কোয়ান্টাম-সীমা ছাড়িয়ে, বড় পরিসরে টানেলিং গবেষণায় পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল জয়

এ বছর পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার পেলেন জন ক্লার্ক, মিশেল দ্যভোরে এবং জন মার্টিনিসনোবেল কমিটি

এতক্ষণে সবাই জেনে গেছেন, এ বছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন জন ক্লার্ক, মিশেল এইচ. দ্যভোরে এবং জন মার্টিনিস নামে তিন মার্কিন বিজ্ঞানী। নোবেল কমিটি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল টানেলিং এবং ইলেকট্রিক সার্কিটে এনার্জি কোয়ান্টাইজেশন গবেষণার জন্য তাঁদের এ পুরস্কার দেওয়া হয়।’ জটিল এই ইংরেজি শব্দগুলোর মানে কী?

কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অদ্ভুতুড়ে জগতে যেসব অদ্ভুত ঘটনা ঘটে; এই বিজ্ঞানীরা সেই ঘটনাগুলো ঘটিয়েছেন হাতে ধরে দেখা সম্ভব, এত বড় পরিসরের কাঠামোয়। কাজটা আপাত দৃষ্টিতে বা প্রথম শুনে শুধু অবিশ্বাস্য নয়, একরকম অসম্ভব মনে হয়। সেই ‘প্রায় অসম্ভব’কে সম্ভব করতে এই বিজ্ঞানীরা বিশেষ একধরনের অতিপরিবাহী বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা বানিয়েছেন। এই ব্যবস্থা বা সিস্টেমটি এক দশা থেকে অন্য দশায় এমনভাবে চলে যেতে পারে যে দেখে মনে হবে, জিনিসটা বুঝি কোনো দেয়াল ভেদ করে অন্য পাশে চলে গেছে।

বাঁ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী জন ক্লার্ক, মিশেল দ্যভোরে এবং জন মার্টিনিস
ফিজিকস ওয়ার্ল্ড

দেয়াল বা মাটি ভেদ করতে মানুষ সুড়ঙ্গ খোঁড়ে। কোয়ান্টাম ব্যবস্থার এ ধরনের কাজকর্ম দেখে মনে হয়, এটাও যেন সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে দেয়াল ভেদ করে ওপারে চলে গেছে। ফলে এ ঘটনাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘টানেলিং’। বাংলায় বলা হয় ‘সুড়ঙ্গ প্রভাব’। তাঁরা আরও দেখিয়েছেন, তাঁদের এই সিস্টেমটি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ভবিষ্যদ্বাণীর মতো করেই নির্দিষ্ট আকার বা প্যাকেট প্যাকেট করে শক্তি শোষণ ও নিঃসরণ করতে পারে।

বিষয়টা ভালোভাবে বুঝতে হলে প্রথমে ‘ম্যাক্রোস্কোপিক’ বা ‘বড় পরিসর’ এবং ‘মাইক্রোস্কোপিক’ বা ‘অতিক্ষুদ্র পরিসর’ কী, তা বুঝতে হবে। পাশাপাশি বুঝতে হবে কোয়ান্টাম জগতের বৈশিষ্ট্য, বিভিন্ন কোয়ান্টাম প্রভাব এবং কোয়ান্টাম টানেলিং। সবচেয়ে বড় কথা, এই আবিষ্কার কেন গুরুত্বপূর্ণ? কী লাভ এত কোয়ান্টাম মেকানিকস করে? এই লেখায় সেই আলোচনাই করব।

বৈপ্লবিক পরীক্ষানিরীক্ষা

শুরুটা করা যাক নোবেলজয়ী পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যানের একটি উক্তি দিয়ে। তিনি বলেছেন, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা নামের যে আজব নিয়ম মেনে উপপারমাণবিক কণারা নিজেদের ক্যারিশমা দেখিয়ে বেড়ায়, সেই সব আজব নিয়ম আসলে দুনিয়ার কেউই বোঝে না। আরও একটু এগিয়ে ফাইনম্যান এ–ও বলেছেন, কেউ যদি দাবি করে যে তারা এসব নিয়ম বোঝেন, তাহলে সেটা ডাহা মিথ্যা কথা!

কোয়ান্টাম বলবিদ্যা নামের আজব বিজ্ঞানটা কেউ না বুঝলেও মুঠোফোন বা ঘরের কম্পিউটার, চিকিৎসা বা গবেষণার কাজে ব্যবহৃত ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ বা ঘরের এলইডি বাতির ভেতরের এলইডি বা লাইট এমিটিং ডায়োড—এসবই বানানো হয়েছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার নিয়ম মেনে। এই এক বিজ্ঞান, যা আমরা ঠিকমতো বুঝি না; কিন্তু আমাদের ঘুমানো, সকালে অ্যালার্ম শুনে জেগে ওঠা থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই কলকাঠি নাড়ছে এটি। ঘাপটি মেরে আছে, জানান দিচ্ছে না আলাদা করে নিজের কথা, কিন্তু উশুল করে দিচ্ছে ষোলো আনা।

কিন্তু এতক্ষণ ধরে যা কিছু বলছি, কোয়ান্টামের যে অদ্ভুত জগৎ, তার পরিসরটি অত্যন্ত ছোট। পরমাণু বা আরও ছোট উপপারমাণবিক কণার মতো ক্ষুদ্র জগতেই এর কাজ। এ জগৎকে পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘মাইক্রোস্কোপিক’ জগৎ। এর বিপরীতে যা কিছু আমরা দেখি, ছুঁতে পারি—বলা যায়, যা কিছু মানুষের কাছে দৃশ্যমান, এই সবই ম্যাক্রোস্পোপিক বা বড় পরিসরের ঘটনা।

যেমন আমরা প্রতিদিন যে বল (টেনিস বল) দেখি, তা অকল্পনীয় সংখ্যক অণু দিয়ে গঠিত। এতে আপনি কোয়ান্টাম প্রভাব দেখতে পাবেন না। আমরা জানি, একটা বলকে দেয়ালে ছুড়ে মারলে তা প্রতিবারই ফিরে আসবে। কিন্তু কোয়ান্টামের অদ্ভুত জগতে হয় কী, একটিমাত্র কণা মাইক্রোস্কোপিক জগতে একই ধরনের বাধার মুখে পড়লে মাঝেমধ্যেই সেই বাধা পেরিয়ে অন্য পাশে হাজির হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ কোনো ইলেকট্রনকে দেয়ালের গায়ে ছুড়ে দিলে দেখবেন, দেয়ালের ভেতরে যেন অদৃশ্য কোনো সুড়ঙ্গ আছে, সেই সুড়ঙ্গ ধরে ওটা চলে গেছে দেয়ালের ওপারে। এই সেই টানেলিং বা সুড়ঙ্গ প্রভাব। বাস্তবে এই ঘটনা দেখা যায় সেমিকন্ডাক্টরের ভেতরে। দেখা যায়, শক্তির বাধা পেরিয়ে কিছু কণা ওপাশে চলে গেছে। এর ফলেই আমাদের মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে কম্পিউটারসহ সব ধরনের বৈদ্যুতিক যন্ত্র কাজ করতে পারে। এ বছরের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল জয়ী বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, এই কোয়ান্টাম টানেলিং কোয়ান্টাম জগতের সীমা ছাড়িয়ে, ম্যাক্রোস্কোপিক বা বড় স্কেলেও পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব।

ঘটনার শুরু ১৯৮৪-৮৫ সালে। জন ক্লার্ক, মিশেল দ্যভোরে এবং জন মার্টিনিস যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলেতে এই পরীক্ষাগুলো চালান। পরীক্ষাগুলো তাঁরা করেন সুপারকন্ডাক্টর বা অতিপরিবাহীর ভেতরে।

সেমিকন্ডাক্টরকে আমরা বাংলায় বলি অর্ধপরিবাহী। অর্থাৎ এর মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহের সময় কিছুটা বাধা পায়। আর সুপারকন্ডাক্টর কথাটির বাংলা হলো অতিপরিবাহী। এই বাংলা থেকেই বুঝতে পারছেন, এর মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহের সময় কোনোরকম বাধা পায় না। এরকম বাধাহীন এক পরিবাহী তথা সুপারকন্ডাক্টর দিয়ে তাঁরা একটি বৈদ্যুতিক সার্কিট তৈরি করেন। এ জন্য তাঁরা ব্যবহার করেন দুটি সুপারকন্ডাক্টর। এই দুটি সুপারকন্ডাক্টরের মাঝখানে বসানো হয় একটি (বিদ্যুতের) অপরিবাহী পাতলা স্তর। এই পরীক্ষায় তাঁরা দেখান, সুপারকন্ডাক্টরের ভেতরের সবকটি চার্জিত কণা একসঙ্গে এমনভাবে আচরণ করে যেন তারা একটি একক কণা—বা কণামেঘ, রয়েছে পুরো সার্কিটজুড়ে, একসঙ্গে।

