অ্যান্টিম্যাটার: বাস্তব নাকি কল্পনা

অ্যান্টিম্যাটার বা প্রতিবস্তুর নাম শুনলেই কেমন যেন একটা অভিজাত অনুভূতি হয়, তা-ই না? যেন মনে হয়, ভবিষ্যতের পৃথিবীর অজানা এক বস্তুর সন্ধান পাওয়া গেছে, যার জাদুর ছোঁয়ায় নিমেষেই বদলে যেতে পারে গোটা পৃথিবী। সবাই অবশ্য এভাবে ভাবেন না। অনেকেই এদের নাম শুনলে আঁতকে ওঠেন। তাঁদের কল্পনায় এরা ভয়ংকর বিধ্বংসী এক বস্তু। এমন কল্পনার পেছনে পুরোপুরি দায়ী মার্কিন লেখক ড্যান ব্রাউনের বিখ্যাত থ্রিলার অ্যাঞ্জেলস অ্যান্ড ডেমনস। সেখানে গল্প আবর্তিত হয় ভ্যাটিকান সিটিতে লুকিয়ে রাখা একটি বিধ্বংসী বোমাকে ঘিরে। গতানুগতিক কোনো বোমা নয়। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে অ্যান্টিম্যাটার ব্যবহার করে তৈরি ভয়ংকর এক মারণাস্ত্র। সেই থেকে অনেকের মনে গেঁথে গেছে অ্যান্টিম্যাটারের বিধ্বংসী রূপ। কিন্তু বাস্তবে আসলেই কি এরা এমন বিপজ্জনক? চলুন জেনে আসি একদম গোড়া থেকে।

অ্যান্টিম্যাটার আসলে কী? সহজ করে বললে, এরা হলো সাধারণ বস্তুকণার মিরর ইমেজ বা প্রতিবিম্ব। কোনো মানুষকে যদি একটি সমতল আয়নার সামনে দাঁড় করানো হয়, তাহলে আয়নায় প্রায় অবিকল সেই মানুষের মতো একটি প্রতিবিম্বের দেখা মিলবে। তবে মানুষ ও প্রতিবিম্বের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য থাকবে। প্রতিবিম্বে দেখা যাবে পার্শ্বপরিবর্তন। অর্থাৎ প্রতিবিম্বের ডান হাত নির্দেশ করবে মূল ব্যক্তির বাঁ হাত এবং প্রতিবিম্বের বাঁ হাত নির্দেশ করবে মূল ব্যক্তির ডান হাত। স্বাভাবিক বস্তুকণা ও প্রতিকণার (অ্যান্টিম্যাটার) মধ্যেও বিষয়টি অনেকটা একই রকম। কেবল একটি মৌলিক পার্থক্য বাদে এরা পুরোপুরি স্বাভাবিক বস্তুকণার মতো। আর সেটা হলো কোয়ান্টাম সংখ্যার চিহ্ন। প্রতিকণার কোয়ান্টাম সংখ্যার চিহ্ন স্বাভাবিক বস্তুকণার ঠিক উল্টো। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আমাদের অতি পরিচিত বস্তুকণা ইলেকট্রনের কথাই ধরুন। ইলেকট্রন ঋণাত্মক আধানবিশিষ্ট এবং চার্জের মান -১। অন্যদিকে ইলেকট্রনের ঠিক সমান ভরবিশিষ্ট প্রতিকণা পজিট্রন ধনাত্মক আধানবিশিষ্ট এবং চার্জের মান +১। অর্থাৎ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোয়ান্টাম সংখ্যার চিহ্ন ঠিক উল্টো।

অ্যানিহিলেশনের মাধ্যমে ভর রূপান্তরিত হয় শক্তিতে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাওয়া যায় দুটি আলাদা ফোটন। এসব ফোটন চিকিৎসাক্ষেত্রে কাজে লাগানো সম্ভব।
ছবি: আ কার্টুন গাইড টু দ্য ফ্যাসিনেটিং রেলম অব ফিজিকস

