবার পেছনে রয়েছে কোয়ান্টাম তত্ত্বের অবদান। ১৯০০ সালে চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের খোলস ভেঙে তত্ত্বটার জন্ম দিয়েছিলেন জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের অমীমাংসিত একটা সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে তিনি বললেন, শক্তি নিঃসৃত হয় নিরবিচ্ছিন্ন নয়, বরং তা নিঃসৃত হয় গুচ্ছ গুচ্ছ প্যাকেটের মতো। যাকে বলে কোয়ান্টা। এই ধারণা কাজে লাগিয়ে ১৯০৫ সালে আলোকতড়িৎ ক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন আলবার্ট আইনস্টাইন। এটাও অনেকদিন ধরে অমীমাংসিত এক রহস্য ছিল বিজ্ঞানীদের কাছে। আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব দিয়ে যাকে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহার করে আইনস্টাইন দেখালেন, আলোকে যদি তরঙ্গ হিসেবে না ভেবে, গুচ্ছ গুচ্ছ কণা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে সমস্যাটা খুব সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। পরবর্তীতে আলোর সেই কণার নাম দেওয়া হয় ফোটন।

এভাবে বিজ্ঞানীরা এক সময় দেখতে পান, আলোর কিছু পরিঘটনা তরঙ্গ তত্ত্ব দিয়ে খুব ভালো মতো ব্যাখ্যা করা যায়। আবার কিছু পরিঘটনা ব্যাখ্যার জন্য কণা তত্ত্ব অপরিহার্য। তাহলে আলোর চরিত্র আসলে কী? আলো কি চরিত্রহীন? তা কি কণা, নাকি তরঙ্গ। অনেক তর্কবিতর্কের পর পদার্থবিদরা একসময় স্বীকার করতে বাধ্য হলেন, আলো দুটো চরিত্রের, অর্থাৎ একই সাথে কণা এবং তরঙ্গ।

বিশ শতকের কোয়ান্টাম তত্ত্বের মাধ্যমে আরও চমকপ্রদ কিছু ব্যাপার আবিষ্কৃত হল। দেখা গেল, ইলেকট্রনের মতো দৃঢ় বস্তুও শক্তি তরঙ্গের মতো আচরণ করতে পারে। ব্যাপারটা উদ্ভট সন্দেহ নেই, কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এটাই নিশ্চিত হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ফোটন বা ইলেকট্রনের মতো কোন অতিপারমাণবিক কণার অবস্থান নির্ধারণ করতে বিজ্ঞানীরা যখন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেন, তখন দেখা যায় তারা কণার মতো আচরণ করছে। কণারা যেমন একইসঙ্গে একটা ছিদ্র দিয়ে যাতায়াত করতে পারে, একইসাথে দুটো ছিদ্র দিয়ে যেতে পারে না, ফোটন ও ইলেকট্রনও ঠিক তেমনই আচরণ করে। কিন্তু ফোটনদের নিদিষ্ট অবস্থান মাপা হয় না, তখন তাদের তরঙ্গের মতো আচরণ করতে দেখা যায়। সে সময় ডাবল স্লিট বা দ্বিচির পরীক্ষায় পাশাপাশি দুটো ছিদ্র দিয়ে ফোটনদের চলাচল করতে দেখা যায় এবং ছিদ্রের উল্টো পাশের দেয়ালে তারা একটা ব্যতিচার নকশা তৈরি করে। একমাত্র তরঙ্গের ক্ষেত্রেই কাজটা করা সম্ভব।

