আধুনিক আলকেমির জন্মকথা

গেটি ইমেজ
তাঁকে শান্ত করতে পাশ থেকে বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড হিসহিস করে বলে উঠলেন, ‘ঈশ্বরের দোহাই, সোডি, একে ট্রান্সমিউটেশন বলো না। সবাই আমাদের আলকেমিস্ট ঠাউরাবে।’

কানাডার মন্ট্রিলে ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা। সালটা ১৯০১। পরমাণুর অদ্ভুত কিছু ব্যাপার নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে গবেষণা করছিলেন দুই বিজ্ঞানী। নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড এবং ইংরেজ বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক সোডি। হঠাৎ পরীক্ষায় এক অদ্ভুত ব্যাপার তাঁদের চোখে পড়ল। গবেষণাগারে থোরিয়ামের সামান্য কিছু নমুণা রাখা ছিল। কোনো একভাবে সেই মৌলটা রূপান্তরিত হয়ে গেল রেডিয়ামে। অদ্ভুত ব্যাপার! চরম উত্তেজনায় সোডি চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, ‘মাই গড! এ তো দেখি ট্রান্সমিউটেশন!’

তাঁকে শান্ত করতে পাশ থেকে বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড হিসহিস করে বলে উঠলেন, ‘ঈশ্বরের দোহাই, সোডি, একে ট্রান্সমিউটেশন বলো না। সবাই আমাদের আলকেমিস্ট ঠাউরাবে।’

রাদারফোর্ডের এরকম আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ ছিল। আসলে এককালে পরশ পাথরের খোঁজে হন্যে হয়ে উঠেছিল মানুষ। এসব মানুষের বিশ্বাস ছিল, এমন এক রাসায়নিক বস্তু আবিষ্কার করা সম্ভব, যার স্পর্শে পারদ বা সীসা মূল্যবান সোনায় পরিণত হবে। কিংবা তা পান করলে মিলবে অমরত্ব। প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে বিভিন্ন সভ্যতার মানুষ নিরন্তর এ চেষ্টা করে গেছে। সেজন্য উদ্ভট সব জাদুবিদ্যা বা তুকতাকের মতো অতিপ্রাকৃত শাস্ত্রীয় আচার আর অদ্ভুত নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে এর চর্চাকারীরা। এর কিছু নমুনা পাওয়া যাবে সত্যজিৎ রায়ের লেখা প্রফেসর শঙ্কুর ‘শঙ্কুর সুর্বণ সুযোগ’ গল্পটিতে (আগ্রহীরা চাইলে পড়ে দেখতে পারেন)। অনেকে সারা জীবনও ব্যয় করেছেন এর খোঁজে। তারা যেন হতে চেয়েছেন রূপকথার সেই কিংবদন্তী রাজা মাইডাসের মতো, যার ছোঁয়ায় সবকিছুই পরিণত হতো মহামূল্যবান স্বর্ণে। কিন্তু হাজারো বছর মাথা কুটেও মেলেনি সেই মহার্ঘ বস্তু কিংবা বিশেষ পদ্ধতি। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এদের ভালো চোখে দেখা হয় না। তাই এই পদ্ধতিকে এখন বলা হয় আলকেমি বা অপরসায়ন। আর তার চর্চাকারীদের বলা হয় আলকেমিস্ট বা অপরসায়নবিদ। এই বেলা বলে রাখি, এ শব্দের উৎপত্তি আরবি ‘আল কিমিয়া’ থেকে। কেমিস্ট্রি শব্দের উৎসও তাই।

আর্নেস্ট রাদারফোর্ড
উইকিপিডিয়া

যাহোক, মেসোপটেমিয়া, প্রাচীন মিশর, পারস্য, ভারত, চীন, প্রাচীন গ্রিস, রোম, মুসলিম সভ্যতা ও সবশেষে ইউরোপে এই আলকেমির চর্চা হয়েছে। এমনকি সর্বকালের অন্যতম সেরা পদার্থবিদ আইজ্যাক নিউটনও যে গোপনে আলকেমির চর্চা করতেন, তার সাক্ষীসাবুদও পাওয়া গেছে সম্প্রতি।

