কণা কোয়ান্টামের পথে

কেতন উড়িয়ে যখন নতুনের জয়ধ্বনি ঘোষিত হয়, তখন বাজে পুরোনোর বিদায়রাগিণী। সামাজিক জীবনে পুরোনোকে বিদায় দিতে, দীর্ঘদিনের নাড়িছেঁড়া সম্পর্ক ছিন্ন করতে বুকের ভেতরটায় হাহাকার করে ওঠে। নস্টালজিক হয়ে ওঠে মন। কিন্তু পদার্থবিদ্যার জগতে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হলে চলে না। সানাই বাজিয়ে মহাসমারোহে নতুনকে বরণ করে নেওয়ার রীতিই এখানে আছে, পুরোনোর জন্য দুফোঁটা চোখের জল ফেলার মানুষ এ জগতে মিলবে না। শতাব্দীর পর শতাব্দী যায়, নতুন নতুন তত্ত্বে সমৃদ্ধ হয় পদার্থবিদ্যার জগৎ। দলে দলে তরুণ গবেষকেরা ঝাঁপিয়ে পড়েন নতুন এই বিজ্ঞানের নাড়ি-নক্ষত্র জানার উদ্দেশ্যে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই পদার্থবিদ্যার জগেক ওলট-পালট করে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল।

৭ অক্টোবর, ১৯০০ সাল। জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক তখন বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। হেনরিখ রুবেন্স তাঁর গবেষণা সহকর্মী। ওই দিন রুবেন্স আর তাঁর স্ত্রী বেড়াতে আসেন প্ল্যাঙ্কের বাড়িতে। সেখানেই রুবেন্স জানান, কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের একটা পরীক্ষার কথা। পরীক্ষা থেকে কী ফল পেয়েছেন, তা-ও বলেন। আসলে সমস্যাটা ছিল বিকিরণ-সংক্রান্ত। আদর্শ কৃষ্ণবস্তু, যে নাকি শোষণ করতে পারে তার ওপর পড়া সবটুকু আলো ও তাপশক্তি, তারপর সেই কৃষ্ণবস্তু বিকিরণ করে আলোকরশ্মি। কিন্তু সেই বিকিরণপ্রক্রিয়া মেনে চলে না তখনকার পদার্থবিজ্ঞানের চিরায়ত দুটি গতিতত্ত্ব। সেই গতিতত্ত্বের একটা হলো নিউটনের গতিবিদ্যা এবং অন্যটা ম্যাক্সওয়েলের বিদ্যুত্গতিবিদ্যা। কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের ব্যাখ্যার জন্য অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী লুডভিক বোলজম্যান একটা সূত্র দাঁড় করিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা পুরোপুরি সেই বিকিরণের ব্যাখ্যা দিতে পারে না। অন্যদিকে জার্মান বিজ্ঞানী উইলেহেম ভিন একটা সূত্র দাঁড় করিয়েছিলেন। এ ছাড়া দুই ব্রিটিশ বিজ্ঞানী লর্ড র্যালে ও জেমস জিনস আরও একটি সূত্র দাঁড় করান। কিন্তু কোনোটাই কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না।

সেদিন রুবেন্স প্ল্যাঙ্ককে বলেন, দীর্ঘ তরঙ্গের বিকিরণের ব্যাখ্যা ভিনের সূত্র দিয়েই করা যায়। কিন্তু ক্ষুদ্র তরঙ্গের জন্য সেটা অচল। আবার র্যালে-জিনসের সূত্র দিয়ে ক্ষুদ্র তরঙ্গের বিকিরণ ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু দীর্ঘ তরঙ্গে রেলে-জিনস তত্ত্ব অচল। তার মানে কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ ব্যাখ্যার জন্য দুটো সমীকরণের দরকার হচ্ছে। অথচ সমীকরণ দুটি পরস্পরবিরোধী।

সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে যান রুবেন্স ও তাঁর স্ত্রী। প্ল্যাঙ্ক তখন সমস্যাটা নিয়ে বসে গেলেন টেবিলে এবং সেই দিনই পেয়ে গেলেন আনকোরা একটা সূত্র। এই সূত্র দিয়ে একই সঙ্গে ছোট ও বড় দুই ধরনের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণই ব্যাখ্যা করা যায়। সূত্রটি প্ল্যাঙ্ক লিখলেন একটা পোস্টকার্ডে। তারপর সেটা পাঠিয়ে দিলেন রুবেন্সের কাছে। রুবেন্স সমীকরণের গুরুত্ব কিছুটা হলেও বুঝেছিলেন সেদিন।

১৯ অক্টোবর, ১৯০০। জার্মান ফিজিক্যাল সোসাইটি একটা সভার আয়োজন করে। সভার মূল বিষয়বস্তু কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের পরীক্ষালব্ধ ফলাফল। বরাবরের মতোই বিজ্ঞানীরা সেদিনও ভিন ও র্যালে-জিনসের সূত্রের সঙ্গে পরীক্ষালব্ধ ফলাফল ষোলো আনা মেলাতে পারলেন না। তখন প্ল্যাঙ্ক রুবেন্সকে বললেন, তাঁর সমীকরণটা যেন বিজ্ঞানীরা যাচাই করে দেখেন। বলে সেখান থেকে বাসায় ফিরে আসেন প্ল্যাঙ্ক। পরদিন রুবেন্স প্ল্যাঙ্ককে অভিনন্দন জানিয়ে লেখেন, তাঁর সূত্রটা অভ্রান্ত বলে রায় দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তবে প্ল্যাঙ্ক নিজেও পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। কারণ তাঁর সূত্র অনেকটা অনুমাননির্ভর। বিজ্ঞানে অনুমাননির্ভর সূত্র প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। নিশ্চয়ই এ সূত্রের কোনো শিকড় আছে পদার্থবিজ্ঞানে। প্ল্যাঙ্ক আসলে পদার্থবিজ্ঞানের আগের কোনো সূত্র বা ফর্মুলা খুঁজছিলেন, যেটা থেকে তাঁর সূত্রটা প্রতিপাদন করা যায়। অনেক চেষ্টা করেও প্ল্যাঙ্ক পদার্থবিজ্ঞানের অন্য কোনো সূত্রের সঙ্গে তাঁর নিজের সূত্রটির সম্পর্ক খুঁজে পেলেন না।

তাহলে কি পদার্থবিজ্ঞানের নতুন কোনো দ্বার খুলে গেল তাঁর হাতে? তাহলে বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটা মহাবিপ্লবের ইঙ্গিত করছে। নাকি প্ল্যাঙ্কের সূত্রে কোনো গলদ লুকিয়ে আছে, যা তাঁর চোখে ধরা পড়ছে না? কিন্তু প্ল্যাঙ্ক নিজে কোনো গলদ খুঁজে পেলেন না। সেদিন সভায় যেসব বিজ্ঞানী উপস্থিত ছিলেন তাঁরাও কোনো গলদ খুঁজে পাননি।

প্ল্যাঙ্ক তখন অন্য পথে হাঁটলেন, তাঁর সূত্র দিয়ে ভিন ও র্যালে-জিনস—দুটি সূত্রই প্রতিপাদনের চেষ্টা করলেন। অবাক হয়ে দেখলেন তাঁর সূত্র দিয়ে ভিনের সূত্র প্রতিপাদন করা যায়। প্রতিপাদন করা যায় র্যালে-জিনসের সূত্রও। শুধু তা-ই নয়, এটি দিয়ে বোলজম্যানের পুরোনো সূত্রটিও প্রতিপাদিত হয়। অথচ তাঁর সূত্র চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের কোনো তত্ত্ব দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায় না। প্ল্যাঙ্ক তখন নিশ্চিত হলেন বিজ্ঞান ইতিহাসের নতুন দ্বার তিনি খুলে দিয়েছেন। অর্থাৎ প্রকৃতির সম্পূর্ণ মৌলিক একটি নিয়ম তিনি আবিষ্কার করে ফেলেছেন।