পরীক্ষায় এই কণার মতো সিস্টেমটি প্রথমে শূন্য ভোল্টেজ দশায় আটকে ছিল। শূন্য ভোল্টেজ বা ভোল্টেজহীন এই অবস্থায় পুরো সিস্টেমটির এই দশা পরিবর্তনের মতো যথেষ্ট শক্তি থাকার কথা নয়। অথচ পরীক্ষায় দেখা গেল, হঠাৎ করেই সেখানে ভোল্টেজ এসে হাজির! না, জাদু বা ভেলকি নয়; বিজ্ঞানীরা দেখলেন, সিস্টেমটি আসলে কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্য দেখিয়েছে এই এক্সপেরিমেন্টে। টানেলিং বা সুড়ঙ্গ প্রভাব ব্যবহার করে এটি শূন্য ভোল্টেজ—মানে ‘সুইচ (বা লিভার) অফ’ থেকে হঠাৎ ভোল্টেজ হাজির—মানে ‘সুইচ (বা লিভার) অন’ অবস্থায় চলে গেছে। এরই নাম দেওয়া হলো ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম টানেলিং।

শুধু তা-ই নয়, দেখা গেল, এই সিস্টেম শক্তি শোষণ বা নিঃসরণ করে সব সময় নির্দিষ্ট পরিমাণে। আমরা জানি, পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস। তাকে ঘিরে নির্দিষ্ট কক্ষপথে থাকে ইলেকট্রন। এই ইলেকট্রন যেমন পরমাণুর ভেতরে এক কক্ষপথ থেকে আরেক কক্ষপথে যেতে শুধু নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি শোষণ বা নিঃসরণ করে (শক্তির এই পরিমাণ বা প্যাকেটকে বলা হয় ‘কোয়ান্টা’), বিজ্ঞানীরা বুঝলেন, সেই একই বৈশিষ্ট্য দেখাচ্ছে তাঁদের এই সিস্টেম। এই প্রথম বড় পরিসরে, আমাদের কাছে দৃশ্যমান জগতে কোয়ান্টাম জগতের অদ্ভুতুড়ে বৈশিষ্ট্য দেখা গেল।

টানেলিং এবং পেছনের কথা

এবারের নোবেল জয়ী বিজ্ঞানীদের সাহায্য করেছে আগের কয়েক দশক ধরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন ধারণা এবং পরীক্ষামূলক সরঞ্জাম। ততদিনে আপেক্ষিকতা তত্ত্বের পাশাপাশি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি হয়ে উঠেছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। এবং ইলেকট্রন বা এ ধরনের একটিমাত্র উপপারমাণবিক কণার (অর্থাৎ পরমাণুর চেয়েও ছোট কণা) সুড়ঙ্গ প্রভাব ব্যবহারের ক্ষমতার কথা ততদিনে বিজ্ঞানীরা জানতেন। ১৯২৮ সালে পদার্থবিদ জর্জ গ্যামো বুঝতে পারেন, কিছু ভারী পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের বিশেষ ধরনের ক্ষয়ের কারণ এই টানেলিং। এখানে দেয়াল বা বাধা কোনটা?

পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ভেতরে নিউক্লিয়ার বল কাজ করে। এটি নিউক্লিয়াসের চারপাশে একধরনের শক্তির বাধা তৈরি করে ভেতরে প্রোটন ও নিউট্রন কণাকে আটকে রাখে। এর পরেও মাঝেমধ্যে কোনো কোনো প্রোটন (এবং নিউট্রন) এই বাধা ভেদ করে বেরিয়ে আসে। এতে ওই নিউক্লিয়াস সম্পূর্ণ নতুন এক মৌলে পরিণত হয়। টানেলিং ছাড়া এ ধরনের পারমাণবিক ক্ষয় সম্ভব নয়। আবার সেমিকন্ডাক্টর বানানো হয় ট্রানজিস্টর বা ডায়োডের মতো খুদে ইলেকট্রনিক যন্ত্র দিয়ে। সেগুলোতে ইলেকট্রন কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের মাধ্যমে চলাচল করে বলেই সম্ভব হয়েছে আজকের সব বৈদ্যুতিক যন্ত্র।

পদার্থবিজ্ঞানীরা শিগগিরই ভাবতে শুরু করেন, এমন কোনো টানেলিং ঘটানো কি সম্ভব, যেখানে একসঙ্গে একাধিক কণার টানেলিং হবে?

