চুম্বকের সঙ্গে আমাদের প্রায় সবারই পরিচয় ছোটবেলায়। খেলনা গাড়ি খুলে-টুলে চুম্বকটা বের করে নিতে দারুণ মজা লাগত। আর আলাদা করে যেসব চুম্বক কিনতে পাওয়া যেত, সেগুলো হাতে নিলে রাখতেই ইচ্ছে করত না। একটু বড় হয়ে আমরা বুঝলাম, চুম্বক জিনিসটা বড় অদ্ভুত!
আমরা জানি, চুম্বকের দুটো মেরু থাকে। উত্তর ও দক্ষিণ মেরু। লোহা ও অন্যান্য জিনিসকে আকর্ষণ করে তো বটেই। তবে একটা দণ্ড চুম্বকের উত্তর মেরু আরেকটি দণ্ড চুম্বকের দক্ষিণ মেরুকে আকর্ষণ করে। কিন্তু উত্তর মেরুর কাছে উত্তর মেরু আনলে দুটো চুম্বকই ছিটকে যায় দুদিকে। অদ্ভুত বিষয়টা হলো, একটা দণ্ড চুম্বককে মাঝখান থেকে কেটে বা ভেঙে ফেললে ওটার কোনো একটা মেরু চলে যায় না। বরং নতুন দুটো চুম্বক হয়, প্রতিটারই আবার দুটো করে মেরু থাকে!
আরেকটু বড় হয়ে আমরা জানলাম, চুম্বক শুধু উত্তর-দক্ষিণে ফিরে থাকে। পূর্ব-পশ্চিমে ফেরানোই যায় না। এর কারণ, পৃথিবীর কেন্দ্রটাই আস্ত একটা চুম্বক! সেজন্য পৃথিবীর ভূচুম্বকের উত্তর মেরু আমাদের খেলনা চুম্বকগুলোর দক্ষিণ মেরুকে আকর্ষণ করে। আর আমাদের চুম্বকের উত্তর মেরুকে আকর্ষণ করে ভূচুম্বকের দক্ষিণ মেরু। এই বৈশিষ্ট্যের জন্য চুম্বক দারুণ কাজের জিনিস। আমরা এখন জানি, শুধু খেলনা গাড়িতেই নয়, বাস্তবের বড় গাড়ি কিংবা ফ্রিজেও চুম্বক থাকে। এমনকি এই চৌম্বক বৈশিষ্ট্য কাজে লাগিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানে এমআরআই-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাও করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় ন্যাশনাল হাই ম্যাগনেটিক ফিল্ড ল্যাবরেটরি। এ গবেষণাগারের পরিচালক গ্রেগ বোয়েবিঙ্গার। তিনি বলছেন, ‘চুম্বক পদার্থবিজ্ঞানের গূঢ় রহস্যগুলোর একটি। মানুষ এই চুম্বক ব্যবহার করছে হাজার বছর ধরে। তবে বিজ্ঞানীরা আজও এর ব্যাপারে নতুন নতুন তথ্য জানছেন।’
এই যে চুম্বকের এত গুণ, যার মূলে আছে তার ওই দুই মেরু—এই মেরু তৈরি হয় কীভাবে? আমরা জানি, লোহায় বিদ্যুৎ পরিচালনা করলে তার চুম্বকধর্ম দেখা যায়। আবার আমাদের চুম্বকের দক্ষিণ মেরুকে ভূচুম্বকের উত্তর মেরু আকর্ষণ করে। কিন্তু এই চুম্বক জিনিসটা কী? মেরুগুলো তৈরি হচ্ছে কীভাবে?
