দোলক এবং দোলনগতি কী

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি প্রতীকী ছবি

যা কিছু দোলে, তা–ই দোলক, যেমন দোলনা। দোলকের মজার কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। যার একটি হলো, একটি দোলক একটি বিন্দুকে বারবার অতিক্রম করে, একবার ডান দিক থেকে বাঁ দিকে, আরেকবার বাঁ দিক থেকে ডান দিকে; এই ধরনের গতিকে দোলনগতি বলে। পরপর দুবার একই দিক থেকে একটি নির্দিষ্ট বিন্দুকে অতিক্রম করার সময়কে দোলনকাল বলে। প্রতিটি দোলকের একটি নির্দিষ্ট দোলনকাল থাকে। এখন আমরা আলোচনা করব বিশেষ একটি দোলক নিয়ে। এই বিশেষ দোলক আর কিছু নয়, এটি একটি পাকবিহীন সুতার মাথায় ছোট্ট একটি ভারী বল। একে শক্ত একটি অবলম্বন থেকে ঝুলিয়ে খুব অল্প পরিসরে ভারী বলকে দুলতে দিই। বিশেষ শর্তে দেখা যায় যে এর দোলনকাল নির্ভর করে শুধু দোলকের দৈর্ঘ্য ও পৃথিবীর অভিকর্ষজ ত্বরণের ওপর, এখানে হলো দোলকের দোলনকাল, হলো দোলকের দৈর্ঘ্য এবং হলো সেই স্থানের (যে স্থানে দোলক দুলছে) পৃথিবীর অভিকর্ষজ ত্বরণ।

বিষয়টি সত্যিই ভাবার মতো, সুতার মাথায় ভারী বল না থাকলে সুতা দুলবে না। অথচ দোলকের দোলনকালে এই ভরের কোনো ভূমিকা নেই। বলটির কাজ হলো পৃথিবীর অভিকর্ষ বল অনুভব করা, যার জন্য সুতা দোল খায়। দোলনকাল পৃথিবীর অভিকর্ষজ ত্বরণের ওপর নির্ভর করে, যা কিনা পুরো পৃথিবীর একটি বৈশিষ্ট্য। আমরা চাইলেই খুব সহজেই এ রকম একটি দোলক তৈরি করতে পারি এবং দোলনকাল মেপে মেপে পৃথিবীর প্রতিটি স্থানের অভিকর্ষজ ত্বরণ বের করতে পারি। শুধু কি তা–ই, আমরা একটি দোলকের দোলনকাল থেকে পৃথিবীর ভরও মাপতে পারি, যদি পৃথিবীর ব্যাসার্ধ জানা থাকে। আসলে আমরা দোলকের দোলনকাল মেপে (কল্পনা করলেই চলবে) পৃথিবীর ব্যাসার্ধ এবং পৃথিবীর ভর দুটোই মাপতে পারি। ব্যাপারটা খুবই সহজ। দোলকের দোলনকাল প্রথমে পৃথিবীর পৃষ্ঠে মাপব, তারপর খাড়া ওপরের দিকে উঠতে থাকব। ঠিক যে উচ্চতায় দোলনকাল পৃথিবীপৃষ্ঠের দোলনকালের একেবারে দ্বিগুণ হবে, সে উচ্চতাই হলো পৃথিবীর ব্যাসার্ধ। তারপর বসে কয়েক সেকেন্ড হিসাব করলেই পৃথিবীর ভর পাওয়া যাবে, আস্ত পৃথিবীর ভর (হিসাব নিজের জন্য)। সুতার মাথায় সামান্য একটি ভর বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়েই পৃথিবীর মতো এত বৃহৎ একটি বস্তুর ভর মাপতে পারা চাট্টিখানি কথা নয়, যেখানে আমরা পৃথিবীর খুব ছোট্ট একটি অংশকেই একসঙ্গে দেখতে পাই। তার মানে, সাধারণের মধ্যেই দোলক একটি অসাধারণ বিষয়।

দোলনগতির অন্য একটি বিষয় হলো পটেনশিয়াল। সাধারণত দোলনগতির পটেনশিয়ালকে দ্বারা প্রকাশ করা হয় এবং একে হারমোনিক পটেনশিয়াল বলা হয়।

আমরা বাস্তবে যা দেখি, একটি দোলককে দোল দিয়ে ছেড়ে দিলে কিছুক্ষণ পরেই দোলকটি থেমে যায়। এর কারণ হলো দোলকের ওপর বাতাসসহ অন্যান্য কিছুর বাধা, যা এখানে আলোচনা করা হয়নি এবং এখানে শুধু একমাত্রিক দোলকের কথাই আলোচনা করা হয়েছে।