সাধারণ পরিবাহী পদার্থে মুক্ত ইলেকট্রন পুরো পদার্থের মধ্যে ছুটে বেড়ায়। এর ফলেই বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। তবে এতে অনেক কম হলেও চলাচলে কিছুটা বাধা পায় ইলেকট্রন। বিজ্ঞানীরা দেখলেন, অত্যন্ত কম তাপমাত্রায় কিছু কিছু পদার্থের ভেতরে ইলেকট্রনগুলো দলবদ্ধ হয়ে ছন্দবদ্ধ স্রোতের মতো কোনোরকম বাধা ছাড়াই প্রবাহিত হয়। এই যে কোনোরকম বাধাহীন ইলেকট্রনের প্রবাহ—এটাই অতিপরিবাহিতা। আর এসব পদার্থকে বলে অতিপরিবাহী বা সুপারকন্ডাক্টর। এ সময় ইলেকট্রনগুলো জোড়ায় জোড়ায় যুক্ত থাকে। এই জোড়া বা পেয়ারকে বলা হয় ‘কুপার পেয়ার’। লিওন কুপার, জন বার্ডিন এবং রবার্ট শিফার প্রথম সুপারকন্ডাক্টর কীভাবে কাজ করে, তা ব্যাখ্যা করেন। এ জন্য ১৯৭২ সালে তাঁদের নোবেল দেওয়া হয়। এর প্রথম জন লিওন কুপারের নামেই ওই কুপার পেয়ার নাম রাখা হয়েছে।

কুপার পেয়ারগুলো সাধারণ ইলেকট্রনের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে আচরণ করে। আমরা জানি, একই বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দুটি ইলেকট্রন কখনো একই জায়গায় থাকতে পারে না। পাঠ্যবইতে পাউলির বর্জন নীতি হিসাবে এটা আমরা পড়েছি। কিন্তু সুপারকন্ডাক্টরের ইলেকট্রনগুলো যখন জোড়া বাঁধে, তখন তারা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য কিছুটা হারিয়ে ফেলে। অর্থাৎ দুটি আলাদা ইলেকট্রন সব সময় স্বতন্ত্র হলেও দুটি কুপার পেয়ার হুবহু একরকম হতে পারে। এর মানে, একটি সুপারকন্ডাক্টরের সব কটি কুপার পেয়ারকে একটি একক সত্তা বা একটি কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল সিস্টেম হিসেবে বর্ণনা করা যায়। কোয়ান্টাম মেকানিকসের ভাষায়, এদেরকে একটিমাত্র ‘ওয়েভ ফাংশন’ দিয়ে বর্ণনা করা যায়। এই ওয়েভ ফাংশনটি সিস্টেমটিকে একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় এবং নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যসহ পর্যবেক্ষণ করার সম্ভাবনা বর্ণনা করে। এবারের নোবেল জয়ীদের পরীক্ষায় এই সম্মিলিত অবস্থার ওয়েভ ফাংশনের বৈশিষ্ট্যগুলোই প্রধান ভূমিকা রেখেছে।

এবারের নোবেল জয়ী গবেষণার আগে আরও দুজন বিজ্ঞানীর কথা বলতে হয়। এর একজন ব্রায়ান জোসেফসন। দুটি সুপারকন্ডাক্টরকে একটি পাতলা ইনসুলেটর (অন্তরক বা বাধা) দিয়ে যুক্ত করা হলে, ওই বাধার মধ্য দিয়েই একধরনের যোগাযোগ (বা সুড়ঙ্গ) গড়ে ওঠে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ভাষায় একে বলা হয় ‘জোসেফসন জাংশন’। বলা বাহুল্য, ব্রায়ান জোসেফসনের নামেই এই নামকরণ। এই বিজ্ঞানী দেখান, এই জাংশনের দুই পাশে অদ্ভুত কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল ঘটনা ঘটে। এরপরে, তাঁর এ কাজ আরও এগিয়েন নেন অ্যান্থনি লেগেট। জোসেফসন জংশনে ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম টানেলিং হতে পারে কি না, এ বিষয়ক তাত্ত্বিক কিছু কাজ করেন তিনি। এ জন্য ২০০৩ সালে তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।