দুই মাস সূত্রটা নিয়ে কাটাছেঁড়া করলেন প্ল্যাঙ্ক। তবু কোনো ত্রুটি খুঁজে পেলেন না। তারপর অনেক খেটেখুটে একটা প্রবন্ধ লিখলেন। প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল, ‘অন দ্য থিওরি অব দ্য এনার্জি ডিস্ট্রিবিউশন ল অব দ্য নরমাল স্পেকট্রাম’।

সে বছর ১৪ ডিসেম্বর জার্মান ফিজিক্যাল সোসাইটির আরেকটা সভায় নিজের প্রবন্ধটি পড়ে শোনালেন প্ল্যাঙ্ক। সেখানে কোয়ান্টাম তত্ত্বের ওপর বিস্তারিত আলোচনা করলেন তিনি।

প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনেক বিজ্ঞানীই তখন মেনে নিতে পারেননি। হুট করে এক জার্মান বিজ্ঞানী পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক এক শাখার কথা বলছেন—সেটা হজম করতে অনেকেরই কষ্ট হয়েছিল। অনেকেই প্ল্যাঙ্কের রোমান্টিক মনের অতিকল্পনা ভেবে গুরুত্ব দেননি বিষয়টাতে। ভেবেছিলেন কিছুদিন আলোচনা চলবে, তারপর কোনো খুঁতটুত বেরিয়ে পড়েবে, তখন সব আলোচনা থেমে যাবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটল উল্টো ঘটনা। দিন যত গড়াল কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভিত তত মজবুত হতে লাগল।

প্ল্যাঙ্ক যখন কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ সমস্যা সমাধান করছেন, ঠিক তখনই আরেকটা সমস্যা হাজির হয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে। সেটা হলো আলোক-তড়িৎক্রিয়া। ধাতব পাতের ওপর আলো ফেললে সেই পাত থেকে ইলেকট্রন নির্গত হয়। কেন হয়? এর গাণিতিক ব্যাখ্যা কী?

নিউটনের গতিতত্ত্বের পক্ষে এর ব্যাখ্যা দেওয়া একেবারেই অসম্ভব। ম্যাক্সওয়েল বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তত্ত্ব ও এর ব্যাখ্যা দিতে পারে না। তাহলে? তখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা আলোকে শুধু তরঙ্গই ভাবতেন। কণাতত্ত্ব বহু আগেই বাতিল হয়ে গেছে। তা ছাড়া আলোক--তড়িৎক্রিয়া আলোর কম্পাঙ্কের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। সুতরাং আলোক তড়িৎক্রিয়ার ব্যাখ্যা তরঙ্গতত্ত্বের ভেতরেই খুঁজতে হবে। মুশকিল হলো, তরঙ্গের পক্ষে কীভাবে সম্ভব একটা কণাকে ধাতুর ভেতর থেকে আলাদা করা?

লাল আলোর পক্ষে সম্ভব নয় ধাতু থেকে ইলেকট্রন বের করা। সম্ভব নয় দৃশ্যমান কোনো আলোর পক্ষেই। কখনো-সখনো অতিবেগুনি রশ্মির আঘাতে ইলেকট্রন বেরিয়ে আসে বটে, কিন্তু সেসব ইলেকট্রনের গতি খুবই কম। কিন্তু আলোর কম্পাঙ্ক বাড়ালে অর্থাৎ অতিবেগুনি রশ্মির চেয়েও বেশি কম্পাঙ্কের আলো ব্যবহার করলে নিঃসৃত ইলেকট্রনের বেগ অনেক বেশি হয়। আবার কতগুলো ইলেকট্রন একবারে বের হয়, সেটা নির্ভর করে আলোর তীব্রতা বা উজ্জ্বলতার ওপর। এই বিষয়গুলো বিজ্ঞানীরা অনেক ভাবলেন। ব্যাখ্যা দাঁড় করারও চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোনো সমাধান বের হলো না।