দুই

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকটা পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসের এক উত্তেজনাপূর্ণ সময়। সে সময়কে পদার্থবিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ বললেও বিন্দুমাত্র বাড়িয়ে বলা হবে না। তখন নিয়মিত বিরতিতে নিত্যনতুন যুগান্তকারী সব ধারণা হাজির করছিলেন পদার্থবিদেরা। চমকে দিচ্ছিলেন গোটা বিশ্বকে। ক্রমেই বদলে যাচ্ছিল মহাবিশ্ব নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। সে সময় পদার্থবিজ্ঞানকে আমূল বদলে দেওয়ার মূল কারিগর ছিলেন আইনস্টাইন। ১৯০৫ সালে তাঁর প্রকাশিত আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব এবং এর প্রায় ১০ বছর পর প্রকাশিত আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল পদার্থবিজ্ঞানে। আপেক্ষিকতা–ঝড়ে সব লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়ার সময় অনেকটা নিভৃতেই গড়ে উঠছিল আরেকটি যুগান্তকারী ধারণা। একদল পদার্থবিদ একমনে কাজ করে যাচ্ছিলেন ইলেকট্রনের মতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা নিয়ে। সেখান থেকেই সূত্রপাত হয় কোয়ান্টাম মেকানিকসের। খোঁজ মেলে চোখের সামনে লুকানো এক অদ্ভুত জগতের, যেখানে কাজ করে না পদার্থবিজ্ঞানের সাধারণ নিয়মকানুন। পুরোপুরি অচল আমাদের সাধারণ জ্ঞান।

পদার্থবিজ্ঞানের অনেক রথী-মহারথী তাঁদের পুরো কর্মজীবন ব্যয় করেছেন আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম মেকানিকসের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটাতে। কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। কারণ, এরা আলাদা আলাদা জগতের বাসিন্দা। একটি কাজ করে গ্রহ–নক্ষত্রের মতো বিশাল ভরের বস্তু নিয়ে, অন্যটি ব্যাখ্যা করে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার জগৎ। আপাতদৃষ্টে দুইয়ের ভেতর কোনো যোগসূত্র নেই। কিন্তু পদার্থবিদেরা মোটেও হাল ছাড়ার পাত্র নন। অবশেষে ১৯২৮ সালে ব্রিটিশ পদার্থবিদ পল ডিরাকের হাত ধরে আসে সফলতা।

আরও পড়ুন

আইনস্টাইনের ভর-শক্তি সমীকরণ (E=mc2) এবং শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণ ব্যবহার করে দুই ভিন্ন জগৎকে এক করার কাজে নেমেছিলেন পল ডিরাক। প্রথম দিকে তিনিও খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। কারণ, এগুলোর আগামাথা কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। তবে অসম্ভব মেধাবী ডিরাক ঠিকই পথ খুঁজে নেন। জন্ম হয় ডিরাক সমীকরণের। এর মাধ্যমে একবিন্দুতে মেলানো সম্ভব হয় কোয়ান্টাম মেকানিকস ও আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বকে। ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় আলোর কাছাকাছি বেগে গতিশীল থাকা ইলেকট্রনের আচরণ। যা–ই হোক, ডিরাকের সমীকরণের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। সেটির সমাধান ছিল দুটি। একটি সমাধান কাজ করত ঋণাত্মক আধানবিশিষ্ট ইলেকট্রনের জন্য। আর অন্যটি অজানা এক কণার জন্য, যে কণার আচরণ পুরোপুরি ইলেকট্রনের মতো, কিন্তু তড়িৎ আধান ধনাত্মক। এভাবেই ডিরাকের সমীকরণের মাধ্যমে প্রতিকণার অস্তিত্ব থাকার বিষয়টি নজরে আসে বিজ্ঞানীদের। প্রতিটি স্বাভাবিক বস্তুকণার বিপরীতে একটি করে প্রতিকণার অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনার কথা বলেন ডিরাক। পরবর্তী সময়ে ১৯৩২ সালে আমেরিকান পদার্থবিদ কার্ল ডি অ্যান্ডারসন প্রথমবারের মতো কসমিক রশ্মিতে সত্যি সত্যি এদের একটির অস্তিত্ব খুঁজে পান। নিশ্চিতভাবে আবিষ্কৃত হয় ইলেকট্রনের প্রতিকণা পজিট্রন।

তিন

প্রতিকণার নাগাল পাওয়া খুব একটা সহজ কাজ নয়। এদের দেখা পেতে হলে কাজে লাগাতে হয় আইনস্টাইনের ভর-শক্তি সমীকরণকে। শক্তিকে রূপান্তরের মাধ্যমে তৈরি করা যায় এদের। যত বেশি ভরের প্রতিকণা তৈরি করতে হবে, তত বেশি শক্তির প্রয়োজন পড়বে। শক্তির রূপান্তরের মাধ্যমে অবশ্য এককভাবে কোনো প্রতিকণা পাওয়া সম্ভব নয়। এরা সব সময় এদের বিপরীত স্বাভাবিক কণাসহ আবির্ভূত হয়। অর্থাৎ শক্তির রূপান্তরের মাধ্যমে আমরা যদি পজিট্রন পেতে চাই, তাহলে সঙ্গে একটি ইলেকট্রনও পাওয়া যাবে।

পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটর বা কণা ত্বরকযন্ত্রের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। বিশাল এ যন্ত্রে খুব দ্রুতগতিতে বিভিন্ন কণার মধ্যে সংঘর্ষ ঘটানো হয়। ফলে অবমুক্ত হয় বিপুল পরিমাণ শক্তি। এরা রূপান্তরিত হয়ে তৈরি করে কণা-প্রতিকণাজোড়। সাধারণত বেশি ভরের প্রতিকণা তৈরি করতে ব্যবহার করা হয় কণা ত্বরকযন্ত্রের। পজিট্রনের মতো কম ভরের প্রতিকণা তৈরি করতে এত কাঠখড় পোড়াতে হয় না। উচ্চশক্তিসম্পন্ন ফোটন থেকেই এদের পাওয়া যায়। বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় হরহামেশাই তৈরি হয় উচ্চশক্তির ফোটন। এছাড়াও ধনাত্মক বিটাক্ষয়প্রক্রিয়ায় সরাসরি পাওয়া সম্ভব পজিট্রন।

কণা বনাম প্রতিকণা
এবার একটি মজার তথ্য দেওয়া যাক। ঘরে বসেও চাইলে পজিট্রন পেতে পারি আমরা। এ জন্য খুব বেশি টাকাও খরচ করতে হবে না। কেবল বাজার থেকে কলা কিনে নিয়ে এলেই হবে!
আরও পড়ুন

এবার একটি মজার তথ্য দেওয়া যাক। ঘরে বসেও চাইলে পজিট্রন পেতে পারি আমরা। এ জন্য খুব বেশি টাকাও খরচ করতে হবে না। কেবল বাজার থেকে কলা কিনে নিয়ে এলেই হবে! কলার মধ্যে প্রচুর পরিমাণ পটাশিয়াম থাকে। সেই পটাশিয়ামের সামান্য অংশ তেজস্ক্রিয়। সেগুলো থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাওয়া যায় পজিট্রন। একটি সাধারণ আকারের কলায় ৪৮ মাইক্রোগ্রামের সমান তেজস্ক্রিয় পটাশিয়াম থাকতে পারে। সেগুলো থেকে প্রতি ৭৫ মিনিটে উৎপন্ন হতে পারে একটি করে পজিট্রন। কলা ছাড়া আমাদের আশপাশে আরও অনেক উৎস রয়েছে, যেগুলো থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রতিকণা তৈরি হচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হলো, এসব প্রতিকণার শেষ পরিণতি কী? কী ঘটে এদের ভাগ্যে? নিশ্চয়ই এদের অস্তিত্ব খুব বেশি সময় ধরে থাকে না। যদি থাকত, তাহলে বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই এদের শনাক্ত করে ফেলতে পারতেন। যা–ই হোক, সহজ করে বললে, উৎপন্ন হওয়ার খুব অল্প সময় পরেই প্রতিকণা ধ্বংস হয়ে যায়। যখন কোনো প্রতিকণা এর বিপরীত স্বাভাবিক কণার সংস্পর্শে আসে, তখনই তারা একে অন্যকে ধ্বংস করে দেয়। এ ঘটনার নাম অ্যানিহিলেশন।

চার

কী ঘটবে, যদি মাত্র শূন্য দশমিক ৫ গ্রাম প্রতিবস্তু ও শূন্য দশমিক ৫ গ্রাম স্বাভাবিক বস্তুকে পরস্পরের সংস্পর্শে আনা হয়? উত্তরটা বোধ করি সবারই জানা হয়ে গেছে এতক্ষণে। ঘটবে ভয়ংকর বিস্ফোরণ। মুক্ত হবে বিপুল পরিমাণ শক্তি। আইনস্টাইনের ভর-শক্তি সমীকরণ ব্যবহার করে এ শক্তির মান নিমেষে জেনে নেওয়া সম্ভব। আলোর বেগ ৩×১০ মিটার/সেকেন্ড হলে উৎপন্ন শক্তির মান হবে,

শক্তি = ভর × (আলোর বেগ)

= (০.৫ + ০. ৫) × (১০-৩)(৩×১০); [১ গ্রাম = ১০-৩ কিলোগ্রাম]

