এক্স-রে দিয়ে পরমাণুর প্রথম ছবি

ওহাইয়ো বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র

এক্স-রে ব্যবহার করে প্রথমবারের পরমাণুর ছবি তুলেছেন একদল পদার্থবিজ্ঞানী। বুধবার গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয় নেচার জার্নালে। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়ো বিশ্ববিদ্যালয় ও আরগন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরেরির ২০জন গবেষক দুটি ভিন্ন পরমাণুর ভেতরে উঁকি দেন এক্স-রশ্মির সাহায্যে।

এক্স-রে বেশ অদ্ভুত এক বিদ্যুৎচৌম্বকীয় তরঙ্গ। দৃশ্যমান আলোর চেয়ে এর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কম, কিন্তু কম্পাঙ্ক অনেক বেশি। এই রশ্মি জীবদেহের মাংস ভেদ করে চলে যেতে পারে। তবে নিম্নশক্তির এক্স-রে হাড় ভেদ করতে পারে না। ফলে নিম্নশক্তির এক্স-রে ব্যবহার করে শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গের ছবি নেওয়া যায়। চিকিৎসাক্ষেত্রে এ রশ্মির ব্যবহার চলছে অনেকদিন ধরেই। এবার একক পরমাণুর বৈশিষ্ট্য শনাক্তে ব্যবহার করা হলো রশ্মিটি।

নিজেদের গবেষণা প্রসঙ্গে ওহাইয়ো বিশ্ববিদ্যালয় ও আরগন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির পদার্থবিদ ও গবেষণাপত্রটির প্রধান লেখক সাউ ওয়াই লা বলেন, ‘নানাভাবে এক্স-রে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এটা কতটা অসাধারণ, তা মানুষ এখনও জানে না। আমরা একক পরমাণু মাপতে পারতাম না, অন্তত এর আগে পর্যন্ত।

গবেষক দলটি এসটিএম-এর দক্ষতার সঙ্গে এক্স-রের শক্তিকে একত্রিত করেছেন। সম্মিলিত এই ব্যবস্থাকে বলছেন, সিনক্রোটন এক্সরে স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপি। সংক্ষেপে এসএক্স-এসটিএম (SX-STM)।

কীভাবে হলো?

পরমাণুর বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করার অর্থ শুধু ছবি তোলা নয়। ১৯৫৫ সালেই বিজ্ঞানীরা প্রথম পরমাণুর ছবি তোলেন। আশির দশকে পরমাণু-চিত্রগ্রাহকদের পছন্দের যন্ত্র ছিল স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপ বা এসটিএম (STM)। এসটিএম বিশেষত্ব হলো এর অগ্রভাগের আকার হতো একটি ব্যাকটেরিয়ার সমান।

বিজ্ঞানীরা পরমাণুর পৃষ্ঠতলে এই যন্ত্রের অগ্রভাগ নাড়াতেন। ফলে ইলেকট্রনের মাঝদিয়ে সুড়ঙ্গ তৈরি হতো। চলত বিদ্যুৎ প্রবাহ। চিরুনি নিয়ে মাথা আঁচড়ালে যেমন স্থির বিদ্যুৎ তৈরি হয় প্রক্রিয়াটি অনেকটা তেমন। যা-হোক, এসটিএম এর অগ্রভাগের সাহায্যে এই বিদ্যুৎ শক্তি শনাক্ত করা হতো, আর মাইক্রোস্কোপ একে রূপান্তর করত ছবিতে। এসটিএম এর সাহায্যে পরমাণুর স্থান পরিবর্তন করা যেত। ১৯৮৯ সালে আইবিএম এর দুই বিজ্ঞানীকে প্রথম এসটিএম ব্যবহারকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জেনন পরমাণুর সাহায্যে তাঁরা IBM এর অক্ষরগুলো তৈরি করেন।

এ তো ছিল পরমাণুর ছবি তোলা ও স্থান পরিবর্তন। তবে সত্যিকার অর্থে পরমাণু বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করার কাজটি আরও অনেক বেশি কঠিন। এ সময় পরমাণুকে পর্যবেক্ষণ করতে হয়, উপাদান অনুযায়ী সাজাতে হয়, ধর্ম শনাক্ত করতে হয়, রাসায়নিক বিক্রিয়ায় কেমন আচরণ করবে পরমাণুটি তা জানতে হয়।

