বল নয়, গর্ত

নিউটন ১৬৮৬ সালে মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কার করেন। এই সূত্রমতে, মহাবিশ্বের সব বস্তু একে অপরকে আকর্ষণ করে। যদি দুটি বস্তুর মধ্যে দূরত্ব d হয় এবং ওদের ভর হয় m ও M, তবে এই বলের পরিমাণ হলো, F = GmM/d2.....................(1)

নিউটনের তত্ত্বে স্থান বা স্পেসের কোনো ভূমিকা নেই। স্পেস শুধুই ফাঁকা স্থান, বিশ্বজোড়া এক নিষ্ক্রিয় রঙ্গমঞ্চ, যেখানে এই টানাটানির খেলা চলছে। এই সমীকরণটি যে ভুল বা বড়জোর আংশিক সত্য, তা সহজেই বোঝা যায়। এই সূত্রমতে, দুটি বস্তুর মধ্যে মহাকর্ষ বল ওদের ভরের গুণফলের সঙ্গে বাড়ে এবং ওদের দূরত্বের বর্গের সঙ্গে কমে। এখানে G হলো মহাকর্ষের ধ্রুবক।

এই বল কোথা থেকে আসে? কেন আসে? বস্তু দুটি নড়াচড়া করলে বল কি একই থাকবে? একজন নড়লে আরেকজন কি তা সঙ্গে সঙ্গে টের পেয়ে যায়? খবরের আদান-প্রদানে কত সময় লাগে?

নড়াচড়ার খবর কীভাবে এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুর কাছে পৌঁছায়? বস্তু ও আলোর মধ্যে আকর্ষণের সম্পর্কটা কী? নিউটন নিজেও ভালো করে জানতেন যে তাঁর সমীকরণের এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার ক্ষমতা নেই! নিউটনের সূত্র যে সঠিক নয়, তা প্রথম জানা যায় সূর্যের চারদিকে বুধ গ্রহের চলাফেরা দেখে। নিউটনের সূত্র থেকে সূর্যের চারদিকে বুধ গ্রহের কক্ষপথের যে বেগে ঘোরার (Precession) কথা, গ্রহটি সেই বেগে ঘোরে না। সূর্যের খুব কাছে বলেই বুধ গ্রহের এই দশা। তেমনি খুব বড় নক্ষত্র, নিউট্রন স্টার, কৃষ্ণগহ্বর ইত্যাদির আশপাশে নিউটনের সূত্র ভুল তথ্য দেয়।

এরপর বৈদ্যুতিক বলের কথায় আসা যাক। দুটি বস্তুর মধ্যে দূরত্ব যদি d হয় এবং বৈদ্যুতিক চার্জ হয় Q ও q, তবে তাদের মধ্যে বৈদ্যুতিক বল কত? সে খবর মিলবে নিচের সমীকরণ থেকে, এটা কুলম্বের সূত্র বলে পরিচিত, F=KqQ/d2..................... (2)

আরও পড়ুন
স্পেসকে এক ভরহীন তোশক বলে ভাবা যেতে পারে। ভর এই তোশকে বাঁক সৃষ্টি করে। আশপাশের বস্তু সেই বাঁক অনুসারে চলে। দূর মহাশূন্যে কোনো বিশেষ পছন্দের দিক নেই, ওপর, নিচ, ডান, বাম সব সমান।

কুলম্ব এই সূত্র দিয়েছিলেন ১৭৮৪ সালে। এখানেও চার্জগুলো নড়াচড়া শুরু করলে কী হবে, তার কোনো হদিস নেই। ১৮৬১-৬২ সালে জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল দিলেন আরও কিছু সূত্র, সেগুলো থেকে সব খবর মিলবে। চার্জ চলাফেরা শুরু করলেই বৈদ্যুতিক ফিল্ড নড়াচড়া শুরু করে, বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র নড়াচড়া করলে আবার চৌম্বক ক্ষেত্র উদয় হয়, চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তন ঘটলে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র হয়। এই দুই ক্ষেত্র জড়াজড়ি করে নাচতে নাচতে চলতে থাকে, তাকেই আমরা বলি আলো। আরেক নাম বৈদ্যুতিক চুম্বকের ঢেউ (electromagnetic wave)। কোয়ান্টাম-বিজ্ঞানে ওকে বলা হয় ফোটন। ওরাই দুটো চার্জের মধ্যে খবরের আদান-প্রদান করে।