= ৯×১০১৩ জুল

ঠিক কতটুকু পরিমাণ শক্তি এটি? উদাহরণ দিই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষেপ করা হয়েছিল ‘লিটল বয়’ ও ‘ফ্যাট ম্যান’ নামের দুটি পারমাণবিক বোমা। প্রথমটিতে অবমুক্ত শক্তির পরিমাণ ছিল প্রায় ৬.৩×১০১৩ জুল এবং অন্যটিতে ৮.৪×১০১৩ জুল। অর্থাৎ মাত্র আধা গ্রামের সমান অ্যান্টিম্যাটার পারমাণবিক বোমার চেয়ে বেশি ধ্বংসলীলা চালাতে সক্ষম। তবে স্বস্তির বিষয় হলো, বর্তমান প্রযুক্তিতে এদের ব্যবহার করে বোমা তৈরি করা সম্পূর্ণ অসম্ভব।

বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস থেকে সহজেই পাওয়া যায় পজিট্রন। আর কণা ত্বরকযন্ত্র থেকে পাওয়া যায় অ্যান্টিপ্রোটন। এদের সমন্বয়ে প্রতিপরমাণু তৈরি করতে হলে প্রথমেই উভয়ের গতিবেগ কমিয়ে কাছাকাছি নিয়ে আসতে হয়। যদি ভাগ্য সহায় থাকে, তাহলে এরা একে অন্যের বাঁধনে বাঁধা পড়ে তৈরি করবে একটি অ্যান্টিহাইড্রোজেন পরমাণু। সার্নের গবেষকেরা বেশ সফলতার সঙ্গে এ প্রক্রিয়ায় এগুলো তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন
আরও পড়ুন

সমস্যাটি আসলে ঠিক কোথায়? কেন এগুলো তৈরি করা সম্ভব নয়? প্রথম সমস্যা, পর্যাপ্ত পরিমাণ অ্যান্টিম্যাটার তৈরি করা নিয়ে। আলাদাভাবে অ্যান্টিপার্টিকেল বা প্রতিকণা তৈরি খুব একটা কঠিন কিছু নয়। বর্তমান প্রযুক্তিতে বেশ ভালোভাবেই করা সম্ভব। কিন্তু এদের সমন্বয়ে প্রতিপরমাণু তৈরি করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস থেকে সহজেই পাওয়া যায় পজিট্রন। আর কণা ত্বরকযন্ত্র থেকে পাওয়া যায় অ্যান্টিপ্রোটন। এদের সমন্বয়ে প্রতিপরমাণু তৈরি করতে হলে প্রথমেই উভয়ের গতিবেগ কমিয়ে কাছাকাছি নিয়ে আসতে হয়। যদি ভাগ্য সহায় থাকে, তাহলে এরা একে অন্যের বাঁধনে বাঁধা পড়ে তৈরি করবে একটি অ্যান্টিহাইড্রোজেন পরমাণু। সার্নের গবেষকেরা বেশ সফলতার সঙ্গে এ প্রক্রিয়ায় এগুলো তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন। কিন্তু আপাতত এ পর্যন্তই আমাদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা। প্রতিপরমাণুর সমন্বয়ে প্রতি–অণু তৈরি করা এখনো মানুষের নাগালের বাইরে। আর আধা গ্রাম অ্যান্টিম্যাটার তৈরি করা তো আপাতত কল্পনারও বাইরে।

দ্বিতীয় সমস্যা অ্যান্টিম্যাটার সংরক্ষণ করা নিয়ে। বিপরীত স্বাভাবিক কণার এতটুকু স্পর্শ পেলেই এগুলো একে অন্যকে ধ্বংস করে দেয়। তাই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে অবশ্যই এদের স্বাভাবিক কণা থেকে দূরে সরিয়ে রেখে সংরক্ষণ করতে হবে। এটি মোটেও সহজ কোনো কাজ নয়। কারণ, প্রচলিত কোনো পদ্ধতি আমরা ব্যবহার করতে পারব না। আমাদের হাঁটতে হবে ভিন্নপথে। প্রথমেই তৈরি করতে হবে ভ্যাকুয়াম বা শূন্যস্থান। তারপর সেখানে উৎপাদন করতে হবে প্রতিকণা। উৎপন্ন হওয়ার পরই এরা ভ্যাকুয়াম ছাড়িয়ে বিভিন্ন দিকে চলে যেতে চাইবে। ঠিক তখনই আমাদের কাজে লাগাতে হবে ইলেকট্রিক ও ম্যাগনেটিক ফিল্ড। এদের কল্যাণে প্রতিকণা বাঁধা পড়ে থাকবে অদৃশ্য এক জেলখানায়। পুরো বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। তাই অ্যান্টিম্যাটারের শক্তি কাজে লাগানো এখনো আমাদের ধরাছোঁয়ার বেশ খানিকটা দূরেই রয়েছে।