এবারের নোবেল জয়ীরা কীভাবে কী করলেন

এই বিজ্ঞানীদের গবেষণাগুলো জন ক্লার্কের গবেষণার আগ্রহের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে গিয়েছিল। তিনি তখন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের অধ্যাপক। ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে মিশেল দ্যভোরে প্যারিসে পিএইচডি শেষ করে জন ক্লার্কের গবেষণা দলে পোস্টডক হিসেবে যোগ দেন। এই দলেই ছিলেন পিএইচডি শিক্ষার্থী জন মার্টিনিস। তিন জন একসঙ্গে মিলে চ্যালেঞ্জ নিলেন, ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম টানেলিং সম্ভব কি না, তার একটা বিহিত করেই ছাড়বেন।

পরীক্ষার সেটআপ সাজানো হলো। বৈদ্যুতিক সার্কিটের সব বৈশিষ্ট্য দেখেশুনে, এবং বাইরের সব ধরনের প্রভাব পরিমাপ করে তাঁরা নিশ্চিত হলে, এর খুঁটিনাটি সব এখন তাঁদের নখদর্পনে। এবার কোয়ান্টাম ঘটনা পরিমাপ করতে হবে। সে জন্য তাঁরা জোসেফসন জাংশনে একটি দুর্বল বিদ্যুৎ প্রবাহ পাঠিয়ে সেটার ভোল্টেজ পরিমাপ করেন। স্বাভাবিকভাবেই এই জাংশনের ভোল্টেজ শুরুতে ছিল শূন্য। এরপর তাঁরা দেখেন, সিস্টেমটি টানেল করে এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে এবং একটা ভোল্টেজ তৈরি করতে কত সময় নেয়।

কোয়ান্টাম মেকানিকস হলো সম্ভাবনার বিজ্ঞান। সব সম্ভবের এই বিজ্ঞানে পরিমাপ করতে হয় খুঁটিয়ে। অসংখ্যবার পরিমাপ করে, সেগুলোকে গ্রাফে প্লট করে এই বিজ্ঞানীরা দেখেন, সিস্টেমটা কতক্ষণ পর শূন্য ভোল্টেজের দশা থেকে ভোল্টেজ দশায় আসে। অর্থাৎ কখন এতে ভোল্টেজ তৈরি হয়। একসময় দেখা গেল, ঘটনা ঘটেছে। টানেলিংয়ের মাধ্যমে এই সিস্টেমের কুপার পেয়ারগুলো সুসংবদ্ধ একটিমাত্র বিশাল কণার মতো আচরণ করেছে। নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি শোষণ করে এটি নিজ দশা বদলে ফেলেছে, এখন এতে ভোল্টেজ আছে! এভাবে কোয়ান্টাম জগতের সীমা ছাড়িয়ে কোয়ান্টামের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য চলে এল আমাদের দৃশ্যমান জগতে—ম্যাক্রোস্কোপিক স্কেলে। অসংখ্যবার পরিমাপ করার ফলে (ঠিক অর্ধায়ু বা নিউক্লিয়াসের স্বতস্ফূর্ত তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের মতোই) এ ঘটনা ঘটার একটা গড় সময়ও তাঁরা নির্ণয় করলেন। বিষয়টা কেমন, তা ব্যাখ্যা করতে অর্ধায়ুর কথাটা ছোট্ট করে বলি।

আমরা জানি, তেজস্ক্রিয় মৌলগুলোর নিউক্লিয়াস নিজে নিজে ক্ষয় হতে থাকে। কোনো তেজস্ক্রিয় পরমাণুর নমুনা রেখে দেওয়া হলে একটা নির্দিষ্ট সময় পর দেখা যায়, এর অর্ধেক পরিমাণ ক্ষয়ে গেছে। এই অর্ধেক পরিমাণ ক্ষয় হতে যে সময় লাগে, তার নাম অর্ধায়ু বা হাফ-লাইফ। তেজস্ক্রিয় মৌলগুলোর প্রতিটির অর্ধায়ু নির্দিষ্ট। যেমন তেজস্ক্রিয় কার্বন-১৪ (এতে ৬টি প্রোটন ও ৮টি নিউট্রন থাকে)-এর অর্ধায়ু ৫,৭৩০ বছর। অর্থাৎ ১০০ গ্রাম নমুনা রেখে দিলে ৫ হাজার ৭৩০ বছর পর এই নমুনার অর্ধেক ক্ষয় হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক কোন পরমাণুটি ক্ষয় হবে বা হারিয়ে যাবে, এটা আমরা জানি না। তাহলে এই সময়টা কীভাবে মাপা হলো? হাজারো বার হিসাব করার পর একটা গড় সময় পাওয়া গেছে, সেই সময়টাই এই অর্ধায়ু। একইভাবে অসংখ্যবার পরিমাপ করে ম্যাক্রোস্কোপিক স্কেলে টানেলিং ঘটার গড় সময় নির্ণয় করেন এই বিজ্ঞানীরা।

