কোয়ান্টাম স্কেলে সময় পরিমাপের নতুন উপায়

সময়ের পরিমাপ বলতে আমরা যা বুঝি তা হলো, ‘এখন’ আর ‘তখন’ এর মধ্যকার সময়ের ব্যবধান। অর্থাৎ অতীত ও বর্তমানের দুটি বিন্দুর মাঝের পার্থক্যেকে আমরা সময় হিসেবে পরিমাপ করি। বর্তমানে প্রায় সব ঘড়ি কাজ করে এভাবে।

কোয়ান্টাম পর্যায়ে ইলেকট্রনের কম্পন অবশ্য ভিন্ন কথা বলে। সেখানে ‘তখন’ বিষয়টা সবসময় নিশ্চিত নয়। এমনকি ‘এখন’ ব্যাপারটাও ধোঁয়াশায় ঢাকা। স্টপওয়াচ এ ক্ষেত্রে আর কাজ করে না। এ সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান লুকিয়ে আছে কোয়ান্টাম মেঘের আকৃতির মাঝেই। ২০২২ সালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে এমনটাই দাবি করেন সুইডেনের আপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। গবেষণাপত্রটি ১৮ অক্টোবর ফিজিক্যাল রিভিউ রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত হয়।

এ গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল, বস্তুর তরঙ্গের মতো ধর্ম। একে বলা হয় রিডবার্গ অবস্থা। এখানে সময় পরিমাপের জন্য কোনো সূচনা বিন্দুর প্রয়োজন হয় না।

রিডবার্গ পরমাণুগুলো অনেকটা ফোলানো বেলুনের মতো। তবে এখানে পরমাণুর ইলেকট্রন মেঘকে ফোলানোর জন্য বায়ুর পরিবর্তে এনার্জি বা শক্তি ব্যবহার করা হয়। আর পরমাণুর অভ্যন্তরে এ শক্তি সরবরাহ করা হয় লেজার ব্যবহার করে। রিডবার্গ পরমাণুর ইলেকট্রন মেঘ নিউক্লিয়াস থেকে বেশ দূরে অবস্থান করে।

লেজারের মাধ্যমে ইলেকট্রনকে উত্তেজিত করতে প্রতিটি ইলেকট্রনকে আলাদাভাবে উত্তেজিত করার প্রয়োজন হয় না। থেমে থেমে লেজার নিক্ষেপ করে ইলেকট্রনকে উচ্চ শক্তিস্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় লেজারের মধ্যকার আলোর শক্তি চলে যায় ইলেকট্রনের কাছে। কিছু কিছু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে আবার ইলেকট্রনের অবস্থান পরবর্তনের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করার জন্য দ্বিতীয় আরেকটি লেজার ব্যবহৃত হয়। এর মাঝে সময়ের প্রবাহও আছে। এ পদ্ধতিকে বলা হয় পাম্প-প্রোব পদ্ধতি। তাৎক্ষণিকভাবে কোনো উচ্চ গতিসম্পন্ন ইলেকট্রনের গতি পরিমাপের জন্য এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়।

পরমাণুকে রিডবার্গ অবস্থায় নিয়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়। বেশ কঠিন। বলা প্রয়োজন, কোনো পরমাণু রিডবার্গ অবস্থায় নেওয়ার সময় ইলেকট্রনের গতিবিধি সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন পদার্থবিজ্ঞানীরা।

কোয়ান্টাম অবস্থায় এসব ইলেকট্রন অনেকটা প্রাণীর মতো আচরণ করে। ইলেকট্রনের নড়াচড়া এ সময় অ্যাবাকাস-এর ঘুঁটিগুলোর মতো হয়। ইলেকট্রনের এই আচরণকে গাণিতিক ভাষায় বলা হয় ‘রিডবার্গ তরঙ্গ প্যাকেট’।

স্বাভাবিক তরঙ্গের মতো একাধিক রিডবার্ড তরঙ্গ প্যাকেট একই তলে স্পন্দিত হলে, এদের মাঝে উপরিপাতন ঘটে। অর্থাৎ একটি তরঙ্গ আরেকটির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়ে। ফলাফল হিসেবে অনন্য প্যাটার্ন তৈরি হয়। আণবিক অঞ্চলে যথেষ্ট পরিমাণ রিডবার্গ তরঙ্গ প্যাকেট ফেলতে পারলে এমন কিছু অনন্য প্যাটার্ন তৈরি করবে, যারা প্রত্যেকে আলাদা আলাদা সময় নির্দেশ করবে। কারণ, এসব তরঙ্গ তখন একটি অন্যটির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে নিজেরা বিকশিত হয়। আমরা একে সময়ের অনন্য ছাপ বলতে পারি।

নতুন গবেষণাটিতে বিজ্ঞানীরা সময়ের অনন্য ছাপ যাচাই করে দেখেন। এতে দেখা যায়, কোয়ান্টাম টাইমস্ট্যাম্পিং বা কোয়ান্টাম চিহ্ন-এর একটি রূপ হিসেবে কাজ করার জন্য এরা যথেষ্ট স্থিতিশীল। উত্তেজিত হিলিয়াম পরমাণু ব্যবহার করে পরীক্ষাটি করা হয়।

সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী ও গবেষক দলটির প্রধান মার্তা বারহোল্টস বলেন, ‘আপনি যদি কাউন্টার ব্যবহার করেন, তবে আপনাকে শূন্যকে ব্যাখ্যা করতে হবে। গণনা শুরু করতে হবে একই বিন্দু থেকে। এর সুবিধা হলো, আপনার ঘড়ি চালু করার প্রয়োজন নেই। শুধু ইন্টারফিয়ারেন্স বা ব্যতিচার কাঠামোর দিকে তাকালেই বলতে পারবেন, ৪ চার ন্যানোসেকেণ্ড বা ৫ ন্যানোসেকেন্ড বা এতটা সময় পেরিয়ে গেছে।’

অর্থাৎ নতুন এ পদ্ধতিতে সময় পরিমাপের জন্য কোনো শুরু বা শেষ বিন্দুর প্রয়োজন হয় না। যেকোনো সময়েই পরমাণুর কোয়ান্টাম স্তরে উঁকি দিলেই বোঝা যাবে, কী পরিমাণ সময় অতিবাহিত হয়েছে। পাশাপাশি নির্ণয় করা যায় সূক্ষ্মতম সময়। এ পদ্ধতিতে সেকেন্ডের ১.৭ ট্রিলিয়ন ভাগের একভাগ সময় পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেছেন বিজ্ঞানীরা।

ভবিষ্যতে কোয়ান্টাম ঘড়ির পরীক্ষায় হিলিয়ামের পরিবর্তে অন্যান্য পরমাণু ব্যবহারের কথা ভাবছেন বিজ্ঞানীরা। সেই সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন শক্তির লেজার ব্যবহার করতে পারেন। এতে করে বিস্তৃত পরিসরে এই পদ্ধতি কীভাবে ও কতটুকু  কাজ করে, তা জানা সম্ভব হবে। এমনটাই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ।

সূত্র: সায়েন্স অ্যালার্ট