এলএইচসির চেয়েও বড় কণাত্বরক যন্ত্র বানাচ্ছে সার্ন

বিজ্ঞান জগতের খোঁজখবর যাঁরা রাখেন, তাঁরা নিশ্চয়ই লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারের (এলএইচসি) নাম শুনেছেন। হয়তো শুনে অবাক হবেন, ব্যাপক এই প্রকৌশল কীর্তি নির্মাণের জন্য মাটির নিচে বয়ে চলা আস্ত এক নদীকে বরফ বানিয়ে জমিয়ে ফেলা হয়েছিল! এবারে এই যন্ত্রের আরও বড় এক সংস্করণ তৈরি করতে যাচ্ছে সার্ন। এই যন্ত্রটির নাম দেওয়া হয়েছে ফিউচার সার্কুলার কলাইডার (এফসিসি)। কেন এই বিশাল কণাত্বরক বানানো হচ্ছে? বিষয়টা বুঝতে প্রথমে এলএইচসির কাছে ফিরতে হবে।

২৭ কিলোমিটার পরিধির এলএইচসি নামের বিশাল কণাত্বরক যন্ত্রটি আধুনিক বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে গেছে অনেকখানি। সুইজারল্যান্ড ও ফ্রান্সের সীমান্তের নিচ দিয়ে, সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের কাছে এই বিশাল কণাত্বরক যন্ত্র। ইংরেজি কলাইডারের বাংলা কণাত্বরক অনেকের কাছে অদ্ভুত ঠেকলেও, এটিই আসলে শব্দটির যথার্থ অর্থ। এই যন্ত্রে আসলেই কণাদের ত্বরিত করা হয়, তারপর সংঘর্ষ ঘটানো হয় প্রচণ্ড বেগে। এভাবেই এ যন্ত্রে ২০১২ সালে শনাক্ত করা হয়েছে হিগস বোসন কণা—জনপ্রিয় ধারায় সংবাদপত্রের কল্যাণে যেটি অনেকের কাছে পরিচিত ‘ঈশ্বর কণা’ নামে। এই কণাটির গুরুত্ব বর্তমান বিজ্ঞানে অপরিসীম। কণাপদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড বা প্রমিত মডেলে এই কণাটির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়াই অন্য সব কণার ভর হিসেবে আবির্ভূত হয়। কণাটি ছাড়া প্রমিত এই মডেল ছিল অনেকাংশেই দুর্বল ভিতের কাঠামোর কণা। হিগস বোসন এই মডেলকে টেকসই বলে প্রমাণ করেছে, বর্তমান বিজ্ঞানের পরিচিত সব বস্তুকণার ভিত্তি গড়ে দিয়েছে। সুনিশ্চিতভাবে দেখিয়েছে, বিজ্ঞানীদের কণাবিষয়ক ধারণাগুলো সঠিক।

রিং বা ফাঁসের মতো এই কলাইডারের পরিধি ৯১ কিলোমিটারের মতো হবে। প্রায় ২০০ মিটারের মতো গড় গভীরতা (ডেপথ) থাকবে রিংটির। এতে ১০০ টেরা ইলেকট্রন ভোল্টের মতো শক্তিসীমায় পরীক্ষা চালানো যাবে

এককালে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন, হিগস বোসন শনাক্ত করা গেলেই বিজ্ঞানের চূড়ান্ত পরিণতি হাতের মুঠোয় চলে আসবে, পাওয়া যাবে সবকিছুর তত্ত্ব—থিওরি অব এভরিথিং। পরে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন, শুধু এটুকুতে হবে না। এলএইচসি ১৪ টেরা ইলেকট্রন ভোল্ট শক্তিসীমায় পরীক্ষা চালাতে পারে বটে, তবে মহাকর্ষ ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে এক সুতায় গাঁথার জন্য যে পরীক্ষাগুলো করা প্রয়োজন, তা এই কণাত্বরক যন্ত্র দিয়ে করা সম্ভব নয়। কাজেই বিজ্ঞানীরা আরও বড়, আরও শক্তিশালী কণাত্বরক যন্ত্র নির্মাণের লক্ষ্যে কাজ শুরু করলেন।

এই প্রক্রিয়া বরাবরই দীর্ঘ। কাজেই ২০১৯ সালে প্রথম এর ধারণা প্রকাশিত হলেও এতদিন এটি খুব বেশিদূর এগোয়নি। সম্প্রতি এ পথে আরেকধাপ এগিয়েছে সার্ন। সংস্থাটির পলিসি, অর্থনীতি ও উপদেষ্টা কমিটির সদস্যরা পুরো পরিকল্পনা খতিয়ে দেখেছেন, বাস্তবায়নের লাভ-ক্ষতি নিয়ে আলোচনা করেছেন গত ৯ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার। সব মিলে সার্ন জানাচ্ছে, ২০৩০ দশকের মাঝামাঝি (অনেকে বলছেন, ২০৩৫ সালের দিকেই) এর নির্মাণ শুরু হতে পারে। ২০৪৫ সাল নাগাদ এর একটি কণাত্বরক যন্ত্র—ইলেকট্রন-পজিট্রন কলাইডার (এফসিসি-ইই) সক্রিয় হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দ্বিতীয় আরেকটি যন্ত্র, যাতে প্রোটন-প্রোটন সংঘর্ষ ঘটানো হবে (এফসিসি-এইচএইচ), তার নির্মাণ কাজ শেষ হবে ২০৭০ দশক নাগাদ।