তত দিনে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক তাঁর কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন। তবে বিজ্ঞানী মহলে সাড়া ফেলতে পারেনি তখনো। কিন্তু সুইজারল্যান্ডের পেটেন্ট অফিসের কর্মী আলবার্ট আইনস্টাইন অন্য রকম ভেবেছিলেন। অফিসে-বাড়িতে বসেই তিনি থিওরি অব রিলেটিভিটির খসড়া কষছেন মনে মনে আর খাতা-কলমে। তৈরি করছেন ব্রাউনীয় গতির জুতসই ব্যাখ্যাও। একই সঙ্গে ভাবছেন কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়েও। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল, আলোক তড়িিক্রয়ার ব্যাখ্যা খোঁজা। আর সে জন্য প্রথম যে ভাবনাটি আইনস্টাইনের মাথায় এসেছিল, সেটা ছিল যুগান্তকারী। আলো শুধু শক্তি বা তরঙ্গ নয়, কণাও। আইনস্টাইন বললেন এ কথা। অর্থাৎ বিজ্ঞানে আবার ফিরে এল আলোর কণাতত্ত্ব। তবে নিউটনের কণাতত্ত্বের সঙ্গে আইনস্টাইনের কণাতত্ত্বের কোনো মিল নেই। আলোকে শক্তির প্যাকেট হিসেবে আখ্যায়িত করলেন আইনস্টাইন। তবে তিনি আলোক তড়িিক্রয়া ব্যাখ্যা করার জন্য চিরায়ত কণাবিদ্যা বা বিদ্যুত্চুম্বকীয় তত্ত্বের দিকে হাত বাড়ালেন না। বরং বিকিরণের জন্য ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক যে কোয়ান্টাম তত্ত্ব দিয়েছিলেন, সেটা দিয়েই ব্যাখ্যা করলেন আলোক তড়িিক্রয়া। প্ল্যাঙ্ক আলোর ক্ষুদ্র শক্তিগুচ্ছকে বলেছিলেন, প্যাকেট বা কোয়ান্টাম। আইনস্টাইন আলোর সর্বনিম্ন শক্তির সেই প্যাকেটকেই বললেন আলোর কণা। আরও পরে সেই কণার নাম হয় ফোটন।

ফোটন ভরহীন কণা। তবে গতিশীল ফোটনের ভরবেগ আছে বলে উল্লেখ করলেন আইনস্টাইন। ভরবেগ ও শক্তিসম্পন্ন কণাকে তিনি তুলনা করলেন কামানের গোলার সঙ্গে। কামানের গোলা প্রচণ্ড বেগে কোনো বস্তুকে আঘাত হানে। গুঁড়িয়ে দেয় সেই বস্তুকে। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় আঘাত পাওয়া বস্তুটি। সেই বস্তুর টুকরা টুকরা অংশ প্রবল বেগে ছিটকে বেরিয়ে যায়। আইনস্টাইন বলেন, আলোর ফোটন কণা প্রবল বেগে কামানের গোলার মতো গিয়ে আঘাত হানে ধাতুর পরমাণুতে। তখন পরমাণুর ভেতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে যায় ইলেকট্রন কণা।

যে আলো আলোক-তড়িৎক্রিয়া অংশ নেয়, তার উজ্জ্বলতাও আলোক-তড়িৎক্রিয়াবিশেষ ভূমিকা রাখে। আলোকরশ্মি যত উজ্জ্বল হবে, তার ইলেকট্রন নির্গমনের সংখ্যা তত বেশি থাকবে। যে আলোর কম্পাঙ্ক যত বেশি, তার শক্তিও তত বেশি। সুতরাং সেই আলো ধাতুর ওপর যে ধাক্কা দেবে সে ধাক্কার জোরও তত বেশি হবে। সুতরাং ইলেকট্রন বের করার ক্ষমতা সেই আলোর বেশি থাকবে। একসঙ্গে দুটো সমস্যার সমাধান হলো। আলোক তড়িিক্রয়ার সমস্যাটা মিটল। সেই সঙ্গে কোয়ান্টাম তত্ত্বও প্রতিষ্ঠিত হলো শক্তপোক্তভাবে। আলোক-তড়িৎক্রিয়া ব্যাখ্যার পর থেকে তরুণ বিজ্ঞানীরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন বিজ্ঞানের এই নতুন শাখাটিতে। এর ১৬ বছর পর ১৯২১ সালে আইনস্টাইন পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার। হ্যাঁ, আইনস্টাইন তাঁর বিখ্যাত আবিষ্কার থিওরি অব রিলেটিভিটির জন্য নোবেল পাননি। পেয়েছিলেন আলোক তড়িিক্রয়া ব্যাখ্যার জন্য। আইনস্টাইনের ঠিক আগের বছর নোবেল পেয়েছিলেন প্ল্যাঙ্ক। তবে প্ল্যাঙ্ক কিন্তু বিকিরণের কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যাখ্যা করার পর খুব বেশি এগোতে পারেননি।