কাজেই এসব দেখে মনে হয়, আলোর অস্তিত্ব তরঙ্গ হিসেবে নাকি কণা হিসেবে পাওয়া যাবে, তার অনেকটাই নির্ভর করে পর্যবেক্ষকের মনের ওপর। বস্তুকণার ক্ষেত্রেও কথাটা সত্য। আপনি যা দেখছেন, তা নির্ভর করে, কীভাবে দেখছেন এবং কী জানেন, তার ওপর। বেশিরভাগ পদার্থবিদ এখন মনে করেন, কোন ফোটন বা ইলেকট্রনের ওয়েভ ফাংশন ধসে যাওয়ার জন্য মানুষের চেতনা অপরিহার্য, যাতে তা কণা হিসেবে একটা নিদিষ্ট অবস্থান দখল করতে পারে। তা না হলে, সেটা কেবলই তাত্ত্বিক বস্তু, যার কোন অবস্থান বা গতি নেই।

এক শ বছর আগেও সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে আমরা বুঝতাম, পরমাণু ও ফোটনসহ সকল বস্তুর অস্তিত্ব একদম স্বাধীন, আমাদের পর্যবেক্ষণের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু আধুনিক ধারণা আগের সেই চিন্তাভাবনা পাল্টে দিয়েছে। এখন আমরা জানি, ফোটন বা ইলেট্রনের অস্তিত্বের জন্য আমাদের পর্যবেক্ষণ করা একান্ত জরুরি। কেমন ভুতুড়ে ব্যাপার-স্যাপার!

এর ফলে নতুন কিছু ভুতুড়ে প্রশ্নও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পদার্থবিজ্ঞান জগতে। কোন বিড়াল যদি কোন ইলেকট্রন পর্যবেক্ষণ করে, তাহলে কি তার ওয়েভ ফাংশন কলাপস করে বা ধসে যায়? তারপর ইলেকট্রনটা বাস্তব কণায় পরিণত হয়? মানুষ যদি না থাকত, তাহলে কি ফোটন সবসময় তরঙ্গের মতো আচরণ করতো? কখনও বিচ্ছিন্ন কণার মতো আচরণ করতো না? উত্তর হল, আমরা জানি না। কিংবা ‘হ্যাঁ’-ও বটে। কিন্তু সেটা যে বিস্ময়কর ব্যাপার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এই উদ্ভট ব্যাপারটাকে আরেকটু পরিষ্কার করা যাক। এক শতাব্দী আগে আমরা যদি সনাক্ত করতাম যে সামান্য কিছু আলো (কিংবা কোন ভৌত কণা) একটা যন্ত্রে এসে পৌঁছেছে, যার মাধ্যমে তার আসার দিক বা গতিপথ মাপা সম্ভব, তাহলে আত্মবিশ্বাসের সাথে তার নিশ্চিত পথ নির্ধারণ করতাম। কিন্তু এখন তা ভাবার আর জো নেই। বর্তমানে আমরা শুধু একটু বলতে পারি, আমরা পর্যবেক্ষণ করার আগ পর্যন্ত ওই আলোর কোন দিক বা গতিপথ ছিল না। সত্যিকার ফোটন বা ইলেকট্রন বা অন্য কিছু হিসেবে তার কোন অস্তিত্ব ছিল না। বরং তার পর্যবেক্ষণকৃত অস্তিত্বই একমাত্র অস্তিত্ব। পর্যবেক্ষণের কারণেই বাস্তবতা মূর্ত হয়। কোন কিছুই আসলে নিদিষ্ট নয়। পদার্থবিদ জন হুইলার একবার বলেছিলেন, ‘কোনো ঘটনা যতক্ষণ না পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে, ততক্ষণ সেটা বাস্তব কোনো ঘটনা নয়।’

তাই আলোর রহস্য ভাঙতে গিয়ে আমরা এখন আরও গভীর রহস্যের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছি। সেটা উদঘাটনের জন্যই এখনও কাজ করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। দেখা যাক, সে রহস্যে আলো ফেলা যায় কিনা।

সূত্র:

দ্য গড ইকুয়েশন/ মিচিও কাকু

জ্যাপড/ বব বারম্যান

লাইট/ ব্রুস ওয়াটসন

উইকিপিডিয়া