দোলনগতির আরও একটি উদাহরণ হলো স্প্রিংয়ের সঙ্গে লাগানো একটি ভর; একটি স্প্রিংয়ের এক মাথা শক্ত অবলম্বন থেকে ঝুলিয়ে অন্য মাথায় একটি ভর থাকবে। এবার ভরকে টেনে ছেড়ে দিলেই ভর ওপরে–নিচে দোল খাবে। বিশেষ শর্তে স্প্রিংয়ের মাথায় ভরের যে দোলনকাল, তা নির্ভর করবে শুধু বস্তুর ভর এবং স্প্রিংয়ের একটি বৈশিষ্ট্যের ওপর, যাকে স্প্রিং কনস্টেন্ট বলে। স্প্রিংয়ের মাথার ভর বা দোলকের যে দোলনগতি, এর মূলে হলো হুকের সূত্র—বস্তুর ওপর রেস্টোরিং বল একটি নির্দিষ্ট বিন্দু থেকে সরণের সমানুপাতিক এবং বিপরীতমুখী, অর্থাৎ যখনই ত্বরণ সরণের সমানুপাতিক এবং বিপরীতমুখী হবে, তখনই দোলনগতি পাওয়া যাবে। এই ধরনের গতিকে (অবস্থান, গতি ও ত্বরণ) ত্রিকোণমিতির সাইন বা কোসাইন ফাংশন দিয়ে প্রকাশ করা যায়।

দোলনগতির অন্য একটি বিষয় হলো পটেনশিয়াল। সাধারণত দোলনগতির পটেনশিয়ালকে দ্বারা প্রকাশ করা হয় এবং একে হারমোনিক পটেনশিয়াল বলা হয়। এই পটেনশিয়াল থেকেই হুকের সূত্র পাওয়া যায়, কারণ পটেনশিয়াল ও বলের মাঝে একটি সম্পর্ক আছে। এই ধরনের পটেনশিয়াল যদি কোথাও থাকে, তাহলে স্থির অবস্থায় একটি বস্তুকে ছেড়ে দিলে যেকোনো বিন্দু থেকে পটেনশিয়ালের মূল বিন্দুতে যেতে একই সময় লাগবে। এর মানে হলো, বস্তুর অবস্থান মূল বিন্দু থেকে যত কাছেই বা দূরে থাকুক না কেন, বস্তুটি স্থির অবস্থা থেকে ছেড়ে দিলে মূল বিন্দুতে পৌঁছাতে একই সময় লাগবে, যা আসলে দোলনকালের চার ভাগের এক ভাগ (হিসাব নিজের জন্য)। বিষয়টা খুবই অদ্ভুত, ধরে নিই এ রকম একটি পটেনশিয়াল ঢাকায় আছে, যার মূল বিন্দু হলো গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট। আরও ধরে নিই, এই পটেনশিয়াল প্রত্যেক মানুষের ওপর কাজ করে এবং ঢাকা পুরোপুরি সমতল এবং কোনো ঘর্ষণ নেই। তাহলে একটি লাইন বরাবর যেকোনো জায়গার যেকোনো মানুষ স্থির অবস্থা থেকে যাত্রা শুরু করলে বলের প্রভাবে একই সময়ে জিরো পয়েন্টে চলে আসবে; কারণ হলো যে যত দূরে থাকবে, তার ওপর তত বেশি ত্বরণ কাজ করবে, আর যে যত কাছে থাকবে, তার ওপর তত কম ত্বরণ কাজ করবে।

হারমোনিক পটেনশিয়াল সমস্যার সমাধান করা যায় বলেই আমরা নানা উপায়ে এর সমাধান করে থাকি। স্কুল থেকে শুরু করে পিএইচডি লেভেলেও এই হারমোনিক পটেনশিয়াল সমস্যার সমাধান বের করতে হয়।

কোয়ান্টাম মেকানিকসেও দোলনগতির সমাধান করা যায়। বিজ্ঞানের অল্প কিছু সমস্যার মধ্যে হারমোনিক পটেনশিয়াল একটি, যার যথাযথ সমাধান আছে। অর্থাৎ এই হারমোনিক পটেনশিয়ালের মাঝে একটি ছোট বস্তু (কোয়ান্টাম মেকানিক্যালি ছোট, যেমন একটি অ্যাটম) রেখে দিলে বস্তুর বর্ণনাকারী একটি ফাংশন পাওয়া যাবে, এগুলোকে একত্রে আইগেন ফাংশন বলে। যে ফাংশন থেকে বস্তুর অবস্থান, গতিশক্তি, পটেনশিয়াল এনার্জি, নানা কিছু বের করা যায়। সবচেয়ে মজার হলো, একটি বস্তু যখন হারমোনিক পটেনশিয়ালে থাকবে ও শুধু নির্দিষ্ট কিছু এনার্জিতে থাকতে পারবে, এটাই কোয়ান্টাম মেকানিকসের কথা। একটি বস্তুকে যখনই কোনো পটেনশিয়ালে রাখা হবে, তখনই ওর বিশেষ কিছু এনার্জি থাকবে, এটা মূলত নির্ভর করে পটেনশিয়ালের ওপর। অথচ মুক্ত অবস্থায় একটি বস্তুর যেকোনো পরিমাণ এনার্জি থাকতে পারে।