১৯১১ সাল। বিখ্যাত স্বর্ণপাত পরীক্ষাটা সদ্য করেছেন ব্রিটেন-প্রবাসী নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড। সেই পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করেই তৈরি করেছেন একটা পরমাণু মডেল। কিন্তু তাঁর পরমাণু মডেলে কিছু ত্রুটি ছিল। সেই মডেলে রাদারফোর্ড বলেছিলেন, পরমাণু নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘোরে ইলেকট্রনগুলো, ঠিক যেভাবে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে গ্রহগুলো। তাই এই মডেলের নাম দেওয়া হয় সোলার সিস্টেম অ্যাটম মডেল। কিন্তু স্কটিশ বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল আগেই বলেছিলেন, চার্জিত কণা বৃত্তপথে ঘুরলে বিদ্যুত্চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে। তার ফলে কণাটি শক্তি হারায়। শক্তি একসময় পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে। শক্তি ক্ষয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটু করে কমবে ইলেকট্রনের সঙ্গে নিউক্লিয়াসের দূরত্ব। তার মানে ইলেকট্রন কক্ষপথের ব্যাসার্ধ ক্রমেই ছোট হতে থাকবে। শক্তি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরোপুরি শূন্য হয়ে যাবে ব্যাসার্ধ। তখন ইলেকট্রন গিয়ে পড়বে নিউক্লিয়াসের বুকে। ম্যাক্সওয়েলের সূত্র আর রাদারফোর্ডের মডেল অনুসারে হাইড্রোজেন পরমাণুর ইলেকট্রন অল্প সময়ের মধ্যে সর্পিল গতিতে ঘুরতে ঘুরতে নিউক্লিয়াসে গিয়ে পড়বে। তাহলে রাদারফোর্ডের সৌর মডেলের অস্তিত্ব থাকল কোথায়?

ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসে পতিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরমাণুর ভারসাম্য আর থাকার কথা নয়। তখন ভেঙে পড়বে রাদারফোর্ডের মডেল। রাদারফোর্ড মডেল তাহলে নিজেই নিজেকে বাতিল করে দিচ্ছে। এত বড় একটা অসংগতি নিয়ে বিজ্ঞান চলতে পারে না। তাই আরও একবার বড় ধরনের একটা সমস্যার মুখোমুখি পদার্থবিদ্যা। যেমনটা হয়ে ছিল কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণে, যেমনটা হয়েছিল আলোক-তড়িৎক্রিয়া। দুই ক্ষেত্রে ত্রাতার ভূমিকা পালন করেছিল কোয়ান্টাম তত্ত্ব। এবার তাহলে কী হবে? এ প্রশ্নের জবাব রাদারফোর্ডের কাছে ছিল না। তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল ডেনিশ বিজ্ঞানী নিলস বোরের জন্য।

