যাহা ভর তাহাই ওজন নয়

দুটি শব্দ দিয়েই ভার বোঝায়। তবে তাদের কাজ এবং সংজ্ঞা ভিন্ন। ভর ও ওজন কতটা আলাদা, এদের মধ্যে সম্পর্কই-বা কতটুকু, তা একটু বোঝার চেষ্টা করি।

প্রতিদিনের জীবনে আমরা ‘ভর’ ও ‘ওজন’—শব্দ দুটি এমনভাবে ব্যবহার করি, যেন দুটি এক। সত্যি বলতে, পৃথিবীতে দুটোর পার্থক্য সাদা চোখে ওভাবে টের পাওয়া একটু কঠিনই বটে। কিন্তু বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এদের পার্থক্য যোজন যোজন। তবে একটির সঙ্গে অন্যটি সম্পর্কিত। দুটি শব্দ দিয়েই ভার বোঝায়। তবে তাদের কাজ এবং সংজ্ঞা ভিন্ন। ভর ও ওজন কতটা আলাদা, এদের মধ্যে সম্পর্কই-বা কতটুকু, তা একটু বোঝার চেষ্টা করি।

ভর মানে, কোনো বস্তুর মধ্যে কতটুকু পদার্থ রয়েছে, তার পরিমাপ। আরও স্পষ্ট করলে বললে, বস্তুটি কী ধরনের পদার্থ দিয়ে তৈরি এবং তাতে যে কয়টি পরমাণু আছে, সেগুলো কতটা ভারী, তা বোঝায় ভর। ভরের একক কিলোগ্রাম বা কেজি। ধরুন, একটা তরমুজ। পাল্লায় মেপে দেখলেন ১ কেজি। এটা হলো ভর। অর্থাৎ তরমুজটিতে ১ কেজি পরিমাণ বস্তু আছে। কেউ কেউ বলতে পারেন, আমরা তো ‘ওয়েইট মেশিন’ বা ‘ওজন মাপার যন্ত্রে’ মাপি, তাহলে ওজন না দেখিয়ে ভর দেখায় কেন? সে কথায় পরে আসছি।

আরেকটা উদাহরণ দিই। ধরুন, আপনি ১ কেজি লোহা ও ১ কেজি তুলা নিলেন। এটা নিয়ে একটা প্রচলিত ধাঁধা আছে। দুটোর মধ্যে কোনটির ভর বেশি? আসলে ভর একই। কারণ দুটির মধ্যেই ১ কেজি পরিমাণ বস্তু আছে। তবে এদের আয়তন হবে ভিন্ন। এক কেজি লোহাকে আপনি একটা ছোট ব্যাগে ভরতে পারলেও তুলাকে ওতে আঁটাতে পারবেন না। সে জন্য লাগবে আরও বড় ব্যাগ। কারণ, লোহার সমপরিমাণ ভর তৈরি করতে তুলার অনেক বেশি পরমাণু লাগে। তাই জায়গাও লাগে বেশি। (বলে রাখি, তুলা একটি যৌগিক পদার্থ। তবে সহজ করে বললে, লোহার চেয়ে তুলার অণু অনেক হালকা। )

ধরুন, আপনার ভর ৬০ কেজি। আপনি দাঁড়িয়ে থাকুন কিংবা সোফায় কুঁকড়ে শুয়ে থাকুন, আপনার ভর ওই ৬০ কেজিই থাকবে। বাড়িতে থাকুন কিংবা সিনেমা হলে, ভরের কোনো পরিবর্তন হবে না।

কোনো বস্তু থেকে কিছু অংশ সরিয়ে আপনি তার ভর পরিবর্তন করতে পারেন। যেমন একটা আপেলের অর্ধেক খেয়ে ফেললেন। তখন আপেলের ভর কমবে। হয়তো আপনার ব্যাগে ১০টা বই আছে। সেখান থেকে বন্ধুকে দুটি বই ধার দিলেন। এতেও ব্যাগের ভর কমবে। আবার একটা শিশু যখন ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে, তখন তার ভর বাড়ে। এভাবে কোনো বস্তুর ভর বাড়ানো বা কমানো যায়। তবে আকার বা স্থানভেদে বস্তুর ভর পরিবর্তন করা যায় না। একটা উদাহরণ দিই। 