সময় যেহেতু জানা গেল, এবারে সেই অতিবিশাল একটিমাত্র কণাকে শূন্য ভোল্টেজ দশায় বিভিন্ন শক্তির তরঙ্গদৈর্ঘ্য সরবরাহ করতে লাগলেন বিজ্ঞানীরা। দেখা গেল, এই অতিবিশাল কণা শুধু নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি শোষণ করে উচ্চ শক্তিদশায় চলে যায়। আবার সেই একই পরিমাণ শক্তি নিঃসরণ করে এটি নিম্ন শক্তিদশায় নেমে আসে। ঠিক ইলেকট্রনের কক্ষপথ পরিবর্তনের মতো। সেই সঙ্গে দেখা গেল, শক্তি যত বেশি, টানেলিং তত দ্রুত ঘটে। এভাবে বোঝা গেল, পুরো সিস্টেমটি বড় পরিসরে হুবহু কোয়ান্টাম জগতের কণার মতো কাজ করছে।

কেন গুরুত্বপূর্ণ এই বিজ্ঞানীদের গবেষণা

‘শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল’ নামের বিখ্যাত মানস পরীক্ষাটি বাস্তবে করা গেলে কী হতো? কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রভাব হাতে-কলমে দেখতে পারতাম আমরা। উদাহরণটা আমরা বুঝি, কাজেই বিড়াল মেরে বা না পেরে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা পর্যবেক্ষণের এই উদাহরণ আমাদের এতটা আকৃষ্ট করে।

এই পরীক্ষাটিও সেরকম। এটি কোয়ান্টাম মেকানিকস সম্পর্কে আমাদের আরও গভীর ধারণা দিয়েছে। লেজার বা সুপারফ্লুইডের মতো ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম প্রভাবগুলো আসলে অসংখ্য ক্ষুদ্র কণার সম্মিলিত আচরণের ফল। অর্থাৎ ঘটনাটা মাইক্রোস্কোপিক জগতে ঘটে, আমরা এর প্রভাব দেখি ম্যাক্রোস্কোপিক জগতে—আমাদের কাছে দৃশ্যমান জগতে। কিন্তু এই পরীক্ষায় এই বিজ্ঞানীদের তৈরি পুরো সিস্টেমটি (যাতে কোটি কোটি কুপার পেয়ার ছিল) একটি একক ম্যাক্রোস্কোপিক সত্তা বা কণা হিসেবে আচরণ করেছে এবং একটি পরিমাপযোগ্য ভোল্টেজ তৈরি করেছে। অর্থাৎ, একটু আগে বেড়ে বলতেই পারেন, শ্রোডিঙ্গারের বিড়ালের মতো ম্যাক্রোস্কোপিক (মানস) পরীক্ষা হাতে-কলমে করে ফেলেন এই বিজ্ঞানীরা!

এই সিস্টেমটাকে একধরনের ‘কৃত্রিম পরমাণু’ হিসেবে ব্যবহার করে নানা ধরনের নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব। আবার এটাকে বিভিন্ন কোয়ান্টাম প্রযুক্তিতে ব্যবহার করাও সম্ভব। শুধু মুখে মুখে বলার বিষয় নয়, জন মার্টিনিস শক্তির এই কোয়ান্টাইজেশন কাজে লাগিয়ে একধরনের ‘কিউবিট’ তৈরি করেছেন। এই কিউবিট হলো কোয়ান্টাম কম্পিউটারের তথ্যের একক। সরল কথায়, এর মাধ্যমে কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করা সম্ভব। (আগ্রহীরা কিউবিট এবং ০ ও ১-এর সুপারপজিশনের বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত হলে, শূন্য ভোল্টেজ থেকে ভোল্টেজ দশায় এই পরিবর্তনের সঙ্গে বিষয়টির সংশ্লিষ্টতা হয়তো বুঝতে পেরেছেন।) অর্থাৎ কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে এই নোবেল জয়ীদের গবেষণা।

এভাবেই এই তিন বিজ্ঞানী আমাদের ভৌত জগত সম্পর্কে আমাদের তাত্ত্বিক ধারণাকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি পরীক্ষণমূলক পদার্থবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জগতে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছেন। সে কারণেই তাঁদের সম্মান জানিয়েছে নোবেল কমিটি।

সূত্র: নোবেলপ্রাইজ ডটঅর্গ