এবার আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা বা মহাকর্ষ সূত্রটি লেখা যাক,

Rµν-(1/2) gµν R + gµνλ = 8π G/c4) Tµν............ (3)

আইনস্টাইনের সূত্রে স্পেস নিষ্ক্রিয় শূন্যস্থান নয়, নির্লিপ্ত দর্শক নয়। বস্তুর ভর অনুসারে নিজের শরীরে বাঁক সৃষ্টি করে স্পেস গতি সৃষ্টি করে। মহাকর্ষ এখানে বল নয়, গর্ত! একটি নরম তোশকের ওপর যদি একটি মার্বেল রাখি, তবে তোশকে একটি ক্ষুদ্র বাঁক, ভাঁজ বা গর্ত তৈরি হবে।

যদি আমি মার্বেলের পাশে তোশকের ওপর বসি, তবে সেখানে আরেকটা বড় গর্ত তৈরি হবে এবং মার্বেলটি গড়িয়ে সেই গর্তে বা আমার গায়ে এসে লাগবে। স্পেসকে এক ভরহীন তোশক বলে ভাবা যেতে পারে। ভর এই তোশকে বাঁক সৃষ্টি করে। আশপাশের বস্তু সেই বাঁক অনুসারে চলে। দূর মহাশূন্যে কোনো বিশেষ পছন্দের দিক নেই, ওপর, নিচ, ডান, বাম সব সমান। পৃথিবীর কাছে এলে সবাই পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে যেতে চায়, কারণ পৃথিবীর ভর এক বিরাট গর্ত খুঁড়ে স্পেসের সেই সমতা ভেঙে দিয়েছে। তেমনি সময়ের তির সব সময় অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে ছোটে, কারণ ১৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন বছর আগের সেই মহাবিস্ফোরণ সময়ের সমতা ভেঙে দিয়েছে। আলোর ঢেউয়ে যেমন বৈদ্যুতিক এবং চুম্বকের ক্ষেত্র জড়াজড়ি করে নাচে, মাধ্যাকর্ষণের ঢেউয়ে তেমনি স্পেস ও সময় জড়াজড়ি করে দোল খায়।

আরও পড়ুন

আইনস্টাইন ১০ বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে আপেক্ষিকতার সমীকরণটি বের করেন। সে আমলের অনেক নামকরা গণিতজ্ঞের পরামর্শ নিয়েছিলেন, মাঝেমধ্যে প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। ১৯১৫ সালের নভেম্বর মাসে আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিক তত্ত্ব বিজ্ঞানীদের এক সম্মেলনে প্রকাশ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সম্মেলন শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে তাঁর নিজের অঙ্কগুলো ভুল মনে হয়েছিল। এখন কী করা যায়? মাথায় হাত দিয়ে আইনস্টাইন চেয়ারে বসে ভাবছিলেন। হঠাত্ মনে পড়ে গেল যে প্রায় দুই বছর আগে একটি সমাধান খুঁজে পেয়েছিলেন, সেটা তখন প্রায় অসম্ভব মনে হয়েছিল। পুরোনো কাগজের স্তূপ থেকে সেই সমাধানটি খুঁজে বের করলেন। অনেকবার পড়লেন। না, এটাই তো সঠিক সমাধান! ওটাই হলো ওপরের ৩ নম্বর সমীকরণ। সমীকরণটি যেন এক অপূর্ব কবিতা, মানুষের বুদ্ধিমত্তার সর্বশ্রেষ্ঠ ফসল। ওই সমীকরণের অলিগলি সব বুঝতে একজন সাধারণ মাধ্যাকর্ষণ বিজ্ঞানীর সারা জীবন কেটে যায়। ওপরের সমীকরণগুলোর মধ্যে শুধু এই সমীকরণটি সত্য, বাকিগুলো মিথ্যা। অবশ্য বিজ্ঞানে সত্য বলে কিছু নেই। এই সমীকরণ সত্য বলে ধরে নিতে হবে যত দিন পর্যন্ত না ওর কোনো ভুল খুঁজে পাওয়া যাবে। আইনস্টাইনের এই সমীকরণের কোনো ভুল আজ পর্যন্ত কেউ খুঁজে পায়নি।

মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ ঠেকাতে আইনস্টাইন এই মহাজাগতিক ধ্রুবক তাঁর সমীকরণে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। পরে ১৯২৯ সালে এডউইন হাবল যখন টেলিস্কোপ দিয়ে আলোর রঙের পরিবর্তন মেপে (Dopler red shift) মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ আবিষ্কার করেন, তখন আইনস্টাইন এই ধ্রুবককে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল বলে উল্লেখ করেছিলেন।

সমীকরণের কিছু অংশ আমাদের পরিচিত যেমন মাধ্যাকর্ষণ ধ্রুব G, আলোর গতি c, বৃত্তের পরিধি এবং ব্যাসের অনুপাত π। R, g ও T হলো যথাক্রমে রিচি (Ricci), মেট্রিক (Metric) ও স্ট্রেস-শক্তির টেন্সর (Tensor)। λ-কে (ল্যামডা) মহাজাগতিক ধ্রুবক বলা হয়। শুরুতে ল্যামডা অংশটি সমীকরণে ছিল না। ১৯২২ সালে আলেক্সান্ডার ফ্রিডম্যান এই সমীকরণের একটা সমাধান খুঁজে পান, সেই সমাধানে মহাবিশ্ব ক্রমাগত সম্প্রসারিত হতে থাকবে। আইনস্টাইনের কাছে ব্যাপারটা অসম্ভব মনে হয়েছিল। মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ ঠেকাতে আইনস্টাইন এই মহাজাগতিক ধ্রুবক তাঁর সমীকরণে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। পরে ১৯২৯ সালে এডউইন হাবল যখন টেলিস্কোপ দিয়ে আলোর রঙের পরিবর্তন মেপে (Dopler red shift) মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ আবিষ্কার করেন, তখন আইনস্টাইন এই ধ্রুবককে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল বলে উল্লেখ করেছিলেন। ইদানীং এই ধ্রুবক আবার পদার্থবিদদের নয়নমণিতে পরিণত হয়েছে। না খুঁজে পাওয়া গুপ্ত পদার্থ এবং গুপ্ত শক্তির (Dark matter, Dark energy) খবর হয়তো এই ধ্রুবের কাছেই মিলতে পারে!

আরও পড়ুন

µ বা ν  ০, ১, ২ বা ৩, এই চারটি সংখ্যা হতে পারে। 0 সময়ের এবং ১, ২ ও ৩ স্পেসের তিন দিকের প্রতীক। বোঝাই যাচ্ছে, স্থান আর কাল জড়াজড়ি করে আছে, দুটো মিলে একসঙ্গে স্পেসটাইম বা স্থানকাল। আইনস্টাইনের সমীকরণটি বুঝতে হলে টেন্সর গণিতের খুঁটিনাটি ভালো করে জানতে হবে। সেটা এখানে সম্ভব নয়। তাই নিচে মনগড়া চতুর্থ সমীকরণটি লিখেছি। পণ্ডিতেরা বিরক্ত হবেন না, আইনস্টাইনের সমীকরণটিকে গণিতবিদ্যাভীত বন্ধুদের জন্য সহজ করে লেখার চেষ্টা করেছি মাত্র!

R = T..................... (4)

এই সমীকরণের বাঁয়ে মহাবিশ্বের বাঁক, ডানে ভরশক্তি। খুব সহজ ভাষায় এই সমীকরণ যা বলতে চাচ্ছে তা হলো, ভরশক্তি মহাবিশ্বকে বলছে কেমন করে বাঁকতে হবে এবং বাঁকা মহাবিশ্ব ভরশক্তিকে বলছে কেমন করে এই বাঁকা পথে চলতে হবে!

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

* লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন