ত্রিমাত্রিক ক্রিস্টালে বন্দী ইলেকট্রন, ইলেকট্রনিকস প্রযুক্তিতে নতুন সম্ভাবনা

ত্রিমাত্রিক ক্রিস্টালের ভেতরে ইলেকট্রনকে ফাঁদে ফেলেছেন বিজ্ঞানীরাছবি: সংগৃহীত

প্রথমবারের মতো ত্রিমাত্রিক ক্রিস্টালের ভেতরে ইলেকট্রনকে ফাঁদে ফেলেছেন বিজ্ঞানীরা। ফলে ‘ইলেকট্রনিক ফ্ল্যাট ব্যান্ড’ দশায় ইলেকট্রন যেসব কোয়ান্টাম প্রভাব দেখায়, সেগুলো নিয়ে আরও ভালোভাবে গবেষণা করা যাবে। এর অংশ হিসাবে গবেষণা করা যাবে সুপারকন্ডাকটিভিটি বা অতিপরিবাহিতা নিয়েও। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বা এমআইটির একদল পদার্থবিজ্ঞানী এ কাজ করেছেন। গত ৮ নভেম্বর, বুধবার নেচার জার্নালে এ বিষয়ক একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়।

কাজটি সম্ভব হয়েছে বিশেষ ধরনের এই ত্রিমাত্রিক ক্রিস্টালের পারমাণবিক জ্যামিতিক গঠনের কল্যাণে। ত্রিমাত্রিক ক্রিস্টালের মধ্য দিয়ে ছোটার সময় ইলেকট্রন কেলাস বা ক্রিস্টালের গাঠনিক পরমাণুগুলোর সঙ্গে ভিন্নভাবে মিথস্ক্রিয়া করে। এ সময় এর গতিশক্তি সাধারণত ব্যান্ডের সীমার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। ইলেকট্রনের ব্যান্ড যদি ফ্ল্যাট বা সমতল হয়, তবে এর সীমার মান হয়ে যায় শূন্য। অর্থাৎ এর শক্তি আর ক্রিস্টালের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্যে কোনো সম্পর্ক থাকে না। সহজ করে বললে, ইলেকট্রনের বেগ তখন শূন্য হয়ে পড়ে এবং এটি কেলাসের নির্দিষ্ট জায়গায় আটকে যায়।

ত্রিমাত্রিক ক্রিস্টাল
ছবি: সংগৃহীত
গবেষকদলটি এ জন্য যে ক্রিস্টালটি ব্যবহার করেছেন, তার বিন্যাস অনেকটা জাপানি ঝুড়ি বানানোর একধরনের কাঠামোর মতো।

সমতল ব্যান্ডের ইলেকট্রনও আশপাশের ক্রিস্টালের পরমাণুগুলোর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে। তবে এই মিথস্ক্রিয়ার সময়ের শক্তি এত সামান্য যে তা হিসাবে না ধরলেও চলে। কিন্তু ইলেকট্রন যখন আটকে যায়, তখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অতিপরিবাহিতা ও অন্যান্য তড়িৎচৌম্বকীয় বৈশিষ্ট্য দেখাতে শুরু করে ক্রিস্টাল কাঠামোটি।

গবেষকদলটি এ জন্য যে ক্রিস্টালটি ব্যবহার করেছেন, তার বিন্যাস অনেকটা জাপানি ঝুড়ি বানানোর একধরনের কাঠামোর মতো। এই কাঠামোর নাম ‘কাগামো’। বিশেষ এ জ্যামিতিক গঠনের মধ্য দিয়ে ছুটতে গিয়ে ফ্ল্যাট ব্র্যান্ডে আটকা পড়েছে ইলেকট্রন।

কাগামো গঠনের মতো দ্বিমাত্রিক ক্রিস্টালে আগেই বিজ্ঞানীরা ফ্ল্যাট ব্যান্ডের ইলেকট্রন পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। সেখান থেকেই এ গবেষকদল ত্রিমাত্রিক কাগামো ক্রিস্টাল নিয়ে গবেষণার কথা ভাবেন। এতে ইলেকট্রনকে আটকে ফেলার পর কিছুটা রাসায়নিক পরিবর্তন-পরিমার্জনের মাধ্যমে তৈরি করা হয় সুপারকন্ডাকটর বা অতিপরিবাহী। অর্থাৎ এর মধ্য দিয়ে ইলেকট্রন কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই প্রবাহিত হতে পারে।

'কোয়ান্টাম গবেষণার নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে গবেষণাটির ফলাফল। আমরা দেখিয়েছি, ক্রিস্টালের বিশেষ এ বিন্যাস শুধু ইলেকট্রনকে ফাঁদেই ফেলে না, পদার্থের অতিপরিবাহী ধর্মও তৈরি করে।'
রিকার্ডো কোমিন, অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, এমআইটি

এমআইটির পদার্থবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক জোসেফ সেকেলস্কি। তিনি এ গবেষকদলের একজন। প্রকৃতিও এভাবেই ক্রিস্টাল তৈরি করে বলে জানান তিনি। বলেন, ‘আমরা কিছু মৌলকে একসঙ্গে জুড়ে দিয়েছি। এ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে ক্যালসিয়াম ও নিকেল। এগুলোকে উচ্চতাপমাত্রায় গলানোর পর ঠান্ডা করা হয়েছে। ফলে পরমাণুগুলো নিজে থেকেই বিন্যস্ত হয়ে তৈরি করেছে কাগামো-বিন্যাস।’

এর মাধ্যমে ত্রিমাত্রিক ক্ষেত্রে ইলেকট্রনের অদ্ভুত আচরণ নিয়ে নতুন গবেষণার দুয়ার খুলে গেল। এ প্রসঙ্গে গবেষণাপত্রটির সহলেখক ও এমআইটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রিকার্ডো কোমিন বলেন, কোয়ান্টাম গবেষণার নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে গবেষণাটির ফলাফল। আমরা দেখিয়েছি, ক্রিস্টালের বিশেষ এ বিন্যাস শুধু ইলেকট্রনকে ফাঁদেই ফেলে না, পদার্থের অতিপরিবাহী ধর্মও তৈরি করে। এই মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ হলো ফ্ল্যাট ব্যান্ডের ক্রিস্টালগুলোকে ব্যবহারোপযোগী করে তোলা। কক্ষতাপমাত্রায় যেন কাজ করে, সে লক্ষ্যে গবেষণা করা।’

শিগগিরই বাজারে আসছে বিজ্ঞানচিন্তার নভেম্বর সংখ্যা 

অনলাইনে বিজ্ঞানচিন্তার নভেম্বর সংখ্যা অর্ডার করতে এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.prothoma.com/product/35548/bigganchinta-november-2023

আরও পড়ুন

এটা সম্ভব হলে ভবিষ্যতে বৈদ্যুতিক লাইন আরও কার্যকর করে তৈরি করা যাবে। পাশাপাশি শক্তিশালী কোয়ান্টাম কম্পিউটার, দ্রুততর ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্র তৈরি করা যাবে আরও সহজে। এমনটাই মনে করেন এ গবেষকেরা।

লেখক: প্রদায়ক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: আইএফএল সায়েন্স, নেচার