লোহার (Fe) একটি পরমাণুর চিত্র (বামে)।
অধ্যাপক সাউ ওয়াই লা

এক্স-রের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা একগুচ্ছ পরমাণুর বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করতে পারতেন। এক্স-রে যখন পরমাণুতে আঘাত করে, তখন রশ্মির শক্তি পরমাণুর ইলেকট্রনের স্থানান্তরিত হয়। অতিরিক্ত শক্তি পেয়ে ইলেকট্রন উত্তেজিত অবস্থায় চলে যায়। আগের অবস্থায় আসতে ইলেকট্রন অতিরিক্ত শক্তি বিকিরণ করে। মজার ব্যাপার হলো, এই শক্তি বিকিরিত হয় এক্স-রে তরঙ্গ আকারে। নতুন তৈরি এই এক্স-রে ব্যবহার করে পরমাণুর বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করা সম্ভব।

তবে, এজন্য সাধারণ এক্স-রে হলে হবে না। প্রয়োজন শক্তিশালী এক্স-রশ্মি। প্রয়োজন সিনক্রোট্রনের মতো কণাত্বরক যন্ত্র। গবেষক দলটি আর্গন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে অবস্থিত কণা ত্বরক যন্ত্র ব্যবহার করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিয়ন রাজ্যে অবস্থিত এই কণাত্বরক যন্ত্রের পরিধি এক মাইলের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। এতে উচ্চগতিতে চলমান ইলেকট্রনগুলো একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষের জড়িয়ে পড়ে না। এর পরিবর্তে গতিশীল ইলেকট্রনগুলো একটি অস্থির চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে যায়। এ সময় ইলেকট্রনের অতিরিক্ত শক্তি এক্স-রশ্মি আকারে বিকিরিত হয়।

নির্দিষ্ট পরমাণু ব্যবহার করে কীভাবে আরও ভালো পদার্থ তৈরি করা যায় তা জানা যাবে। প্রোটিন নিয়ে গবেষণার জন্যও আবিষ্কারটি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ভবিষ্যতে টিকা তৈরির কাজেও প্রভাব ফেলবে এক্স-রের এই নতুন ব্যবহার।

গবেষক দলটি এসটিএম-এর দক্ষতার সঙ্গে এক্স-রের শক্তিকে একত্রিত করেছেন। সম্মিলিত এই ব্যবস্থাকে বলছেন, সিনক্রোটন এক্সরে স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপি। সংক্ষেপে এসএক্স-এসটিএম (SX-STM)। এক্স-রে এবং এসটিএম-এর সংমিশ্রণ সহজ নয়। দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি। ফলে এ দুটিকে একত্রিত করতে উভয় ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা কয়েক বছর ধরে কাজ করেছেন একসঙ্গে।

এসএক্স-এসটিএম প্রযুক্তি ব্যবহার করে, গবেষকেরা সফলভাবে দুটি ভিন্ন পরমাণুর ইলেকট্রন বিন্যাস শনাক্ত করেছেন। এদের একটি লোহার পরমাণু ও অন্যটি টারবিয়ামের পরমাণু। টারবিয়াম একটি বিরল ধাতু। পারমাণবিক সংখ্যা ৬৫।

কী লাভ?

গবেষক দলটির মতে, তাঁদের এই আবিষ্কার নানা ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন কোয়ান্টাম কম্পিউটার। পরমাণুর ইলেকট্রনে তথ্য সঞ্চয় করা যায় এখানে। এ তথ্য পড়ার জন্য নতুন আবিষ্কৃত কৌশলটি ব্যবহার করা যাবে। কৌশলটি আরও আয়ত্তে আনা গেলে রাসায়নিক বিক্রিয়া আরও নিখুঁত ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন বিজ্ঞানীরা।

অধ্যপক লা মনে করেন, এক্স-রে বিজ্ঞান এখন যেভাবে কাজ করে তার ওপর ভিত্তি করেই এসএক্স-এসটিএম বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করা যেতে পারে। নির্দিষ্ট পরমাণু ব্যবহার করে কীভাবে আরও ভালো পদার্থ তৈরি করা যায় তা জানা যাবে। প্রোটিন নিয়ে গবেষণার জন্যও আবিষ্কারটি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ভবিষ্যতে টিকা তৈরির কাজেও প্রভাব ফেলবে এক্স-রের এই নতুন ব্যবহার।

পদার্থবিদ লা এবং তাঁর সহকর্মীরা এক্স-রে ব্যবহার করে দুটি পরমাণু পর্যবেক্ষণ করেছেন। এর অর্থ এক্স-রের সাহায্যে পরমাণু পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। গবেষক দলটি মনে করেন, এখন যে কেউ চাইলে এ গবেষণাটি করতে পারেন একাধিক পরমাণু নিয়ে। এতে অদূর ভবিষ্যতেই আবিষ্কারটির সরাসরি কার্যকারিতা দেখতে পাবো হয়ত আমরা।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: পপসাই ডট অর্গ