রিঅ্যাক্টরের ইতিকথা
অদৃশ্য শক্তি
পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয় নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটর। এতে নিউক্লিয়ার ফিশন প্রক্রিয়ায় প্রচুর তাপশক্তি উৎপন্ন হয়, যা পরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। রিঅ্যাকটর কী, কীভাবে কাজ করে তা ছোটদের জন্য খুব সুন্দরভাবে উঠে এসেছে রিঅ্যাকটরের ইতিকথা বইয়ে। আলেক্সেই ক্রিলোভের লেখা এই বই বাংলায় অনুবাদ করেছেন বিজয় পাল। মস্কোর ‘রাদুগা’ প্রকাশন থেকে বইটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৪ সালে। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি প্রকাশিত হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে…
তুমি দেখেছ, কীভাবে বাড়ি তৈরি করা হয়? ইট কিংবা কংক্রিটের প্লেট নিয়ে তা ওপরে তোলা হয় এবং ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে উপযুক্ত জায়গায় বসিয়ে দেওয়া হয়।
খোদ ইট এবং বাড়ি গড়ে মানুষ। তাদের সাহায্য করে বিভিন্ন ধরনের মেশিন: কংক্রিট-মেশানো যন্ত্র, ট্র্যান্সপোর্টার, ক্রেন, মোটর গাড়ি...
মানুষ এবং মেশিন যাতে কাজ করতে পারে—মাল টানতে, তুলতে, ঠেলতে ও ঘোরাতে ফেরাতে পারে—তার জন্য চাই শক্তি, অনেক শক্তি।
মানুষ শক্তি পায় কোথা থেকে? তা অবশ্য তুমি ছেলেবেলা থেকেই জানো। মা-বাবা, দাদা-দিদিমা হয়তো অনেক বারই তোমায় বলেছেন, ‘না খেলে গায়ে জোর হবে কী করে?’ আর এটা খুবই খাঁটি কথা। মানুষ শক্তি পায় খাদ্যের সঙ্গে। প্রসঙ্গত, খাদ্যের সঙ্গেই সে পায় ‘ইট’, ‘নির্মাণ সামগ্রী’, যা দিয়ে সে গঠিত।
তা মেশিনগুলো শক্তি পায় কোথা থেকে? তারা কী ‘খেয়ে বাঁচে’? মেশিনের খাদ্য হচ্ছে: তেল, গ্যাস, পেট্রল, পাথুরে কয়লা, পাঁট, কেরোসিন, বিজলী...
‘আরে দাঁড়ান, দাঁড়ান’—বলবে তুমি, ‘একটি সুস্বাদু কাটলেট কিংবা এক গ্লাস দুধ এবং এক পিপে কালো তেল অথবা যা কেউ কখনো চোখেও দেখেনি সেই বিজলীর মধ্যে মিলটা কোথায়?’ আপাতদৃষ্টিতে কোথাও মিল নেই। তবে একটু ভেবে দেখলে, মিল আছে অনেক জায়গায়।
কাটলেট, দুধ, মাখন লাগানো রুটি, পেট্রল, গ্যাস, বিদ্যুৎ প্রবাহ—এ সবকিছু শক্তি জোগায়।
এই অদৃশ্য শক্তি প্রয়োজন সবার এবং সর্বত্র। তা প্রয়োজন রেল ইঞ্জিন গড়ে ওটাকে জায়গা থেকে সরানোর জন্য, শার্ট ও ব্যাগ সেলাইয়ের জন্য, রকেটকে উড়তে বাধ্য করার জন্য এবং বই পড়ার জন্য। শক্তি প্রয়োজন যাতে শিরায় শিরায় রক্ত বইতে পারে, যাতে পেশি শক্তিশালী হয়, যাতে মস্তিষ্ক ভালো কাজ করে...
...আমাদের দূর পূর্বপুরুষদের কত কষ্টই না করতে হয়েছে। তাদের ঘিরে ছিল অজ্ঞাত ও শত্রুভাবাপন্ন এক পৃথিবী। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ, ঠান্ডা, বন্য জন্তুজানোয়ার—এক কথায় বিপদ ছিল পদে পদে। এই সব শক্তিধর প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে সংগ্রামে আদিম মানুষকে ভরসা করতে হতো কেবল নিজস্ব শক্তির ওপর।
তবে তাদের সহায় ছিল কেবল নিপুণ হাত আর চটপটে পা-ই নয়। হিংস্র জন্তুজানোয়ারেরাও দ্রুত বেগে ছুটতে পারত। মানুষের প্রধান অস্ত্র ছিল তার তীক্ষ্ম বুদ্ধি।
...বজ্রাঘাতে গাছে আগুন লাগল। বাতাস স্ফুলিঙ্গ উড়িয়ে নিয়ে গেল। তা থেকে আগুন ধরল পাশের গাছটিতে। জ্বলতে লাগল ঝোপঝাড়। ঘাসের ওপর দিয়ে রক্তবর্ণ আগুন ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।
দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল বন। বন থেকে পালাতে লাগল ভীতসন্ত্রস্ত জন্তুজানোয়ারেরা। দূর আকাশে উঠে গেল পাখিরা। কেবল চামড়া পরা গাট্টাগোট্টা একদল লোকই দাঁড়িয়ে থাকে বনপ্রান্তে। ভয়ে তারা অগ্নিকাণ্ডের স্থান থেকে দূরে সরে যায়। কিন্তু তারা জানে আগুন শিগগিরই নিভে যাবে। আর ক্ষিপ্ত আগুনের লেলিহান শিখার পরিবর্তে থেকে যাবে জ্বলন্ত সোনালি কয়লার স্তূপ, ওই স্তূপগুলোর কাছে কনকনে শীতের রাতে মিলবে তাপ। আর ছাইয়ের নিচে খুঁজে পাওয়া যাবে পোড়া ও নরম আহারযোগ্য শিকড়...
তারপর কেউ একজন আগুন থেকে কিছুটা কয়লা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল স্তূপীকৃত শুষ্ক ঘাসের ওপর। জ্বলে উঠল প্রথম ক্যাম্প-ফায়ার। মানুষ আগুনকে বশীভূত করে পৃথিবীতে সবার চেয়ে শক্তিশালী হলো।
কেন? কারণ, সে পেল শক্তির নতুন উৎস; দুর্ভিক্ষ, অন্ধকার আর হিংস্র জন্তুদের সঙ্গে সংগ্রামে তা হলো তার এক মহাশক্তিধর মিত্র।