ধরুন, আপনার ভর ৬০ কেজি। আপনি দাঁড়িয়ে থাকুন কিংবা সোফায় কুঁকড়ে শুয়ে থাকুন, আপনার ভর ওই ৬০ কেজিই থাকবে। বাড়িতে থাকুন কিংবা সিনেমা হলে, ভরের কোনো পরিবর্তন হবে না। আপনি পৃথিবী ছেড়ে চাঁদ বা মঙ্গল গ্রহে চলে গেলেও একই থাকবে ভর। তবে সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময়ের ভর ও রাতে ঘুমাতে যাওয়ার কালে ভরে কিছুটা হেরফের হতে পারে। কারণ সারাদিনে খাওয়াদাওয়ার জন্য কিছুটা হলেও ভর বাড়বে। 

এবার দেখা যাক, ওজন কী। কোনো বস্তুকে পৃথিবী তার নিজের দিকে যে পরিমাণ ত্বরণে আকর্ষণ করে, তা-ই ওই বস্তুর ওজন। ধরুন, একটি ১০০ গ্রাম ভরের বলকে ১০ তলা বিল্ডিংয়ের ওপর থেকে ছেড়ে দিলেন। এখন বলটিকে পৃথিবী যত বেগে আকর্ষণ করবে, সেটাই তার ওজন। বুঝতেই পারছেন, ১ কেজি ভরের লোহা ও তুলার ওজনও একই হবে পৃথিবীতে। বলে রাখি, পৃথিবী আপনাকে কত বেগে টানছে, বুঝতে গিয়ে আবার ১০ তলা থেকে যেন ঝাঁপ দেবেন না! আমরা টের না পেলেও পৃথিবী আমাদের নিয়মিতই আকর্ষণ করছে। সে জন্যই ভেসে না গিয়ে আমরা হাঁটতে বা বসতে পারি।

ওজনের ক্ষেত্রে বস্তুর ভর ও অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে ও চাঁদে আপনার ওজন এক হবে না। কিন্তু ভর একই থাকবে।

এই ওজন কীভাবে পাওয়া যায়? ভরকে পৃথিবীর অভিকর্ষজ ত্বরণ ৯.৮১ দিয়ে গুণ করলে ওজন পাওয়া যায়। একে নিউটন দিয়ে প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ পৃথিবীতে আপনার ভর ৬০ কেজি হলে ওজন হবে ৬০ × ৯.৮১ = ৫৮৮.৬ নিউটন।

এবারে একটা মজার বিষয় বলি। ডিজিটাল ‘ওজন মাপার যন্ত্র’গুলো কিন্তু আসলে ‘ওয়েইট মেশিন’ নয়, এগুলো ‘মাস’ মেশিন। মাপে ওজনই, তবে দেখায় ভর। আসলেই। আপনি যদি নিজের ভর মাপতে কোনো ওজন মাপার যন্ত্রে উঠে দাঁড়ান, ওটা প্রথমে আপনার ওজন মাপবে। তারপর সেটাকে ৯.৮১ দিয়ে ভাগ করে ভর দেখাবে। অর্থাৎ ওটা যদি আপনার ওজন পায় ৫৮৮.৬ নিউটন, তাহলে আপনার ভর দেখাবে ৬০ কেজি।

পৃথিবী থেকে চাঁদের মহাকর্ষ ত্বরণ অনেক কম, ৬ ভাগের ১ ভাগ।

পৃথিবীর বাইরে, ভিনগ্রহে মহাকর্ষ ত্বরণের মান ৯.৮১ মিটার/ সেকেন্ড নয়। চাঁদ হোক বা অন্য কোনো গ্রহ, মহাকর্ষ ত্বরণের মান ভিন্ন। ফলে ওজনও এক হবে না। কোন গ্রহে ওজন কত হবে, তা নির্ভর করে ওই গ্রহের ভরের ওপর। যে বস্তুর ভর বেশি, তার মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বা টান—অন্যভাবে বললে, মহাকর্ষ ত্বরণও বেশি হয়। যেমন চাঁদে ৬০ কেজি ভরের কোনো বস্তুর ওজন হবে ৯৭.৭ নিউটন। কারণ, পৃথিবী থেকে চাঁদের মহাকর্ষ ত্বরণ অনেক কম, ৬ ভাগের ১ ভাগ। কোনো বস্তুর ভর বাড়া বা কমার সঙ্গে ওজনও পরিবর্তিত হয়। কোন গ্রহে আপনার ওজন কত হতে পারে, তা বিস্তারিত জানতে এই লেখাটি পড়ুন: কোন গ্রহে আপনার ওজন কত 

সূত্র: সায়েন্স নিউজ এক্সপ্লোরস ও লাইভ সায়েন্স ডট কম