বোর ভাবলেন, একটু ভিন্নভাবে। বিদ্যুত্চুম্বকীয় তত্ত্ব দিয়ে রাদারফোর্ডের মডেল ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। পদার্থবিদ্যার নতুন তত্ত্বটা কি ব্যবহার করা যায়? প্ল্যাঙ্ক-আইনস্টাইনের প্রতিষ্ঠা করা কোয়ান্টাম তত্ত্ব। কোয়ান্টাম তত্ত্ব তখনো অনেকের কাছে এটা কাল্পনিক হাইপোথিসিস। এমনকি বোরেরও আস্থা ছিল না ওই তত্ত্বে। তবু তাঁর মনে হলো পরমাণু মডেলে কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহারের কথা। তত্ত্বটির আগের দুটি সাফল্যই বোধ হয় বোরকে অনুপ্রাণিত করেছিল।

সাধারণ বলবিদ্যায় ইলেকট্রনের কক্ষপথের স্থায়ী আকার ছিল না। থাকবে কী করে, সর্পিলাকারে যে কক্ষপথ ছোট হতে হতে নিউক্লিয়াসে পতিত হয়, তার আবার নির্দিষ্টতা কী? এই সমস্যার হাত থেকে বাঁচাতে পারে কোয়ান্টাম তত্ত্ব। বোর বললেন, পরমাণুর ভেতরে ইলেকট্রনের কক্ষপথের একটা নির্দিষ্ট আকার থাকা উচিত। নির্দিষ্ট আকার না থাকলে পরমাণু স্থায়ী হবে না। তেমনি রাদারফোর্ডের মডেল আর বিদ্যুত্চুম্বকীয় তত্ত্বও মেনে চলবে খানিকটা। অর্থাৎ ঘুরতে থাকা ইলেকট্রন বিদ্যুত্চুম্বকীয় শক্তিও বিকিরণ করবে। কিন্তু দুটো বিপরীতমুখী ঘটনা একসঙ্গে কীভাবে ঘটবে?

বোর বললেন ঘটবে, তবে একই সঙ্গে নয়। ইলেকট্রনের জন্য পরমাণুর একটা নয়, একাধিক কক্ষপথ আছে। সেসব কক্ষপথ মোটেও সর্পিল নয়। বৃত্তাকার। একটা নির্দিষ্ট কক্ষপথে যখন ইলেকট্রন অবস্থান করে তখন সেই ইলেকট্রন কোনো শক্তি নির্গমন করে না। বোর ইলেকট্রনের কক্ষপথে শক্তির একটা মাপকাঠি তৈরি করে দিলেন। একটা নির্দিষ্ট কক্ষপথ একটা নির্দিষ্ট শক্তি ধারণ করে। সেই শক্তির চেয়ে ইলেকট্রনের শক্তি কমবেশি হলে সেই কক্ষপথে আর থাকতে পারবে না। চলে যাবে নিচের বা ওপরের কোনো কক্ষপথে। অর্থাৎ বোরের কক্ষপথ নিরবচ্ছিন্ন শক্তির কক্ষপথ নয়। বরং কক্ষপথগুলো নির্দিষ্ট শক্তি নিয়ে অবস্থান করে পরমাণুর বিভিন্ন স্তরে। নিউক্লিয়াস থেকে সবচেয়ে কাছের কক্ষপথটি সবচেয়ে কম শক্তি ধারণ করে। নিউক্লিয়াসের থেকে কক্ষপথের দূরত্ব যত বেশি, কক্ষপথের শক্তিও তত বেশি।

কথা হচ্ছে, কক্ষপথ থাকলেই বা লাভ কী, ইলেকট্রন যদি সব কক্ষপথে থাকতে না পারে? ধরা যাক, হাইড্রোজন পরমাণুর কথা। এই পরমাণুতে একটামাত্র ইলেকট্রন আছে। তাই বলে কি এর কক্ষপথও একটা? তাই যদি হয়, তো রাদারফোর্ডের পরমাণুতেই ফিরে যেতে হবে!