এই প্রশ্নটির সবচেয়ে মৌলিক জবাব হলো, যে পদার্থ দিয়ে চুম্বকটি তৈরি, তার ভেতরে রয়েছে ওই পদার্থের পরমাণু। আর পরমাণুর ভেতরে আছে ইলেকট্রন। আসল কেরামতি এই ইলেকট্রনদের।
পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে ধনাত্মক চার্জযুক্ত নিউক্লিয়াস। আর একে ঘিরে থাকে এক বা একাধিক ঋণাত্মক চার্জযুক্ত ইলেকট্রন। প্রতিটি ইলেকট্রন তার চার্জের জন্য একটা অতিক্ষুদ্র চুম্বকক্ষেত্র তৈরি করে। বিজ্ঞানীরা ইলেকট্রনের এই বৈশিষ্ট্যকেই বলেন স্পিন। এই অতিক্ষুদ্র চুম্বকক্ষেত্রগুলোর বেশ কয়েকটির মেরু যদি একইদিকে থাকে, তাহলে সেই বস্তুটা চুম্বক পদার্থে পরিণত হয়।
এমনিতে ইলেকট্রনের স্পিন ধর্মটি একটি বিমূর্ত ধারণা। নামটি ‘স্পিন’, যার বাংলা হয় ঘূর্ণন—তাই অনেকে মনে করেন, ইলেকট্রন স্পিন করে মানে বুঝি ঘোরে। আসলে তা নয়। আসলে চার্জযুক্ত কোনো বস্তু ঘুরতে থাকলে এর চারপাশে একধরনের চুম্বকক্ষেত্র তৈরি হয়। বিজ্ঞানীরা ইলেকট্রনের চারপাশে এ ধরনের চুম্বকক্ষেত্র পরিমাপ করেছেন। এই চুম্বকক্ষেত্র তৈরি করার বৈশিষ্ট্যটিকেই তাঁরা বলেন ‘স্পিন’। কারণ, স্পিনের দিক উল্টে দিলে চুম্বকক্ষেত্রের মেরুও উল্টে যায়।
ইলেকট্রন সাধারণত জোড় বেঁধে থাকে। ফলে একটির স্পিন অন্যটির বিপরীতমুখী স্পিনকে বাতিল করে দেয়। ফলে যেকোনো পরমাণুর মোট চুম্বকত্বের মান শূন্য হয়ে যায়। কিন্তু লোহার মতো কিছু পদার্থে এমনটা ঘটে না। লোহার কথাই বলি। লোহার পরমাণুতে ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসের চারপাশে এমনভাবে থাকে যে প্রতিটি পরমাণুতে একটি বিজোড় ইলেকট্রন দেখা যায়। ফলে প্রতিটি লোহার পরমাণুতে অতিক্ষুদ্র চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি হয়। এজন্যই লোহার চুম্বক ধর্ম আছে।
যেসব পদার্থের এমনিতে চুম্বক ধর্ম নেই, সেগুলোর প্রতিটি পরমাণুর চৌম্বকক্ষেত্র নানা দিকমুখী হয়। কোনো নির্দিষ্ট দিকে থাকে না। ফলে একে অন্যকে বাতিল করে দেয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, তাই শেষ পর্যন্ত পদার্থটিতে আর চুম্বকত্ব দেখা যায় না। তবে বিদ্যুৎ পরিচালনা করে বা চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে এদেরকে একই দিকে ফেরানো যায়। তখন এদের মধ্যেও দেখা যায় চুম্বকত্ব।
এবারে একটা মজার বিষয় নিয়ে বলা যাক। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরেই ‘ম্যাগনেটিক মনোপোল’ বা শুধু একমেরু বিশিষ্ট চুম্বক খুঁজে ফিরছেন। পদার্থবিজ্ঞানের পরশ পাথর বলা যায় একে। কিন্তু এর কোনো খোঁজ আজও পাওয়া যায়নি। অদ্ভুত বিষয় হলো, ইলেকট্রন ও প্রোটন কিন্তু বৈদ্যুতিকভাবে মনোপোল—অর্থাৎ একভাবে চার্জিত। হয় ঋণাত্মক, না হয় ধনাত্মক। যেমন ইলেকট্রন শুধুই ঋণাত্মক। কিন্তু ইলেকট্রন ও অন্যান্য মৌলিক কণায় সৃষ্ট চুম্বকত্বে আবার দুটো মেরুই দেখা যায়। আর এগুলো যেহেতু মৌলিক কণা, তাই এদের আর ভাঙাও যায় না। এখানে এসে পদার্থবিজ্ঞানীরা তাই থমকে গেছেন। তাঁরা আর জানেন না, একমেরু বিশিষ্ট চুম্বকের অস্তিত্ব আসলেই সম্ভব কি না। চুম্বকত্ব তাই আজও রহস্য। যে রহস্যের সমাধানের উপায় আমাদের এখনো জানা নেই।
লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা
সূত্র: লাইভ সায়েন্স, উইকিপিডিয়া, নাসা