একটু আগেই বলেছি, আলকেমিস্টরা এমন এক পদ্ধতি আবিষ্কার করার চেষ্টা করে গেছেন, যা দিয়ে কমদামী ধাতুকে (সীসা বা লোহা) মূল্যবান ধাতুতে (যেমন স্বর্ণ) রূপান্তর করা যাবে। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ট্রান্সমিউটেশন। বাংলায় বলা যায় রূপান্তর। কিন্তু সে যুগের গ্রিকসহ আরও কিছু সভ্যতায় পণ্ডিতরা বিশ্বাস করতেন, বিশ্ব চারটি উপাদান দিয়ে গঠিত। মাটি, পানি, আগুন ও বাতাস। অন্যদিকে ভারতীয় পণ্ডিতদের বিশ্বাস ছিল পঞ্চভূতে। অর্থাৎ আগের চারটি ছাড়াও আরেকটি উপাদানের কথা বিশ্বাস করতেন তাঁরা। সেটি আকাশ!

এ ধারণা পরিবর্তন হয়েছে এই সেদিন। মানে আঠারো শতকের দিকে। বলা চলে, ১৭৮৭ সালের দিকে আধুনিক রসায়নের সূচনা করেন ফরাসি বিজ্ঞানী অ্যান্তোনি ল্যাভোয়েসিয়ে (সত্যি বলতে, তাঁর নামের সঠিক উচ্চারণ অঁতোয়ান লাভোয়াজিয়ে)। তাঁর মতে, ওই চারটি বা পাঁচটি মৌলিক উপাদান যথেষ্ট নয়, বরং আরও বেশি। তাঁর হিসেবে সেই সংখ্যাটি ছিল ৩৩টি। এর মধ্যে কয়েকটি মৌলের আবিষ্কর্তা তিনি নিজেই। সেগুলো দিয়েই মৌলিক উপাদানের একটা তালিকা তৈরি করেন ল্যাভোয়েসিয়ে। তিনি আরও বললেন, কোনো তুকতাক বা ম্যাজিক দিয়ে কোনো উপাদানকে আরেক উপাদানে রূপান্তর করা সম্ভব নয়। যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ দিয়ে আলকেমিস্টদের ভুল প্রমাণ করেন ল্যাভোয়েসিয়ে।

গ্রিকসহ আরও কিছু সভ্যতায় পণ্ডিতরা বিশ্বাস করতেন, বিশ্ব চারটি উপাদান দিয়ে গঠিত। মাটি, পানি, আগুন ও বাতাস
সংগৃহীত

তাঁর হাতেই আসলে রসায়নের বিপ্লবের সূচনা হয়। কারণ পরের ৮২ বছর তাঁর দেখানো পথেই হাঁটতে শুরু করেন অন্যান্য রসায়নবিদেরা। অবশ্য ল্যাভোয়েসিয়েও পুরোপুরি ভুলের উর্ধ্বে ছিলেন না। তবে শুরু হিসেবে তাঁর দিকনির্দেশনাকে ভালোই বলা যায়। ল্যাভোয়েসিয়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে শুরু হলো নতুন আরেক যুগ। এর মধ্যে আবিষ্কৃত হলো আরও নতুন কিছু মৌল। ১৮৬৯ সালে রুশ রসায়নবিদ দিমিত্রি মেন্দেলিভ তখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত মৌলগুলোকে বিশেষ ক্রম অনুসারে একটা তালিকায় সাজান। সেই তালিকাটাকে এখন পিরিওডিক টেবিল বা পর্যায় সারণি নামে সবাই চেনেন। মেন্দেলিভ ছাড়াও সে যুগে পর্যায় সারণি তৈরি করেছিলেন আরও কজন বিজ্ঞানী। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে তাঁরটাই ছিল সেরা। সে কারণেই সেটার মৌলিক কাঠামো এখনো এই আধুনিক যুগেও টিকে আছে।

পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিষয়টা নিয়ে অবাক হন খোদ রাদারফোর্ডও। এই তথ্যটুকুর ওপর নির্ভর করে নতুন এক পারমাণবিক মডেলের প্রস্তাব করেন তিনি। সেটা অনেকটা সৌরজগতের মতো। পরে ১৯১৩ সালে ড্যানিশ বিজ্ঞানী নীলস বোরের সঙ্গে মিলে মডেলটা কিছুটা সংশোধন করেন।

একে বলা যায় মেন্দেলিভের আশ্চর্য কীর্তি। কারণ মৌলের ধাঁধাটা ছিল সে যুগে মাথা ঘোরানো। কিন্তু তার প্রায় আদ্যোপান্ত না জেনেই সমাধানের চেষ্টা করেন তিনি। তাঁর তালিকায় হাইড্রোজেনকে রাখা হয়েছিল সবার শুরুতে। এরপর পারমাণবিক ভরের ভিত্তিতে বাকি মৌলগুলোকে পরপর সাজাতে থাকেন তিনি (সহজ করে বললে, কোনো পরমাণুর মোট ভরই আসলে পারমাণবিক ভর)। এভাবে সেকালে আবিষ্কৃত সবচেয়ে ভারী মৌল ইউরেনিয়াম স্থান পায় তাঁর তালিকার একদম শেষে। মৌলগুলোকে গ্রুপেও ভাগ করেন তিনি। কলামগুলোতে মৌলগুলোর ধর্মের ভিত্তিতে সাজাতে থাকেন। সে সময়ের জানা কোনো মৌলের ধর্ম যদি ওই প্যাটার্নের সঙ্গে না মিলত, তাহলে জায়গা শূন্য রেখে দিতেন। এরকম তিনটি জায়গা ফাঁকা ছিল তাঁর তালিকায়। ভবিষ্যতে সে মৌলগুলো আবিষ্কৃত হবে বলে অনুমান করেন মেন্দেলিভ। এমনকি সেগুলোর ধর্ম কেমন হবে, তারও ভবিষ্যদ্বাণী করেন। এ ব্যাপারে মেন্দেলিভের অনুমান শতভাগ ঠিক ছিল। কয়েক দশকের মধ্যেই ওই শূন্যস্থান পূরণ হয়। আবিষ্কৃত হয় মৌল তিনটি।

অ্যান্তোনি ল্যাভোয়েসিয়ে
উইকিপিডিয়া

বিশ শতকের ক্রান্তিলগ্নে পরমাণু সম্পর্কে আরও নতুন নতুন ব্যাপার জানতে পারলেন বিজ্ঞানীরা। দেখা গেল, সব বস্তুর মৌলিক গাঠনিক একক পরমাণু। এর আকার মোটামুটি আপনার হাতের তালুর এক বিলিয়ন ভাগ। পরমাণুর ভেতরের বিশেষ একটা কিছুই নির্ধারণ করে দেয় সেটা কোন মৌল হবে। এর পেছনে হেনরি বেকরেল এবং মেরি ও পিয়ের কুরির অবদান বেশ বড়। কারণ তাঁরা পরমাণুর তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণা করে পরমাণুর গভীরের অনেক রহস্য উন্মোচন করেন। আরও আছেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জে জে টমসন। তিনি আবিষ্কার করেন পরমাণুর খুদে এক কণা। নাম ইলেকট্রন। সেটা ১৮৯৭ সালের কথা।

এর চার বছর পর কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরমাণুর অদ্ভুত কিছু ব্যাপার নিয়ে গবেষণা করছিলেন আর্নেস্ট রাদারফোর্ড এবং ফ্রেডরিক সোডি। তাঁদের গবেষণাগারে থোরিয়াম মৌলটা রূপান্তরিত হয়ে রেডিয়ামে পরিণত হয়েছিল। সে ঘটনা তো শুরুতেই বলেছি।

ঘটনাটা আলকেমিস্টদের স্বপ্নের সেই ট্রান্সমিউটেশন ছিল না সত্যি, তবে ছিল নতুন এক বিজ্ঞানের জন্মক্ষণ। এর প্রায় এক দশক পরে, ১৯১১ সালে পরমাণু কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস আবিষ্কার করেন রাদারফোর্ড। সেটা মূলত পরমাণুকেন্দ্রের অতিখুদে একটা অংশ। এ প্রসঙ্গে পদার্থবিদ আর্নেস্ট লরেন্স বেশ কিছুদিন পর বলবেন, ‘পরমাণুর আকৃতি যদি একটা ক্যাথেড্রালের সমান হয়, তাহলে নিউক্লিয়াসের আকার সেখানের একটা মাছির সমান।’ তবে লরেন্স উল্লেখ করেননি, ওই খুদে মাছির মধ্যেই গোটা ক্যাথেড্রালের সবটুকু ভর পুঞ্জিভূত থাকে। অবিশ্বাস্য কাণ্ড!

পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিষয়টা নিয়ে অবাক হন খোদ রাদারফোর্ডও। এই তথ্যটুকুর ওপর নির্ভর করে নতুন এক পারমাণবিক মডেলের প্রস্তাব করেন তিনি। সেটা অনেকটা সৌরজগতের মতো। পরে ১৯১৩ সালে ড্যানিশ বিজ্ঞানী নীলস বোরের সঙ্গে মিলে মডেলটা কিছুটা সংশোধন করেন। তাতে পরমাণু গহিনের দীর্ঘদিনের ধাঁধার কিছুটা সমাধান পাওয়া গেল। এ মডেল অনুসারে, নিউক্লিয়াসের চারপাশের কিছু কক্ষপথে নির্দিষ্ট সংখ্যক ইলেকট্রন ঘুরপাক খাচ্ছে। খুদে ইলেকট্রন কণাগুলো ঋণাত্মক চার্জবাহী। সেগুলো পার্শ্ববর্তী অন্যান্য পরমাণুর ইলেকট্রনের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে রাসায়নিক বন্ধন তৈরি করে। এভাবেই গড়ে উঠে একেকটা অণু। প্রতিটি মৌলের তার আগের মৌলের চেয়ে এক বা একাধিক ইলেকট্রন বেশি থাকতে পারে।

তবে কোনো মৌলের আচার-আচরণ কেমন হবে, তা ইলেকট্রনের সংখ্যা দিয়ে নির্ধারিত হয় না। প্রায় একই সময়ে হেনরি মোসলে নামে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ বিজ্ঞানী পরমাণুর ধাঁধার সমাধান আরেকটু এগিয়ে নিয়ে গেলেন। এক্স-রে ব্যবহার করে তিনি দেখান, প্রতিটি মৌলের নিউক্লিয়ার চার্জ তার আগের মৌলের চেয়ে এক একক বেশি। এর মানে, নিউক্লিয়াসে এমন কিছু একটা আছে, যা ধনাত্মক চার্জবাহী। আর সেটাই ইলেকট্রনের ঋণাত্মক চার্জ প্রতিরোধ করে। এই দুইয়ের কাটাকাটিতে পরমাণু থাকে চার্জ নিরপেক্ষ। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, এই আবিষ্কারটা যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা দেখে যেতে পারেননি মোসলে। কারণ এরপরই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইউরোপে। তাতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দেন মোসলে। গালিপোলিতে যুদ্ধের ময়দানে মারা যান। কিন্তু তাঁর গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার মেন্দেলিভের পর্যায় সারণির মৌলগুলোর সজ্জা ব্যাখ্যা করল। এর পাঁচ বছর পর নিউক্লিয়াস রহস্যের চাদর সরিয়ে দেন সেই নিউজিল্যান্ডার। মানে আবারও রাদারফোর্ড।

ফ্রেডরিক সোডি
উইকিপিডিয়া
প্রোটন ও নিউট্রনকে একত্রে বলা হয় নিউক্লিওটাইড। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা প্রোটন ও নিউট্রনের ৩ হাজার ৩০০টিরও বেশি বিন্যাস আবিষ্কার করেছেন।

নিউক্লিয়াস মূলত দুটি কণা দিয়ে গঠিত। এদের একটির নাম প্রোটন। এ কণাটাও প্রথম আবিষ্কার করেন ওই রাদারফোর্ডই। ১৯১৯ সালে। একটা মাত্র প্রোটন দিয়েও একটা পরমাণু গঠিত হতে পারে। যেমন হাইড্রোজেন। এর নিউক্লিয়াসে একটা মাত্র প্রোটন, যাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে একটি মাত্র ইলেকট্রন। নিউক্লিয়াসে দুটো প্রোটন মানে সেটা হিলিয়াম পরমাণু। এভাবে প্রোটন সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আসতে থাকে নতুন নতুন পরমাণু। ৯২টি প্রোটন মানে ইউরেনিয়াম।

কিন্তু এখানে জন্ম নিল আরেকটা ধাঁধার। আগেই বলেছি, প্রোটনের চার্জ ধনাত্মক। কাজেই নিউক্লিয়াসে একাধিক প্রোটনের পাশাপাশি থাকা অসম্ভব। কারণ প্রোটনেরা পরস্পরকে বিকর্ষণ করবে। চুম্বকের সমধর্মী মেরু বিকর্ষণ করার মতো। কিন্তু তাহলে নিউক্লিয়াস বহাল তবিয়তে টিকে থাকে কীভাবে? তাদের তো ভেঙে যাওয়ার কথা! সেই উত্তরও দিলেন রাদারফোর্ড। তিনি অনুমান করলেন, নিউক্লিয়াসের ভেতর নিশ্চয়ই আরেকটা কণা থাকে, যারা পরমাণুকে একত্রে ধরে রাখতে সহায়তা করে। আরও বললেন, কণাটা প্রোটন আকৃতির হবে এবং তার চার্জ হবে নিরপেক্ষ। তিনি কাল্পনিক এই কণার নাম দিলেন, নিউট্রন।

তাঁর অনুমান খাপে খাপে মিলে গেল ১৯৩২ সালে। অনেক খোঁজাখুজির পর অবশেষে আবিষ্কৃত হলো কণাটা। কাজটা করলেন পদার্থবিদ জেমস চ্যাডউইক। রাদারফোর্ড তখন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাভেনডিশ ল্যাবরেটরিতে কর্মরত। তাঁরই সহকারী চ্যাডউইক। লম্বা, পাতলা দেহের মানুষটির নাকটা কাকের ঠোঁটের মতো। অধরা কণাটা শনাক্ত করতে একটানা ১০ দিন ল্যাবরেটরিতে কাজ করে গেছেন তিনি। প্রতি রাতে ঘুমিয়েছেন মাত্র তিন ঘন্টা। সেদিন সদ্য আবিষ্কারটা সম্পর্কে সহকর্মীদের জানালেন চ্যাডউইক। এরপর দুম করে ঘোষণা করলেন, তিনি ক্লোরোফর্ম নিয়ে একটানা ১৫ দিন ঘুমাতে চান।