বোর বললেন, হাইড্রোজেন পরমাণুতে একাধিক কক্ষপথ আছে। সেগুলোর সবগুলোতেই থাকতে পারে ইলেকট্রন। কিন্তু ইলেকট্রন তো আর ভূত-প্রেতের গল্পের মতো নয়, যে একই সঙ্গে সবগুলো কক্ষপথে থাকবে! বোর বললেন, ইলেকট্রন সব কক্ষপথেই থাকতে পারবে, তবে একসঙ্গে নয়। পরমাণুটি কখন কোন অবস্থায়, কী পরিমাণ শক্তি নিয়ে আছে, তার ওপর নির্ভর করে ইলেকট্রন কোন শক্তিস্তরে থাকবে। একেক সময় একেকটা কক্ষপথে থাকতে পারে।

তার মানে ইলেকট্রন যেমন নিম্ন শক্তির কক্ষপথে থাকতে পারে, তেমনি বেশি শক্তির কক্ষপথেও থাকতে পারে। ধরা যাক, ইলেকট্রন ওপরের দিকের একটা কক্ষপথে আছে। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি নিঃসরণ করে সে নিচের শক্তিস্তরে আসতে পারবে। তাহলে কিন্তু বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় শক্তি নিঃসরণের একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কিন্তু নির্দিষ্ট কক্ষপথে যখন ঘোরে, তখন বিদ্যুত্চুম্বকীয় শক্তি নিঃসরণ করতে পারে না।

তাহলে কি ইলেকট্রন শুধু উচ্চ শক্তির কক্ষপথ থেকে নিচের শক্তিস্তরে আসতে পারে? নিচের থেকে ওপরে যেতে পারে না। বিদ্যুত্চুম্বকীয় তরঙ্গতত্ত্বে বলা হয়েছে ঘূর্ণনশীল চার্জিত কণা বিদ্যুত্চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে। বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ বা শক্তি শোষণের কথা বলা হয়নি সেই সমীকরণে। শক্তি বিকিরণ করা মানে ইলেকট্রনের শক্তি কমে যাওয়া। শক্তি কমে গেলে শুধু নিচের কক্ষপথে যেতে পারে। ওপরের কক্ষপথে যেতে হলে শক্তি শোষণ করে ইলেকট্রনকে আরও শক্তিশালী হতে হবে। এখানেই বোরের কৃতিত্ব। তিনি বললেন, একটা নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরতে থাকা ইলেকট্রন শক্তি শোষণও করতে পারে। তবে শক্তি শোষণ করলে তার শক্তি বেড়ে যায়, সুতরাং সেই কক্ষপথে সে ঘুরতে পারবে না। লাফ দিয়ে চলে যাবে ওপরের কোনো কক্ষপথে। এ ঘটনা বিদ্যুত্চুম্বকীয় তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় চিরায়ত বলবিদ্যার কোনো তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করাও। বোর তাই কোয়ান্টাম তত্ত্বের দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন।

বোর বলেছিলেন, পরমাণুর ভেতরে ইলেকট্রনের কক্ষপথগুলো নিরবচ্ছিন্ন নয়, বিচ্ছিন্ন। প্ল্যাঙ্ক যেমন বলেছিলেন, কৃষ্ণবস্তু নিরবচ্ছিন্নভাবে শক্তি নিঃসরণ করতে পারে না। শক্তি আসে ঝাঁকে ঝাঁকে বা গুচ্ছ আকারে। বোর অনেকটা একই রকম কথা বললেন পরমাণুর কক্ষপথের ক্ষেত্রেও। পরমাণুর কক্ষপথ নিরবচ্ছিন্ন নয়। বিকিরণের শক্তি প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকের সরল গুণিতকে থাকে। কখনো ভগ্নাংশ আকারে থাকে না। বোর বললেন, ইলেকট্রনের কক্ষপথের শক্তিও কখনো নিরবচ্ছিন্ন নয়। প্ল্যাঙ্ক বিকিরণের জন্য যে কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্ম দিয়েছিলেন, আইনস্টাইন সেটাকে এগিয়ে নিয়েছিলেন এক ধাপ—সেই কোয়ান্টাম তত্ত্বকেই খুদে কণিকাদের জগতে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করেন নিলস বোর। তারপর তাঁর নিজের চেষ্টায়, তাঁর একঝাঁক তরুণ ছাত্রদের পরিশ্রমে গড়ে ওঠে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা।

লেখক: সাংবাদিক

সূত্র: নেচার