পাঁচ

আলোচনার শুরুতেই আমরা বলেছিলাম, প্রতিকণা আসলে স্বাভাবিক কণার মতোই। পার্থক্য কেবল এদের কোয়ান্টাম সংখ্যায়। বাকি সব একই রকম। আসলে এ কথা পুরোপুরি সত্য কি না, তা বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিতভাবে জানেন না। আপাতত পাওয়া তথ্যপ্রমাণ সাপেক্ষে তাঁরা এমনটাই অনুমান করেন। প্রতিকণা নিয়ে বিজ্ঞানীদের জানাশোনা এখনো সীমিত। এদের ঘিরে থাকা অনেক রহস্যের কূলকিনারা এখন পর্যন্ত হয়নি। তেমনই একটি রহস্যের নাম অ্যান্টিম্যান্টার অ্যাসিমেট্রি প্রবলেম।

মহাবিশ্বে সমানসংখ্যক কণা ও প্রতিকণার অস্তিত্ব থাকার কথা। কিন্তু এমনটা হয়নি। মহাবিশ্বের সবখানে কেবল স্বাভাবিক কণার রাজত্ব। প্রতিকণার দেখা মেলে খুব কম। তাহলে, কোথায় হারাল প্রতিকণাগুলো?

একটু ব্যাখ্যা করা যাক। মহাবিশ্বের যাত্রা শুরু হয়েছিল বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে একটি বিন্দু থেকে। সে বিন্দু ছিল অকল্পনীয় শক্তির আধার। সেসব শক্তি রূপান্তরিত হয়েছিল কণা-প্রতিকণাযুগলে। পরমুহূর্তেই এরা একে অন্যকে ধ্বংস করে দিয়ে পুনরায় রূপান্তরিত হয়েছিল শক্তিতে। বিগ ব্যাংয়ের পর এ প্রক্রিয়া ক্রমাগত চলতে থাকে। তবে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে ঘটে ছন্দপতন। কারণ, সম্প্রসারণের ফলে ধীরে ধীরে ঠান্ডা হতে থাকে মহাবিশ্ব। একসময় বন্ধ হয়ে যায় কণা-প্রতিকণা যুগল তৈরির প্রক্রিয়া। যদি এভাবেই সূচনা হয় মহাবিশ্বের, তাহলে তো মহাবিশ্বে সমানসংখ্যক কণা ও প্রতিকণার অস্তিত্ব থাকার কথা। কিন্তু এমনটা হয়নি। মহাবিশ্বের সবখানে কেবল স্বাভাবিক কণার রাজত্ব। প্রতিকণার দেখা মেলে খুব কম। তাহলে, কোথায় হারাল প্রতিকণাগুলো?

খুব সম্ভবত বিগ ব্যাংয়ের পর উৎপন্ন হওয়া কণা ও প্রতিকণার সংখ্যা একদম সমান ছিল না; সামান্য অসামঞ্জস্যতা ছিল। প্রতি ১০ লাখ কণা-প্রতিকণা যুগলে একটি অতিরিক্ত স্বাভাবিক কণা তৈরি হয়েছিল। ফলে যুগলগুলো একে অপরকে ধ্বংস করে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে গেলেও থেকে গিয়েছিল অতিরিক্ত স্বাভাবিক কণাগুলো। এদের নিয়েই তৈরি হয়েছে আমাদের বর্তমান মহাবিশ্ব। এদের দিয়েই গঠিত আমরা সবাই। এ ক্ষেত্রেও প্রশ্ন আসে, কেন ও কীভাবে তৈরি হলো বাড়তি সেই স্বাভাবিক কণা? এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের অজানা। তা ছাড়া এখন পর্যন্ত প্রতিকণাদের নিয়ে এসবই পদার্থবিদদের যৌক্তিক অনুমান। নিশ্চিত প্রমাণের খোঁজে তাঁরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। দেখা যাক, তাঁদের চেষ্টা সফল হয় কি না।

লেখক: অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (এনপিসিবিএল)

সূত্র: ১. দ্য ম্যাটার-অ্যান্টিম্যাটার অ্যাসিমেট্রি, হোম ডট সার্ন

২. দ্য স্টোরি অব অ্যান্টিম্যাটার, সারাহ মারকুয়ার্ট

৩. আ কার্টুন গাইড টু দ্য ফ্যাসিনেটিং রেলম অব ফিজিকস, ড. বেঞ্জামিন ভার, ড. বরিস লেমার, রিনা পিকলো