যাহোক, নিউট্রন কণা আবিষ্কারের কারণে পারমাণবিক চিত্র এবং পর্যায় সারণির রহস্যগুলো বোঝা সম্ভব হলো। দেখা গেল, প্রোটনের সংখ্যা (পারমাণবিক সংখ্যা নামেও পরিচিত) মৌলের চরিত্র নির্ধারণ করে। কোনো মৌলে যত বেশি প্রোটন থাকবে, তার ধনাত্মক চার্জও হবে তত বেশি। কাজেই তাতে ইলেকট্রন সংখ্যা বেশি থাকবে। অন্যদিকে পরমাণুতে নিউট্রনের সংখ্যা বাড়া-কমার সঙ্গে একই পরমাণুর ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ তৈরি হয়। এদের বলা হয় আইসোটোপ। কোনো পরমাণুতে ছয়টি প্রোটন থাকা মানে সেটা কার্বন পরমাণু। কিন্তু প্রকৃতিতে কার্বন-১২ (এখানে ছয়টি প্রোটন ও ছয়টি নিউট্রন থাকে), কার্বন-১৩ (ছয়টি প্রোটন ও সাতটি নিউট্রন), এমনকি কার্বন-২২ (ছয়টি প্রোটন ও ১৬টি নিউট্রন) পরমাণুও আছে। হালকা মৌলের জন্য আদর্শ ভারসাম্য হলো একটি প্রোটনের জন্য একটি নিউট্রন। কিন্তু মৌল যত ভারী হতে থাকে, তার পারমাণবিক সংখ্যাও তত বাড়তে থাকে। একইসঙ্গে তাকে ভারসাম্যে বা স্থিতিশীল রাখতে প্রয়োজন পড়ে তত বেশি নিউট্রন কণা। কিন্তু তারপরও কিছু মৌল দীর্ঘদিন স্থিতিশীল থাকতে পারে না। নিউক্লিয়াস অস্থিতিশীল হয়ে গেলে সেখান থেকে কিছু কণা ছিটকে বাইরে চলে আসে কিংবা পরিবর্তন হয়ে যায়। এটাই আমাদের কাছে বিকিরণ নামে পরিচিত।

প্রোটন ও নিউট্রনকে একত্রে বলা হয় নিউক্লিওটাইড। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা প্রোটন ও নিউট্রনের ৩ হাজার ৩০০টিরও বেশি বিন্যাস আবিষ্কার করেছেন (বিভিন্ন শক্তি দশায়)। এর মধ্যে বেশিরভাগ নিউক্লিয়াসই অস্থিতিশীল। তবে রাদারফোর্ড ও চ্যাডউইকের মতো প্রথম দিকের অগ্রদূতদের কাছে নিউক্লিওটাইডের এত বেশি বিন্যাস ছিল অকল্পনীয়। অবশ্য ইতালির একদল প্রায় দীনহীন বিজ্ঞানীর কারণে একদিন পরমাণুর ভেতরটা তছনছ হয়ে গেল। কারণ তাঁরা সেখানে একটু নাড়া দিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন কী ঘটে।

সেই বিজ্ঞানী হলেন এনরিকো ফার্মি, অনেকের কাছে যার পরিচয় ‘পোপ অব ফিজিকস’ নামে। পরমাণু নিয়ে তাঁর গুরুত্বরপূর্ণ গবেষণা ও আবিষ্কারের কারণে নতুন নতুন মৌল তৈরি করা সম্ভব হলো। মানে সম্ভব হয়েছিল এক মৌলকে আরেক মৌলতে রূপান্তর বা ট্রান্সমিউটেশন, যা ছিল প্রাচীন আলকেমিস্টদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। এক অর্থে বলা যায়, সেটাই ছিল আধুনিক আলকেমির জন্মক্ষণ।

সে গল্প হবে আরেক দিন।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: দ্য পোপ অব ফিজিকস: এনরিকো ফার্মি অ্যান্ড দ্য বার্থ অব অ্যাটোমিক এজ/ জিনো সার্গে

সুপারহেভি: মেকিং অ্যান্ড ব্রেকিং দ্য পিরিওডিক টেবিল/ কিট চ্যাপম্যান

দ্য লাস্ট ম্যান হু নিউ এভরিথিং: দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস আব এনরিকো ফার্মি/ ডেভিড এন, শ্যাওয়ার্জ

উইকিপিডিয়া