যেখানে নির্মিত হচ্ছে এফসিসি
সূত্র: সার্ন

কেমন হবে নতুন এই কণাত্বরক যন্ত্র? এর পরিধি হতে পারে ৮০-১০০ কিলোমিটারের মতো। নতুন ফিজিবিলিটি স্টাডি (পরিকল্পনা কতটা বাস্তবায়ন করা যাবে, সে বিষয়ক গবেষণা) বলছে, রিং বা ফাঁসের মতো এই কলাইডারের পরিধি ৯১ কিলোমিটারের মতো হবে। প্রায় ২০০ মিটারের মতো গড় গভীরতা (ডেপথ) থাকবে রিংটির। এতে ১০০ টেরা ইলেকট্রন ভোল্টের মতো শক্তিসীমায় পরীক্ষা চালানো যাবে। এর মাধ্যমে কণাপদার্থবিজ্ঞানের বড় কিছু প্রশ্নের জবাব মিলবে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা।

বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প প্রতিষ্ঠান জড়িত এর সঙ্গে। দেশ-বিদেশের বড় বড় বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এটি পদার্থবিজ্ঞান, কণাপদার্থবিজ্ঞান, কসমোলজি বা সৃষ্টিতত্ত্বের মতো বিজ্ঞানের শাখাগুলোকে এগিয়ে নেবে। তবে প্রশ্ন হলো, এর মাধ্যমে কি সবকিছুর তত্ত্বের সন্ধান মিলবে?

গোটা মহাবিশ্ব যখন প্রচণ্ড উত্তপ্ত এক মহাজাগতিক কড়াইয়ের মতো ছিল, ওর ভেতরে জ্বাল দেওয়া হচ্ছিল কণাদের স্যুপ বা ঝোল—সেই সময়ে কণাদের প্রচণ্ড গতির সংঘর্ষ ঘটছিল প্রতিমুহূর্তে। সেই সংঘর্ষই তাঁরা ঘটাতে চান পৃথিবীতে, তৈরি করতে চান সেই আবহ, ভেদ করতে চান মহাকর্ষের কোয়ান্টাম তত্ত্বের রহস্য
লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার ও ফিউচার সার্কুলার কলাইডারের তুলনামূলক চিত্র
সূত্র: সার্ন

বিজ্ঞানীদের ধারণা, মহাবিশ্বের শুরুর সময়টায় মহাবিশ্বের মৌলিক চারটি বল—মহাকর্ষ, শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল, দুর্বল নিউক্লিয়ার বল ও তড়িৎ-চুম্বক বল—একীভূত ছিল। পরে এগুলো ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা বাকি তিনটি বলকে একীভূত করতে পারলেও মহাকর্ষকে এগুলোর সঙ্গে এক সুতায় গাঁথতে পারেননি। সমস্যাটা ওখানেই। সমাধানের জন্য প্রয়োজন মহাকর্ষের একটি কোয়ান্টাম তত্ত্ব। সে জন্য হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে (অর্থাৎ প্রোটন) পরস্পর সংঘর্ষ করিয়ে তাঁরা মহাবিশ্বের শুরুর দিকের সেই সময়ের অবস্থা তৈরি করতে চান। গোটা মহাবিশ্ব যখন প্রচণ্ড উত্তপ্ত এক মহাজাগতিক কড়াইয়ের মতো ছিল, ওর ভেতরে জ্বাল দেওয়া হচ্ছিল কণাদের স্যুপ বা ঝোল—সেই সময়ে কণাদের প্রচণ্ড গতির সংঘর্ষ ঘটছিল প্রতিমুহূর্তে। সেই সংঘর্ষই তাঁরা ঘটাতে চান পৃথিবীতে, তৈরি করতে চান সেই আবহ, ভেদ করতে চান মহাকর্ষের কোয়ান্টাম তত্ত্বের রহস্য।

সে জন্যই নির্মিত হচ্ছে এই নতুন কণাত্বরক যন্ত্র। তবে এটি আসলেই কতটা সফল হবে, তা আগে থেকে বলার উপায় নেই। আমরা শুধু আশা করতে পারি। গোটা পৃথিবীর বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা যে চেষ্টায় কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁরা হয়তো হঠাৎ করেই সেই পরশপাথরের সন্ধান পাবেন; যেভাবে দুর্ঘটনাক্রমে, কিংবা দীর্ঘদিনের চেষ্টার অকস্মাৎ ফল হিসেবে বারবার বিজ্ঞানীদের হাতে ধরা দিয়েছে বড় সাফল্য। হয়তো তাতে বড় ভূমিকা রাখবে নতুন এই কণাত্বরক যন্ত্র। এটাই বিজ্ঞানপ্রেমী সবার প্রত্যাশা।

সূত্র: সার্ন, ইউনিভার্স টুডে, উইকিপিডিয়া