হারমোনিক পটেনশিয়ালে থাকা একটি বস্তুর সবচেয়ে কম এনার্জি হলো, এখানে এনার্জির একক হলো (এখানে, হলো প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক, এবং বস্তুর ভর)। পরের এনার্জিগুলো এক একক করে বাড়তে থাকবে। আরও একটি বিষয় হলো, সবচেয়ে কম এনার্জির আইগেন ফাংশনটি মূল বিন্দুর সাপেক্ষে প্রতিসম এবং পরেরটা অপ্রতিসম, তার পরেরটা আবার প্রতিসম, এভাবেই চলতে থাকবে এবং একটি হারমোনিক পটেনশিয়ালে অসংখ্য আইগেন ফাংশন আছে। প্রতিটি আইগেন ফাংশনের ক্ষেত্রে বস্তুর গড় গতিশক্তির পরিমাণ আর গড় স্থিতি শক্তির পরিমাণ সমান, যা কিনা মোট শক্তির অর্ধেক; হারমোনিক পটেনশিয়ালে থাকলে একটি বস্তুর শুধু গতিশক্তি আর স্থিতিশক্তিই সম্ভব।

হারমোনিক পটেনশিয়াল সমস্যার সমাধান করা যায় বলেই আমরা নানা উপায়ে এর সমাধান করে থাকি। স্কুল থেকে শুরু করে পিএইচডি লেভেলেও এই হারমোনিক পটেনশিয়াল সমস্যার সমাধান বের করতে হয়। এখন একটি প্রশ্ন করে রাখি, উত্তরটা নিজেদের বের করতে হবে। প্রশ্নটা হলো, বাস্তবে এই হারমোনিক পটেনশিয়াল কি কোথাও আছে? যদি হারমোনিক পটেনশিয়াল থাকে, তাহলে কোথায় আছে, আর যদি না থাকে, তাহলে হারমোনিক পটেনশিয়ালের সমাধানই বা করি কেন!

দোলন আছে গাছের পাতার দোলনে, গাছের ডালে, ইলেকট্রিক সার্কিটে, মলিকুলের ভেতর অ্যাটমে, ক্রিস্টালে, অর্থাৎ আমাদের চারদিকেই শুধু দোলক আর দোলনগতি।

দোলনগতির সঙ্গে যুক্ত আরও একটি মজার বিষয় হলো রেজোন্যান্স বা অনুরণন! একটি দোলককে অল্প পরিসরে দুলিয়ে ছেড়ে দিলে দোলক যে দোলনকালে দোলে, তাকে ন্যাচারাল বা স্বাভাবিক দোলনকাল বলে। চাইলেই একটি দোলককে যেকোনো দোলনকালে দোলানো সম্ভব (একটি দোলককে হাত দিয়ে ধরে দ্রুত বা আস্তে দোলানো যায়), এর জন্য বাইরে থেকে কাউকে দোল দিতে হবে, বাইরে থেকে যে দোল দেওয়া হচ্ছে, তার দোলনকালকে আরোপিত দোলনকাল বলে। যখন স্বাভাবিক দোলনকাল আর আরোপিত দোলনকাল দুটো সমান হয়, তখন বাইরে থেকে শক্তি সংগ্রহ করে দোলনের পরিসর আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে, যে দোলাচ্ছে তার থেকেই শক্তি সংগ্রহ করা হয়। একেই রেজোন্যান্স বা অনুরণন বলে। ঝুলন্ত সেতু, বিল্ডিং, এগুলোও দোলকের মতো কাজ করে, তবে এদের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বিশেষ দোলনকাল থাকে। এবং এদের দোলাতে অনেক শক্তির প্রয়োজন পড়ে। যখন বাইরে থেকে স্বাভাবিক দোলনকালের সমান দোলনে দোল দেওয়া হয়, তখন এরা বাইরে থেকে শক্তি নিতে থাকে। বেশি শক্তি নিতে নিতে একসময় ভেঙেও পড়ে যেতে পাড়ে। ভূমিকম্পের সময় বিল্ডিংও এভাবে ভেঙে পড়তে পারে। একইভাবে ঝড়ে ঝুলন্ত সেতু এ কারণেই ভেঙে পড়তে পারে।

আমাদের চারপাশে দোলক আর দোলনগতির অভাব নেই। দোলন আছে গাছের পাতার দোলনে, গাছের ডালে, ইলেকট্রিক সার্কিটে, মলিকুলের ভেতর অ্যাটমে, ক্রিস্টালে, অর্থাৎ আমাদের চারদিকেই শুধু দোলক আর দোলনগতি। দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবলে, আমাদের জীবনটাও যেন বিশেষ একটি দোলক, যেখানে আছে অনেক অনেক রেজোন্যান্স, এর বাইরে আর কিছু নয়; দোলা আর দোলানোই যেন আমাদের জীবনের একমাত্র কাজ!

লেখক: অধ্যাপক, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত